করোনার ভুয়া রিপোর্ট : সাবরিনা-আরিফসহ আটজনের মামলার রায় ১৯ জুলাই

আগের সংবাদ

মসলার বাজারে ঈদের আঁচ : খুচরা বাজারে দামের উল্লম্ফন, ডলার সংকট ও এলসি জটিলতার অজুহাত

পরের সংবাদ

বানভাসিদের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই

প্রকাশিত: জুলাই ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

** পানি আতঙ্কে নির্ঘুম রাত ** ভাত খাইতাম পারি না ঘর বানাইতাম কিলা ** শূন্য বসতভিটায় ধানের চারা **
অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য ও ছায়াদ হোসেন সবুজ, সুনামগঞ্জের দুর্গত এলাকা ঘুরে : বন্যায় প্রায় বিধ্বস্ত সিলেট অঞ্চল। একটু উন্নতির আভাস মিলতেই মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। ভাসিয়ে নেয়া ভিটে আবার ভরাট করে থাকার উপযোগী করার অদম্য লড়াই চলছে। ভেঙে যাওয়া ঘর আবার জোড়া দেয়ার চেষ্টা বন্যার্তদের। কিন্তু যেখানে খাবারের অভাব চরমে উঠেছে; সেখানে নতুন করে ঘর বানানোও তাদের কাছে অসম্ভব লড়াই। তবে যখনই তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, তখনই আবার শুরু হয়েছে ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢল। এতে সিলেট অঞ্চলের নদীগুলো ফের ফুলে-ফেঁপে উঠছে। পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কায় নির্ঘুম রাত পার করেছেন মানুষ।
সরজমিন বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বানের পানিতে কোথাও পুরো ঘর ভেসে গেছে, কোথাও শুধু ঘরের চাল রয়েছে, আবার কোথাও ভিটের মাটি ধসে গেছে। কোথাও কোথাও দেখা গেছে, ভেসে যাওয়া শূন্যভিটায় ধানের চারা গজিয়েছে। সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার পাণ্ডারগাঁও ইউনিয়নের একটি বসতভিটায় দেখা গেছে, ধানের চারা গজিয়েছে। হঠাৎ দেখে মনে হবে এটি একটি বীজতলা, কিন্তু উপরে চাল ঝুলে থাকায় বুঝা যায়, এখানে একসময় ঘর ছিল। প্রলয়ঙ্কারী বন্যা ওই ঘরের সব ভাসিয়ে নিয়েছে। ঘরটিও লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। পানির তোড়ের কাছে অসহায় ওই পরিবারটি আশ্রয় নিয়েছে অন্যত্র।
‘ভাত খাইতাম পারি না ঘর বানাইতাম কিলা’ : ‘গত ১০ দিন ধইরা ছেলেমেয়ে নিয়া রাস্তায় আছি। খাইয়া না খাইয়া বাইচ্চা আছি। কত কষ্ট কইরা ধারদেনা কইরা ঘর বানাইছিলাম, বন্যায় ঘরটা তছনছ করিলাইছে। এখন ঘুমানির জায়গাও নাই। পানি কমার পর মনে মনে আশা করছিলাম, বাড়িত যাইতাম। গিয়া দেখি আমার সুন্দর ঘরটা ভাইঙা পানিত পইড়া আছে। আর কিচ্ছু বাকি রইছে না। এখন কোনোখানো যাইবার জায়গা নাই। ভাতই খাইতাম পারি না, ঘর বানাইতাম কিলা।’ বন্যার আগ্রাসনে ঘরবাড়ি হারানো সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার খাইক্কারপাড় গ্রামের মানুষরা

এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন আর ঘর মেরামতের কাজ করছিলেন। বন্যায় জীবন বাঁচালেও সহায় সম্বল সবই হারিয়ে বসে আছেন তারা। বন্যার পানি নামলেও বহু কষ্টে তৈরি বসতঘরটি আর নেই, ঢলের পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এতে হাজারো পরিবার সংকটে পড়েছে। এসব পরিবার এখন আশ্রয়কেন্দ্রে আছে। তাই বন্যা শেষ হলেও সর্বস্ব হারানো এসব মানুষ কবে নিজ ভিটায় উঠতে পারবেন, তা একেবারেই অনিশ্চিত।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, যেদিকেই চোখ যায় বিধস্ত ঘরবাড়ি আর আবর্জনা। কোথাও ঘর ভেঙে পানিতে তলিয়ে আছে, আবার কোথাও টিনশেডের তৈরি ঘর তছনছ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখলে যে কারো মনে হতেই পারে যেন কোনো সুনামি এসে সবকিছু তছনছ করে গেছে। ভিটেমাটি হারিয়ে বন্যার্ত মানুষ এখন রাস্তায়। তাদের চোখেমুখে কান্না। শুধু খাইক্কাপাড় গ্রামই নয়; এমন চিত্র এখন উপজেলার প্রতিটি গ্রামের। 
সরজমিন উপজেলার খাইক্কারপাড় ও অন্যান্য এলাকা ঘুরে দেখা যায়, খাইক্কাপাড় এলাকার অধিকাংশ ঘরবাড়ি এখনো লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। কিছু ঘর এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। অনেকে বন্যায় বিধস্ত হওয়া ঘর পরিবার পরিজন নিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করছেন। তবে এখনো ত্রাণের আশায় পথ চেয়ে আছেন বেশিরভাগ বন্যার্তই। ত্রাণের নৌকা দেখলেই পিছু নেন এই এলাকার মানুষ। অনেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করায় ঘর ঠিক করার কোনো উপায় নেই। তাদের ভরসা এখন মহাসড়ক। ঝুঁকি নিয়ে এই গ্রামের অনেক মানুষই এখন সড়কে বসবাস করছেন। মানুষে গরুতে মিলেমিশে একাকার। বিদ্যুৎ না থাকায় তাদের কষ্ট বেড়েছে দ্বিগুণ। ফলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এই এলাকার বন্যার্তরা। কোথায় থাকবেন কী করবেন সে নিয়েই এখন চিন্তা ঘরবাড়ি ছাড়া মানুষের। 
এদিকে বৃষ্টি চলমান থাকায় আবারো বাড়ছে বন্যার পানি। পানি বাড়ায় আতঙ্ক বিরাজ করছে বন্যার্তদের মাঝে। পানি কমে যেসব রাস্তায় চলাচল শুরু হয়েছিল, এখন তা আবারো ডুবে গিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। নতুন করে আবারো প্লাবিত হচ্ছে নি¤œাঞ্চল। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন মানুষ।
দোয়ারাবাজার ঘুরে এসে ভোরের কাগজের ছাতক প্রতিনিধি শংকর দত্ত জানিয়েছেন, গোলার ধান, গাভি ও একটি বাছুর হারিয়ে রাস্তায় নেমেছেন মান্নারগাঁও ইউনিয়ের ডুলপশী গ্রামের রবীন্দ্র দাসের পরিবার। সম্প্রতি বন্যায় তার দুটি গাভি ও একটি বাছুর মারা যায়। প্রায় ২শ মণ ধান বন্যায় ভেসে যায়। বেঁচে থাকার অবলম্বন শেষ। তিনি বলেন, কীভাবে বাঁচব। ত্রাণ পাই না। দুদিন উপবাস ছিলাম। খাবার পানি ছিল না। বৃষ্টির পানি খেয়ে বেঁচে ছিলাম। দোয়ারাবাজার উপেজেলার পাণ্ডারগাঁও গ্রামের রণজিৎ পাল, সুনতী রানী, গিয়াস মিয়া কৃষি কাজেই নির্ভরশীল। সম্প্রতি বন্যায় তাদের ঘর ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সঙ্গে ধানসহ সব চলে যায়। আগেরদফা বন্যায় মাঠে গেছে আউশ ধান আর এখন ঘরে রাখা ধান পানিতে নষ্ট হয়েছে। বানের পানিতে মেয়ে তামান্না ও ছেলে সৌরভ হাসানকে হারিয়ে উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের ময়না মিয়া নদীর ধারে হাঁটছেন, আর কাঁদছেন। ছেলেমেয়ের মৃতদেহ পেলেও ঘরের ধান চাল কিছুই পাননি তিনি। বুক ভরা ব্যথায় হাউমাউ করে কেঁদে ময়না মিয়া বলেন, আমি অসহায় গরিব মানুষ। কোনো ক্রমে সংসার চলে, কী খাব কোথায় যাব?
এবারের বন্যায় সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে, ১৪ জনের। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছিলেন আশ্রয়কেন্দ্রে। পানি কমায় বাড়ি ফিরতে শুরু করলেও সেখানে কোথাও ভিটা নেই, কোথাও চাল নেই। পাশাপাশি রয়েছে রোগবালাই। সবমিলিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়ার পাশাপাশি খাদ্য সংকটেও ভুগছেন। সরকারি ত্রাণও অল্প। বেসরকারি ত্রাণ যাচ্ছে না বললেই চলে। ভয়াবহ বন্যায় এ অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। মান্নারগাঁও ইউনিয়নের ডুলবশি, খিড়াখালি গ্রামের জয়নাল আবেদীন জানিয়েছেন, ঘরে কোমর পানি ছিল। এর আগে কোনো দিন না খেয়ে থাকেননি জানিয়ে তিনি বলেন, এবারে বন্যায় বাচ্চাসহ না খেয়ে থাকতে হয়েছে। ফার্মের ১২শ মুরগি মারা গেছে। পুকুরের মাছ চলে গেছে। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। উপজেলার টেংরাটিলা গ্রামের মাছচাষি শের মাহমুদ ভুঁঁইয়া জানান, বাড়ির পাশে ৪০০ শতক জমির ওপর ৩টি পুকুর রয়েছে তার। বন্যায় প্রায় ১৫ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। এছাড়াও মাছচাষি সিরাজ মিয়া, সোহেল আহমদ ও শের মাহমুদ ভুঁইয়ার মতো উপজেলার দুই শতাধিক মাছচাষির স্বপ্ন ভেসে গেছে বানের জলে। পুঁজি হারিয়ে এখন দিশাহারা এসব চাষি। তারা বেশির ভাগই পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ করে থাকেন। কিন্তু সব ভেসে যাওয়ায় লোন শোধ করবেন কী করে- সেই চিন্তায় কোনো সমাধান পাচ্ছেন না। চাষি জাকির হোসেন জানান, বন্যায় ধান গেল, পুকুরের মাছ গেল, শেষমেশ বাদামখেত ছিল; এখন তাও গেল। সরকার যদি আমাদের পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না। আলীপুর গ্রামের বাদামচাষি মনির উদ্দিন বলেন, হাওরপারে আট কানি জমিতে বাদাম চাষ করেছি। প্রতি কানি (৩০ শতক) জমিতে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এখন সব জমি পানির নিচে। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। তারা জানান, বাদাম চাষাবাদে খরচ বেশি। তার চেয়েও বেশি খরচ শ্রমিকে। ৫শ টাকার নিচে দৈনিক মজুরিতে শ্রমিক মেলে না। এখন শ্রমিক না পেয়ে নিজেরাই বাদাম তুলছেন। এত কষ্টের ফসল এখন পানির নিচে। সবার বাদাম পচে গেছে। এই বাদাম তুললে লাভ দূরে থাক; বীজ, সার, পানি ও শ্রমিকের খরচও উঠবে না- বলেন, চাষি নুরুল ইসলাম। এদিকে, গ্রামীণ কাঁচা রাস্তাঘাট পানির নিচ থেকে ভেসে উঠলেও কাদা মাটিতে পরিণত হওয়ায় এসব রাস্তা দিয়ে পায়ে হেঁটে চলাচল করা যাচ্ছে না। ঘরবাড়ি পানির নিচ থেকে ভেসে উঠলেও বসবাস করতে গিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে গ্রামবাসীদের। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বন্যার পানি নামলেও শিক্ষা কার্যক্রম এখন স্বাভাবিক হয়নি।
নতুন করে পানি বাড়ছে ছাতক-দোয়ারাবাজার উপজেলায়। আগের ক্ষত শেষ হতে না হতেই আবার চতুর্থবারের মতো বন্যার আশঙ্কা উপজেলার বাংলাবাজার, নরসিংপুর, দোয়ারাবাজার, মান্নারগাঁও, পাণ্ডারগাঁও, দোহালিয়া, ল²ীপুর, বোগলাবাজার ও সুরমা ইউনিয়নে দেখা যায় বড় বড় খানাখন্দে ভরে গেছে। এখন আবার আতঙ্কে রয়েছে সুরমা নদীর তীরবর্তী শতশত পরিবার।
কুরবানির হাটে মাত্র একটি গরু : কুরবানির ঈদের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। তবে এখনো জমেনি কুরবানির হাট। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছে ঈদবাজারে। বুধবার উপজেলা সদরের পৌরশহরের হেলিপ্যাড মাঠে কুরবানির প্রথম পশুর হাট বসে। ওইদিন দুপুর ১২টায় সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, হাটে মাত্র একটি গরু উঠেছে। পশুশূন্য হাট- ক্রেতা নেই, বিক্রেতাও নেই। হাটে গরু নিয়ে আসা পৌর এলাকার ইকড়ছই পারুয়া বাড়ির কৃষক সিরাজুল ইসলাম জানান, কিছুক্ষণ আগে গোয়ালঘরের একটি গবাদি পশু হাটে নিয়ে এসেছি। এখনো হাটে আর কেউ গরু নিয়ে আসেননি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়তো কিছুটা বাজার জমতে পারে। তবে আশানুরূপ হবে না। কারণ এখনো উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের বন্যার পানি রয়েছে। সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়নি। মানুষ এখনো পানিবন্দি। এজন্য হাট জমবে না। হাটের ইজারাদার মকবুল হোসেন ভুঁইয়া জানান, কুরবানি ঈদের প্রথম পশুর হাট আজ আমরা বসিয়েছি। বন্যার কারণে ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপস্থিতি কম। প্রসঙ্গত, গত ১৭ জুন জগন্নাথপুর উপজেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। গত কয়েক দিনে উপজেলা সদরের উঁচু এলাকা থেকে বন্যার পানি কমলেও নিচু এলাকায় ধীরে ধীরে পানি নামছে। হাওরাঞ্চল ও নি¤œাঞ্চলের কয়েক হাজার পরিবার এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছে। পানি কমার সঙ্গে বাড়ছে দুর্ভোগ। গত ১২ দিনেও স্বাভাবিক হয়নি সড়ক যোগযোগব্যবস্থা। ডুবে আছে অসংখ্য গ্রামীণ রাস্তাঘাট। এছাড়া বসতবাড়িতেও পানি রয়েছে। বন্যার কারণে এবারে ঈদে প্রভাব পড়বে বলে মনে করেছেন স্থানীয়রা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়