দৈনিক ওঠানামার মধ্যেই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী

আগের সংবাদ

জনগণের সাহসেই পদ্মা সেতু : বন্যার দুর্ভোগ ও ক্ষতি কমাতে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার > বিএনপির নেতা কে? সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ চরমে : উন্নতি উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, অবনতি মধ্যাঞ্চলে

প্রকাশিত: জুন ২২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ ডেস্ক : সব নদনদীর পানি কিছুটা কমেছে। তবে এখনো বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষণ দেখা গেলেও অবনতি হচ্ছে মধ্যাঞ্চলে। বন্যার পানি স্থায়ী হওয়ায় বানভাসিদের দুর্ভোগ আরো চরম আকার ধারণ করেছে। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের ডুবে যাওয়া ঘরবাড়ি ও নৌকায় অবস্থান করা মানুষজন। এসব বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য, শুকনো খাবার, ওষুধ ও শিশুখাদ্যের সংকটে পড়েছেন বানভাসি মানুষ। এ সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট-
কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্রের নুনখাওয়া পয়েন্টে পানি ১ সেন্টিমিটার ও ধরলার ব্রিজ পয়েন্ট ২ সেন্টিমিটার কমেছে। তবে ব্রহ্মপুত্রের চিলমারী পয়েন্টে পানি ২ সেন্টিমিটার বেড়ে সব নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ অবস্থায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বন্যার পানি স্থায়ী হওয়ায় বানভাসিদের দুর্ভোগ আরো চরম আকার ধারণ করেছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের ডুবে যাওয়া ঘরবাড়ি ও নৌকায় অবস্থান করা মানুষজন। এসব বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য, শুকনো খাবার, ওষুধ ও শিশুখাদ্যের সংকটে পড়েছেন বানভাসি মানুষ।
বন্যাকবলিত এলাকায় তীব্র হয়ে উঠছে গবাদিপশুর খাদ্য সংকটও। রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে থাকায় এবং স্রোতের তীব্রতায় ভেঙে যাওয়ায় এসব এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে। কলাগাছের ভেলা এবং নৌকায় এখন যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম তাদের। বন্যাকবলিত এলাকায় পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত লোকজন অভিযোগ করে বলেন, তারা কোনো চিকিৎসা কিংবা ওষুধ পাচ্ছেন না। কাগজ-কলমে মেডিকেল টিম থাকলেও বাস্তবে কোথাও তা দৃশ্যমান হয় না হচ্ছে না।
এদিকে সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা শুরু হলেও তা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। বন্যাকবলিত অধিকাংশ এলাকায় ত্রাণ সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ করছেন অনেকেই। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভগবতীপুর চরের জোহরা খাতুন জানান, চুলা জ¦ালাতে পারছি না। ঘরের সব কিছু পানিতে তলিয়ে গেছে। ছেলেমেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছি। মেম্বার-চেয়ারম্যান কেউ খোঁজখবর নিচ্ছেন না।
উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা আমির হোসেন জানান, বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি তলিয়ে থাকায় নিজেরাই কষ্টের মধ্যে আছি। এ অবস্থায় গরু-ছাগলের খাবারও জোগাড় করতে পারছি না। কামলাও চলে না, ঘর-দরজা ভেঙে যাচ্ছে আগামীতে কী করব বুঝতে পারছি না।
সদরের ধরলা সেতু এলাকার সওদাগর পাড়ার বেড়ি বাঁধসংলগ্ন বন্যাকবলিত মানুষ অভিযোগ করেন, কয়েকদিন ধরে পানিবন্দি দিন যাপন করলেও এখনো কোনো ত্রাণ সহায়তা পাননি তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতার পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও কিছু এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাধ্যমতো বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু বাস্তবে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে তা দৃশ্যমান হচ্ছে না। প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ অপ্রতুল হওয়ায় তা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন পাচ্ছেন না বলে একাধিক জনপ্রতিনিধি সাংবাদিকদের বলেন।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, ৯ উপজেলার বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ৩৩৮ টন চাল, নগদ ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ১৮ লাখ ৯৫ হাজার

টাকার শিশুখাদ্য ও ১৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকার গো-খাদ্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপৎসীমার উপর কিছুটা স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। বন্যার পানি ধীরগতিতে কমতে শুরু করেছে বলে জানান তিনি।
জামালপুর : জামালপুরে বিভিন্ন নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ২টায় জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ ও বকশীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন জানান, জেলার ৪ উপজেলার ২৮টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ৯৩টি গ্রামের ৫০ হাজার মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। দেওয়ানগঞ্জের ৩টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ৯ হাজার ৬৪৮ জন। বাকিরা নিজ বাড়িতেই অবস্থান করছেন। জেলার ১ হাজার ৯৪৪ হেক্টর জমির ফসল, ১৫ মিটার বাঁধ ও ৮০টি মৎস্য খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ৭৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
মঙ্গলবার জেলার ইসলামপুর উপজেলার চীনাডুলি ইউনিয়নের আমতলী বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায় যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাজারের আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বাড়িঘরে পানি ঢুকলেও নিজ গৃহ ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছেন না বন্যার্তরা।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাঈদ জানান, এই সময়ে পানি কমার কথা ছিল। কিন্তু সকাল থেকে টানা বৃষ্টির কারণে আবারো বাড়তে পারে যমুনা নদীর পানি।
গাইবান্ধা : ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে জেলার সব নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে গাইবান্ধায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় ঘাঘট নদীর পানি গাইবান্ধা শহর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪২ সেন্টিমিটার এবং ব্রহ্মপুত্রের পানি তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে ১৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এছাড়া তিস্তা ও করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধি হলেও এ দুটি নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার নিচে রয়েছে।
ঘাঘট নদের পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে গাইবান্ধা শহর রক্ষা বাঁধের প্রায় দেড় কিলোমিটার অংশ। অতিবৃষ্টির কারণে এ বাঁধের বিভিন্ন অংশে ছোট-বড় গর্ত ও মাটি ধসে খাদের সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় যে কোনো সময় বাঁধ ধসে জেলা শহর প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন জনগণ।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার ২৩টি ইউনিয়নে ৯৬টি গ্রাম বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৪৭ হাজার ৫৬৩ জন মানুষ। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৪৫ হাজার ৫৮৪ জন। বন্যাকবলিত চার উপজেলার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ৮০ টন চাল ও নগদ ৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা বিতরণ করা হচ্ছে এবং নতুন করে আরো বরাদ্দের চাহিদা পাঠানো হয়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, বন্যাকবলিত ৪ উপজেলার ১১১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে পানি ওঠায় পাঠদান কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও সদর উপজেলার ১৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে পানি ওঠায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
নেত্রকোনা : নেত্রকোনায় বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও নদনদীর পানি এখনো বিপৎসীমার উপর দিয়েই বইছে। পানিবন্দি হয়ে আছেন জেলার ৬৩টি ইউনিয়নের ২ লক্ষাধিক মানুষ। এরই মধ্যে ৩২৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ১ লাখ ১৬ হাজার বানভাসি মানুষ। অনেক আশ্রয় কেন্দ্রের চারপাশেও থইথই পানি। দুই দিন ধরে এক উপজেলায় কাজ করলেও জেলার চারটি উপজেলায় বন্যাদুর্গতদের দুর্ভোগ লাঘবে সেনাবাহিনী কাজ করবে বলে জানান ১৯ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর নকিব আহমেদ চৌধুরী। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে রান্না করা খাবারের সংকটের পাশাপাশি শিশুখাদ্যের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। দেখা দিচ্ছে রোগবালাই, মাথাব্যথা, জ¦র, পাতলা পায়খানাসহ চর্মরোগ। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ৯৬টি মেডিকেল টিম গঠন করলেও বন্যার্ত অনেকের অভিযোগ তারা এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। এদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হলেও বানভাসি মানুষের অভিযোগ, তারা প্রয়োজনীয় ত্রাণ পাচ্ছেন না।
নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ জানান, জেলায় বন্যাদুর্গতদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ১৩ লাখ নগদ টাকা, ৩৩৩ টন চাল ও ৪ হাজার ৯৫০ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুর্গত লোকজনের মাঝে ১৩১ টন চাল, ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা ও ২ হাজার ৩০০ শুকনো খাবারের প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে। অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহন লাল সৈকত জানান, নদনদীর পানি কমতে শুরু করেছে।
এদিকে গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আকাশপথে নেত্রকোনার উপর দিয়ে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সিলেটে যান।
শেরপুর : বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। উজানে উন্নতি হলেও ভাটি এলাকায় এখনো পানিবন্দি রয়েছেন শত শত মানুষ। তাদের দুর্ভোগ বেড়েছে। সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
এলজিইডির শেরপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শেরপুর সদরসহ ৪টি উপজেলায় ২২টি রাস্তার ক্ষতি সাধিত হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখতে বিভিন্নভাবে কয়েকটি ইউনিট কাজ করছে বলে তিনি জানান।
মহারশি নদীর রামেরকুড় বাঁধ ভেঙে ও সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শ্রীবরদী উপজেলার ১০টি গ্রামসহ তিন উপজেলার অর্ধ শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। ঘরে ঘরে ঢলের পানি প্রবেশ করায় চুলা জ¦লছে না পানিবন্দি মানুষের। গবাদিপশু, হাঁস-মুরগিসহ গৃহপালিত পশু নিয়ে বিপাকে রয়েছেন কৃষকরা। রাস্তাঘাট ভেঙে চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পাহাড়ি ঢলের পানিতে পুকুর তলিয়ে শত শত পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের পানি নেমে যেতে শুরু হলেও ভাটি এলাকাগুলোতে এখনো প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। কোনো কোনো এলাকার মানুষ কলার ভেলা ও নৌকাযোগে যাতায়াত করছেন। দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে শত শত মানুষকে। দ্বিতীয় দফায় বন্যায় পানিতে ডুবে শিশুসহ ৪ জনের মৃত্য হয়েছে।
মঙ্গলবার ঝিনাইগাতী উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম আব্দুল্লাহেল ওয়ারেজ নাইম পানিবন্দি বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে শুকনো খাবার ও নগদ অর্থ মানবিক সহায়তা হিসেবে মানুষের হাতে তুলে দেন। জেলা প্রশাসক সাহেলা আক্তার বলেন, বন্যার্তদের মাঝে এরই মধ্যে ১০০ টন বিশেষ বরাদ্দের চাল, ৫ লাখ টাকা ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
ফেনী : উজানে অতিবৃষ্টিপাত বন্ধ থাকায় দ্রুতগতিতে পানি নিষ্কাশনের জন্য সোনাগাজীতে অবস্থিত ফেনী রেগুলেটরের (মুহুরী প্রজেক্ট) ৪০টি গেট খুলে দেয়ায় পরশুরাম ও ফুলগাজীর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এতে ফুলগাজী-পরশুরাম সড়ক ও বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়ক থেকে রাতের মধ্যে পানি নেমে পড়েছে। সোমবার সকালেই ফেনী রেগুলেটরের ৪০টি গেট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
সোমবার সকালে মুহুরী নদীর ১২২ কিলোমিটার বাঁধের চারটি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে ১৫ গ্রাম প্লাবিত হয়। একই সময় ভারি বর্ষণে ফুলগাজী বাজারের গার্ডওয়ালের ভেতর দিয়ে মুহুরী নদীর পানি প্রবেশ করে ফুলগাজী বাজার প্লাবিত হয়েছে।
হঠাৎ করে সব গেট খুলের দেয়ার বিষয়ে ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী নুর নবী বলেন, সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত একদিনে মুহুরী নদীতে ১২৩ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। অতিরিক্ত পানি সরে যেতে ফেনী রেগুলেটরের গেট খুলে দেয়া হয়। তিনি আরো বলেন, ফুলগাজী উপজেলা যাতে বন্যার কবলে না পড়ে সেই বিবেচনায় অতিরিক্ত পানি সরে যেতে ফেনী রেগুলেটরের সব গেট খুলে দেয়া হয়েছে।
বর্ষা মৌসুমে বন্যার প্রকোপ কমানো ও আমন ফসলে অতিরিক্ত সেচ সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল মুহুরী সেচ প্রকল্প। এর পানি নিয়ন্ত্রণ কাঠামোতে রেগুলেটরে রয়েছে ৪০টি গেট।
মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজারের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। মনু নদের পানি কমতে শুরু করায় শহরবাসীর বন্যা আতঙ্ক কমেছে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সরজমিন মনু নদসংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আগের দিনের চেয়ে মনু নদের চাঁদনীঘাট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৩৪ সে.মি. নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে জেলার উজানে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও হাওর অঞ্চলে কোনো উন্নতি হয়নি।
এদিকে ঢলের পানি হাওরে প্রবেশ করায় হাকালুকি ও কাউয়াদীঘিতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে ভাটি এলাকাসহ হাওর অঞ্চলে বন?্যার অবনতি ঘটেছে বলে হাওর পাড়ের বাসিন্দারা জানিয়েছেন।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলার সাতটি উপজেলার ৪৪টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত। এতে পানিবন্দি পরিবার ৪৭ হাজার ৭১০টি। যার লোক সংখ্যা ২ লাখ ২৩ হাজার ২২৫ জন। এরই মধ্যে ১০১টি আশ্রয় কেন্দ্র্র খোলা হয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩৩০ টন চাল, ১ হাজার ৭০০ পিচ শুকনা খাবার ও নগদ ১৮ লাখ ২০ হাজার টাকা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) : সুনামগঞ্জে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে এখনো শহরের বেশ কিছু পাড়া-মহল্লার বাড়িঘরে হাঁটু সমান পানি রয়েছে। বানের পানি কমলেও ত্রাণের জন্য চলছে হাহাকার। বানভাসিরা বলছেন, অনেকেই ত্রাণ পাননি। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্রে জানা গেছে বন্যাদুর্গত সব উপজেলাতেই ত্রাণসামগ্রী ও নগদ টাকা পৌঁছে দেয়া হয়েছে।
এদিকে সোমবার বিকালে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা সদরে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে ত্রাণ নেয়ার সময় হুড়োহুড়িতে ৮-১০ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গুরুতর একজনকে প্রথমে তাহিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেটে পাঠানো হয়। গতকাল মঙ্গলবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিলেট রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। তিনি তাহিরপুর উপজেলার উজান তাহিরপুর গ্রামের শহীদ আলীর ছেলে বিপ্লব মিয়া (৫০)।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সোমবার বিকালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি ত্রাণবাহী হেলিকপ্টার তাহিরপুর উপজেলা সদরের শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে উপর থেকে নিচে ত্রাণসামগ্রী ফেলতে থাকে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তের মধ্যে কয়েক শতাধিক দুর্গত মানুষ ত্রাণ পেতে হুড়োহুড়ি শুরু করেন। এতে ৮-১০ জন আহত হন। অন্য আহতদের স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেয়া হয়।
এদিকে সরকারি ত্রাণ তৎপরতার পাশাপাশি সোমবার সকাল থেকে সুনামগঞ্জে বানভাসিদের মধ্যে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন ও সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশ, ২৮ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন (বিজিবি), সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের নেতৃত্বে জেলা ছাত্রলীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, সুনামগঞ্জ জেলার বন্যাকবলিত সব উপজেলা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতারাসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেছে।
মঙ্গলবার বিকালে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ২৪ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণও ছিল খুবই কম ১১ মি.মি.। তবে এখনো জেলার কয়েকটি উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ও মোবাইল যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম ভোরের কাগজকে জানিয়েছেন, জেলা সদরসহ সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলায় ৬২০টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৬৭০ টন জিআর চাল, নগদ ৮০ লাখ টাকা ও ১২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া জেলা সদরের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন ২০ হাজার বানভাসি লোকজনকে খিচুড়ি রান্না করে তা সরবরাহ করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানিয়েছেন, জেলা সদরসহ ১১ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। জেলার প্রত্যেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে খিচুড়ি রান্না করে বানভাসিদের মধ্যে বিতরণ করছেন, যা বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জে ক্রমাগত পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি ভয়াবহ ধারণ করতে যাচ্ছে। জেলার আজমিরীগঞ্জ ও কাদিরগঞ্জ এলাকায় মঙ্গলবার বিকাল ৫টায় কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৪৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়।
এদিকে উজান-ভাটি দুদিক থেকেই চাপে পড়েছে হবিগঞ্জ। সিলেট ও সুনাগঞ্জের বন্যার পানি কালনি-কুশিয়ারা দিয়ে নামছে হবিগঞ্জে। অন্যদিকে জেলার ভাটি এলাকা দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা নদীর পানি বেড়েই চলছে। এতে উজান-ভাটি দুদিক থেকেই হবিগঞ্জে ঢুকছে পানি। ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন জেলার বানিয়াচঙ্গ, আজমিরীগঞ্জ, নবীগঞ্জ, লাখাই ও হবিগঞ্জ সদর উপজেলার অন্তত ২৭টি ইউনিয়ন ও হবিগঞ্জ পৌরসভার প্রায় আড়াইশ গ্রামের কয়েক লাখ মানুষ। এখনো পানিবন্দি সব জায়গায় পৌঁছায়নি খাদ্য সহায়তা। অনাহারে দিন কাটছে বানভাসিদের। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে মানুষ। অপরদিকে প্রতিদিনই বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করছেন জেলা প্রশাসকসহ কর্মকর্তারা। মাঠে আছেন জনপ্রতিনিধিরাও। জেলা প্রশাসন বলছে, বানভাসিদের উদ্ধার তৎপরাতা চলছে। সেই সঙ্গে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, খোয়াই নদীর পানি ইতোমধ্যেই বিপৎসীমার অনেক নিচে নেমে গেছে। তবে হাওরে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৪৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান জানান, বন্যাদুর্গতদের জন্য জেলায় ৯৩টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় ৭ হাজার মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে শুকনো খাবার পৌঁছে দেয়া হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়