প্রকাশিত: জুন ২৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
কাগজ প্রতিবেদক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের মানুষের সাহস ও পাশে দাঁড়ানোর কারণেই সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে পদ্মা সেতু আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বে দেশের মানুষের মাথা উঁচু করে দিয়েছে। মানুষের কাছ থেকে যে অভূতপূর্ব সাড়াটা আমি পেয়েছিলাম, সেটাই কিন্তু আমার সাহস আর শক্তি। মানুষ আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। তাদেরই সাহসে এই পদ্মা সেতু আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বুধবার বেলা ১১টায় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে পাশে থাকায় বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী। বরাবরের মতই সংবাদ সম্মেলন সরাসরি সম্প্রচার করে রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ বেতার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীলতার ‘অচলায়ন’ ভাঙতে পেরেছি। সাহস নিয়ে নিজেদের টাকায় নিজেরা পদ্মা সেতু করার ফলে আজকে বাংলাদেশের সম্মান ফিরে এসেছে। নইলে আমাদের দেশের সবার একটা মানসিকতা ছিল যে, আমরা অন্যের অর্থায়ন ছাড়া কিছুই করতে পারব না। বিশ্বব্যাংক যখন টাকাটা তুলে নিয়ে গেল আমরা যখন সিদ্ধান্ত নিলাম, অন্তত আমরা সেই জায়গার থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি। সেই অচলায়ন ভেঙে আমরা নিজেদের আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছি।
তিনি বলেন, ২০১১ সালে এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করা হয়। এরপর শুরু হয় ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রের পেছনে কে বা কারা ছিল, তা বহুবার বলেছি। ব্যক্তি স্বার্থে বিশেষ এক ব্যক্তির উদ্যোগে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। পরে আরও কয়েকজন যুক্ত হয়েছে। দুর্নাম রটানো হয়, দুর্নীতির অভিযোগ
তোলা হয়। ব্যাংকের একটি এমডি পদ একজনের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ হয় কী করে! ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বার্থের জন্য দেশের মানুষের কেউ ক্ষতি করতে পারে; এটা সত্যিই কল্পনার বাইরে ছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, এই ষড়যন্ত্রকারীরা ছাড়াও বিশ্বব্যাংকের অভ্যন্তরে একটি গ্রুপ ছিল, যারা অন্যায্যভাবে কিছু কিছু বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিল। বিশ্বব্যাংক একটি প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য করার লক্ষ্যে পরোক্ষ চাপ দিতে থাকে। রাজি হইনি। এরপর থেকেই তারা পদ্মা সেতুর কার্যক্রমে বাধা দিতে থাকে। দুদক তদন্ত করে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পায়নি। পরে কানাডার আদালতেও প্রমাণ হয়, পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি।
পদ্মা সেতু যখন উদ্বোধনের দ্বারপ্রান্তে তখন বিশ্ব ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থায়ন নিয়ে কোনো দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে কিনা বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কি-না? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের বিষয়ে বলব- ওই যে একটা কথা আছে না, ‘নিজের ভাঁড় ভালো না, গোয়ালার ঘিয়ে দোষটা কী!’ আমাদের দেশেরই লোকের প্ররোচনায় তারা বন্ধ করেছিল, এটাই বাস্তবতা। আমার তো কিছু বলার দরকার নেই। তারা নিজেরাইতো বুঝতে পারবে। যদি তাদের অনুশোচনা থাকে। আর না থাকলে কারো বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার নেই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবার মাথায় রাখতে হবে যে, বিশ্ব ব্যাংকের আমরাও অংশীদার। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বিশ্বব্যাংক থেকে যে আর্থিক সহায়তা আসে, সেটা তারা ‘অনুদান বা ভিক্ষা দেয় না’। বরং, ঋণ হিসেবে নিয়ে সেগুলো পরিশোধ করা হয়।
পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে গেলেও বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ হওয়া ওই অর্থ অন্যান্য প্রকল্পে আসার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের নামে যে টাকা বরাদ্দ হবে, সেই টাকা নষ্ট করার কোনো অধিকার তাদের নেই। পদ্মা সেতুতে বরাদ্দ টাকা তারা বন্ধ করছে। ওই টাকা আমরা উদ্ধার করে অন্যান্য প্রজেক্টে ব্যবহার করতে পেরেছি। এটা আমাদের অনেকে জানে না। আমাদের যারা অর্থনীতিবিদ বা আমাদের যারা কাজ করে তারা এটা কেন মাথায় রাখে না যে, এরা কোনো দাতা না। ব্যাংকের একটা অংশীদার হিসেবে আমরা লোন নিই এবং সুদসহ সেই লোন আমি পরিশোধ করি। কাজেই, বাংলাদেশের নামে বরাদ্দ টাকা বাংলাদেশকে দিতে তারা বাধ্য।
ছিয়ানব্বইয়ের সরকারে বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন পরামর্শ সভার আয়োজন ঢাকায় নিয়ে আসার কথা তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, কনসালটেন্সি মিটিংয়ে আমরা সব সময় যেতাম। আমি বললাম কেন, ওরা এখানে এসে দিয়ে যাবে। তারপর থেকে আমি শুরু করলাম, তারা ঢাকায় এসে আমাদের লোনটা কি নেব, সেটা ঠিক করবে। বারবার আমরা যাব না। তখনকার অর্থমন্ত্রীকে বলছিলাম, বারবার আমরা যাব কেন? আমরাতো লোন নিচ্ছি। তাদের গরজে তারা টাকা দেবে, কাজও এখানে এসে করুক। আপনি কনসালটেন্সি মিটিং ঢাকাতে করেন। এরপর ঢাকায় আমরা মিটিং করেছি। এই টেকনিক্যাল জিনিস জানা দরকার। আমাদের জুজুর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।
প্রধানমন্ত্রী জানান, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালে জাপান সফরে পদ্মা ও রূপসা নদীর ওপর সেতুর প্রস্তাব দিলে জাপান রাজি হয়। ২০০১ সালে পদ্মা সেতুর সমীক্ষার তথ্য আসে। ওই বছরের ৪ জুলাই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর পদ্মা সেতুর নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে অগ্রাধিকার তালিকায় পদ্মা সেতু প্রকল্প যুক্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার।
পদ্মা সেতুর ব্যয় বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ২০১০ সালের মধ্যে নকশা চূড়ান্ত হয়। পরের বছর জানুয়ারিতে সংশোধিত ডিপিপি দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। সেতুর দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার করার কারণে ব্যয় বাড়ে। এরপর ৪১টি স্প্যানের মধ্যে ৩৭টি স্প্যানের নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের সুযোগ রাখা হয়েছে।
বন্যার দুর্ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকানোর ক্ষমতা মানুষের নেই, সরকারেরও নেই। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমানো এবং দুর্ভোগ লাঘবে সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। সিলেট-সুনামগঞ্জের ভয়াবহ বন্যায় দুর্গত মানুষের দুর্ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সরকার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছে। বন্যার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি উদ্ধার এবং ত্রাণ কার্য পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছি। কোনো সময় ক্ষেপণ না করে সিভিল প্রশাসনের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এবং কোস্টগার্ড, পুলিশ বাহিনীকে নিয়োজিত করেছি। বিভিন্ন বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষকলীগ নেতাকর্মীদের দুর্গত মানুষের সহায়তার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তারা দুর্গত এলাকায় ত্রাণ কাজ চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্যার ঝুঁকি থাকে। পানি নেমে আসবে দক্ষিণ অঞ্চলে। সেজন্য আগাম প্রস্তুতি আমাদের আছে। প্রত্যেকের সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে; কাজেই যেখানেই বন্যা হবে আমরা সেভাবেই সেটা মোকাবিলা করব।
তিনি বলেন, আমি নিজে গত মঙ্গলবার সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং নেত্রকোনা জেলার বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি। বন্যাকবলিত সিলেট অঞ্চলে ১ হাজার ২৮৫টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ৩০০ মেডিকেল টিম কাজ করছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত বন্যাকবলিত ১১ জেলায় ৯০০ টন চাল, ৩ কোটি ৩৫ লাখ নগদ টাকা এবং ৫৫ হাজার শুকনো ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার শুকনো খাবার এবং বিশুদ্ধ পানির। আমরা সে ব্যবস্থাই করেছি। আমাদের দলের নেতাকর্মীরাও সাধ্যমত দুর্গত মানুষের ঘরে শুকনো এবং রান্না করার খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় পানি কমতে শুরু করেছে। বন্যার পানি নেমে গেলে বাড়িঘর মেরামত এবং কৃষি পুনর্বাসনের কর্মসূচি হাতে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছি। আমরা বন্যাকবলিত মানুষের আশ্বাস দিতে চাই, সরকার আপনাদের পাশে আছে। মানুষের ভোগান্তি লাঘবে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, চলমান করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত গোটা বিশ্বকেই একটি অস্বস্তিকর অবস্থার মুখোমুখি করেছে। সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়েছে। খাদ্যশস্যের উৎপাদন এবং পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বেড়েছে পরিবহন ভাড়া। ফলে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে।
শেয়ার করুন
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।