সোহেল চৌধুরী হত্যা : শেষ দিনেও দাখিল হয়নি কেস ডকেট

আগের সংবাদ

ভয়াবহ বন্যায় দিশাহারা মানুষ

পরের সংবাদ

সাক্কুর পরাজয় পাঁচ কারণে

প্রকাশিত: জুন ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি, কুমিল্লা থেকে ফিরে : ২০০৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হয়েছিলেন তিনি। এরপর ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ৬৫ হাজার ৫৭৭ ভোট পেয়ে মেয়র পদে নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আফজল খানকে তিনি ২৯ হাজার ১০৬ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো দলীয় প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করেন মনিরুল হক সাক্কু। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানার বিরুদ্ধে জয় তুলে নেন ১১ হাজার ৮৫ ভোটের ব্যবধানে। তবে এবার আর হ্যাটট্রিক করা হলো না মনিরুল হক সাক্কুর। কুসিকের তৃতীয় নির্বাচনে ৩৪৩ ভোটে নৌকার প্রার্থীর কাছে সাক্কুর পরাজয়ের কারণ নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ ও আলোচনা।
সাধারণ ভোটার থেকে শুরু করে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা রিফাতের বিজয় আর সাক্কুর হারের পাঁচটি মূল কারণ চিহ্নিত করেছেন। সাক্কুর পরাজয়ের মূল কারণ নিজ দলীয় নেতা নিজাম উদ্দিন কায়সার। যিনি পেয়েছেন ২৯ হাজার ২৯৯ ভোট। নির্বাচনী মাঠে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতের পাশাপাশি তাকে লড়তে হয়েছে কায়সারের সঙ্গেও। বিএনপির ভোট দুই ভাগ হয়ে যাওয়ায় মূলত সাক্কুর পরাজয়। দুজনই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে সেই ভোট দুজনের বাক্সে ভাগ হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভোট এভাবে ভাগ না হলে অধিকাংশ ভোট যেত সাক্কুর বাক্সে। সে ক্ষেত্রে তার পাওয়া ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোটের সঙ্গে আরো ভোট যুক্ত হতো।
দ্বিতীয়ত, গুঞ্জন রয়েছে, সারাদেশ চলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে; আর এই কুমিল্লা চলে স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের নেতৃত্বে। তার কথার বাইরে কুমিল্লায় কোনো কথা চলে না। এর আগে দুইবার অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে নিজ দলের প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করতে সাক্কুকে জিতিয়েছেন তিনি। সাক্কুর মাথায় ছিল বাহারের আশীর্বাদের হাত। এবার আশীর্বাদের হাত বদল

হয়ে যায় রিফাতের মাথায়। তাই জয়ের মালাও রিফাতের। ফলে কপাল পুড়ে সাক্কুর। তৃতীয়ত, কুমিল্লা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ গৃহদাহ অনেক পুরনো। এবারের নির্বাচনেও শুরুর দিকে কুমিল্লা আওয়ামী লীগের একটা বড় অংশ ছিল নীরব-নিষ্ক্রিয়। গত সপ্তাহে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে অভিমান ভেঙে সবাই নৌকার পক্ষে মাঠে নামেন প্রকাশ্যে। ভোটের মাঠে এটি প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন অনেকেই। চতুর্থত, ইভিএমের ভোটে অনেক ধীরগতি ছিল। এই অভিযোগ প্রতিটি প্রার্থীই করেছেন। অনেক ভোটার ভোট না দিয়ে ফেরত গেছেন, যার বেশির ভাগই সাক্কুর ভোটার ছিলেন বলে মনে করা হয়। পঞ্চমত, দুবার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সাক্কুর বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন কাজে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া জলাবদ্ধতা ও যানজট নিরসনে ব্যর্থতা, নতুন ভোটারদের কাছে টানতে না পারা তার পরাজয়ের কারণের তালিকায় আছে।
জানতে চাইলে কুমিল্লার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বীর মুক্তিযোদ্ধা বশির উল আনোয়ার ভোরের কাগজকে বলেন, শহরের সমস্যা অনেক। প্রতিশ্রæতি দিয়ে ক্ষমতায় যান সবাই, কিন্তু পূরণ হয় না। একটা শ্রেণির মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল। দীর্ঘদিন একচেটিয়া ক্ষমতার কাছে জিম্মি ছিল, মানুষ অসহায় ছিল। সাধারণ মানুষ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। হোম ট্যাক্স বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এতে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এছাড়া রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। সাক্কুর ওপর নিজ দল বিএনপিও ক্ষুব্ধ। বিএনপির ভোট দুই ভাগ হয়ে যাওয়ায় মূলত সাক্কুর পরাজয় হয়। তিনি যে ভোট পেয়েছেন, তার অধিকাংশ সাধারণ ভোটারের ভোট। আর নিজাম উদ্দিনের বাক্সে গেছে বিএনপির অধিকাংশ ভোট।
নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের জয়কে বড় করে দেখছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা পাপড়ি বোস। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, নিরপেক্ষ, অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ভোট ছিল। পরে উত্তেজনা হয়েছে, তা আবার নিয়ন্ত্রণেও এসেছে। প্রশাসন সারাদিন সতর্ক ছিল। ভোটে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনরায় হয়েছে।
সাক্কুর পরাজয়ের কারণ অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে নিজের পক্ষের ঘনিষ্ঠ নেতাদের প্রকাশ্যে মাঠে না নামাতে পারা, সাংগঠনিক ব্যর্থতা, ভোটকেন্দ্রে কমসংখ্যক কর্মী থাকা, কোথাও কোথাও এজেন্ট না থাকা, নির্বাচনী প্রচারণায় কিছুটা পিছিয়ে থাকা, দলীয় সমর্থন না পাওয়ার মতো বিষয়।
এদিকে নির্বাচনে ফল ঘোষণার শেষ সময়ে এসে আওয়ামী লীগ প্রার্থী রিফাত ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সাক্কুর সমর্থকদের মধ্যে হট্টগোল হয়েছে। ফল ঘোষণার আগে দুই প্রার্থীরই জয়ী হওয়ার গুজব ছড়িয়ে এ হট্টগোল হয়। এ হট্টগোলের কারণে কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তন থেকে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা প্রায় এক ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয়। পরে রিফাতকে বেসরকারিভাবে মেয়র নির্বাচিত ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী। সাক্কুর চেয়ে ৩৪৩ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী দেখানো হয়েছে তাকে। সাক্কু ও তার সমর্থকদের দাবি, পরিকল্পিত ঘটনার মাধ্যমে ফলাফল পাল্টে দেয়া হয়েছে। ফলাফল ঘোষণার পরই তা প্রত্যাখ্যান করে সাক্কু বলেছেন, নির্বাচনে তিনি পরাজিত হননি। তার ফল ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। পরাজয়ের কারণ কেন বিশ্লেষণ করব- নির্বাচনের এ ফলই তো আমি প্রত্যাখ্যান করি।
কোনো ফোনের কারণে ফলাফল পাল্টে যায়নি : কোনো ফোনের কারণে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে গেছে- এমন অভিযোগ ঠিক নয় বলে দাবি করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নবী চৌধুরী। গতকাল বৃহস্পতিবার জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ওই সময়ের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি সিইসি, ডিসি ও এসপির সঙ্গে কথা বলছিলেন। অন্য কারো ফোন আসেনি। একটি ফোনের কারণে ফলাফল ম্যানিপুলেশন হয়েছে, একজন প্রার্থীর পক্ষ থেকে যে ইঙ্গিত করা হচ্ছে, সেটা ঠিক নয়।
রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, ভোট গ্রহণ চলাকালে বৃষ্টি হয়েছে, বিদ্যুৎ চলে যায়। এছাড়া চারটি কেন্দ্রের ফল আসতে দেরি হয়েছে। এ কারণে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের ফল তৈরিতে দেরি হয়েছে। পাশাপাশি দুই পক্ষের নেতাকর্মী ও অনুসারীদের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে ফলাফল ঘোষণায় দেরি হয়েছে। তিনি বলেন, ফলাফল ঘোষণার একপর্যায়ে সেখানে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু ও তার নেতাকর্মীরা উপস্থিত হন। পরে সেখানে আরেকজন মেয়র প্রার্থীর অনুসারীরাও চলে আসেন। সেøাগানের কারণে কেউ কারো কথা শুনতে পাচ্ছিল না। এসব কারণেই মূলত ফলাফল ঘোষণা বিলম্ব হয়েছে।
মনিরুল হক সাক্কুর অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, পরাজিত প্রার্থী চাইলে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন, তবে নতুন করে ফলাফল দেয়া সম্ভব নয়। ফল ঘোষণার সময় তারা কেন অভিযোগ জানাননি। কারণ, তাদের হাতে তো রেজাল্ট শিট ছিল। তিনি আরো বলেন, যে চারটি কেন্দ্রের ফলাফল নিয়ে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সেখানে তাদেরও প্রতিনিধি ছিলেন। সেখানে তাদের যে রেজাল্ট শিট দেয়া হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে আমরা যে ঘোষণা দিয়েছি, সেখানে কোনো অমিল থাকলে আমাদের বলতে পারতেন। কিন্তু সেটা তারা করেননি।
ভোটের দিন রাতে ফলাফল প্রকাশকে কেন্দ্র করে যে তুমুল হট্টগোল হয়েছে তাতে বিস্মিত সাধারণ নাগরিক থেকে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও। পাপড়ি বোস বলেন, ঘটনাটি শোভনীয় নয়। এতে মানুষের মনে খটকা লেগেছে। ইসি হট্টগোলের শুরুতেই রেজাল্ট দিয়ে দিতে পারত। এত সুন্দর ভোট উৎসব শেষটা ভালো হলো না, এটি দুঃখ থেকে গেল।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়