ঐক্য পরিষদের বিবৃতি : ধর্ম মন্ত্রণালয়ে বাজেট বরাদ্দে ধর্মীয় বৈষম্য অবসান দাবি

আগের সংবাদ

নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা : সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি

পরের সংবাদ

দগ্ধদের আকুতি- ‘দোয়া কইরেন যেন বেঁচে থাকি’

প্রকাশিত: জুন ৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইমরান রহমান : ‘ডাক্তাররা শরীরের অনেক মাংস কেটে ফেলেছে। অনেক ইনজেকশন দিয়েছে। ভালোমতো তাকাতেও পারছি না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হয় আর বাঁচব না। বাবা-মাকে বইলেন দোয়া করতে। আপনারাও দোয়া কইরেন, আমি যেন বেঁচে থাকি।’ আইসিইউ বেডে ব্যান্ডেজে মোড়ানো পোড়া শরীর নিয়ে এভাবেই চাচির কাছে বেঁচে থাকার আর্তনাদ জানালেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হওয়া ফরমানুল ইসলাম। চাচি ফরিদা ইয়াসমিন চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না। কয়েক মিনিটের জন্য কষ্ট চেপে রেখে আইসিইউ ওয়ার্ডের বাইরে এসে চিৎকার করে কান্না শুরু করেন। তাকে সান্ত¡না দিতে দিতে চোখের পানি ফেলেন ফরমানুলের অন্য স্বজনরাও।
শুধু ফরমানুলই নয়, সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডিতে দগ্ধ যাদের শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে তাদের বেশির ভাগই স্বজনদের কাছে বেঁচে থাকার আকুতি জানাচ্ছেন। আর স্বজনরা তাৎক্ষণিক সান্ত¡না দিলেও আড়ালে এসে আহাজারিতে ভেঙে পড়ছেন। গতকাল সোমবার দুপুরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (আইসিইউ) সামনে ফরমানুলের চাচির সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। বারবার মূর্ছা দিতে দিতে ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, দুই পায়ের রান ও পেছনের অংশ থেকে অনেক মাংস কেটে ফেলছে। ঠোঁট ও চোখ পুড়ে গেছে। ভালোমতো তাকাতেও পারেনি। শুধু বলল,‘ বাবা-মাকে দোয়া করতে বলবেন…’ বলেই কান্না শুরু করেন তিনি। তাকে সান্ত¡না দিতে দিতে চোখের পানি ফেলছিলেন, ফরমানুলের বন্ধু বেলাল, খালু রশিদ আহমেদ ও চাচাতো ভাই সোহেল শিকদার। তারা জানান, সীতাকুণ্ডের ওই ডিপোতে রিসিভার হিসেবে কাজ করতেন ফরমানুল। বাড়ি বাঁশখালী। বাবার নাম নাসির হোসেন। এক ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার বড় সে।
ফরমানুলের স্বজনদের মতোই কান্না করতে দেখা যায় দগ্ধ গাউছুল আজমের স্ত্রী নাজমা ইসলামকে। একই রকম চিত্র দেখা যায় পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের সামনেও। ওই ওয়ার্ডের সামনে লিফটের পাশে বসে কাঁদছিলেন দগ্ধ নজরুল ইসলামের স্ত্রী রূপা বেগম। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি বলেন, ‘ভেতরে গেছিলাম। উনি (স্বামী) ভালোমতো কথা বলতে পারতাছে না। বারবার মেয়েদের দেখতে চাচ্ছে। আর দোয়া করতে বলছে। উনার কিছু হয়ে গেলে মেয়েদের নিয়ে রাস্তায় বসতে হবে। ডাক্তাররা বলছে, ভালো হয়ে যাবে। সেই আশায় বসে আছি।’ এসময় তার পাশে থাকা ছোট মেয়ে হাবিবা ‘আব্বু যাব আব্বু যাব’ বলে বায়না করতে থাকলে, হাবিবাকে জড়িয়ে ধরে আবারো কান্নায় ভেঙে পড়েন রূপা বেগম।
এদিকে, সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় রাজধানীর শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়া রোগীর বেশির ভাগই আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। গতকাল বেলা সাড়ে ১২টায় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম।
তিনি বলেন, গতকাল সোমবার ভোর পর্যন্ত মোট ১৫ জন রোগী এসেছেন। তাদের মধ্যে একজন দগ্ধ না হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ১৪ জনের মধ্যে ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক উল্লেখ করে অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম জানান, তাদের মধ্যে চারজন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) আছেন। ৪ জনের অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। এছাড়া ১৪ রোগীর মধ্যে ১৩ জনের চোখ ‘হাইলি এফেক্টেড’ হয়েছে। তাদের চিকিৎসায় ঢামেকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহায়তা নেয়া হচ্ছে। ১০ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করে অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সেইসঙ্গে ঢামেক থেকেও চিকিৎসকরা এসে তাদের দেখে গিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এখান থেকে সবধরনের চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেনের নেতৃত্বে চিকিৎসকদের একটি দল বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রয়েছেন। ওখান থেকে আরো ৭-১০ জন রোগী এখানে পাঠানো হতে পারে বলে জানানো হয়েছে।
এদিকে আমাদের ঢামেক প্রতিনিধি জানান, গতকাল দুপুরে সজীব নামে আরো একজনকে বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয়েছে। এ নিয়ে বার্ন ইউনস্টিটিউটে রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ জন। আর রাসেল নামে একজনকে ঢামেকে স্থানান্তর করা হয়েছিল, তিনি চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন।
জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে : বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল সোমবার দুপুরে রাজধানীর শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে দুর্ঘটনায় আহতদের দেখতে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এরপর সাংবাদিকদের তিনি একথা জানান।
মন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রাম এবং ঢাকার সব হাসপাতালকে আমরা নির্দেশনা দিয়েছি। তারা চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে এবং বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে একটি টিম গেছে। চট্টগ্রামের টিমও কাজ করছে। যেসব রোগীর অবস্থা গুরুতর, তাদের প্রয়োজনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য আমরা বলেছি। যারা আসতে চাচ্ছেন, তাদের আমরা নিয়ে আসছি। এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সীতাকুণ্ডের দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন মারা গেছেন। এছাড়া ২০০ জন আহত হয়েছেন। যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ৯ জন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী। নিহতদের সবার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। দুর্ঘটনার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী খোঁজখবর রাখছেন এবং নির্দেশনা দিচ্ছেন।
নিহতদের বেতন চলমান থাকবে : স্মার্ট গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের জিএম মো. মমতাজ উদ্দিন বলেছেন, নিহত প্রত্যেককে ১০ লাখ, অঙ্গ হারানো প্রত্যেককে ৬ লাখ, আহত প্রত্যেককে ৪ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। পাশাপাশি নিহত যাদের ছোট বাচ্চা আছে, সে কর্মক্ষম হলে কোম্পানিতে চাকরি দেয়া হবে। তার আগ পর্যন্ত নিহত ব্যক্তি যে পরিমাণ বেতন পেতেন সেটি অব্যাহত রাখা হবে।
উল্লেখ্য, গত শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সীতাকুণ্ড উপজেলার কদমরসুল এলাকার প্রাইভেট আইসিটি বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগে। সংশ্লিষ্টরা জানান, রাতে একটি কনটেইনারে আগুন লাগে। পরে সেটি বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে আগুন ডিপোর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এ দুর্ঘটনায় প্রথমে ৪৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও গতকাল স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মৃতের সংখ্যা বলা হয়েছে ৪১। যার মধ্যে ২২ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকিদের পরিচয় নিশ্চিত হতে ডিএনএ টেস্ট করছে সিআইডি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়