ঐক্য পরিষদের বিবৃতি : ধর্ম মন্ত্রণালয়ে বাজেট বরাদ্দে ধর্মীয় বৈষম্য অবসান দাবি

আগের সংবাদ

নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা : সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি

পরের সংবাদ

ডিপো নয় যেন মৃত্যুপুরী ফের বিস্ফোরণের শঙ্কা!

প্রকাশিত: জুন ৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রীতম দাশ, সীতাকুণ্ড থেকে ফিরে : চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপো যেন একটি মৃত্যুপুরী। ভয়াবহ বিস্ফোরণে সৃষ্ট আগুন দুদিনেও পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়নি। এখনো ডিপোর ভেতরে কন্টেইনারে ধিকি ধিকি জ্বলছে আগুন। কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়ছে ধোঁয়া। চারপাশে উৎকট পোড়া গন্ধ। কিছুক্ষণ পরপর কিছু ফেটে পড়ার শব্দে উপস্থিত সবার মধ্যে আতঙ্ক-ভয় যেন ঘিরে ধরেছে। সেই ডিপোতে আবারো বিস্ফোরণের আশঙ্কায় খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর সদস্য ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের।
এদিকে ওই ভয়াবহ বিস্ফোরণে ব্যাপক হতাহতের ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে এখনো ভর করে আছে আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা। যেন বিভীষিকাময় পরিস্থিতি পার করছেন তারা। এখনো ডিপোর চারপাশে এবং ডিপোর বাইরে ছড়িয়ে আছে বিস্ফোরণে কন্টেইনার ভেঙে গিয়ে ধাতব টুকরো। কোথাও পড়ে আছে ভাঙা প্লাস্টিকের পাইপ, লোহার টুকরো, ছাই হয়ে যাওয়া কাপড়ের স্তূপ। কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনার দুদিন পরের চিত্র এটি।
গতকাল সোমবার দুপুরেও ডিপোর বিভিন্ন অংশ থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। দুয়েকটি জায়গায় কন্টেইনারে জ্বলছিল আগুনও। সকাল সোয়া ১০টা পর্যন্ত সংবাদকর্মীদের ডিপোর ভেতরে ঢুকতে দেয়া হলেও ডিপোতে রাসায়নিক ভর্তি আরো ৪টি কন্টেইনারের সন্ধান পাওয়ায় এবং বিভিন্ন স্থানে আগুন এখনো না নেভায় নিরাপত্তার স্বার্থে সেখান থেকে সংবাদকর্মীদের বের করে দেয়া হয়। বিএম ডিপোর ভেতরে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীর সদস্যরা। ডিপোর প্রধান ফটকে বাইরে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী ইউনিট, সিআইডি, ফরেনসিক বিভাগ, পিবিআইসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট, র‌্যাব, আনসার সদস্যরা অবস্থান করছেন। সংবাদ সংগ্রহে ভিড় করেছেন গণমাধ্যমকর্মীরাও। ডিপোর বাইরে ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন উদ্ধারকারী সংস্থার সারি সারি গাড়ি।
ফের কন্টেইনার বিস্ফোরণের আশঙ্কা : এদিকে বিএম ডিপোতে আরো ৪টি কন্টেইনারে রাসায়নিক বস্তুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী। ডিপোর বিভিন্ন স্থানে আগুন এখনো না নেভার পাশাপাশি ডিপোতে রাসায়নিক ভর্তি আরো ৪টি কন্টেইনারের সন্ধান পাওয়ায় ফের বিস্ফোরণের আশঙ্কা করছে সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিস। নিরাপত্তার স্বার্থে কন্টেইনারগুলো নিরাপদে সরিয়ে রাখতে বিশেষ ব্যবস্থায় কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের বিশেষজ্ঞ টিম। গতকাল সোমবার দুপুরে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ১৮ ব্রিগেড অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, রাসায়নিক বস্তু ভর্তি আরো ৪টি কন্টেইনার শনাক্ত করা হয়েছে। কন্টেইনারগুলো নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখতে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের বিশেষজ্ঞ টিম। এদিকে রবিবার থেকে পানি সরবারহসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে আগুন নেভানো ও উদ্ধার কাজে যোগ দেয় নৌবাহিনী। নৌবাহিনীর বানৌজা ভাটিয়ারি ঘাঁটির অধিনায়ক কমান্ডার এন এ এস এন নাদিরুজ্জামান বলেন, ‘ফায়ারট্রাক, অ্যাম্বুলেন্স ও জনবল নিয়ে অগ্নিনির্বাপনে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি পানি সরবরাহ নিশ্চিত করেছি।’
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, কন্টেইনার ডিপোটিতে ‘হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড’ নামে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক ছিল। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ; উচ্চতাপে এটি বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে। বিস্ফোরণে পুরো এলাকায় রাসায়নিকের বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে। এতে উদ্ধারকর্মীরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক

(প্রশিক্ষণ) মনির হোসেন জানান, ডিপোর ভেতরে এখনো একাধিক কন্টেইনারে রাসায়নিক রয়েছে। বিশেষ পদ্ধতিতে আগুন নেভানোর চেষ্টা চলছে। এজন্য অত্যাধুনিক কেমিক্যাল টেন্ডার আনা হয়েছে। ২০ জনের বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী দল কাজ করছে। আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক মো. ফখর উদ্দিন বলেন, আগুন এখন নিয়ন্ত্রণে আছে, তবে পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়নি। আমরা কাজ করছি। বিভিন্ন কন্টেইনারে আগুন জ্বলছে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি আগুন নেভানোর। আরো ৪টি কন্টেইনারে রাসায়নিক আছে। তাই আমাদের সাবধানতার সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে।
এদিকে ডিপোতে ড্রেন হয়ে মদনহাট খাল দিয়ে রাসায়নিকের দূষণ যাতে সাগরে না পৌঁছায়, সেজন্য কাজ করছে সেনাবাহিনীর একটি বিশেষজ্ঞ দল। সেনাবাহিনীর ১ ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিরা সুলতানা গতকাল সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখানে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের ২৬টি কন্টেইনার ছিল। অন্যকোনো রাসায়নিক ছিল না কিনা তা এখনো জানা যায়নি। আমরা রাসায়নিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় বিভীষিকার কথা : বিএম ডিপোর পাশের কেশবপুর গ্রামের বাসিন্দা মোমিনুল হক বর্ণনা করেন শনিবার রাতের বিভীষিকার কথা। তিনি বলেন, আগুন লাগে রাত সাড়ে ৯টার দিকে। শুরুতে ডিপোর লোকজন নিজেরা আগুন নেভাতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। তখন সেখানে ডিপোর দুই শিফটের কর্মচারী, কাভার্ডভ্যানের চালক-সহকারী, শ্রমিক, সিএন্ডএফের লোকজনসহ হাজারখানেক মানুষ ছিল। পরে আগুন নেভাতে না পেরে ফায়ার সার্ভিসে খবর দেয়। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন একটা কন্টেইনারে পানি ছিটাল। এর কিছুক্ষণ পরই সেটা বিস্ফোরিত হয়ে যায়। তখন যারা কাছাকাছি ছিল, সবাই ছিটকে পড়ে। এরপর আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়তে থাকে একের পর এক কন্টেইনারে। তারপর আর থাকতে পারিনি। কিন্তু বাসায় গিয়েও থাকতে পারছিলাম না। আবার আসি রাত দেড়টার পর। তখন দেখি একের পর এক লাশ বের হচ্ছে। পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া বীভৎস লাশ। যারা বেঁচে আছেন, তারা অধিকাংশই দগ্ধ। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, রাত সাড়ে ১০টার পর হঠাৎ করে বিকট শব্দে আশপাশের বাড়িঘরসহ সব কিছু কেঁপে উঠল। আওয়াজের পর দেখি আগুনের লেলিহান শিখা। শব্দে আমাদের বাসাবাড়ির দরজা-জানালা ভেঙে পড়ে যায়।
ডিপোতে দাহ্য পদার্থ মজুত নিয়ে প্রশ্ন : ভয়াবহ বিস্ফোরণের পেছনে দাহ্য পর্দাথের উপস্থিতি নিয়ে এবং ডিপোতে রাসায়নিক মজুতের অনুমতি ছিল কিনা- এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে ব্যাপক আলোচনা চলছে। রাসায়নিক থাকার সব ধরনের অনুমোদন রয়েছে বলে ডিপো কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয় বলছে, সেখানে রাসায়নিক বস্তু থাকার বিষয়টি জানাই ছিল না তাদের। বিস্ফোরক অধিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, বিএম কন্টেইনার ডিপোর রাসায়নিক বা দাহ্য পদার্থ রাখার কোনো অনুমতি নেই। সেখানে দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণ বা মজুতের কোনো নিয়ম না মানার কারণেই হয়তো ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছি, রাসায়নিক থেকে আগুন লেগেছে এবং সেখানে দাহ্য পদার্থও ছিল। দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে ফেটে যাওয়া বেশ কিছু ‘হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের’ প্লাস্টিক জার দেখা যায়। তৈরি পোশাক ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন আমদানি ও রপ্তানির কন্টেইনার খালাস ও পরিবহনের জন্য গড়ে তোলা ডিপোতে কেন রাসায়নিক মজুত বা সংরক্ষণ করা হবে?
এদিকে ঘটনার সময় শনিবার রাত সাড়ে ৯টার পর থেকে রবিবার পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ডিপোতে রাসায়নিক থাকার খবর ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের জানানোই হয়নি বলে সংস্থাটি জানিয়েছে। চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রথাগতভাবে পানি দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কারণ ডিপোতে যে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিল, সেটা ডিপোর কেউ ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তাদের জানায়নি। রাসায়নিক থাকার কথা জানতে পারলে আমরা হয়তো অন্যভাবে এগোতাম; আরো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারতাম, ফোম ব্যবহার করতে পারতাম।
রবিবার সকালে পরিদর্শন শেষে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মো. শাহজাহান বলেছিলেন, ডিপোতে ২৬টি কন্টেইনারে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ছিল। এর বাইরে ডিপোর টিনশেডেও প্লাস্টিকের জারেও এই রাসায়নিক ছিল। আগুন লাগার পর কন্টেইনারে থাকা রাসায়নিক ভর্তি জার ফেটে যায়। এতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বের হয়ে কন্টেইনারের সংস্পর্শে আসে। অক্সিজেন নির্গত হয়ে আগুনের সংস্পর্শে এসে জ্বলতে থাকে। এতে কন্টেইনারের ভেতরে তাপমাত্রা বেড়ে বিস্ফোরণ ঘটে। কন্টেইনার ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে স্পিøন্টারের মতো তা ছড়িয়ে পড়ে।
চট্টগ্রাম নগরী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ২৪ একর জায়গায় অবস্থিত বিএম কন্টেইনার ডিপো ২০১১ সালের মে মাসে নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটির বাংলাদেশ অংশে মালিকানায় রয়েছে স্মার্ট গ্রুপ। এটির ধারণক্ষমতা সাড়ে চার হাজার কন্টেইনার। ওই ডিপোতে ৪ হাুজার ৩০০ কন্টেইনার ছিল। তার মধ্যে ৩ হাজার কন্টেইনার ছিল খালি। বাকিগুলোতে ছিল আমদানি করা এবং রপ্তানির জন্য রাখা বিভিন্ন পণ্য। বিএম কন্টেইনার ডিপোর পরিচালক মুজিবুর রহমানের মালিকানাধীন আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের উৎপাদিত হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডও রপ্তানির জন্য রাখা ছিল কন্টেইনারে। ওই রাসায়নিকই আগুনকে ভয়ঙ্কর রূপ দিয়েছে বলে ফায়ার সার্ভিসের ধারণা। এই ডিপোর পরিচালক মো. মুজিবুর রহমান স্মার্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। তার বড় ভাই মুস্তাফিজুর রহমান বর্তমানে ডিপোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়