করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

বিজলী শাড়ি ঘর

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চলো না সামনের দোকানটায় ঢুকি…
কাজলকে অনবরত এক অনুরোধ করে যাচ্ছে মুক্তা। প্রায় বছর ছয় হতে চলেছে ঢাকার বাসিন্দা কাজল। এই শহরের রাস্তায় সাজানো নিয়ন বাতি, ধুলোর আবরণে ঢেকে যাওয়া সবুজ পাতা, অফিস ফেরত মানুষগুলোর গায়ে লেগে থাকা ঘামের গন্ধ, বুড়িগঙ্গার নিকশ কালো জল, শক্তির দম্ভ দেখিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলা মেট্রোরেলের লাইন- সব খুব গভীরভাবে চেনা কাজলের। কিন্তু এতগুলো বছরে একটিবারের জন্যও নিউমার্কেট নামক মানুষের স্তূপে প্রবেশ করা হয়ে ওঠেনি।
আজ শুক্রবার, ছুটির দিনে ভিড়ে ঠাসা এই বিপণিবিতান। এখন প্রায় সন্ধ্যা, প্রতিটি দোকানে হাজার হাজার ক্ষমতার বাহারি বাতি জ্বলে উঠেছে। চোখ ঝলসানো এই বাতিগুলো যেন দিনের আলোর চেয়েও বেশি শক্তিশালী। মায়াবী আলোয় লাল-নীল-সবুজ-হলুদ শাড়ি-কামিজগুলো আরো উজ্জ্বল, আরো ঝকঝকে, জরি-চুমকির কাজ থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে মনের কোণে ঠিকই ভালো লাগার জন্ম দেয়। ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে ব্যবসায়ীদের কতরকম কৌশল! দোকানের নামটাও ভেতরে সুঁই ফোটায় ‘বিজলী শাড়ি ঘর।’ এই দোকানের ঝাঁ চকচকে কাচ ভেদ করে একটা কুসুমরঙ্গা শাড়ি মুক্তার মন জয় করে ফেলেছে, নিজেকে মানায় কি না এটা সে পরখ করতে চায়। এমন আলোর রোশনাই থেকে শহরের আধুনিক মেয়েরাই বাঁচতে পারে না, মুক্তার তো সদ্য পা পড়েছে ঢাকায়, তার ভালো লেগে যাওয়াটা একদম অস্বাভাবিক কিছু নয়।
মুক্তার সঙ্গে কাজলের বিয়ে হয়েছে আঙুলের কর গুনে গুনে মাত্র ২৯ দিন। বিয়ের কাহিনী শুনে রাজধানীতে বসবাসরত মানুষেরা রূপকথার গল্প ভেবে ভুল করতে পারেন। কাজলের বাবা জাফর হোসেন হঠাৎ ফোন করে জানালেন তিনি অসুস্থ, ছেলের জন্য মন ছটফট করছে। ঢাকা থেকে মেহেরপুর, যাতায়াত সহজ নয়। অফিসে কাজেরও প্রেসার খুব। কিন্তু বাবার অসুখ বলে কথা! খুব কষ্টে চারদিনের ছুটি যোগাড়-যন্তর করে বাড়িতে যায় কাজল। ঢুকেই চোখ দুটো কেমন জ্বালা করে উঠে গরম ভাপ বের হতে শুরু হলো। পুরো বাড়িতে যেন উৎসবের আমেজ। কামারের গনগনে আগুনে পোড়ানো দায়ের মতো মেজাজ হয়ে গেল গরম। এত দূরের পথের ধকল, শরীর খুব করে চাইছে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে, মন চাইছে এই পায়েই ঢাকায় ফেরত চলে আসে। কাজল দরজার সামনে খানিকক্ষণ দাঁড়ায় তারপর নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে।
মায়ের হাতের রান্নায় উদর ভর্তি করে, বিড়ালের লোমের মতো নরম কম্বলে গোটা শরীর মুড়ে দেওয়া ওমে কাজলের দুই চোখ সবে ঢুলুঢুলু, আফিয়া বেগম এসে সেই চোখজোড়ার সামনে মেলে ধরলেন এক ছবি। টকটকে লাল রঙের ক্যাটকেটে পাথর বসানো শাড়ি জড়িয়ে, গলায় সস্তা ইমিটেশনের চকচকে গয়না পরে শক্ত হয়ে দাঁড়ানো সদ্য কৈশোর পার হওয়া এক নারী, বোঝাই যায় ছবি তোলায় সে তেমন অভ্যস্ত নয়।
-‘ওর নাম মুক্তা। তোমার বাবা পছন্দ করেছেন। বিয়েও ঠিকঠাক।’
-‘বিয়েই যখন ঠিকঠাক তখন আমাকে বলার আর কি দরকার, গলার উপর রাম দা রেখে কোপ কয়টা দেবে তা জানতে চায়’- মনে মনে বিড়বিড় করে কাজল।
প্রায় নয় মাস ধরে সারার সঙ্গে গভীর প্রণয়ে জড়িয়ে আছে সে। যদি সারা না থাকতো, মুক্তা, সিক্তা, রিক্তা যাকে ইচ্ছা বিয়ে করা কোনো ব্যাপারই ছিল না। সব আয়োজন করেই ফেলেছেন জাফর হোসেন। শহর থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বেনারসি কেনা হয়েছে, গোপন সিন্দুক থেকে অতি প্রিয় সীতাহারটা বের করে দিয়েছেন আফিয়া বেগম, পাঁচটা খাসি এবং দুইটা গরু কেনা শেষ, প্যান্ডেলের লোক কথা বলতে চলে এসেছে, শুধু যার বিয়ে তার মতামতের জন্য অপেক্ষা করা হয়নি। আগেকার দিনে এইভাবে বিয়ে হতো বলেই শুনেছে কাজল, আজকালও এমন হয়! তাও আবার কাজলের নিজের জীবনে! কিচ্ছু করার নেই, গলায় ফাঁস দেওয়া শেষ, এখন পায়ের নিচের টুলটা ধাক্কা দিয়ে ফেলতেই হবে। ভবিষ্যতের ওপর সব ছেড়ে দেয় কাজল, মনের এই ক্ষতে নিজেই সান্ত¦নার মলম লাগিয়ে বারবার উচ্চারণ করে যে পরেরটা পরেই ভাবা যাবে। হৃদয়ে আংটির প্যাঁচ বসানো জাফর সাহেবের মতের বিরুদ্ধে গেলে হয়তো ঘটে যাবে বড় ধরনের অঘটন। কাজলেরই ভুল হয়েছে, সারার কথাটা অন্তত মায়ের কানে কানে কোনো একদিন বলে ফেলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হতো। সে যে এটা ভাবেনি তা নয় তবে সারাকে আর একটু বুঝে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু এর মাঝখানেই জড়িয়ে গেল তৃতীয়পক্ষ এবং একদম স্থায়ীভাবেই সে শিকড় গেঁথে ফেলতে চাইছে কাজলের জীবনে। শিকড় যত গভীরেই প্রবেশ করুক, তা কেটে ফেলার মতো ধারালো অস্ত্রও তখন তৈরি করা যাবে, বরং আপাতত এই কুড়িয়ে পাওয়া জীবন উপভোগের সিদ্ধান্ত নেয় কাজল।
বিয়ে পর্ব ভালোমতো চুকে যাওয়ার পর মুক্তার মুখটা প্রথম ঠিকঠাক নজরে এলো। সস্তা পার্লারের মেক আপের পরত ভেদ করে উঠে এসেছে তার স্নিগ্ধ শান্ত মুখ! প্রসাধনীর আস্তরণে ঢেকে পড়া চোখের দিকে তাকালেও বোঝা যায় এখনো কোনো পাপের স্পর্শ সেখানে পড়েনি। অথচ যে হাত দিয়ে সে মুক্তার দুটো হাত ধরে তাকে একটা ভালোবাসায় মোড়া জীবনের প্রতিশ্রæতি দেবে সেই হাতে লেগে আছে অন্য একজনের গন্ধ। কিন্তু মুক্তাকে কোনোমতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না এসব। ল্যাঠা সব চুকে যাক, তারপর সময় এলে অন্য খেলা পাতানো যাবে, মনে মনে ভেবে নেয় কাজল।
জাফর হোসেন শুধু বিয়ে করিয়েই ক্ষান্ত হননি, মুক্তাকে বাক্স প্যাটরাসহ ছেলের সঙ্গে ধরিয়ে দিয়েছেন। কতবার বাবাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে কাজল যে বাসাটা একটু গুছিয়ে তারপর নিয়ে যাবে। বাবার এক কথা, মুক্তাই সব গুছিয়ে নেবে। কথা যে বাবা মিথ্যা বলেছেন তা নয়, নিজের বাসা এখন নিজেই চিনতে পারে না কাজল, মুক্তার হাতের ছোঁয়ায় সব হয়ে উঠেছে পরিপাটি, সুন্দর। কোথাও একটা বালির কণা লেগে থাকে না, বিছানায় নেই মাংসের ঝোলের দাগ, বালিশ-তোশক থেকে উঠে আসে না বোটকা গন্ধ, জামা-কাপড় আলমারিতে পাটে পাটে সাজানো। মুক্তা যখন তার দুধসাদা হাতে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে ঘুম ভাঙায়, তখন মনে হয় জীবন আসলেই সুন্দর। অফিস থেকে ফিরে গরম ভাতের সঙ্গে লাউ চিংড়ি, বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল, গরুর মাংসের ভুনা পাতে পড়লে ভুলে যায় সারা বলে যে এক নারীর অস্তিত্ব রয়েছে তার জীবনে। নতুন এ জীবনের সবটুকু সুখ পরতে পরতে উপভোগ করতে থাকে কাজল, সময় বুঝে দুধের ওপর থেকে সরটুকু তুলে তলার বাটিভর্তি দুধ ফেলে দেবে একদিন, একথা ভেবেই দিনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে সে।
-মুক্তা, ঘর থেকে একদম বাইরে যাবে না।
-কেন?
-তুমি কিছুই চেনো না, ঢাকা শহর খুব খারাপ জায়গা। বিপদে পড়বে। একবার আমার এক বন্ধুর বউয়ের কি হয়েছে শুনলে তোমার তো ভয়ে গা কাটা দিয়ে উঠবে।
-কী হয়েছে? রিক্তার পেটের ভেতরের নাড়ি-ভুড়ি অব্দি কেঁপে ওঠে কাজলের এ কথায়।
-আমার বন্ধু আফসারের বউ একা একা বাসায় থাকে, একদিন বেল বাজার পর দরজা খোলে, তারপর দুই-তিনটা ছেলে ঘরে ঢুকে বাসার সব নিয়ে পালিয়ে গেল। তুমি বাইরে তো যাবেই না, বেল বাজলেও দরজা খুলবে না। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে তোমাকে ফোন করবো তারপর দরজা খুলবে। পাশের বাসার কেউ এলেও খুলবে না। ঢাকা শহরে কাউকে বিশ্বাস নেই মুক্তা। কোথাও যেতে হলে আমি তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবো।
কিন্তু কাজল সঙ্গে করেও কোথাও নিয়ে যায় না মুক্তাকে। প্রায় এক মাস একদম ঘরবন্দি জীবন কাটায় সে। বাইরে বের হলে যদি আবার কখনো সারার সামনে পড়তে হয় তাই মুক্তাকে সবসময় লুকিয়ে রাখে কাজল।
কাজল এবং সারার অফিস পাশাপাশি। প্রতিদিন অফিস ছুটির পর সারাকে নিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে রিকশায় ঘুরে, কফিশপে আড্ডা, গল্প অথবা প্রেম শেষে বাসায় ফিরে কাজল মেতে ওঠে মুক্তার উষ্ণ আলিঙ্গনে।
শুক্রবার সকাল থেকে মুক্তার চোখের জল আর কোনো বাধাই মানে না। যে সবসময় ছুটে বেড়াতো গ্রামের এ মাথা থেকে ও মাথা, সর্ষে ফুলের গন্ধে যার পাগল-পাগল লাগতো, কোচভর্তি করে শিউলি কুড়ানোর জন্য মোরগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যে ঘুম থেকে জেগে উঠতো- গত এক মাস সে সূর্যের আলো গায়ে মাখেনি। খালাতো বোনের মুখে মুক্তা গল্প শুনেছে ঢাকার নিউমার্কেটে নাকি রং-বেরঙের শাড়ি পাওয়া যায়। বিয়ের সময় ছোট খালা একটা শাড়ি কেনার জন্য কিছু টাকা দিয়েছিলেন। খুব শখ সে একটা চুমকি বসানো শাড়ি কিনবে। কাজল অনেক ওজোড় আপত্তি করেছিল। কিন্তু শেষমেশ কান্না দেখে মায়া হলো। সারার বাসা উত্তরা, ছুটির সন্ধ্যায় তার নিউমার্কেট আসার কথা না। মনে মনে নিজেকেই যুক্তি দেখিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে রিকশায় উঠে বসলো কাজল।
কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি! মুক্তা যে দোকানে যেতে চাচ্ছে কাচের দরজা ভেদ করে সেখানে দৃষ্টি গিয়েছিল কাজলের, ‘বিজলী শাড়ি ঘরে’ বসে মুখে হালকা হাসি মেখে শাড়ি বাছাই করছে সারা। কাজলের হাতটা টেনে টেনে দোকানের ভেতরে নিয়ে গেল মুক্তা। প্রদর্শন করা কুসুম রঙের শাড়িটাই সে কিনবে।
-দেখো তো এই শাড়িটায় আমাকে কেমন লাগবে? দুধে আলতা গায়ের ওপর শাড়ির আঁচল ফেলে জানতে চায় মুক্তা।
একবার শাড়ির দিকে চোখ ফেলে কাজল, আবার কিছুটা দূরে বসে থাকা সারার মুখের দিকে আড়চোখে তাকায়। ফোন বের করে বার্তা লেখে ‘আমি কাল তোমাকে সব বুঝিয়ে বলবো।’ সারা বুদ্ধিমতী, নিশ্চয় কোনো অঘটন ঘটাবে না।
-ফোন রেখে একটু দেখো না আমাকে কেমন লাগবে? মুক্তার আহ্লাদী আবদার।
সুরেলা বার্তাবহ আওয়াজে বাদামি রঙের চামড়ার ব্যাগ থেকে এন্ড্রয়েড ফোন বের করে চোখের সামনে মেলে ধরে সারা। প্রায় চল্লিশ সেকেন্ড মনোযোগ দিয়ে পড়ে। ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বাইরে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ায়। খানিকটা এগিয়ে প্লাস্টিকের সস্তা টুলে বসে থাকা কাজলের গালে সপাট একটা চড় কষিয়ে হনহন করে চলে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় দোকানে মডেলের মতো শাড়ি জড়িয়ে রাখা কর্মচারীটির হাত থেকে পড়ে যায় চুমকি বসানো শাড়িটি। ক্যাশ বাক্স আগলে রাখা টেকো মাথার লোকটা টাকার অংক ভুলে যেতে থাকে।
-মহিলা তোমাকে চড় মারলো কেন? আরে ভাই, আপনারাও চুপচাপ দেখে গেলেন, কিছু বললেন না? কেমন শহরে এলাম, মানুষ হয়ে মানুষকে অকারণে এভাবে কেউ মারে? মুক্তা শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে অনর্গল বলে যেতে থাকে।
কাজলের গালে বসে গেছে সারার পাঁচটি আঙুলের দাগ। গালের ঠিক এই পাশটিতেই গত সন্ধ্যায় সে দিয়েছিল আলতো চুম্বন। জ্বলে পুড়ে হাহাকার করে চলেছে নগ্ন বাম গাল, মস্তিষ্ক সংকেত পাঠাচ্ছে বিরামহীন ‘কাজল, হাতের শীতল স্পর্শ পেতে চাইছে তোমার গাল, দাও, দাও, হাতটা বুলিয়ে দাও গালে।’ পাথরের মতো অসাড় হাত দুটো উপরে উঠানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে থাকে কাজল।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়