করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

রবি ঠাকুরের সুভা নয়

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমার সুদীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে কোনো পারিবারিক বা সাংসারিক সমস্যা বা বিপর্যয় ঘটেনি। স্বামী-স্ত্রী একই আদর্শের হলে, মতের মিল হলেও মনের মিল থাকে। পরস্পরের সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে উভয়ে সচেতন থাকলে ঝামেলা হওয়ার কথা নয়। আমাদের দু’জনের পাঠাভ্যাস আছে। বই পড়ে, নামাজ পড়ে, কুরআন পড়ে ও গান শুনে, বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীত শুনে, টিভি দেখে ভালোই সময় কাটে। আমার স্ত্রীর নাম মিনু। বছর কয়েক আগে আমার সহপাঠী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. ফরাস উদ্দিনের উদ্যোগে পদক্ষেপ ’৬৪ নামে আমরা একটা সংগঠন করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সব ছাত্র-ছাত্রী ’৬৪ সালে মাস্টার্স করেছে তাদের নিয়েই এই সংগঠন। বছরে তিন চারবার আমরা মিলিত হই। সবাই গল্প করি। অতীত দিনের স্মৃতিচারণ করি। গান-বাজনা করি। আমরা সমস্বরে গান গাই, ‘পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়’, ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না’ ইত্যাদি। খাওয়া-দাওয়া করি। সারাটা দিন যে কখন কীভাবে কেটে যায় বুঝতে পারি না। জন্মদিনে, নববর্ষে, ঈদের দিনে পরপস্পরকে শুভেচ্ছা জানাই। কোনো সদস্য আর্থিক সংকটে পড়লে সবাই মিলে চাঁদা তুলে তার সাহায্যে এগিয়ে যাই। কেউ অসুস্থ হলে খোঁজখবর নিই।
বিপর্যয় শুরু হলো দেশে কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে। লকডাউন জারি হওয়ার পর থেকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। কারো সঙ্গে যোগাযোগ থাকে না। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম টেলিফোন বা মোবাইল ফোন। শুধু বন্ধু-বান্ধব নয়, আত্মীয়-স্বজন থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। বাড়ি থেকে বের হতে পারি না, কারো বাড়ি যেতে পারি না, কেউ আসতে পারে না। আড্ডা দিতে পারি না। এটা এক প্রকার বন্দিজীবন, মনমেজাজ খিটখিটে থাকে। চুল কাটার জন্য সেলুনেও যেতে পারি না। ঘরে মিনুকে দিয়ে বাড়তি চুল কাটাই। কোনো কারণ ছাড়াই মিনুর সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি। মিনুর ভালো কথাও আমার সহ্য হয় না। কোনো আত্মীয় বা বন্ধু অসুস্থ হলে দেখতে যেতে পারি না। কারো মৃত্যু হলে জানাজায়, দাফনে যেতে পারি না, বিয়ে-শাদির তো প্রশ্নই উঠে না। মনে হয় অনির্দিষ্টকালের জন্য আদিম গুহায় বাস করছি। মনে জেদ ওঠে, ‘এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে?’
আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলের নাম শুভ। মেয়ের নাম কান্তা। শুভ থাকে সিডনিতে। সেখানে চাকরি করতে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে। দুতিন বছরে একবার দেশে আসে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে তাও বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানে স্ত্রী আর একটি মেয়ে নিয়ে বিরাট সংসার পেতে বসেছে। শুভ নিয়মিত ফোন করে। মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠিয়ে পুত্রের কর্তব্য পালন করে। তাদের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য যে আকুতি আমাদের মনের মধ্যে আছে তা তারা বুঝতে পারে না। আমি বুঝি না টাকা-পয়সা খরচ করে সন্তানকে দূর দেশে পাঠিয়ে পিতা-মাতা কী আনন্দ পান (শুভ অবশ্য নিজের খরচেই বিদেশ গেছে)। বিদেশে থাকতে থাকতে একসময় তারা সেসব দেশের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট ও অনুরক্ত হয়ে পড়ে- নিজ দেশের কথা, মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনের কথা আস্তে আস্তে ভুলতে থাকে। পরে এক সময়ে একেবারেই ভুলে যায়। পশু-পাখিদের বাচ্চারা যেমন বড় হওয়ার সাথে সাথে বাবা-মাকে ছেড়ে গভীর অরণ্যে হারিয়ে যায়। পরে দেখা হলেও কেউ কাউকে চিনতে পারে না। এ যেন অনেকটা তেমনি। আমি পশু নই, পাখিও নই। আমি মানুষ। পুত্র স্নেহ এবং পিতৃত্বের আনন্দ নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চাই। কিন্তু সেটা ওরা বুঝবে না। কেউ বুঝতে চায় না।
শুভ এবং বৌমা লুবনার সংগীত প্রতিভা ছিল। খুব ছোট বেলা থেকে শুভ বাঁশি, মাউথ অর্গান বাজাতে পারতো। তার মধ্যে সংগীত প্রতিভা দেখে আমি তাকে হারমোনিয়াম ও গিটার কিনে দিয়েছিলাম। ওর আর মেয়ে কান্তার জন্য গানের শিক্ষক রেখেছিলাম। শুভ কবিতা লিখতো, গান লিখতো, তাতে সুর দিত। লুবনা সে গান গাইতো। লুবনা ভালো কীর্তন গাইতো। একবার শিল্পকলা একাডেমির একটি অনুষ্ঠানে সে একটি কীর্তন গেয়েছিল। তার সে গান ‘বনমালী তুমি পরজনমে হইয়ো রাধা’ এখনো আমার কানে বাজে। আমি তাকে উৎসাহিত করার জন্য খুশি হয়ে পাঁচশ’ টাকা দিয়েছিলাম। ২৫/৩০ বছর আগে পাঁচশ’ টাকার অনেক দাম ছিল, বিশেষ করে আমার মতো স্বল্পবিত্তের কাছে।
কিছুদিন দুজনে সংগীত চর্চা করে। আমার বেশ ভালো লাগে। আমার ইচ্ছা ছিল আমার সন্তানদের মধ্যে কেউ শিল্পী বা সাহিত্যিক হোক। প্রত্যেক পিতা-মাতা সন্তানের মাধ্যমে তার আকাক্সক্ষার পূর্ণতা পেতে চায়। কিছুদিন পর দেখলাম তারা গানের ভিডিও, ক্যাসেট করা নিয়ে ব্যস্ত। শহরের দেয়ালে পোস্টার লাগায়। আমি বুঝলাম, খেল খতম। শিল্পী হওয়ার আগেই যারা প্রচার নিয়ে ব্যস্ত হয়, তাদের দ্বারা শিল্পচর্চা হয় না। সংগীত সাধনার বিষয়। শুধু প্রতিভায় বড় হওয়া যায় না। চর্চা না থাকলে, শিল্পী হওয়া যায় না।
বছর কয়েক পর দু’জনে অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাংকের চাকরি নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যায়। এবং সেই সঙ্গে তাদের সংগীত চর্চারও ঘটে সমাপ্তি। নাতনী মনীষারও সংগীত প্রতিভা আছে, সারাক্ষণ তার মুখে গান লেগে থাকে, কিন্তু সে গান বাংলা গান নয়- বিদেশি ভাষার সংগীত। আমি তার এক বর্ণও বুঝি না। তার মধ্যে আমি আমাকে খুঁজে পাই না। ব্যর্থতার জন্য আমরাই দায়ী। ওর নাম রাখা হয়েছিল নিসর্গ ঈভ। সে ঈভ হয়ে গেল, নিসর্গ হতে পারল না। সম্প্রতি মনীষা আমার কাছে কোনো একটা রবীন্দ্র সঙ্গীতের কথা জানতে চেয়েছে। আশা জাগে, সে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা করবে।
আমার মতে আমাদের সন্তানরা বিদেশে যাবে পড়ালেখা করার জন্য, জ্ঞান অর্জনের জন্য, অর্থ উপার্জনের জন্য, কিংবা ভ্রমণের জন্য। স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য নয়। বিদেশে স্থায়ী হয়ে পড়লে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ভুলে যাবে। এক অর্থে এদের ‘ছিন্নমূল’ বললে অত্যুক্তি হবে না। শুধু অঢেল সুখ আর অর্থ উপার্জন কোনো মানুষের কাম্য হতে পারে না। জাগতিক প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে মানুষের জীবনে আরো অনেক কিছু পাওয়ার আছে, যা মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে আলাদা করে রেখেছে। মানুষ খাওয়ার জন্য বাঁচে না, বাঁচার জন্য খায়। সেই বাঁচা অন্য প্রাণীর থেকে অনেক উচ্চতর পর্যায়ের। বিদেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে সুখ থাকতে পারে, গৌরবের কিছু থাকে না। নিরবচ্ছিন্ন সুখও এক ধরনের শাস্তি। সুখ-দুঃখেই মানুষের জীবন। কেননা, জীবন শুধু একটাই। সুখ না পেলে দুঃখকে জানা যায় না, দুঃখ না পেলে সুখকে চেনা যায় না। একে অন্যের পরিপূরক।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু তাঁর বৃদ্ধ পিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। হিমালয়ের সমান উচ্চ জনপ্রিয়তা নিয়ে একটা রাষ্ট্রের জন্মদাতা একটি শিশুর মতো কেঁদে পিতার বুক চোখের পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। পিতা-পুত্র দু’জনের মিলন চোখের পানিতে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এ দৃশ্য যারা দেখেছে তারাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। পিতা-পুত্র দু’জনে ভাগ্যবান এবং পুণ্যবান না হলে এমন বিরল দৃশ্যের অবতারণা হয় না।

মেয়ে কান্তা ঢাকাতেই থাকে। স্বামী আর শাশুড়ি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। ওদের সেবা করতে করতেই তার জীবন সারা। আগে সপ্তাহে দু-একবার আসতো। এখন করোনাকালে তা বন্ধ হতে বসেছে। মাঝে মাঝে হঠাৎ একগাদা খাদ্যদ্রব্য আর ওষুধপত্র নিয়ে হাজির হয়। হুমকি-ধামকি দেয়। ভালো থাকার উপদেশ দেয়। বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের শাসন ভালোই লাগে। শৈশবে ফিরে যাই। কান্তা চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সম্প্রতি একটি ছবি করে প্রথম পুরস্কার হিসেবে দু’লক্ষ টাকা পাওয়ার পর ছবি নির্মাণের জন্য তার উৎসাহ আরো বেড়ে গেছে।
নাতনি প্রমা সাংবাদিক। সে-ই বেশি খোঁজ নেয়। যতœ নেয়। প্রমা পড়াশোনায় ভালো। লেখে ভালো। প্রতিভা আছে। তার বড় হওয়ার যোগ্যতা আছে, ক্ষমতাও আছে। কিন্তু তার মধ্যে বড় হওয়ার আকাক্সক্ষা নেই। আকাক্সক্ষা আর কৌতূহল মানুষকে বড় করে, স্বপ্ন মানুষকে পথ দেখায়। যে স্বপ্ন দেখে সে স্বপ্ন বাস্তবায়নও করতে পারে। মাইগ্রেন তাকে মাঝে মাঝে বিরক্ত করে। আল্লাহ প্রত্যেক মানুষের মধ্যে কম বেশি প্রতিভা দিয়েছেন। শুধু প্রতিভা বলে কেউ বড় হয় না। ব্যক্তি তার নিজস্ব যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা, আন্তরিকতা ও চর্চার দ্বারা সেই প্রতিভার সদ্ব্যবহার করলেই কেবল জীবনে সাফল্য লাভ করতে পারে। মানুষ বড় হয় কর্মগুণে। কর্মবিমুখতা মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। সময়ের সদ্ব্যবহার করতে হয়। বাউল কবি বলেছেন, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’। শৈশরে আমার গৃহশিক্ষক মোসলেহ উদ্দিন স্যার বলতেন, ‘চরঃপয ুড়ঁৎ ধসনরঃরড়হ যরময’. রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আকাক্সক্ষাকে বড় করো। শক্তি কারো বড়, কারো ছোট, কিন্তু আকাক্সক্ষাকে আমরা ছোট করবো না।’
মানুষ সন্তান কামনা করে, সন্তানের জন্ম দেয়া শুধু বংশ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নয়। তার প্রত্যাশা থাকে (কখনো প্রকাশ্যে, কখনো অপ্রকাশ্যে) জীবনের শেষ প্রান্তে যেন সে সন্তানদের সান্নিধ্যে নিরাপদ আশ্রয় পায়। কিন্তু সে প্রত্যাশা তার সবসময় পূরণ হয় না। আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু সামাদ যে একসময় সচিবের পদ মর্যাদায় চাকরি করতো, বাস করতো ধানমন্ডিতে তার নিজস্ব আলিশান ভবনে। সম্প্রতি তার দুই ছেলে বিদেশ থেকে এসে সে বাড়ি বিক্রি করে বৃদ্ধ বাবা-মাকে একটি বৃদ্ধ-আশ্রমে ভর্তি করিয়ে দিয়ে বাড়ি বিক্রির টাকা-পয়সা বৈধ-অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করে চলে গেছে। এ ধরনের দৃষ্টান্ত শুধু একটি দুটি নয়। এসব প্রবাসী সন্তান পিতা-মাতার মৃত্যুর প্রতীক্ষায় থাকে, তাদের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অংশ বিক্রি করে টাকা-পয়সা বিদেশে পাচার করে। দেশের জন্য, দেশের আত্মীয়-স্বজনের জন্য কিছুই রেখে যায় না। জনহিতকর কোনো কাজে ব্যয় করে না। যাদের হৃদয়ে দেশপ্রেম নেই তারাই দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে। যে গরিব দেশবাসীর টাকায় তারা এককালে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছিল সে কথা তাদের মনে থাকে না। এরা শুধু নিতে জানে, দিতে জানে না। এর ব্যতিক্রমও আছে। সেটা খুব সামান্য। ব্যতিক্রম কখনো দৃষ্টান্ত হতে পারে না। বিত্তশালী প্রবাসীদের চেয়ে প্রবাসী শ্রমিকরা বেশি টাকা পাঠায় দেশে। আত্মীয় স্বজনদের জন্য তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের অর্থে বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। নিজেরা অর্ধভুক্ত, অভুক্ত জীবন কাটায়। তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা কেউ মনে রাখে না। খাঁটি দেশপ্রেমিক কেবল এদের বলা যায়।
করোনা আবির্ভাবের পর দু’মাস না যেতেই আমাদের একমাত্র গৃহকর্মী ফরিদা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার গায়ে জ¦র, গলা ব্যথা, মাথা ব্যথা এবং সেই সঙ্গে কাশি। সব লক্ষণ করোনার। প্রাথমিকভাবে তাকে ডাক্তারের পরামর্শে প্যারাসিটামল খেতে দিই, গরম পানি দিই। দু’দিন পর ডাক্তার বললেন রক্ত পরীক্ষা করাতে। কোভিড-১৯ পজিটিভ কিনা বোঝা যাবে। ফরিদা রক্ত পরীক্ষা করাতে রাজি হলো না। বললো, ‘হাসপাতালে গায়ে সুঁই ফুটালে মানুষ মারা যায়। এ রোগ বড়লোকের, গরিবের নয়। আমার করোনা হয়নি।’ ফরিদা বাসা ছেড়ে চলে গেল। বাঁচার জন্য সে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেল।
আমরা পড়লাম মহাবিপদে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই সত্তরোর্ধ। আমি সংসারের কোনো কাজই পারি না। শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে মিনু সামান্য কিছু রান্না করে। আমি ঘর ঝাড়– দিই, কাপড় চোপড় ধুই। এভাবে কতদিন চলে? ইতোমধ্যে মিনু একদিন বাথরুমে পড়ে ভীষণ ব্যথা পায়। ফ্লোরে বসে পড়ে। আমি তাকে টেনে তুলতে পারি না। আমার শক্তিতে কুলায় না। কেয়ারটেকার আর আমি দু’জনে মিলে তাকে তুলি। এরপর থেকে মিনু কিছুদিন থাকে শয্যাশায়ী। একটু সুস্থ হওয়ার পর ট্রলি ধরে হাঁটার চেষ্টা করে।
কেয়ারটেকারকে বললাম, যেমন করে পার একজন গৃহকর্মী নিয়ে এসো। বেতন যা চায় দেব। কিন্তু লোক আমার চাই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একজন মধ্যবয়সি নারীর খোঁজ পাওয়া গেল। সে বেশি বেতন চায় না। কিন্তু তার মেয়েটিকেও সঙ্গে রাখতে হবে। আমি বললাম, কোনো আপত্তি নেই। মা-মেয়ে দু’জন একসঙ্গে থাকবে। মেয়েটির বয়স ১২/১৩ বছর। মা তাকে ঘরে একা রেখে আসতে সাহস পায় না। দেশে বর্তমানে দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য অনেক বেড়ে গেছে। দুর্বৃত্তদের বড় একটা শাস্তিও হয় না। মেয়েটি বোবা।
গৃহকর্মীর নাম জমিলা। মা-মেয়ে বেশ ভালোই থাকে। জমিলা ঘরের সব কাজ করে। বোবা মেয়েটি ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সে দীর্ঘক্ষণ নিজেকে দেখে। মুখের বিচিত্র ভাবভঙ্গি করে। তারপর এক সময় ছুটে যায় মায়ের কাছে। কিচির মিচির করে কী যেন বলে। সে ভাষা কেবল জমিলাই বুঝতে পারে। মা-মেয়ে দুজন এক সঙ্গে হেসে ওঠে। বোবা মেয়ে দেখলেই আমার রবীন্দ্রনাথের সুভা গল্পের কথা মনে পড়ে। সব বোবা মেয়েকে আমার সুভা মনে হয়। আমি মেয়েটের নাম দিলাম সুভা।
সুভা ঘর ঝাড় দিতে এসে অনেক সময় আমার টেবিলের বই নাড়াচাড়া করে, খুব মনোযোগ দিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টায়। ছবিওয়ালা বই খোঁজে। কখনো অ্যাকুরিয়ামের সামনে এসে দাঁড়ায়। মাছের খেলা দেখে, তার তাড়া খেয়ে মাছেরা ছুটোছুটি করে, সে হাততালি দিয়ে হাসে। আমাকে কিছু একটা বলতে চায়। আমি মাথা নাড়ি। সে খুশি হয়। কী বুঝেছে কেবল সে-ই জানে।
এবার ঈদে মিনু সুভাকে একটি সুন্দর জামা কিনে দেয়। একদিন আমি ঘরে বসে খবর কাগজ পড়ছি। সুভার পরনে সুন্দর লাল জামা। আমার চারপাশ ঘুরতে থাকে। তারপর এক সময় জামাটি ধরে আমাকে দেখায়। তার মুখে অনাবিল সুন্দর হাসি। আমি ইশারায় বলি, খুব সুন্দর। সুভা ছুটে যায় তার মায়ের কাছে।

* * * * * *
এমনি এক সুভা আমাদের জীবনে আরেকবার এসেছিল। অনেক বছর আগে। তখনো দেশ স্বাধীন হয়নি। পাকিস্তান আমলে মিনু আর আমার একসঙ্গে চাকরি হয়েছিল রাজশাহীতে। মিনুর চাকরি হয়েছিল রাজশাহী গভ: কলেজে। সে প্রভাষক পদে যোগদান করে। আমি যোগদান করি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের শাখা অফিসে।
রাজশাহীতে আমাদের খুব সুন্দর দিন কাটতে থাকে। আমাদের বাসার সামনে বিশাল পদ্মা। বাঁধ পার হলেই পদ্মার পানি। মাঝে মাঝে বাঁধের ওপর হাঁটি। বর্ষাকালে পদ্মায় পানি থাকে কানায় কানায় পূর্ণ। নদীতে সমুদ্রের ঢেউ উঠে। শীত-গ্রীষ্মে ধুঁ-ধুঁ বালুচর। যখন ধূলির ঝড় শুরু হয় তখন শহরের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ধুলায় ভরে যায়, অন্ধকার হয়ে যায় সমস্ত শহর। শহরের কর্মচাঞ্চল্য বন্ধ হয়ে যায়। এ দৃশ্য চাক্ষুষ না দেখলে ধারণা করা যাবে না।
সুন্দর বিকেলে আমরা ঘণ্টা হিসাবে রিকশা ভাড়া করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার এলাকাসহ সমস্ত শহর ঘুরে বেড়াই। আমাদের কোলে থাকে ২/৩ বছরের এক ছেলে এক মেয়ে- শুভ আর কান্তা। কী পরিচ্ছন্ন সুন্দর শহর রাজশাহী। সেসব স্মৃতি মনে হলে এখন গেয়ে উঠি, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’। শাহ্ আবদুল করীমের গান। কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না’।
আমরা দু’জন চাকরিজীবী হওয়ায় দিনের বেলায় বেশিরভাগ আমাদেরকে বাইরে থাকতে হতো। ঘরের কাজসহ ছেলেমেয়ে দুটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অধিক কর্মী রাখা হয়েছিল। বৃদ্ধ কফিল উদ্দিন শুভর দেখভাল করতো। কান্তার জন্য ছিল বারো তেরো বছরের মেয়ে, হোনি। রান্নার জন্য সত্তর বছর বয়সের এক বৃদ্ধা। কফিল উদ্দিন মিনুর শৈশবকালে তাদের বাসায় ছিল। হোনি কান্তাকে কোলে নিয়ে মাঠে পাড়ার ছেলে মেয়েদের সঙ্গে গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা আর লুকোচুরি খেলতো। কফিল বাজার করতো। কিন্তু হিসাব মিলাতে পারতো না। হিসাব দেয়ার সময় বেশি খরচ দেখাতো। যদি বলতাম, অতিরিক্ত টাকা কোথায় পেলে? সে মাথা চুলকাতো। সে ঘরের মেঝে এবং কাপড় পরিষ্কার করতো। হোনিও মাঝে মাঝে এসব কাজ করতো। বৃদ্ধার কাজ রান্না করা। ওর নাম জানতাম না। আমরা সবাই বুড়ি ডাকতাম। বুড়ির মাথার সব চুল সাদা। চক্ষু দুটি কোটরাগত এবং বর্ণহীন। মুখে একটা দাঁতও অবশিষ্ট নেই। সারাক্ষণ কী যেন চিবাতো। শিশুদের মতো ফোকলা দাঁতের হাসি হাসতো। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছিল। গায়ের রং ফর্সা। তার কোনো সন্তান-সন্ততি ছিল না। বুড়িকে দেখে বোঝা যায় এককালে সে দারুণ সুন্দরী ছিল। অল্প বয়সে এক মুসলমান যুবকের প্রেমে পড়ে বাপের বাড়ি ছাড়ে। নিজ ধর্ম ত্যাগ করে। আমার অফিসের দারোয়ান মজির মিয়ার ভাবি। স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। কেবল দেবর মজির মিয়ার কাছে আশ্রয় পায়। মজির মিয়ার কাছে ওর যাবতীয় বৃত্তান্ত শুনেছি।
আমরা খেতে বসলে বুড়ি পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো আর জিজ্ঞাসা করতো, বাবু, রান্না কেমন হয়েছে? আমি বলতাম, চমৎকার। বুড়ির ফোকলা দাঁতের হাসি ছোট্ট শিশুর হাসিকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
স্বাধীনতা- দাবির আন্দোলনে দেশ ক্রমশঃ উত্তাল হতে থাকে। এ সময় একদিন আমার শ্যালক বিনু এসে হাজির। ঢাকায় সলিমুল্লাহ্ হলে সরকারি সমর্থক গুণ্ডা ছাত্র পঁচাত্তর হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে তাকে আসামি করা হয়। আমার বাসায় পলাতক আসামি হিসেবে আশ্রয় নেয়। তখন উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়ে গেছে।
রাস্তাঘাটে শোভা যাত্রা, মিছিল আর গগনবিদারী সেøাগান। শুভ আর কান্তা সেসব সেøাগান শোনে আর বাসায় চেঁচায়- ‘আমাদের দাবি মানতে হবে,’ আগামীকাল, আগামীকাল, হরতাল, হরতাল। জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো,’ তোমার নেতা, আমার নেতা শেখ মুজিবুর, শেখ মুজিবুর’, ‘জয় বাংলা’। আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে যায়। ওদের থামানো যায় না। সারা বাড়ি ঘুরে আর সেøাগান দেয়। খিল খিল করে হাসে। ছড়া কাটে, ‘ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা বোয়াল মাছের দাঁড়ি, টিক্কা খান ভিক্ষা করে শেখ মুজিবের বাড়ি।’
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা মানুষ হত্যা শুরু করে। তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহাকে গুলি করে হত্যা করে। রাজশাহী বিভাগের ডিআইজি প্রিজন মামুন মাহ্মুদকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হানাদার বাহিনী অধ্যাপক হাবিবুর রহমানকে হত্যা করে। পুলিশ ব্যারাক ধ্বংস করে দেয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজশাহী জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কুদরত এলাহী চৌধুরীকে হত্যা করে। কুদরত এলাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দু’ক্লাস সিনিয়র ছিলেন। আমরা সলিমুল্লাহ্ হলে থাকতাম। আমাকে স্নেহ করে তিনি ছোট ভাই ডাকতেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে মানুষ শহর ছাড়তে শুরু করে। অনেকে পদ্মা পাড়ি দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে যায়। মানুষের স্রোত যাচ্ছে আর যাচ্ছে- ছেলে-বুড়া, নারী-পুরুষ সবাই।
একদিন হঠাৎ বুড়ি বাসা থেকে উধাও। তাকে খোঁজ করে কোথাও পাওয়া গেল না। দারোয়ান মজির মিয়া বুড়িকে আমার কাছে দিয়েছিল। সেও কিছু বলতে পারে না। খোঁজ খোঁজ, অনেক খোঁজ। না, কোথাও সে নেই। আমরা ধরে নিলাম, হয় সে মরে গেছে, নয়তো সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে। তাকে আর পাওয়া গেল না। বুড়ি আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। বুড়ির শোকে কফিল উদ্দিন খুব কাঁদলো। অথচ সে-ই সবসময় বুড়ির সঙ্গে ঝগড়া করতো। বুড়ি আমাদের কাছে তার বিরুদ্ধে নালিশ করতো।
আমরা কোথায় যাবো, কী করবো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কোথায় যাবো, কার কাছে থাকবো। সঙ্গে দুটি অল্প বয়সি শিশু। কফিল উদ্দিন কাঁদতে কাঁদতে বললো, বাবা আপনারা যেখানেই যান, আমারে সঙ্গে নিয়ে যাবেন, এখানে একা ফেলে যাবেন না।
আরিচা ঘাট পাকিস্তানি সৈন্যরা দখল করে রেখেছে। কিছুতেই নিরাপদে ঘাট পার হওয়া যাবে না। ঢাকা যাওয়া যাবে না। থেকে যাওয়াই সিদ্ধান্ত হলো। রান্নার কাজের লোক নেই। মজির মিয়া একদিন ১৪/১৫ বছরের একটি মেয়েসহ মাঝবয়সি এক নারীকে আমাদের বাসায় নিয়ে এলো। মেয়েটির মা বলে, আমাকে বেতন দিতে হবে না, শুধু একটু আশ্রয় দেবেন আর আমাদের মা-বেটিকে চারটা খেতে দেবেন। আমাদের ওখানে রাজাকার আর পাকিস্তানি সৈন্যদের বড় উৎপাত। এক একদিন এসে মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়।
বোবা মেয়েটির নাম রেবেকা। রবীন্দ্রনাথের সুভার মতোই তার মুখে অনাবিল সুন্দর হাসি। আমি বললাম, ওর নাম সুভা। ওর মাকে ডাকি সুভার মা। মা ছাড়া ওর ভাষা কেউ বোঝে না।
মিনু একদিন ওকে লাল রঙের সুন্দর শাড়ি কিনে দেয়। সেদিনও সকালে শীতের রোদে বারান্দায় বসে আমি খবরের কাগজ পড়ছিলাম। সুভা সুন্দর শাড়ি পরে এসে আমার চারপাশে ঘোরাফেরা করে। আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। বুঝতে পেরে আমি ইশারায় বললাম, সুন্দর, খুব সুন্দর। হাততালি দিলাম। সুভা খুশিতে তার মায়ের কাছে ছুটে যায়। বোবা মেয়েরা মায়ের কাছেই তাদের সুখ-দুঃখ প্রকাশ করে। মা ছাড়া ওদের কেউ আপন হয় না।

এই সুভা এখনকার সুভার মতো ছিল না, চঞ্চল নয়। বেশিরভাগ সময় বিষণ্ন থাকে। ঘরের দাওয়ায় বসে উদাস দৃষ্টিতে আকাশ দেখে। একটা নিঃসঙ্গ চিল আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যায়। অথচ তাকে পাখা ঝাপটাতে হয় না। কী দ্রুত তার গতি! তার বিস্ময় জাগে। আকাশে মেঘের দল ঘুরে বেড়ায়। কোনো মেঘ দেখতে হাতির মতো, লম্বা শুঁড়, কোনোটা ঘোড়ার মতো, কোনো মেঘ পাক-সেনাদের মতো, হাতে বন্দুক উঁচিয়ে। সুভা শিউরে ওঠে। আতঙ্কিত সুভা ঘরে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। মায়ের বুকে মেয়ে, মেয়ের বুকে মা। মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ মায়ের চোখে ভাসে। সেটা সুখের নয়।
একদিন সুভার মা বলে, দিন দুয়েকের জন্য বাড়ি-ঘর দেখতে যাবো। সেখানে আমার স্বামী আর দুই ছেলেকে রেখে এসেছি।
সুভার মা দু’দিনের ছুটি নিয়ে তার বাড়ি গিয়েছিল। কিন্তু এক সপ্তাহ পার হওয়ার পরও ফিরে না আসায় মজির মিয়াকে খোঁজ নিতে বলি। মজির মিয়া খোঁজ নিয়ে জানালো, পাকিস্তানি সৈন্যরা আর রাজাকারের দল সুভাদের বস্তি জ¦ালিয়ে দিয়েছে। প্রায় সব মানুষকে হত্যা করেছে। সেই সঙ্গে তারা সুভা ও তার মাসহ অনেক মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়