করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ছেলেটির বাবা বাংলাদেশের ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বাবার বন্ধুদের ছেলেরা সবাই পড়ে ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলে। কিন্তু ছেলেটির স্কুল বাংলা মাধ্যমের। যে সময়ের কথা, তখন ফরিদপুর শহরে একটি মাত্র জেলা স্কুল। ওখানে সবার ভর্তি হওয়ার, পড়াশোনা করার সুযোগ নেই। শহরের ছেলের দল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়কে একটা অনুরোধ করলো। কী সেই অনুরোধ? নতুন একটা বাংলা স্কুল খুলতে হবে। তাই হলো। নতুন স্কুল চালু করা তো হলোই, ভদ্রলোক তাঁর নিজের ছেলেকেও ওই স্কুলে পড়তে পাঠালেন।
স্কুলের ক্লাসে ছেলেটির দুই পাশে দুই সহপাঠী বসে। ডানদিকে বাবা ভগবানচন্দ্র বসুর মুসলমান চাপরাশির ছেলে। আর বাঁ দিকে বসে এক জেলের পুত্র। ওদের সঙ্গে ছেলেটি লেখাপড়া, খেলাধুলা করে। অবসর পেলে ওদের কাছ থেকে শোনে পশুপাখি জীবজন্তুর গল্প। শোনে, আর অবাক হয়। কৌতূহলী এই ছেলেটির নাম জগদীশচন্দ্র বসু। বড় হয়ে মস্ত বিজ্ঞানী হয়েছিলেন। গাছপালারও প্রাণ আছে এই তত্ত্বের তিনি প্রতিষ্ঠাতা। তৎকালীন ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে ছিল তাঁর বাবার বাড়ি। তাঁর জন্ম বাংলাদেশের ময়মনসিংহে, ১৮৫৮ সালে। মৃত্যু ১৯৩৭ সালে, ভারতের গিরিডিতে।
এই বিজ্ঞানীর ছেলেবেলার আরো কিছু কথা। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথের দুপাশে নানা ধরনের গাছপালা, ঝোপজঙ্গল মন দিয়ে সে দেখে। একবার এক বন্ধু তাকে বললো,
আয়, তোকে একটা মজা দেখাই।
বলে সে একটা লজ্জাবতী গাছকে ছুঁয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে গাছটির পাতা কুঁকড়ে গিয়ে বুজে গেল। যেন গাছটা সত্যি সত্যি লজ্জায় লুটিয়ে পড়লো। অবাক কাণ্ড তো! শিশু জগদীশ ভাবতেই পারেনি যে এমন কোনো কিছু ঘটতে পারে। ফেরার পথে আবারো লজ্জাবতী গাছকে ছোঁয়ার পর একই ব্যাপার।
রাতে সে বাবাকে বললো আশ্চর্য সেই ঘটনার কথা। বাবা শুধু শুনলেন। কোনো কিছু বললেন না। পরের দিন। স্কুলে যাওয়ার পথে জগদীশ দেখল, হাওয়ায় দুলছে গাছের পাতা। কিন্তু ছুঁয়ে দিতেই একই ঘটনা। দিনের পর দিন একই ব্যাপার। মনে জাগে কৌতূহল। নানা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দেয়। এরকমটি কেন ঘটে? কে দেবে এ প্রশ্নের উত্তর? বাবা ব্যস্ত মানুষ। সারাদিন অফিস করেন। সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ছেলের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন। ছেলে জানতে চায়, বনচাঁড়াল আর লজ্জাবতী গাছের পাতা ছুঁলে তাদের পাতা, ডালপালা সব নিচু হয়ে যায়। কিন্তু আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল এসব গাছকে ছুঁয়ে দিলে তো এদের কিছু হয় না। সেটা কেন হয়?
বাবা ছেলের প্রশ্ন ও কৌতূহলে অবাক হন।
উত্তর দেন,
দ্যাখো, আম-জাম-কাঁঠাল-নারকেল গাছ সাড়া দেয় কিনা, সেটা আমাদের জানা নেই। প্রকৃতির সব রহস্য তো আমরা জানতে পারিনি। তবে কোনো মানুষকে আঘাত করলে সে যেমন ব্যথা ও কষ্ট পায়, চোখের জল পড়ে, গাছপালারও তেমনই। আঘাত পেলে তারা আহত হয়। আম, সজনে গাছের গায়ে কুড়াল দিয়ে দু’কোপ বসিয়ে দাও। দেখবে তুমিও সেই কাটা জায়গা থেকে আঠা বের হচ্ছে। সেটাই হচ্ছে তাদের চোখের জল।
বাবার কথা শুনে জগদীশ ভীষণ অবাক। জানবার আগ্রহ তাঁর বেড়ে যায় আরো। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকে সে। বাবা সাধ্যমতো সেগুলোর উত্তর দেন। কখনো বলেন, প্রকৃতির অনেক কথা আমরা জানি না। বড় হয়ে জানবার চেষ্টা করো তুমি।
বাবার গল্প শুনতে শুনতে রাত গভীর হয়ে যেত। ছেলের চোখে ঘুম নেই। সে বিস্মিত, চমকিত। ঠাকুরমা তেড়ে আসেন। নাতির জন্য তার অনেক উদ্বেগ। জগদীশের বাবাকে শাসন করে বলেন, ছেলেটিকে মেরে ফেলবি নাকি? ঘুমিয়ে পড়। নাহলে এই লাঠি দিয়ে মারব।
ঠাকুরমার শাসনে ছেলেটি ঘুমিয়ে পড়ে ঠিকই। কিন্তু তাঁর কৌতূহল কম না। বড়ো হয়ে বিদ্বান ও বিজ্ঞানী হলেন তিনি। গবেষণা করে বিশ্ববাসীকে জানালেন যে, গাছেরও প্রাণ আছে।
স্থানীয় স্কুলের পাঠ শেষে জগদীশকে ভর্তি করা হয় কোলকাতার হেয়ার স্কুলে। তারপর সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল। হোস্টেলে থাকবার ব্যবস্থা হলো। তখন তাঁর বয়স ১১ বছর। ছাত্র হিসেবে তিনি যেমন মেধাবী, তেমনি পড়াশোনায় গভীর অনুরাগ ও আগ্রহ। ষোলো বছর বয়সে পাস করলেন এন্ট্রান্স (বর্তমান এসএসসি)। ভর্তি হলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। তারপর উত্তীর্ণ হলেন এফএ পরীক্ষা। বিজ্ঞান বিভাগে পাস করলেন বিএ। বিলেতের পথে যাত্রা করলেন ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে। লন্ডনে ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি হলেন মেডিকেল কলেজে। কিন্তু ডাক্তার হওয়া গেল না শেষ পর্যন্ত। মৃতদেহ কাটাকুটির সময় প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। শেষে ছেড়ে দিলেন ডাক্তারি পড়া। ভর্তি হলেন কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে। পড়াশোনা করলেন তিন বছর। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে ট্রাইপস (গণিত, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে প্রথম শ্রেণির সম্মান) নিয়ে স্নাতক হন। একইসঙ্গে তিনি অর্জন করেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রিও (বিএসসি)।
দেশে ফিরলেন ১৮৮৫ সালে। যোগ দিলেন কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। অস্থায়ী অধ্যাপকের পদ। এটি এর আগে এই কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানের পাঠ দেয়ার জন্য অধ্যাপক আনানো হতো বিদেশ থেকে। জগদীশচন্দ্র বসুই এখানে প্রথম এ বিষয়ে ভারতীয় অধ্যাপক হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ১৮৯৪ সলে তাঁকে দেয়া হলো স্থায়ী অধ্যাপকের পদ। শিক্ষকতায় কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে যোগদানের প্রথম দিন থেকেই গণ্য করা হলো স্থায়ী অধ্যাপক হিসেবে। এই সময় তিনি পদার্থ বিজ্ঞানে গবেষণায় মগ্ন হন।
সূ² সূ² যন্ত্রপাতি তৈরি করেছেন। শুরুতে কিছু কাজ করলেন বিদ্যুৎ তরঙ্গের অগ্রগতি বিষয়ে। আরেক খ্যাতিমান বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর গবেষণা সম্পর্কে মন্তব্য, মূল্যায়ন করেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন:
‘জগদীশচন্দ্র নিজে গবেষণা করিয়া এমন সূ² যন্ত্র নির্মাণ করিলেন যাহা হইতে খুব ছোট ছোট ইথার তরঙ্গ নির্গত হয়। যাহার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য এক ইঞ্চির ছয়ভাগের একভাগ মাত্র। এটি ছিল ইথারে সর্বাপেক্ষা ছোট বৈদ্যুতিক ঢেউ তুলিবার যন্ত্র।’
১৮৮৫ সালের ঘটনা। বেতারযন্ত্র তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। কোলকাতার ঐতিহাসিক টাউন হলে ৩৭ বছর বয়সি জগদীশচন্দ্র উপস্থিত। তাঁর সামনে আমন্ত্রিত শ্রোতা-দর্শকবৃন্দ। যুবক বিজ্ঞানী যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছেন। তাঁর প্রায় ৭৫ ফুট দূরে বারুদের একটা স্তূপ রাখা হয়েছিল। যন্ত্রের ওপর পিস্তলের গুলি ছোঁড়ার মতো একটা শব্দ করলেন জগদীশ। ৭৫ ফুট দূরবর্তী বারুদ কোথায় যে উড়ে গেল, তার কোনো হদিস নেই। এই ভোজবাজির রহস্য কী? এটা কী কোনো জাদুকরের কারসাজি? জগদীশ বললেন, মোটেও না। এই যন্ত্র থেকে অদৃশ্য এক তরঙ্গ তৈরি হয়ে বারুদের স্তূপে আঘাত করেছে। বাহবা পেলেন জগদীশ। তিনি আবিষ্কার করেছেন মাইক্রোওয়েভ।
১৮৯৬ সালে আবার ইউরোপে যাবেন। পড়াশোনা শেষে দশ বছর আগে ফিরেছিলেন স্বদেশে। গবেষণায় পাওয়া ফলাফল ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের সামনে উপস্থিত করবেন- এই তাঁর স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা। টাউন হলে যে যন্ত্র থেকে সৃষ্টি করেছিলেন তরঙ্গ, সেটি নিয়ে গেলেন ইউরোপে। ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সের বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়ে বক্তৃতা করলেন। সভায় শ্রোতা-দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জে জে থমসন, যিনি ইলেকট্রনের আবিষ্কর্তা। আরো ছিলেন বিখ্যাত পদার্থবিদ লর্ড ক্যালভিন। সম্মানিত, জয়ী হয়ে দেশে ফিরলেন বিজ্ঞানী জগদীশ।

জগদীশ চন্দ্র বোস আবিষ্কৃত রেডিও মাইক্রোওয়েভ
আবারো মাইক্রোওয়েভ প্রসঙ্গ। ১৮৯৬ সালে মার্কোনি বেতার তরঙ্গ পাঠালেন। পেটেন্টের জন্যে দরখাস্ত করলেন। ছবি নেই বলে মঞ্জুর হলো না। ছবি জোগাড় করে আবার জমা দিলেন ১৮৯৭ সালে। এবার পেটেন্ট পেলেন। মাইক্রোওয়েভের প্রথম আবিষ্কর্তা কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসু। তাহলে পেটেন্ট কেন হলো অন্যের নামে? এ প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। জগদীশচন্দ্র তাঁর কোনো আবিষ্কারের পেটেন্ট নিতে রাজি হননি। প্রিয় বন্ধু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলেছেন এ সম্পর্কে। চিঠিতে লিখেছেন,
“আমার বক্তৃতার কিয়ৎক্ষণ পূর্বে একজন অতি বিখ্যাত টেলিগ্রাফ কোম্পানির ক্রোড়পতি মালিক টেলিগ্রাফ করিয়া পাঠাইলেন, দেখা করিবার বিশেষ দরকার, আমি লিখিলাম সময় নাই, তার উত্তর পাইলাম ‘আমি নিজেই আসিতেছি।’ অল্পক্ষণের মধ্যেই স্বয়ং উপস্থিত। হাতে পেটেন্ট ফর্ম। আমাকে বিশেষ অনুরোধ করিলেন, ‘আপনি আজ বক্তৃতায় সব কথা খুলিয়া বলিবেন না…।’
আমি যে কাজ লইয়া আছি, তাহা বাণিজ্যের লাভালাভের উপরে মনে করি, আমার জীবনের দিন কমিয়া আসিতেছে, আমার যাহা বলিবার তাহারও সময় পাই না, আমি অসম্মত হইলাম”।
এ থেকেই বোঝা যায় তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল কতটা প্রবল। প্রচারের চেয়ে কাজে বেশি বিশ্বাসী ছিলেন নির্লোভ এই মানুষটি।
গবেষণার এক পর্যায়ে জগদীশচন্দ্র বসুর অন্বিষ্ট ছিল বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের প্রভাবে বিভিন্ন অজৈবিক ও জৈব, প্রাণবন্ত পদার্থের আচরণ বা সাড়া। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয়বার ইউরোপে আন্তর্জাতিক পদার্থবিদ্যা কংগ্রেসে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। প্যারিসে যে প্রবন্ধ পাঠ করেন, সেটির বিষয় ছিল : বৈদ্যুতিক উত্তেজনায় জড়বস্তু ও প্রাণবন্ত বস্তুর ক্রিয়া বা সাড়ার মধ্যে সাদৃশ্য। লন্ডনের লিনিয়ান সোসাইটিতে ১৯০২ সালে জগদীশচন্দ্রের প্রদর্শন ও বক্তৃতার বিষয় ছিল : আরো সুনির্দিষ্ট। সেটি হলো: যান্ত্রিক উত্তেজনায় সাধারণ উদ্ভিদের সাড়া। উল্লেখ্য, এই প্রতিষ্ঠানেই বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের লেখা প্রাণিজগতের বিবর্তন বিষয়ক প্রথম প্রবন্ধটি পঠিত ও আলোচিত হয়েছিল। কিছুদিন পর লন্ডন থেকে জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা প্রথম বই ছাপা হয়। প্রকাশক লংম্যান গ্রিন এ্যান্ড কোম্পানি। বইয়ের নাম জড় ও জীবের সাড়া (জবংঢ়ড়হংব রহ ঃযব ষরারহম ধহফ হড়হ-ষরারহম)। এর আগে কারো পক্ষে কল্পনা করারই সাধ্য ছিল না যে, তথাকথিত জড় পদার্থ উদ্ভিদের জীবনে এমন সাড়া দেয়ার ঘটনা ঘটে।
ব্রিটিশ সরকার জগদীশচন্দ্র বসুকে সিআইই (কম্প্যানিয়ন অব দ্য ইন্ডিয়ান এ্যাম্পায়ার) উপাধি দেয়। এই স্বীকৃতি ও সম্মাননা পাওয়া যায় ১৯০৩ সালে। উদ্ভিদের মধ্যে উত্তেজনার কারণে যেসব ঘটনা ঘটে, তা নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করার জন্য তিনি কয়েকটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এটা সম্পন্ন হয় তাঁর নিজ দেশে। ১৯০৪ ও ১৯০৫ সালে। এই কৃতী বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানী প্রথমবার আমেরিকায় যান ১৯০৯ সালে। সে দেশের কয়েকটি বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বক্তৃতা দেন। বিষয় ছিল : পদার্থবিদ্যা ও উদ্ভিদ শারীরবিদ্যা।
ইংল্যান্ড থেকে আরো কয়েকটি পুস্তক প্রকাশিত হয় তাঁর। এগুলোর বিষয় : উদ্ভিদের সাড়া। কৃতিত্বপূর্ণ গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিএসসি ডিগ্রি দিয়ে সম্মানিত করে। তিনি এই স্বীকৃতি পান ১৮৯২ সালে। পরে ১৮৯৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিএসসি ডিগ্রি দেয়। এই বিজ্ঞানীর অসাধারণ ও অবিশ্বাস্য আবিষ্কারসমূহের পরিচয়ের গণ্ডি আরো প্রসারিত হলো। ১৯১৪-১৫ সালে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও জাপান ভ্রমণের সুযোগ আসে তাঁর। আবিষ্কার-উদ্ভাবনগুলো তিনি গুণী-বিজ্ঞানী সমাজে উপস্থাপন করেন।

তাঁর বিশ্বখ্যাত যন্ত্র ‘ক্রেস্কোগ্রাফ’
অধ্যাপনা থেকে অবসর নেন ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে। বয়স তখন ৫৭ বছর। খ্যাতি ও সম্মানের সুবাদে ‘এমেরিটাস অধ্যাপক’ হিসেবে গবেষণাকাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্যে অনুরোধ করা হয় তাঁকে। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘নাইট’ (ঝরৎ) উপাধি দিয়ে সম্মাননা জানায়। সেটা ১৯১৭ সালের ঘটনা। ১৯২০ সালে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি এই বিজ্ঞানীকে ফেলো নির্বাচন করে। সম্ভবত তিনিই প্রথম ভারতীয় নাগরিক, যিনি এই সম্মান পেয়েছেন। সে বছরই জগদীশচন্দ্র বসু লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে প্রদর্শন করেন তাঁর বিশ্বখ্যাত যন্ত্র ‘ক্রেস্কোগ্রাফ’। এই যন্ত্রের বাংলা নাম রাখলেন ‘সমতাল যন্ত্র’। ইংরেজি ঈৎবংপবহফড় থেকে এসেছে ক্রেস্কো শব্দ- যেটির মানে হলো ক্রমোচ্চ পর্যায়ে ওঠা। স্যার জগদীশচন্দ্র বসু অতি উঁচু মানের বুদ্ধি ও বিস্ময়কর নৈপুণ্যে প্রকৃতি জগতের ওই সমতাল যন্ত্রটি ব্যবহার করলেন। উদ্ভিদের অত্যন্ত সামান্য, প্রায় নগণ্য সাড়াকে তিনি লক্ষ গুণ বাড়িয়ে দেখাতে সক্ষম হলেন। সবাই তাঁর নিজের ও স্বদেশি কারিগরদের হাতের কাজের সূ²তা, দক্ষতার ব্যাপক প্রশংসা করেছিল।
মাতৃভাষা বাংলায় তাঁর লেখা একটি বই বের হলো। নাম ‘অব্যক্ত’। বইটিতে সাহিত্যের রূপ-রস আছে। কতিপয় প্রবন্ধে রয়েছে স্বদেশের গৌরবদীপ্ত ঐতিহ্যসচেতনতা ও ইতিহাস, দর্শন বিষয়ে লেখকের জ্ঞানের গভীরতার পরিচয়। বইটি কৌতূহল-জাগানিয়া ও সুখপাঠ্য। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের শক্ত জটিল বিষয়গুলো তুলে ধরার আগ্রহ ছিল এই নির্মোহ বিজ্ঞানী মানুষটির। ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থ তার প্রমাণ। ‘গাছের লিপিযন্ত্র’ নামের একটি লেখা রয়েছে এ বইয়ে। সেটি থেকে খানিক উদ্ধৃতি এখানে-
“গাছের সাড়া দিবার কথা বলিয়াছি। এখন কঠিন সমস্যা এই যে, কি করিয়া গাছের সাড়া লিপিবদ্ধ করা যাইতে পারে। জন্তুর সাড়া সাধারণত কলম সংযোগে লিপিবদ্ধ হইয়া থাকে। কিন্তু চড়–ই পাখির লেজে কুলা বাঁধিলে তাহার উড়িবার যেরূপ সাহায্য হয়, গাছের পাতার সহিত কলম বাঁধিলে তাহার লিখিবার সাহায্যও সেইরূপ হইয়া থাকে। এমনকি, বনচাঁড়ালের ক্ষুদ্র পত্র সুতার ভার পর্যন্তও সহিতে পারে না, সুতরাং সে যে কলম ঠেলিয়া সাড়া লিখিবে এরূপ কোন সম্ভাবনা ছিল না। এজন্য আমি অন্য উপায় গ্রহণ করিয়াছিলাম। আলো-রেখার কোনো ওজন নাই। প্রথমত প্রতিবিম্বিত আলো- রেখার সাহায্যে আমি বৃক্ষপত্রের বিবিধ লিপিভঙ্গি স্বহস্তে লিখিয়া লইয়াছিলাম। ইহা সম্পাদন করিতেও বহু বৎসর লাগিয়াছিল। যখন এই সকল নূতন কথা জীবতত্ত্ববিদদিগের নিকট উপস্থিত করিলাম, তখন তাঁহারা যারপরনাই বিস্মিত হইলেন। …বারো বৎসর শাপই বর হইল। সেই বারো বৎসরের কথা সংক্ষেপে বলিব। কলটি সম্পূর্ণ নূতন করিয়া গড়িলাম। … ইহার পর অসম্ভবকে সম্ভব করিতে আরো ৫/৬ বৎসর লাগিল। যাহা আমার সমতাল যন্ত্রের উদ্ভাবন দ্বারা সম্ভাবিত হইয়াছে।
…বলা আবশ্যক যে, এই সকল কলের দ্বারা বৃক্ষের বহুবিধ সাড়া লিখিত হয়। বৃক্ষের বৃদ্ধি মুহূর্তে নির্ণীত হয় এবং এইরূপে তাহার স্বতঃস্পন্দন লিপিবদ্ধ হয় এবং জীবন ও মৃত্যু রেখা তাহার আয়ু পরিমাপ করে।”
খুবই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। এ বিষয়ে একটি বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করা যায়। তখন ১৮৯৭ সাল। বিলেতে জগদীশচন্দ্রের শিক্ষক ছিলেন লর্ড র‌্যালে। ভারত সফরের এক পর্যায়ে তিনি এসেছেন কোলকাতায়। প্রিয় ছাত্র জগদীশ আছে প্রেসিডেন্সি কলেজে। র‌্যালে তাঁর ছাত্রের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। শিক্ষককে সব ঘুরিয়ে দেখালেন ছাত্র। নিজের হাতে বানানো ল্যাবও দেখালেন। খুব খুশি হলেন অধ্যাপক র‌্যালে। কথায় কথায় এই খবরটা র‌্যালে কলেজের ইংরেজ প্রিন্সিপালকে জানিয়েছিলেন। এই ব্যাপারটা প্রিন্সিপালের পছন্দ হলো না। ওইদিনই জগদীশচন্দ্রকে এক পত্রে লিখলেন, ‘জানতে পারলাম লর্ড র‌্যালেকে তুমি ঘুরিয়ে তোমার গবেষণাগার দেখিয়েছ। আমাকে জানাও কোন অধিকারে তুমি এ কাজ করলে।’
জগদীশচন্দ্র বসু ঘাবড়ে যাওয়ার মতো লোক নন। প্রতিবাদ করার ভাষা তাঁর জানা আছে। একই ধরনের যোগ্যতা, কাজও একই- তবু ইংরেজ অধ্যাপকরা ‘নেটিভ’ অধ্যাপকের চেয়ে বেশি বেতন পান। জগদীশ এমন বৈষম্যের প্রতিবাদ করেছিলেন। প্রতিবাদে কয়েক মাস বেতন নেননি। ছাত্রদের পড়িয়েছেন বিনা বেতনে। শেষ পর্যন্ত জিত হয়েছিল তাঁরই। প্রশাসনকে সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়েছিল। সবাইকে সমান বেতন দিতে বাধ্য করেছিলেন জগদীশচন্দ্র। সেই মানুষটি প্রিন্সিপালের এই অপমান কেন সহ্য করবেন? তাঁর প্রিয় বন্ধু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘটনাটি সম্পর্কে জানতে পারলেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ মনে করে, জগদীশচন্দ্র বসু গবেষণা নয়, যা করছেন তা ‘হবি’ ছাড়া কিছু নয়। বন্ধুর বিপদে রবীন্দ্রনাথ পাশে দাঁড়ালেন। নিজে হাত পাতলেন নানাজনের কাছে। সিদ্ধান্ত নিলেন, অন্তত ২০ হাজার টাকা জোগাড় করবেন। ত্রিপুরার মহারাজা রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশ দুজনেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর কাছে ১০ হাজার টাকা চাইলেন রবীন্দ্রনাথ। এভাবেই গবেষণাগার তৈরির টাকা জোগাড় হয়ে গেল।
জগদীশচন্দ্রের বহুদিনের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা : গবেষণার জন্য মনের মতো একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন। অবশেষে স্বপ্ন পূরণ হলো তাঁর। বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠিত হলো ১৯১৭ সালের ৩০ নবেম্বর। স্বপ্নের গবেষণাগার। চালু হওয়ার প্রথম দিনেই গঠন করা হলো পরিচালকমণ্ডলী। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম সদস্য এর। আবার টাকা দরকার। যন্ত্রপাতি কেনা ও অন্যান্য কাজের জন্যে অনেক টাকা চাই। নাহলে প্রতিষ্ঠান অচল হয়ে পড়বে। জগদীশচন্দ্র দেশব্যাপী নানা জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে পারিশ্রমিক নিলেন। বেশ কিছু অর্থ পাওয়া গেল এতে। গবেষণা মন্দিরের কাজ এগিয়ে যেতে থাকলো। অবশেষে বসু বিজ্ঞান মন্দির হয়ে উঠলো উপমহাদেশীয় বিজ্ঞানীদের তীর্থস্থান।
জগদীশচন্দ্র বসু বৈজ্ঞানিক প্রতিনিধি হিসেবে দশ বার ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যান। লংম্যান গ্রিন এ্যান্ড কোম্পানি তাঁর গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করতে থাকে। একের পর এক। ১৯২৮ সাল পর্যন্ত তারা মোট নয়টি বই বের করে। কোলকাতার বসু বিজ্ঞান মন্দির থেকেও তাঁর লেখা গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হতে থাকে। ভারতবর্ষের বহু জায়গায় বিজ্ঞান ও সাহিত্য সভায় সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করার জন্যে তিনি আমন্ত্রিত হন। মাতৃভূমি বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে ১৯৩৪ সালে।
কোনো কোনো বইয়ে তাঁর সম্পর্কে একটি ভুল তথ্য দেয়া হয়। বলা হয়, উদ্ভিদের যে প্রাণ আছে, সেটা আবিষ্কার করেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। আসলে বিষয়টি সেরকম নয়। উদ্ভিদের যে প্রাণ আছে, এটা মানুষ অনেক আগে থেকেই জানে। উদ্ভিদ বাইরের নানা আঘাত ও উত্তেজনায় কেমন সাড়া দেয়- সেই বিষয়টিই তিনি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ সংক্রান্ত তাঁর একটি লেখা পশ্চিমের এক সাহেব অধ্যাপক (নাম তার ওয়ালার) নিজের নামে ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। রীতিমতো জালিয়াতি। পরে ভাইনস নামে আরেকজন সাহেব অধ্যাপক এই লেখাটি যে আসলে জগদীশচন্দ্রের, সেটি প্রমাণ করেন।
বিজ্ঞান-জগতেরও বাইরে জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন সাহিত্যমনা মানুষ। শুধু সাহিত্যচর্চা করলেও তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকতেন। তাঁর বই ‘পলাতক তুফান’ বাংলা কল্পবিজ্ঞান কাহিনির ভিত গড়ে দিয়েছিল। মোট ১১টি গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন। কয়েকটি অনূদিত হয়েছে ইংরেজি ছাড়াও অন্যান্য ভাষায়। আজকালের ‘জীব-পদার্থবিদ্যা’ যে বিষয়কে বলা হয়, তার প্রথম রূপকার ছিলেন তিনি। গাছের নানা উত্তেজনার সাড়া মাপতে গিয়ে তিনি নিজেই তৈরি করেছিলেন একাধিক যন্ত্র। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্রেস্কোগ্রাফ, রেজোন্যান্ট রেকর্ডার, প্ল্যান্ট ফাইটোগ্রাফ, কম্পাউন্ড লিভার ক্রেস্কোগ্রাফ ইত্যাদি।
জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে তিনি জেনেভা গেলেন ১৯২৮ সালে। সেখানে পেলেন অভূতপূর্ব সম্মান। তাঁর গবেষণাকাজে মুগ্ধ হয়েছিলেন সমকালীন মহাবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। বলেছিলেন, জগদীশচন্দ্র বসু পৃথিবীকে যেসব অমূল্য উপহার দিয়েছেন, তার যে কোনো একটির জন্যই বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।
বৃদ্ধ বয়সে মাঝে মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন জগদীশচন্দ্র বসু। গবেষণা থেকে বিরত হলেও বসু বিজ্ঞান মন্দিরের কাজ দেখাশোনা করতেন নিয়মিত। ১৯৩৭ সালের ২৩ নবেম্বর তিনি পরলোকগমন করেন। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তাঁর ইচ্ছানুসারে সহায় সম্পদ স্ত্রী অবলা বসু স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দান করে দেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়