করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

দার্জিলিংয়ে দুর্বিপাক

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শহরজুড়ে আজ বড্ডো গুমোট। ঘরের ভেতর এসি চলছে নিঃশব্দে। রিমি ঘুমিয়ে কাদা। রুদ্র’র চোখে ঘুম নেই। মাথাজুড়ে প্রচুর প্রশ্নের ভিড়। প্রতিটি প্রশ্ন বারবার ছুটে আসছে রুদ্র’র দিকে। গোয়েন্দা দপ্তরের দুঁদে গোয়েন্দা রুদ্র চৌধুরীর নিজেকে আজ অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে। এই অবস্থায় সে কখনো পড়েনি। যে কোনো রহস্য তার কাছে একতাল অন্ধকার হয়ে এলেও কিছু সময়ের মধ্যেই সে কোনো না কোনো আলোকরেখা খুঁজে পেয়েছে।

সে সব রহস্য অপরাধ সংক্রান্ত। অন্যের ঘটনা। অথচ নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনারহস্য জুড়ে ঘন কুয়াশা।
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তরের কর্মী রুদ্র। সাদা বাংলায় গোয়েন্দা। তার দপ্তর বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন গোয়েন্দা অফিস। সেই অফিসের প্রতিষ্ঠারও একটা ইতিহাস আছে। ১৮৬৮ সালের পয়লা এপ্রিল। তখন কলকাতার চেহারা আজকের মতো ছিল না। ইংরেজরা একটু একটু করে তৈরি করছে তাদের প্রাণের রাজধানীকে। তবুও রাতের বেলাটা শুনশান, বেরোতেও ভয় করে। এমনই এক রাতে টহল দিচ্ছে একজন পুলিশ। কাছেই আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার আলো দেখা যাচ্ছে। বসন্তের হাওয়া এখনো যায়নি। বেশ নিশ্চিন্ত মনেই হাঁটছিল ওই পুলিশ। হঠাৎ টনক নড়ল তার। একটু দূরে রাস্তার ধারেই কিছু একটা বস্তা মতো পড়ে আছে মনে হচ্ছে। সন্দেহ হতে সেদিকে এগিয়ে গেলোসে। বস্তা নয়; সাদা কাপড়ে মোড়ানো কিছু একটা। আরেকটু কাছে যেতেই চমকে উঠল পুলিশটি। কিছুক্ষণ নিজেকে সামলে দৌড় দিলো থানার দিকে। সে দেখতে পেয়েছে, সাদা কাপড়ের গায়ে লেগে আছে টাটকা রক্ত। আর ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে একটি দেহ- এক তরুণীর নিথর, গলাকাটা দেহ পুলিশ মহলে চাঞ্চল্য পড়ে গেল। শুধু পুলিশ মহলেই নয়; কলকাতার প্রতিটা জায়গায় শুরু হলো জল্পনা। খবরের কাগজগুলিতে বেরিয়েছে ঘটনা ও মৃতদেহের বর্ণনা। মেয়েটির গলা কাটা, মুখ খোলা, চোখ দুটো ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসছে। একটি হাত কোমরের পেছনে বেঁধে রাখা। আর ঘটনাস্থল ভেসে যাচ্ছে রক্তে। এমন বীভৎস দৃশ্য দেখে এবং পড়ে শিউরে উঠছেন সবাই। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এটা খুন। কিন্তু এভাবে কলকাতার রাস্তায় কাউকে খুন করে ফেলে রাখার ঘটনা তো সেভাবে ঘটেনি! যা হয়েছে সেসব গুণ্ডা-ডাকাতদের মারামারি অথবা রাজনৈতিক হত্যার ঘটনা। অনেক সময় বেহেড মাতালদের দেহও এভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু তাই বলে এমন অল্পবয়সী মেয়েকে খুন?
নড়ে চড়ে বসল কলকাতা পুলিশ। তখন পুলিশ কমিশনারের জায়গায় স্টুয়ার্ট হগ। তার নির্দেশে বিশেষ একটি দল গঠন করা হলো। আর এই পুরো ঘটনার তদন্ত করার প্রধান দায়িত্ব দেওয়া হলো রিচার্ড রিডকে। ক্ষুরধার বুদ্ধি, সাহসী এবং তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার জন্য হগসাহেবের প্রিয় অফিসার ছিলেন তিনি। শুরু হলো ‘আমহার্স্ট স্ট্রিট হত্যা রহস্য’-র তদন্ত। এই গল্পো মূলত তাকে কেন্দ্র করেই বেড়ে উঠবে এবার। যাই হোক, তদন্তে এসে রিডসাহেব প্রথমেই তরুণীর পরিচয় জানার চেষ্টা শুরু করলেন। উল্লেখ্য, এই হত্যাকাণ্ডেই প্রথমবার এভিডেন্স ফটোগ্রাফিকে তদন্তপ্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়। রিচার্ড রিড প্রথমেই বুঝলেন, এই তরুণী একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। অসম্ভব সুন্দরী, বয়স খুব বেশি হলে কুড়ি-বাইশের মধ্যেই হবে। কিন্তু কে এই তরুণী? কীভাবে মারা গেলেন? উঠে পড়ে লাগলেন রিড।
দেহ দেখে বেশ কয়েকটি জিনিসের দিকে চোখ গেলো তার। প্রথমতো যেভাবে গলাটা কাটা হয়েছে, তা একটি বিশেষ ধরণের ছুরির সাহায্যেই করা হয়েছে। সাধারণত যাকে ‘সেলর’স নাইফ’ বলা হয়। দ্বিতীয়ত, তরুণীর পায়ে চটি বা জুতো কিছু ছিল না। আর পায়ের পাতায় মাটি, ধুলো কিছুই লেগে ছিল না। একেবারে পরিষ্কার পা। তাহলে তো ইনি রাস্তায় হাঁটছিলেন না। তাহলে কি খুন অন্য জায়গায় হয়েছে, তারপর দেহ এনে আমহার্স্ট স্ট্রিট চত্বরে ফেলা হয়েছে? সন্দেহ সেইদিকেই জোরালো হচ্ছে। সেইসঙ্গে আরও একটি জিনিসের দিকে নজর রেখেছিলেন রিচার্ড রিড। এই হত্যাকাণ্ডের আগে, ১৮৬৮ সালেই আরও পাঁচজন মহিলাকে খুন করা হয়। তার মধ্যে তিনজন বারবণিতা। এই হত্যার সঙ্গে কি আগের খুনগুলোর কোনো যোগ আছে? রিড ঠিক করলেন, মেয়েটির মৃতদেহের ছবি শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে দেবেন। কেউ না কেউ তো ঠিকই চিনতে পারবেন এঁকে। এর আগে এমন পদ্ধতির প্রয়োগ ভারতে হয়নি।
কেটে গেলো বেশ কয়েক সপ্তাহ। এখনো কেউ মেয়েটির সম্পর্কে খোঁজ করতে থানায় এলো না। সবাই অধৈর্য হয়ে পড়ছেন। রিডসাহেব অবশ্য শান্ত হয়ে অপেক্ষা করছেন। হঠাৎ দেখা গেলো আলোর সন্ধান। একদিন মিঃ হ্যারিস বলে একজন হাজির হলেন থানায়; নিবাস বৈঠকখানা রোডে। বললেন, ছবির মেয়েটিকে চিনতে পেরেছেন তিনি। ওর নাম রোজ ব্রাউন। খ্রিস্টান, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। বয়সের ব্যাপারটাও ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন রিড। এবং আরও আশ্চর্যের, এই মেয়েটিও বারবণিতা। তবে এখানেই থেমে থাকল না ব্যাপারটা। হ্যারিস বলে ভদ্রলোক জানালেন, মাধবচন্দ্র দত্ত বলে কোনো একজনের সঙ্গে নাকি বেশ কয়েকবার দেখেছেন রোজ ব্রাউনকে।
এই ‘মাধবচন্দ্র দত্ত’-এর ঠিকানা বের করতে দেরি হলো না বেশি। বউবাজারে তার দোকান। সেখান থেকেই গ্রেফতার করা হলো তাকে। সেইসঙ্গে রিড এবং বাকি পুলিশের হাতে উঠে এলো আরও একটি তথ্য। রোজ ব্রাউন নাকি প্রায়শই হাওড়ায় কারোর একটা বাড়িতে যেতেন। কার বাড়ি? ‘যেখানে দেখিবে ছাই’। জানা গেল, কিংসলে নামের এক গুন্ডার সঙ্গে নাকি একটা সম্পর্ক ছিল রোজের। ওর বাড়িতেই নাকি থাকতেন একটা সময়। তবে খুন হওয়ার মাসকয়েক আগে সেখান থেকে চলে আসেন তিনি। তার এও ভয় ছিল, কিংসলে তাকে বাঁচতে দেবে না। যথারীতি হাওড়ায় হানা দিলো কলকাতা পুলিশের একটি দল। কিংসলের বাড়ি তে গিয়ে দেখা গেল, পাখি ফুড়–ৎ! ভেতরে একটি জামা, কিছু মেয়েদের জামাকাপড় পড়ে আছে। আর সেই জামাকাপড়ে রক্তের দাগ! রহস্যের গন্ধ প্রকট হচ্ছে। আরেকটু খুঁজে দেখা যাক! শেষমেশ একটি চাবি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি। কিংসলে’র ওপরেই সন্দেহ গাঢ় হলো সবার। তাকে ধরার জন্য সব জায়গায় জাল ছড়ালেন রিড। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, সে যেন গায়েবই হয়ে গেছে! তবে তদন্তের শেষ দেখে ছাড়লেন রিচার্ড রিড। তিনিও যে দক্ষ খেলোয়াড়! ধরলেন কিংসলে’কে।
এই তদন্তই রিচার্ড রিডকে অন্য স্তরে নিয়ে গেল। কমিশনার স্টুয়ার্ট হগ বুঝলেন, কলকাতা পুলিশের বাইরেও এই গোয়েন্দা বাহিনীকে কাজে লাগাবেন। ১৮৬৮ সালেরই নভেম্বর মাসে চালু হলো কলকাতা পুলিশের আলাদা একটি ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট। পরবর্তীকালে যার সুপারিনটেনডেন্টের দায়িত্বও পেয়েছিলেন রিচার্ড রিড। একের পর এক তদন্তের সমাধান করে তিনি তখন ভারতের গোয়েন্দা সেনসেশন। বলা ভালো, রিচার্ড রিডই ছিলেন খাতায় কলমে কলকাতা শহরের প্রথম গোয়েন্দা। এই রিচার্ড রিডের উত্তরাধিকার বহন করছে রুদ্র। সেই আত্মাভিমান তার পুরো আছে। দুঁদে গোয়েন্দা হিসেবে তার নাম বেশ ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই বলেন যে রুদ্রর মগজাস্ত্রের ধার সাংঘাতিক। অনেকেই ওকে ফেলুদা বলেও ডাকে। সেই রুদ্র’র নিজের জীবনে ঘটে গেছে এক অদ্ভুত ঘটনা যার রহস্য সমাধানে লাট খাচ্ছে সে। সামনে কোনো আলোক রশ্মির দেখা নেই।
রুদ্রর ঘটনার সূত্রপাত নিতান্তই সাদামাটা। বত্রিশ বছর বয়স ছুঁতে ছুঁতেই বৈশাখের ভরা গরমে বাবা-মা’র পছন্দের মেয়ে রিমিকে বিয়ে করলো রুদ্র। বাবা-মা সামলালেন সব। বিয়ের আগেই বাবা বলেছিলেন,
হানিমুনের প্ল্যান কি করলি?
রুদ্র উত্তর দিয়েছিল,
ছুটি কই? যাবো কাছাকাছি কোথাও।
বাবা বললেন-
সেকী! সবাই এখন হনিমুনে বিদেশ-টিদেশ যাচ্ছে।
বাবা, আমি পুলিশে চাকরি করি। বিদেশ যেতে হলে অনেক পারমিশন লাগবে।
তা বলে কাছাকাছি? দেশের মধ্যেই তো অনেক ভালো জায়গা আছে।
যেখানেই যাই, বাংলার বাইরে গেলে পারমিশন লাগবে। ঝামেলা।
আচ্ছা, তবে তুই দার্জিলিং যা। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
রুদ্র’র বাবার আদিবাস দার্জিলিংয়ে ছিল। প্রায় তিন পুরুষের অধিষ্ঠান। কিন্তু রুদ্র’র বাবার চাকরিতে উন্নতির কারণেই তাদের ঘাঁটি গাড়তে হলো কলকাতায়। সল্ট লেকে বাড়ি করে এখন কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বাবার দার্জিলিংয়ে যাতায়াত আছে। অবসরের পরে মাঝেমধ্যেই চলে যান নিজের জন্মভূমিতে। মা পেরে ওঠেন না। হাঁটুতে ব্যথা হয় আজকাল। পাহাড়ে খুব অসুবিধে হয়। মা বলে দিয়েছেন, রুদ্র’র বিয়ের পর থেকে বাবার পাল্লায় পরে আর কোথাও যাবেন না। যা খুশি করুন রুদ্র’র বাবা। রুদ্র’র কাজের সময়ের ঠিক নেই। কখনও কখনও মধ্যরাতেও এক ফোনে বেরিয়ে যেতে হয়। কখনও দু-তিনদিন বাড়িতেই ফেরে না। কোনোদিন বিকেল অবধি ঘুমোল। এহেন ছেলের সাথে কোনো বাপ তার মেয়েকে বিয়ে দেবে? কিন্তু রুদ্র’র মা ঠিক দেখেশুনে নিজের পছন্দের মেয়ে জোগাড় করে ফেললেন। রুদ্র’র চাকরি মায়ের যতই না’পসন্দ হোক, রুদ্র খুব উপভোগ করে তার চাকরি। অদ্ভুত নেশা তাকে টানে। এই চাকরির স্বার্থে রুদ্র সব ছাড়তেও রাজী। মায়ের পছন্দ নিয়ে সে উচ্চবাচ্য করলো না। বিনাপ্রশ্নে বিয়ে করলো রিমিকে। শুধু রিমির বাড়িতে সবার সামনে খুব পরিস্কার করে নিজের চাকরির সমস্যাগুলি বিবৃত করলো।
বাবা ব্যবস্থা করে দিলেন তার দার্জিলিংয়ে হানিমুনের। হানিমুন মানে যে নির্জনে নতুন বিয়ে করা স্ত্রীকে সময় দেওয়া তা রুদ্র’র মনে হলো না। যাওয়ার আগেই নতুন বউকে নিয়ে আসতে হবে দার্জিলিংয়ে র বিভিন্ন পরিচিতদের বাড়িতে, অনুরোধের বন্যা ছুটল। নেমন্তন্ন আর নেমন্তন্ন। রুদ্র’র মনে হলো যে রিমির হয়ত ভালো লাগবে না। কী করা যায়! রিমিকে বিয়ের আগেই ফোন করে বলল পুরোটা। ট্রিপটা ক্যানসেল করে দেবে? রিমি বলল,
সে কি, হানিমুন ক্যানসেল করবে কেন? নেমন্তন্ন করছে যখন, যাবো। তোমাদের পারিবারিক সুনামের ব্যাপার। কাজেই চলো দার্জিলিং।
অফিসে বস বললেন,
সিকিউরিটির ব্যবস্থা করছি।
রুদ্র হেসে ফেললো। বলল,
স্যার, দার্জিলিংয়ে আমার সিকিউরিটি লাগবে না। নিজেদের শহর। ওখানে এমনিতেই আমার বন্ধু-পরিচিতরা যথেষ্ট। আপনি শুধু এস পি’কে জানিয়ে রাখুন। সিম্পলি ফরমালিটি।
বিয়ের দিন সাতেক বাদে দমদম এয়ারপোর্ট থেকে প্লেন ধরলো রুদ্র। সাথে রিভলবার রাখার অনুমতিপত্র ও অস্ত্র ক্যাপ্টেনের কাছে জমা রাখার আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া পুরো ভ্রমণ বেশ মসৃণভাবেই শুরু হলো। প্লেন বাগডোগরাতে নামতেই রুদ্র বুঝল আকাশের অবস্থা বেশ খারাপ। মেঘের পরে মেঘ জমেছে। আগেই বুক করা গাড়ি অপেক্ষায় ছিল। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি ছুটল দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে। মাটিগাড়া অতিক্রম করতেই আকাশের মুখ বেজার। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে বেশ গতিতে। নেপালি ভাষায় রুদ্র ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলো, ঠাণ্ডা আবহাওয়া শুরু হবে কোথা থেকে।
রুদ্র’র মুখে শুদ্ধ নেপালি ভাষার উচ্চারণ শুনে ড্রাইভার ছেলেটি বেশ বিস্ময়ের সাথে উত্তর দিলো,
সোনাদায় সোয়েটার পড়তে হবে। স্যার আপনি কি গোর্খালি? রুদ্র হেসে বলল, তা বলতে পারেন। তবে আমার বউ বাঙালি।
ড্রাইভার বলল, সে বুঝেছি।
রিমি একটু চুপচাপ থাকতে ভালো বাসে। তবে এই সফরে সে যে বেশ খুশি সেটা তার মুখের ভাবে প্রকাশিত। কার্শিয়ং পৌঁছতেই বেশ বড় একটা পুলিশ বাহিনী রাস্তা আটকালো। এক অফিসার এসে জানলার কাঁচ নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, রুদ্র চৌধুরী?
রুদ্র সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল। অফিসার বলল, প্লিজ ফলো মি।
রিমি বেশ বিস্মিত। রুদ্রও বিব্রত। ভাবল নেমে নিজের আই কার্ড দেখায়। কিন্তু প্রয়োজন কী! পরে দেখা যাবে। আগে দেখা যাক কেন ডাকছে। সে ড্রাইভারকে বলল,
ভয় নেই। চলো। দেখি কোথায় নিতে চাইছে।
পুলিশের গাড়ি এঁকেবেঁকে পাহাড় চড়তে লাগলো। পেছনে রুদ্র’র গাড়ি। রুদ্র’র মনে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এখানকার পুলিশ কর্তার বাংলোর দিকে। ডাউহিল স্কুলের পরে বড় বড় সরকারি বাংলো। সংরক্ষিত এলাকা। এখানে আর যাই হোক থানা থাকবে না। কোনো এলিতেলি মানুষের বাসও নেই। কাজেই উৎকণ্ঠার কিছু নেই। এখানকার এসপি যেন কে? ফোন করে জেনে নেবে? ফোন করার আগে দুটো গাড়িই ঢুকল একটা সুসজ্জিত বাংলোয়। বাংলোর দরজায় উজ্জ্বল হাসি মুখে এক পাহাড়ি যুবক। রুদ্র একবারেই চিনে ফেললো। শেরিং। ওর ব্যাচমেট। প্রথমেই কাঁচা নেপালিতে গালি।
শালা, আমার এলাকার ওপর দিয়ে যাবি আমার সাথে দেখা না করে?
তুই জানলি কী করে যে আমি আসছি?
তোর পেছনে একটা সবুজরঙের মারুতি জিপসি দেখিসনি? তোর সুরক্ষার ব্যবস্থা। সব ব্যবস্থা করছি আমি আর আমার সাথে দেখা না করে যাক গে, ভাবীজির সাথে আলাপ করিয়ে দে।
রিমির সাথে আলাপ করিয়ে দিলো রুদ্র। শেরিং-এর সাথে প্রথম আলাপ ট্রেনিং-এর সময়। নেপালি ভাষায় সারাদিন কথা বলতে পারায় রুদ্রকে দ্রুত বন্ধু করে নিয়েছিল শেরিং। আগে আলিপুরদুয়ারে ছিল। সদ্য এসেছে কার্শিয়ং-এ। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে। রুদ্র বাংলোয় ঢুকে দেখলো এলাহী আয়োজন করেছে শেরিং। সত্যিই তো, বন্ধু তার বাড়ির পাশ দিয়ে যাবে আর তার খাতিরদারি হবে না? রুদ্র বলেই ফেললো,
শেরিং, তুই তো আর্লি লাঞ্চের সব ব্যবস্থা করেছিস?
তুই যাবি, আর আমি বসে থাকবো?
শেরিং-এর বাড়িতে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে গাড়িতে উঠল। এখানে এসে রিমির নতুন রূপ দেখলো রুদ্র। একটা নতুন শাড়ি উপহার দিলো শেরিং-এর স্ত্রীকে। শেরিং-এর স্ত্রী দারুণ খুশি। কিন্তু সন্দেহ করায় অভ্যস্ত শেরিং জিজ্ঞাসা করলো, ভাবীজি, নিজের শাড়ি দিয়ে দিলেন?
রিমির সপ্রতিভ উত্তর,
আপনার বন্ধু না বললেও দার্জিলিংয়ে অনেক বন্ধু ও পরিচিত আছেন। আমি আমার শ্বশুর মহাশয়ের সাথে কথা বলে বেশ কিছু গিফট নিয়ে যাচ্ছি। সবাইকে যাতে দিতে পারি।
শেরিং কথা শুনে লাফিয়ে উঠল,
রুদ্র তোর বউ যে এত বুদ্ধি রাখে তুই জানতিস? ভালোই হলো, তোর সংসার গোছানো হবে এটা বুঝে আনন্দ হচ্ছে।
গাড়িতে বসে রুদ্র রিমিকে বললো,
স্যরী, আমার তোমাকে বলা উচিত ছিল গিফট নেওয়ার কথা। টাকাও দেওয়া উচিত ছিল। আমি যে কেন।
রিমি ফিক করে হেসে ফেললো, বললো,
তুমি ব্যস্ত গোয়েন্দা। আমি তোমায় ডিসটার্ব করিনি। বাবাকে বলতেই তিনি সব অ্যারেঞ্জ করে দিলেন।
রুদ্র এই পাহাড়ের নিসর্গে রিমিকে ভালো বেসে ফেললো। চেনা পাহাড়ে অচেনা মেয়েটি মুহূর্তে অসম্ভব চেনা হয়ে গেলো তার কাছে। সব পুরুষই নিজের স্ত্রীর মধ্যে মায়ের প্রতিরূপ দেখতে চায়। মনের অবচেতনে যে নারীমূর্তি ঘুমিয়ে থাকে সেটা মা ছাড়া বোধহয় অন্য কেউ নয়। সেই মা’কেই মানুষ দেখতে চায় স্ত্রীর মধ্যে, কন্যার মধ্যে।
বিকেলের মুখে তারা পৌঁছে গেলো দার্জিলিং শহরে। রুদ্র প্রথমে দার্জিলিংয়ের আগের শহর ঘুম-এ থাকবে ভেবেছিল। বাবা একটু গাঁইগুঁই করলেন, কী দরকার। নিজের পরিচিত জায়গায় থাকো, আমিও নিশ্চিন্ত থাকবো।
অফিসে বসও বললেন,
কেন শুধু শুধু ঘুমে থাকবে? দার্জিলিংয়ে থাকো। সিকিউরিটির সুবিধা অনেক।
অতএব দার্জিলিং। এক সাহেবী বাংলোয় বাবা থাকার ব্যবস্থা করেছেন। সেখানে একজন কেয়ারটেকার ছাড়া আর কেউ নেই। দুজন মালী সকালে আসে বিকেলে চলে যায়। বাংলোয় রান্না সংক্রান্ত সব আয়োজন আছে। ধপধপে বিছানা চাদর লেপ কম্বল। ফায়ার প্লেস থাকলেও রুম হিটার মজুত। একটা মদের সেলার আছে। প্রচুর চিপসের প্যাকেট, বিস্কিট মজুদ। ডিনার আসবে নিচের একটা নামি রেস্তোরাঁ থেকে। কেয়ারটেকার ভদ্রলোক বেশ বৃদ্ধ। বাঙালি। সত্তরের ওপরে বয়েস। অতি সাধারণ দর্শন। কথায় উত্তরবঙ্গের গ্রাম্য টান। নাম বললেন নিত্যানন্দ। সব বুঝিয়ে দিলেন প্রাঞ্জল বাংলায়। বললেন, কাল সকালে গাড়ি আসবে সকাল আটটায়। তারপর থেকে গাড়ি রুদ্র’র। এরপর থেকে গাড়ি রুদ্র’র নির্দেশ মতো আসবে যাবে। তবে কাল সকালে রুদ্র’র ব্রেকফাস্টের নিমন্ত্রণ আছে এসপি সাহেবের বাংলোয়। আটটার মধ্যে তৈরি হয়ে যেন থাকেন তারা। সেরকমই নির্দেশ দিয়েছেন এসপি সাহেব। রুদ্র ঘরে ঢুকে ঝপাং করে বিছানায় ছুড়ে দিলো নিজেকে।

দুই.
সন্ধ্যে নামছে পাহাড়ে। সূর্য ডুবে গেলো ঝপ করে কোনো রেশ না রেখেই। পাহাড়ে পাহাড়ে জ্বলে উঠল আলো। পাহাড় সেজে উঠছে আলোর মালায়। রিমি স্নান করতে গেছে বাথরুমে। রতিক্লান্ত রুদ্র নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে একটি কম্বলের তলায়। বিয়ের পরে এমনই হয় সবার। রিমি ঘরের দরজা বন্ধ করতেই বাঘ হয়ে উঠছিল রুদ্র। কিন্তু সবকিছুর পরে স্নান জরুরি হয়ে উঠল রিমির কাছে। রুদ্রকেও যেতে হবে। বাথরুমে গরম জলের ব্যবস্থা খুব ভালো। বাবার পছন্দের সত্যি তুলনা নেই। বাবাকে এসেই ফোন করে এই কথা বলেছে রুদ্র। বাবা বললেন,
তাহলে বলছিস আমার পছন্দ ভালো? আরে বাবা, আমিও তো একদিন হানিমুন করেছি।
পাশ থেকে মায়ের তীব্র কণ্ঠ শুনল রুদ্র, আদিখ্যেতা, বুড়ো বয়েসে নিজের হানিমুনের গল্পো ফাঁদছে নিজের ছেলের কাছে! ছ্যাঃ।
বাথরুম থেকে রিমি বেরোতেই রুদ্র স্নান সারতে ঢুকে পড়ল। এই ঠাণ্ডায় কাকস্নান করে বেরোতেই রিমি বলল যে তার পেটে চিনচিন করে ব্যথা করছে।
শিরিং-এর বাড়িতে তো খুব বেশি খাওনি। বদহজম বা অম্বল হলো নাকি!
কে জানে! অম্বলের ওষুধ খেলাম একটা। একটু বাদেই কমে যাবে।
দেখো, অসুবিধে মনে হলে আমায় বলো।
না না, তেমন কিছু না। সেরে যাবে।
রুদ্র জামাকাপড় পরে ফোনে মন দিলো। এসপি সাহেবকে ফোন করে তাদের পৌঁছ-সংবাদ জানালো। ধন্যবাদ জানালো সব আয়োজনের ও ব্রেকফাস্টে নিমন্ত্রণ জানানোর জন্য। আরো বেশ কিছু দরকারি ফোন সেরে নিতে নিতেই দরজার ঘণ্টা বেজে উঠল। রিমি খুলে দিলো দরজাটা। খাবার এসে গেছে। তিব্বতি খাবার। সেদ্ধ সেদ্ধ। রিমিকে ডেকে বললো, খেয়ে নাও গরম গরম, পরে ঠাণ্ডা হলে খেতে পারবে না। রিমি বললো,
তুমি খেয়ে নাও, আমি খাবো না। আজ খেলে বমি হয়ে যাবে।
তোমার কি খুব শরীর খারাপ লাগছে?
খুব নয়। তবে গা-গুলানো একটা অনুভূতি আছে। তার চেয়ে আজ ডিনার স্কিপ করি। কাল থেকে ভালোভাবে খাবো।
রুদ্র কথা বাড়ালো না। তার কারোর খাওয়ার ওপরে জোড়াজুড়ি করা পছন্দ নয়। যার যখন যেমন ইচ্ছে হবে, খাবে। নিজে কয়েকটা থুকপা খেয়ে মুখ ধুয়ে ইজি চেয়ারে বসলো।
তোমার কাছে ব্যথা কমার ট্যাবলেট আছে? বেশ কিছুক্ষণ বাদে রিমির এই প্রশ্নে চমকে উঠল রুদ্র।
তোমার খুব ব্যথা করছে?
হ্যাঁ, ভালোই ব্যথা করছে। পেটজুড়ে।
দেখি, দেখাও তো পেটের কোনো জায়গায় খুব ব্যথা রিমি তার পেটের নাভির ডান অংশ দেখিয়ে বললো, ব্যথা এখান থেকে উঠে ছড়িয়ে পড়ছে সারা পেটে।
এ কী! জায়গাটা লাল হয়ে আছে। একটু আগেও তো তখন যেন তুমি অন্য মুডে ছিলে! শোনো, যন্ত্রণাটা দ্রুত বাড়ছে। আর তীব্র হচ্ছে, তুমি আমাকে বরং ব্যথা কমার ওষুধ দাও।
আরে চোটের ওষুধ এখানে কাজ করবে না। অ্যাপেনডিসাইটিস নয় তো? দাঁড়াও, নিত্যানন্দকে ডাকি।
সে বাইরে এসে দেখলো কেয়ারটেকারের ঘরে আলো জ্বলছে। ডাক দিলো,
নিত্যানন্দ, নিত্যানন্দ।
দরজা খুলে নিত্যানন্দ বেরিয়ে এলো। ওর হাঁটা দেখেই রুদ্র বুঝল যে তার বেশ তুরীয় অবস্থা। পাহাড়ের মানুষজনের এই এক দোষ, কাজ শেষ তো বোতল সঙ্গী।
হ্যাঁ বাবু, কোনো সমস্যা হয়েছে?
আমার বউয়ের শরীর বেশ খারাপ করেছে। ডাক্তার পাওয়া যাবে?
নিচে হাসপাতালে পাওয়া যাবে বাবু। তবে এত রাতে নিয়ে যাবেন কী করে? গাড়ি তো নেই। এসপি সাহেবকে ফোন করেন।
ডাক্তারকে ফোন করলে আসবেন না?
আসবেন কী করে? তাকে তো গাড়ি পাঠাতে হবে। আপনি সাহেবকে ফোনে ধরেন।
কথাটা ঠিক। এত রাতে গাড়ি ছাড়া রিমিকে হাসপাতালে নেওয়াও যাবে না বা ডাক্তারকে হাজির করাও অসম্ভব। এসপি সাহেবকে ফোন করলো রুদ্র। কানেক্ট হচ্ছে না। আবার করলো। নাহ, হচ্ছে না। খালি কুঁইকুঁই আওয়াজ। শেরিংকে ধরার চেষ্টা করলো। একই শব্দ। রুদ্র বুঝলো ওর নেটওয়ার্ক যথাসময়ে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। নিত্যানন্দকে নিয়ে সে ঘরে প্রবেশ করলো। দেখলো রিমি কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করছে। রুদ্র’র মনে হলো যে এটা অ্যাকিউট অ্যাপেন্ডিসাইটিস। ওষুধ না পড়লে বার্স্ট করতে পারে। তখন জীবন সংশয় হতে পারে। নিচের হাসপাতালে এই অবস্থায় নেওয়া সম্ভব নয়। একমাত্র রাস্তা হাসপাতাল থেকে ডাক্তারকে হাজির করা। ইঞ্জেকশন দিয়ে আজ রাতের মতো ঠেকাতে পারবে। কাল সকালে যা হোক কিছু করা যাবে। কিন্তু ডাক্তারকে হাজির করতে তাদের কাউকে নিচে হাসপাতালে যেতে হবে। কে যাবে? নিত্যানন্দ বৃদ্ধ, তায় মাল টেনে টপভুজঙ্গ। ভরসা করা বোকামি। রুদ্র দিশেহারা হয়ে নিত্যানন্দকে বললো, আপনি বাইরের বারান্দায় বসে থাকুন আর মাঝে মধ্যে একটু দেখবেন জল-টল চায় কি না। আমি হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনি। যেভাবে পারি আনবো। গাড়ি না পাই কাঁধে করে নিয়ে আসবো।
সেই ভালো, বলে নিত্যানন্দ দরজার পাশের চেয়ারে বসলো। রিমি সমানে দাপাচ্ছে। রুদ্র দ্রুত নেমে গেলোপাহাড়ি পথে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। অঘটনের আশংকা ঘাই মারছে মনের অন্দরে। এ রাস্তাটা নতুন হয়েছে। চওড়া, পিচ ঢালা। কিন্তু হাসপাতালের দূরত্ব কম নয়। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূর পাহাড়ের বাতিগুলো নিভছে। রাস্তার দু’ধারে পাইন আর রডোডেনড্রনের সারি। পতঙ্গশব্দে সাঙ্গীতিক মুর্ছনা। রুদ্র ভাবল, যদি কিছু অঘটন ঘটে! তারপরেই নিজের মনকে প্রবোধ দিলো, না, না, তেমন বিপদ কিছু হবে না। এ এক অদ্ভুত সংকট। নাহ, কখনো এমন অবস্থায় পড়েনি রুদ্র। নিজেকে ‘কুল কুল’ বলতে বলতে নিচের দিকে নামতে থাকল সে। হাসপাতালে পৌঁছতে পৌঁছতে তার প্রায় কুড়ি মিনিট লাগলো, তাহলে ডাক্তারকে নিয়ে ফেরার সময় কমপক্ষে পঁয়ত্রিশ মিনিট লাগবে। যদি একটা গাড়ি পাওয়া যায় তাহলে বাঁচোয়া। হাসপাতালে গিয়ে রুদ্র শুনলো যে ডাক্তারবাবু খেতে গেছেন। ফিরতে ফিরতে কম করে একঘণ্টা। নার্সকে চোস্ত নেপালিতে সে বোঝালো অবস্থাটা। নার্স কিছুটা নির্লিপ্ত গলায় বললেন, আমি কী করব বলুন? এখানে নিয়ে আসলে আমি না’হয় নিজের রিস্কে ব্যথা কমার ইনজেকশন দিতাম।
রুদ্র বাধ্য হলো নিজের বিভাগীয় পরিচয় দিতে। নার্স পরিচয় পেয়ে একটু নড়েচড়ে বসলেন। একজনকে ডেকে বললেন যে ডাক্তারবাবুকে জরুরি তলব দিতে। তারপরে রুদ্র’র দিকে ফিরে বললেন, যেতে-আসতেই তো আধঘণ্টা। যা বললেন তাতে অবস্থা মনে হচ্ছে ক্রিটিকাল।
রুদ্রর কণ্ঠ কেঁপে উঠল, আচ্ছা, এখানে কারোর গাড়ি নেই?
নার্স বললেন, এখন নেই, ড্রাইভারও নেই, হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স অকেজো হয়েছে সপ্তাহখানেক। দিনের বেলায় হলে।
রুদ্র’র সামনে থেকে প্রত্যাশার মেঘ ক্রমেই সরে যাচ্ছে। মুখের ওপরে সজোরে ঘুষি খেলে একটি মানুষের যে অবস্থা হয় তার মুখ অবিকল এখন অবিকল সেরকম। আশার দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে। ফোন চেক করলো বারকয়েক। নাহ, একই শব্দ। রিমির যদি কিছু হয় মানুষজন কী বলবে তাকে? রিমির বাবা-মা? তারা যদি সন্দেহের বশে পুলিশে অভিযোগ জানায়! অবশ্য পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ওর পক্ষে সাক্ষী দেবে। ছি ছি, এসব কী ভাবছে রুদ্র! মনকে জোরে বকুনি লাগালো সে। একটা মেয়ে কতো ভরসা করে, কতো স্বপ্ন দেখে তার সাথে ঘর করতে এসেছে। বেড়াতেও এলো। তার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে নিজেকে কি সে ক্ষমা করতে পারবে? কিন্তু এর বাইরে কীই বা করার ছিল? নিত্যানন্দ আবার ঘুমিয়ে পড়বে না তো! যা মাল টেনে রেখেছে। রিমি যদি জ্ঞান হারায়, নিত্যানন্দ কিছুই তো করতে পারবে না। লড়ঝরে দেহাতী বুড়ো। ধুস, কী কুক্ষণে যে সে হানিমুনে বেরিয়েছিল। না এলেই হত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুদ্র নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে ডাক্তারের ফিরে আসার অপেক্ষা করতে লাগলো। গির্জার ঘণ্টা বেজে উঠেছে। রাত দশটা বাজলো। রুদ্র উসখুস করে উঠতেই হুড়মুড় করে ডাক্তার সেই ডাকতে যাওয়া লোকটির সাথে ঢুকলেন হাসপাতালে। রুদ্র’র খোঁজ নিয়ে সামনে এসে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন-
কী হয়েছে?
রুদ্র নেপালিতে আনুপূর্বিক ঘটনার বর্ণনা দিলো। ডাক্তারবাবু কয়েকটি আনুষঙ্গিক ইনজেকশন সঙ্গে নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিলেন দ্রুত, রুদ্রকে বললেন, চলুন।
গাড়ি নেই। পায়ে হেঁটে রওনা হলেন ওরা। ডাক্তারবাবু সঙ্গে একজন সহকারীকে নিলেন। তারপরে তারা ধরলেন একটি পাকদণ্ডীর পথ। রুদ্র এই রাস্তাটা চেনে না। ভীষণ চড়াই। ডাক্তারবাবু যেতে যেতে কথা বলছেন, জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ। কিন্তু রিমির শরীরের পুরনো ইতিহাস রুদ্র’র অজানা। রিমির শরীর তো সবে চিনতে শুরু করেছে সে। কিছুক্ষণ বাদে ডাক্তারবাবু বলেই ফেললেন,
রুদ্রদাজু, আপনি খারাপ পরিস্থিতির জন্যে তৈরি থাকুন।
কেঁপে উঠল রুদ্র। রিমি কি তবে নেই? ডাক্তার স্পষ্টই তাকে সেই ইঙ্গিত দিলেন। একটা গাড়ির অভাবে রিমি চলে যাবে? মানতে পারছে না রুদ্র। ডাক্তারবাবু আবার বললেন,
এই ঘটনাগুলো খুবই আকস্মিক। রোগী বা তার পরিবার বুঝতে পারে না। দেরী করে। শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে যখন আনে তখন কিছু করার থাকে না। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে ঘটনাটা ঘটল রাতের ঠিক সে সময় যখন গাড়িওয়ালাদের পাওয়া যায় না। অথচ ভোর তিনটের সময় থেকে আপনি গাড়ি পাবেন যথেষ্ট সংখ্যায়।
কথাগুলো ঠিকই বললেন ডাক্তারবাবু। রুদ্র দার্জিলিং শহরকে খুব ভালো চেনে। এখানে তার পরিচিত মানুষের সংখ্যা প্রচুর। তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি কম নয়। তার ওপরে প্রশাসনের সব সুবিধা সে পেতে পারে। প্রয়োজনে রিমিকে হেলিকপ্টারে উড়িয়ে শিলিগুড়িতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রুদ্র’র ছিল। অথচ দশচক্রে আজ সে ভূত হয়েছে। পাকদণ্ডী বেয়ে দ্রুত উঠতে হচ্ছে তাদের। এরমধ্যে ঝটপট করে একটা পাখি ডাক্তারের সহকারীর মুখের ওপরে পড়ল। সে নেপালিতে স্বগতোক্তি করলো, লক্ষণ ভালো নয়, আজ অমাবস্যা। রুদ্র জানে যে এখানকার গোর্খালিরা ভূত-প্রেত-অপদেবতায় বংশপরম্পরায় বিশ্বাস করে এসেছে। রুদ্ররা ট্রেনিং-এর সময় শেরিংকে একবার মধ্যরাতে সাদা চাদর গায়ে মুড়িয়ে সবাই মিলে খুব ভয় দেখিয়েছিল। রুদ্র আবার ভূত-প্রেত তো দূরের কথা ঈশ্বরেও বড় একটা বিশ্বাসী নয়। সে বোঝে যে এই কল্প-কাহিনী বাজারে ছড়িয়ে মানুষকে সংযত রাখার চেষ্টা করা হয়। তাই ভূতকাহিনী জনপ্রিয়। ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের শেখানো হয়।
দূর থেকে বাংলোটা দেখে একটা আন্দাজ করার চেষ্টা করলো রুদ্র। আলো জ্বলছে। নিত্যানন্দ চেয়ারে গভীর ঘুমে। মাথা এলিয়ে রেখেছে। রুদ্র দূর থেকেই চিৎকার করলো, নিত্যানন্দ।
বেচারী চমকে উঠে দাঁড়ালো। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বললো, ম্যাডাম ঘুমিয়ে পড়েছেন। ভালো আছেন।
রুদ্রর শরীর ও মন থেকে চাপ ও শঙ্কা দ্রুত সরে গেলো। রুদ্র ডাক্তারবাবুকে তাদের ঘরটা দেখিয়ে দিলো। নিজে পেছন পেছন ঢুকতে গেলো। ঘরে ঢুকে ডাক্তার চিৎকার করে উঠলেন, এ কী।
রুদ্র ঘরে একধাক্কায় ঢুকে রিমিকে দেখলো। নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে সে। বুক পেট সঠিক ছন্দে ওঠা নামা করছে। তাহলে ডাক্তার চিৎকার করলেন কেন? রুদ্র দেখলো ডাক্তার দ্রুত হাতে রিমির তলপেটের ডানদিকটা উন্মুক্ত করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কে এই অপারেশন করলেন?
কিসের অপারেশন?
অ্যাপেন্ডিসাইটিসের। এ তো কোনো দক্ষ সার্জেনের হাতের কাজ।
কিছু বুঝতে পারলো না রুদ্র। ডাক্তার ব্যান্ডেজটা দ্রুত খুলে ক্ষতস্থানটা পরীক্ষা করলেন। তারপরে রুদ্র’র দিকে মুখ তুললেন, রুদ্রদাজু, আমরা আসার আগে কোনো অত্যন্ত দক্ষ কোনো সার্জেন এই অপারেশনটা করেছেন।
কোন অপারেশন?
আপনার স্ত্রীর অ্যাকিউট অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়েছিল। কিন্তু সময়মতো কেউ অপারেট করে সেটা বাদ দিয়ে দিয়েছে।
কী বলছেন! কোনো ডাক্তার এসে অপারেশন করলেন? ও তো ঘুমোচ্ছে।
ঘুমোচ্ছে তো ওষুধের প্রভাবে। অন্তত আরো সাত-আট ঘণ্টা ঘুমোবে। এদিকে আসুন, দেখুন।
ডাক্তারবাবুকে অনুসরণ করে পাশের টেবিলে যা দেখলো রুদ্র তাতে তার মাথা টলে গেল। সে সেখল একটি প্লেটের ওপরে রক্তাক্ত একটি পটলাকৃতি মাংসপিণ্ড। তার পাশে কিছুটা রক্তমাখা তুলো। রুদ্র ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করলো, এটাই কি অ্যাপেন্ডিসাইটিস।
নাহ, এটা অ্যাপেন্ডিক্স। অ্যাকিউট অ্যান্ড ইনফ্লেমড। আর পাঁচ মিনিট দেরি হলে বাঁচানো যেত না। অ্যাপেনডিক্সটা দেখুন। ফাটার ঠিক আগের চেহারা।
রুদ্র সেই মাংসখণ্ডর দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলো। অদ্ভুত অবয়ব। ফুটিফাটার মতো ওপরের অংশ। চাকা চাকা হয়ে আছে। এটাই পেটের ভেতরে থেকে এত অশান্তির জন্ম দেয়? রুদ্র কিছুটা অসহায়ের মতো ডাক্তারবাবুর দিকে তাকালো। ডাক্তারবাবু ইতোমধ্যে একটা কাগজ তুলে আলোর সামনে ধরলেন। রুদ্র’র দিকে তাকিয়ে বললো, দেখুন প্রেসক্রিপশন ও অপারেশন ডিটেইলস। এমন কি কোনো কোনো ওষুধ দেওয়া হয়েছে তার জেনেরিক নাম।
বললাম না, কোনো ডাক্তার অপারেশন করে আপনার স্ত্রীর প্রাণ বাঁচিয়েছে?
রুদ্র নিত্যানন্দ’র দিকে তাকালো। ভদ্রলোক পুরো ব্যাপারটায় গতবুদ্ধি হয়ে গেছেন। রুদ্র নিত্যানন্দকে বেশ মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞাসা করলো, কে এসেছিল নিত্যানন্দ? কেউ আসেনি?
নিত্যানন্দ কাঁচুমাচু মুখে বললো,
আমি দিব্যি করে বলতে পারি কেউ আসেনি।
আপনি তো মাল খেয়ে টাল হয়ে ছিলেন।
বাবু, আমার হালকা নেশা হলেও আমাকে প্রথমবার ডাকার পর থেকে কাজে কোনো গাফিলতি দেখেছেন? ম্যাডাম ঘুমোনোর পরে আমি সামান্য এলিয়ে বসেছিলাম বটে। কিন্তু দরজা দিয়ে মাছিও গলতে দেইনি।
কেউ যদি না ঢোকে তাহলে এত বড়ো অপারেশন কে করলো?
তা তো বাবু খেয়াল করিনি। আমি কাউকে দেখিনি। ম্যাডামের গোঙানি থামতেই শুধু দরজার এপার থেকে দেখলাম উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন, তারপরে এসে বসলাম এই চেয়ারে।
শুনুন নিত্যানন্দ, ডাক্তারবাবু বললেন যে অপারেশন কেউ করেছে। আপনি যদি কোনো হাতুড়ে ডাক্তারকে দিয়ে অপারেশন করিয়ে থাকেন কোনো অন্যায় করেননি। কিন্তু বলুন প্লিজ।
এবারে রুদ্রকে আটকালেন ডাক্তারবাবু। বললেন, রুদ্রদাজু, এই অপারেশন কোনো হাতুড়ে বা সাধারণ ডাক্তারের কাজ নয়। প্রশিক্ষিত ও নিয়মিত অপারেশন করা হাতের কাজ। প্রেসক্রিপশনটা দেখুন। সব ডিটেইলস ডাক্তারি পরিভাষায় বর্ণিত। এমনকি ওষুধের জেনেরিক নামগুলোও লিখে গেছেন। আমাদের যাতে অসুবিধে না হয়।
চলুন, একটু বসা যাক। কফি হবে একটু?
নিত্যানন্দ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। প্রায় দৌড়েই ঘরের কোনে রাখা ইলেকট্রিক কেটলিতে জল বসিয়ে দিলেন। রুদ্ররা এসে বসলেন বারান্দার সোফায়। ডাক্তারবাবু নিজের শরীর ছেড়ে দিয়ে অত্যন্ত আয়েস করে বসলেন। বললেন, রুদ্রদাজু, এলাম চিকিৎসা করতে। তখন একধরনের শঙ্কায় ভুগছিলাম। এখন দেখছি পুরোটাই রহস্য। কখনো আমার আপনাকে সন্দেহ হচ্ছে। কখনো ওই নিত্যানন্দকে। অপারেশন করে যাওয়া ডাক্তারের ব্যাপারে কেউ তো জানেন। আপনি তো পুলিশের লোক। কোনো বিভাগে জানি না। কিন্তু আমার সন্দেহ কি অমূলক আপনি বলুন!
ডাক্তারবাবু, আমি গোয়েন্দা, ওটা আমার পেশা। আপনি ঠিকই ভাবছেন। তবে।
কী তবে?
এই ব্যাপারটা এত সরল নয়। আপনার প্রতিটি নিরীক্ষণ আমার খুব জরুরি। তাই আপনাকে কিছু প্রশ্ন আমি পরে করব। এখন আসুন, কফি খাই।
ইতোমধ্যে নিত্যানন্দ কফি করে নিয়ে এসেছে। সবাইকে দিয়ে নিজেও নিল সে। রুদ্র বলল,
আপনি বসুন।
নিত্যানন্দ বসল উল্টোদিকে।
নিত্যানন্দ, আপনি বুঝতেই পারছেন একটা রহস্যময় ঘটনা ঘটেছে। তবে যেহেতু ঘটনাটি অপরাধমূলক নয় কাজেই পুলিশ কেস হবে না। এখানে ডাক্তারবাবুর নিরীক্ষণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, আপনার বক্তব্যও খুব জরুরি। আমি নিজে গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করলেও কিছুই বুঝিনি। মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে হবে। আপনাকে একটা অনুরোধ এই যে আপনি আমায় সহযোগিতা করবেন।
সহযোগিতা নিশ্চয়ই করব। কিন্তু বাবু, একটা কথা বলবো? সাহস দিলে বলি।
বলুন, বলুন।
আপনারা যাই বলুন আমি আমার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত যে আমার কোনো গাফিলতি নেই। আমি যা বলেছি তার বাইরে কিছু ঘটেনি। আমাকে মেরে ফেললেও একই জবান পাবেন। মদ খেয়ে বেসামাল হওয়ার বান্দা আমি নই। কাজেই নিজেদের সন্দেহ না করে অন্য কিছু ভাবুন।
অন্যকিছু মানে?
মানে ভূত-প্রেত। আমার মনে হচ্ছে এই কাজ কোনো ভূতের।
ভূত? আমি ভূত-প্রেত বিশ্বাস করি না।

তিন.
সকাল সকাল উঠে পড়লো রুদ্র। ভোরের দিকে তন্দ্রা এসেছিল। আধো ঘুম। মোবাইল বেজে উঠতেই বুঝলো এসপি সাহেব ফোন করেছেন।
বলুন, এসপি সাহেব।
রাতে অনেকবার ফোন করেছিলেন। আমি পাইনি। কিন্তু মেসেজে দেখছি।
হ্যাঁ, আপনার বা অন্য কারোর ফোন বাজেনি। নেটওয়ার্কে সমস্যা ছিল। আমি খুব বিপদে পড়েছিলাম। তাই।
সে কী! কী বিপদ?
রুদ্র আনুপূর্বিক পুরো ঘটনা বিবৃত করলো এসপি সাহেবের কাছে। এসপি সাহেব বললেন, আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আসছি। আপনার ওখানে গিয়ে কফি খেতে খেতে সব শুনব। ভূতের কারবার কি না কে জানে!
রিমি এখনো বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। যে প্রেসক্রিপশনটা এই ঘরে রাখা ছিল সেটা প্রথমে হাতে টেনে নিলো রুদ্র। খুব ভালো করে দেখলো। কোনো ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করা হয়েছে, কোনো সিডেটিভ দেওয়া হয়েছে, কোনো পেইনকিলার দেওয়া হয়েছে, সবগুলোর জেনেরিক নাম লেখা আছে। রক্তচাপ কত ছিল তাও লেখা আছে। সুগার টেস্ট করা হয়নি সেটারও উল্লেখ আছে। আজ কোনো ওষুধ খাবে তাও লিখেছেন যে অপারেশন করেছেন। রিমি কী খাবার খাবে লিখে দিয়েছেন। পুরো প্রেসক্রিপশনে দুটি জিনিস রুদ্র’র চোখে পড়লো। প্রথমতঃ সব ওষুধের নাম জেনেরিক বা মৌলের রাসায়নিক নাম। দ্বিতীয়টি হলো শব্দগুলো লেখার স্টাইল। ইংরেজ আমলের ইংরেজি অক্ষরের আদলে। তখন হাতের লেখার বিশেষ ক্লাস হতো। সবার লেখাই লম্বাটে ও ঈষৎ বাঁকানো হত। রুদ্র’র পিতামহ এই স্টাইলে লিখতেন। পুরো প্রেসিক্রিপশনে ডাক্তারের নাম নেই। সই নেই। কিন্তু শুরুতেই তারিখ লেখা আছে।
এসপি সাহেব আসছেন। তাকে কফি খাওয়াতে গেলে নিত্যানন্দ ভরসা। রুদ্র নিত্যানন্দকে ডাকার জন্য বাইরে এলো। দেখলো নিত্যানন্দ লনে একটি চেয়ারে বসে গভীরভাবে কিছু ভাবছে।
কী ব্যাপার! এই ঠাণ্ডায় আপনি লনে? কী ভাবছেন? কালকের কথা?
হুমম, আমি ভাবছিলাম যদি কোনো ডাক্তার ঢুকেও পড়ে তার উদ্দেশ্য কী? সে নিঃশব্দে অপারেশন করলো, অ্যাপেনডিক্স বার করলো, তারপরে ভ্যানিশ। কোনো মানুষ হলে এমন কেন করবে? নাকি ভূত?
ভূতের হিসেব পরে হবে। এসপি সাহেব আসছেন, কফি খাবেন। আমি রিমির কাছে বসছি। ওর জ্ঞান হওয়ার ও ঘুম ভাঙার সময় হয়েছে। আমাকে না দেখলে।
না, না, বাবু, আমি সব ব্যবস্থা করছি।
রুদ্র’র চোখ পড়লো গেটের দিকে। দেখলো নার্সের পোশাক পরা একটি নেপালি মেয়ে এসে কছে তাদের বাংলোতে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বললো, আমি হাসপাতালে চাকরি করি। ডাক্তারবাবু আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনার বাড়ির লোক না আসা অবধি আমরাই পালা করে সেবা করবো। রুদ্র ডাক্তারবাবুর এই মানবিক দিক অনুভব করে ভীষণভাবে আপ্লুত হলো। সে নার্স মেয়েটিকে সব দেখিয়ে দিলো। মেয়েটি একটি স্যুপের প্যাকেট ইলেকট্রিক কেটলির পাশে রাখলো। রুদ্রকে বললো,
ম্যাডামের ঘুম ভাঙলে খুব খিদে পাবে। তখন স্যুপ দিতে হবে। বাকি ম্যাডামের সারা দিনের খাবার ডাক্তারবাবু পাঠিয়ে দেবেন। সেসব খাবার পছন্দ হলে আপনিও খেতে পারেন। ডাক্তারবাবু আসবেন একটু পরে। কথা বলে নেবেন।
বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। তবু এই সকালে রুদ্র’র মনে হলো স্নান করলে বোধহয় ভালো লাগবে। সে ঢুকে পড়লো বাথরুমে। রিমির ওষুধ আনতে হবে। কিন্তু দার্জিলিংয়ের দোকান আটটার আগে খোলে না। জল গরম করে সারা শরীর দিয়ে সে গ্রহণ করলো ধারাস্নান। মাথার মধ্যে ঝিমঝিমে ব্যাপারটা কেটে গেল। শরীরের পেশিগুলো নমনীয় হলো যেন। ফ্রেশ লাগছে নিজেকে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে সে দেখলো রিমির চোখ নড়ছে। সে দাঁড়ালো রিমির পাশে। বেশ ঘোরের মধ্যে থেকে সামান্য জেগে উঠল যেন। খুব মৃদুস্বরে বললো,
এখন কি সকাল?
রুদ্র তাড়াতাড়ি উত্তর দিলো,
হ্যাঁ, এখন সকাল। তোমার এখন কেমন বোধ হচ্ছে? ব্যথা-ট্যাথা নেই তো?
নাহ, তুমি চলে যাওয়ার পরে আমায় কে যেন মদ খাইয়ে দিলো। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু নেশা তো কাটছে না।
না কাটুক, তুমি কিছু খাবে?
হ্যাঁ, খিদে পেয়েছে।
ইতোমধ্যে নার্স স্যুপ বানিয়ে রুদ্র’র হাতে দিলো। দু’চুমুক খেয়ে রুদ্র’র দিকে তাকিয়ে বললো, আমি আরেকটু ঘুমোই? রুদ্র’র হাতে নার্স একটা ট্যাবলেট দিতেই রুদ্র উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই নার্স বললো, সিডেটিভ, ডাক্তারবাবু পাঠিয়ে দিয়েছেন। সামান্য জল দিয়ে ওষুধটা খেয়ে নিলো রিমি। তারপরে চলে গেলো গভীর ঘুমে। নার্সের জিম্মায় রিমিকে রেখে বারান্দায় আসতেই সে দেখলো যে আরো দু’জনকে সাথে নিয়ে এসপি সাহেব এসে গাড়ি থেকে নামলেন। শেষে নামলেন কাল রাতে আসা হাসপাতালের ডাক্তারবাবু। এই ভদ্রলোককে দেখে বেশ খুশি হলো রুদ্র। এসপি সাহেব আলাপ করিয়ে দিলেন দার্জিলিং জেলার সিভিল সার্জন ডাক্তার মুখার্জির সাথে। তিনি বললেন,
আমি আসতে আসতে সব শুনলাম ডাক্তার গুরুং-এর কাছ থেকে। এ তো অবাস্তব ব্যাপার।
রুদ্র বুঝলো যে কাল রাতে আসা ডাক্তারবাবুর পদবী গুরুং। অথচ কী আশ্চর্য, রুদ্র একবারও নাম জানতে চায়নি। বিহ্বলতা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে পালটে দেয়। ডাক্তার মুখার্জি বললেন যে আমি অপারেশনের জায়গাটা একটু দেখবো আর প্রেসক্রিপশনটা। অ্যাপেনডিক্স তো ফেলে দিয়েছেন!
না ফেলিনি। কেয়ারটেকার বলেছে যে একটু পরে মেথর আসবে। তাকে দিয়ে পুঁতে দেবে কোথাও।
তাহলে চলুন দেখি।
দুই ডাক্তার গেলেন রোগী দেখতে যদিও কাজের কাজটা করেছেন আরেকজন অদৃশ্য ডাক্তার। এসপি সাহেব বেশ কৌতূহলী কণ্ঠে বললেন, রুদ্র তুমি নিজে গোয়েন্দা। এত নাম তোমার। কী মনে হচ্ছে এই রহস্যের ব্যাপারে?
স্যার, এখানে যেটা ঘটেছে তাতে রোগী বাদে মাত্র দুজন মানুষ ঘটনার আগে পরে বা ঘটনার সময় ছিল। প্রথম হলাম আমি। আমি হাসপাতালে ছুটে গিয়ে অপেক্ষা করে ডাক্তার গুরুং-কে নিয়ে ফিরি। কাজেই আমি ঘটনার সাথে জড়িত নই। রইলো বাকি নিত্যানন্দ। রিমির যন্ত্রণা দেখে হয় ও নিজে অপারেশন করেছে যা কার্যত অসম্ভব। এখানে কেয়ারটেকারের চাকরি করছে গত পঁচিশ ছাব্বিশ বছর। কখনই চিকিৎসাশাস্ত্রের কোনো কাজ করেনি। এমনকি ওষুধের দোকানেও ছিল না। এখানে নাকি সবারই পরিচিত। এমনকি ডাক্তার গুরুং ওকে দীর্ঘদিন চেনেন। কথায় উত্তরবঙ্গের গেঁয়ো সুর। যে সন্দেহ আমার দৃঢ় হয়েছিল তা হলো রিমির যন্ত্রণা দেখে ও আশপাশের কোনো হাতুড়ে ডাক্তারকে ডেকে এনেছিল যে অপারেশন করেছে। কিন্তু কাজটা বেআইনি। তাই চেপে গেছে। কাল রাতে নিত্যানন্দকে বেশ চেপে ধরেছিলাম। তীব্রভাবে অস্বীকার করেছে। ও ঘটনাটা নিয়ে চিন্তিত। ওর কাছেও ঘটনাটা রহস্য। ওর ব্যবহারে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। ডাক্তার গুরুং-ও নিশ্চিত করেছেন এই জায়গার আশপাশে কোনো হাতুড়ে ডাক্তার নেই।
তাহলে কি ভূত-টুত এসেছিল?
স্যার, ভূত-প্রেতে আমি বিশ্বাসী নই। আমাদের হাতে দুটি ক্লু আছে। অপারেশনের প্যাটার্নটা নাকি পুরনো আর ডাক্তারের হাতের লেখা। ওটা নিয়ে এগোলেই খুঁজে পাওয়া যাবে।
তোমার এই নিত্যানন্দের লেখা চেক করেছো? এই কেয়ারটেকারের লেখার সাথে মিললে।
স্যার, সে সম্ভাবনা নেই। এ বেচারির ডান হাত বহুদিনই পঙ্গু। ভারী কাজ করে না। কফি বানায় মূলত বাঁ হাতে। ডানহাত সাপোর্টিভ। ট্রে আনার সময় ডান হাতের সাপোর্ট নেয়। দেখবেন, কফি হাতে তুলে দেয় না। নিজের কাপ নেয় বাঁহাতে। কাল এখানে আসার পরে এন্ট্রির সময় দেখলাম যে সব গেস্ট নিজেরা এন্ট্রি বুকে নিজেদের ডিটেইলস লিখেছে। আমিও লিখলাম। ওপরে দিনক্ষণের হিসাব লেখা আঁকাবাঁকা অক্ষরে। ওকে দেখে বোঝা যায় না। কিন্তু আমার লাগেজ ও বাঁ হাতে তুলে নিতেই আমার সন্দেহ হলো। জিজ্ঞাসা করতেই বললো, যে নিউরোলজিক্যাল সমস্যায় তার ডান হাত অকেজো।
হুম, তাহলে?
স্যার আমার যেটা মনে হয় তা হলো, আমার যাওয়ার পরে নিত্যানন্দ যখন বাইরে বসে ছিল তখন সে মালের নেশায় হয়ত তন্দ্রা গিয়েছিল। তখনই কোনো একজন ডাক্তার ঢোকেন এবং পেশেন্টের অবস্থা দেখে অপারেশন করেন। তারপরে তন্দ্রাচ্ছন্ন নিত্যানন্দকে পাশ কাটিয়ে চলে যান। কিন্তু নিত্যানন্দ বলছে যে সে সজাগ ছিল।
এই সম্ভাবনাটা আমার মনে হচ্ছে ঠিক রাস্তা। নিত্যানন্দ যাই বলুক মাতালের কথা কেউ বিশ্বাস করে! এটা যদি ভূতের কীর্তি না হয়ে থাকে তাহলে তোমার যুক্তিটি ঠিক। কিন্তু কে সে? কোথাকার ডাক্তার? কেন এসেছিলেন? কেনই বা আত্মপরিচয় গোপন করে চলে গেলেন? প্রশ্ন অনেক।
স্যার, আমিও খুব গভীর ভাবে ভেবেছি। নিত্যানন্দ ঘুমিয়ে পড়েছিল কিনা জানি না যদিও অস্বীকার করছে। তবে কেউ ঢুকেছিল। তার সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে আপনার সিভিল সার্জনের মতামতের ওপরে।
ইতোমধ্যে দুই ডাক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বসলেন ওদের উল্টোদিকে। ইতোমধ্যে নিত্যানন্দ এসপি সাহেবের শ্যেনদৃষ্টির সামনে কফির ট্রে এনে রাখলো। আরেকবার ভিতরে গিয়ে আরেক ট্রে’তে নিয়ে এলো কুকিজ ও বিস্কুট। এসপি সাহেব নিত্যানন্দ’র দু’হাত ভালো করে মেপে নিলেন। তার দৃষ্টি নরম হয়ে গেল। রুদ্র বুঝলো যে এসপি সাহেব সন্দেহ’র তালিকা থেকে নিত্যানন্দকে বাদ দিলেন। ডাক্তার মুখার্জি কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন,
রুদ্র আপনার মিসেস খুব ভালো আছেন। টোটালি আউট অফ ডেনজার। যেই করুণ নিখুঁত অপারেশন করেছেন। আর পাঁচ মিনিট দেরি হলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেত। আজ এই ডাক্তারের প্রেসিক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ ও খাবার চলবে। ওষুধ ডাক্তার গুরুং নিয়ে এসেছেন। দেওয়া হয়ে গেছে নার্সকে। ও খাইয়ে দেবে সময় মতো।
ডাক্তার মুখার্জি থামতেই এসপি সাহেব বললেন, আপনার ডাক্তারি পরামর্শ শেষ হলে এই ডাক্তার ও তার অপারেশন নিয়ে কিছু বলুন। এমন রহস্য আমি জীবনে পাইনি। পুরো গোল সবকিছু।
দেখুন এই অপারেশন এখন খুব সহজ। ল্যাপ্রোস্কোপির মাধ্যমে রোগীর পেটে তিনটে ফুটো করে ক্যামেরা ও আলো ঢুকিয়ে দিয়ে অন্য ফুটো দিয়ে অ্যাপেনডিক্স কাটার যন্ত্র ঢোকানো হয়। মনিটরে ছবি দেখে সাবজেক্ট কেটে বার করা হয়। পেটের ভেতরে কোনো অর্গান যদি ওভারল্যাপিং অবস্থায় না থাকে তাহলে ওপেন করা হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে ওপেন করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে অপারেট করা হত আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে। যে এই কাজটা করেছে তার নিখুঁত ও নিয়মিত সার্জারি করা হাত। ওপেন সার্জারিতে সুপার স্পেশালিস্ট। তার প্রেসক্রিপশন দেখলাম। জেনেরিক নামে লিখেছেন। দুএকজন লিখলেও এখন সবাই ব্র্যান্ড নামেই লেখেন। হয়তো তিনি প্রাচীনপন্থী। তার হাতের লেখায়ও একই ছাপ। আমার ঠাকুরদার মতো হাতের লেখা। আগে বিভিন্ন কনভেন্ট স্কুলে হাতের লেখা শিক্ষা করানো হতো। তাতে ছাত্রদের লেখার একটা টাইপ তৈরি হত। এই লেখা সেই ধরনের। তবে।
কী তবে?
এই ডাক্তার সম্পর্কে একটা প্রতিমূর্তি আমার মনে তৈরি হয়েছে। উনি যেন চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, খুব বেশি হলে সত্তরের দশককে রিপ্রেজেন্ট করছেন। এটা আরো মনে হলো এই জন্যে যে একটি ডাক্তারি বানান উনি লিখেছেন যা ছিল পঞ্চাশ বছর আগে, এখন পরিবর্তিত।
হুমম, তাহলে তো ভূতের কীর্তি মনে হচ্ছে।
অপারেশনে দক্ষ এমন ভূত যদি আপনি ধরতে পারেন আমায় জানাবেন এসপি সাহেব। আমি নতুন যন্ত্রপাতিতে ট্রেনিং দিয়ে গাঁয়ে পাহাড়ে পাঠাবো। ওদের তো যেতে পয়সা ও সময় কিছুই লাগবে না। বলেই হাঁ হাঁ করে হেসে উঠলেন।
আরে সামনে কোনো ক্লু’ই নেই। কোনো মানুষ ডাক্তার এই অপারেশন করলে বলা যেতো যে সে আগের আমলের ডাক্তার। চুপিচুপি এসেছে আবার চলে গেছে। কিন্তু এলোই বা কোথা থেকে? আর গেলো কোথায়?
রহস্যভেদ করা আপনাদের কাজ। আমার নয়। ওটা আপনারা করুন। আমি আমার মতামত জানিয়েছি। এবারে আমি আমার অফিসে যাবো। কাজেই উঠবো।
দুই ডাক্তারকে ড্রপ করতে গাড়ি বেরিয়ে গেলো। এসপি সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, বাড়িতে জানিয়েছো?
নাহ স্যার। কাল নেটওয়ার্ক সমস্যা। আর আজ সকাল থেকেৃ।
তুমি দ্রুত বাবা-মা’কে এটুকু জানাও যে তোমার স্ত্রীর অ্যাপেনডিক্স অপারেশন হয়েছে হঠাৎ। দিন সাতেক বাদে ফিরে আসছো। ভয়ের কিছু নেই। আপাতত সব বেড়ানো নেমন্তন্ন খাওয়া বাদ। সবাইকে বাবা যেন জানিয়ে দেন।
ওরা বড্ড উদ্বিগ্ন হবেন।
তা বলে কি তুমি অপারেশনের কথা বলবে না? বলবে হয়ে গেছে, কোনো ভয়ের কারণ নেই। তবে এই ভূত-প্রেতের গল্পো বলো না।
না না সেসব কিছু বলবো না।
ইতোমধ্যে এসপি সাহেবের গাড়ি মস্ত এক টিফিন কেরিয়ার নিয়ে এসে পৌঁছলো। সাথে বাব

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়