করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

বঙ্গবন্ধুর নান্দনিক অনুভব

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধু সব বিচারেই ছিলেন নান্দনিক। ছিলেন গণমানুষের নেতা। নিরন্তর মানুষের কল্যাণের চিন্তায় থাকতেন নিমগ্ন। তবু চারপাশের সৌন্দর্য অবগাহনে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। এমনকি জেলে বসেও তিনি প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন তার শৈল্পিক চোখ দিয়ে। শরৎচন্দ্রের ‘আঁধারের রূপ’ তাঁকেও আকৃষ্ট করেছে। প্রতিদিন তিনি যেসব সৌন্দর্য অনুভব করেছেন তা তাঁর মনের ক্যামেরায় বন্দি হয়ে যেতো। তার প্রমাণ মেলে তাঁর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র পাতায় পাতায়। তাঁর নান্দনিকতা পিয়াসী মন প্রতি মুহূর্তের সৌন্দর্যবোধে পুলকিত হতো। রবীন্দ্রনাথের মতে আর্টের কাজই হচ্ছে, বিশ্বের যেটুকু আমাদের মনোহর করে সেইটুকু সযতেœ তার অন্য অংশ থেকে বিচ্ছন্ন করে আমাদের কাছে অবিমিশ্র উজ্জ্বল করে ধরা। সেই বিচারে বঙ্গবন্ধুও ছিলেন এক বড়মাপের শিল্পী। লেখক বঙ্গবন্ধুর কলমের ডগায় শিল্পীর আঁচড় টানার মতোই তাঁর নৈমত্তিক নান্দনিক অনুভূতির চমৎকার প্রকাশ ঘটতে দেখতে পাই। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ছাড়াও ‘আমার দেখা নয়া চীন’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’তেও নান্দনিক বঙ্গবন্ধুর স্বতঃস্ফূর্ত সৌন্দর্যবোধের আকর্ষণীয় প্রকাশ চোখে পড়ে।

প্রতি মুহূর্তের সৌন্দর্যবোধ
দুপুরের দিকে সূর্য মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতে শুরু করেছে। রৌদ্র একটু উঠবে বলে মনে হয়। বৃষ্টি আর ভালো লাগছে না। একটা উপকার হয়েছে আমার দূর্বার বাগানটার। ছোট মাঠটা সবুজ হয়ে উঠেছে। সবুজ ঘাসগুলো বাতাসের তালে তালে নাচতে থাকে। চমৎকার লাগে, যেই আসে আমার বাগানের দিকে একবার না তাকিয়ে যেতে পারে না। বাজে গাছগুলো আমি নিজেই তুলে ফেলি। আগাছাগুলোকে আমার বড় ভয়, এগুলো না তুললে আসল গাছগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন আমাদের দেশের পরগাছা রাজনীতিবিদ- যারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক তাদের ধ্বংস করে এবং করতে চেষ্টা করে। তাই পরগাছাকে আমার বড় ভয়। আমি লেগেই থাকি। কুলাতে না পারলে আরো কয়েকজনকে ডেকে আনি। আজ বিকেলে অনেকগুলো তুললাম। (‘কারাগারের রোজনামচা’ ২০১৮, বাংলা একাডেমি, পৃ. ১১৭)
এই যে গাছ-আগাছা, বাগান ও সমাজের রূপক বিচারে তার সৌন্দর্যবোধ ফুটে উঠেছে এ থেকেই তাঁর নান্দনিক ভাবনা রূপরেখা অনুমান করা যায়। তিনি শুধু বাগানের আগাছা পরিষ্কার করতে চাননি, সমাজের আগাছা দূর করতে চেয়েছিলেন, সমাজকেও বাগানের মতো করে সুন্দর করে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। সৌন্দর্যের চর্চা যিনি করেন তার প্রতি কর্মের মধ্যেই সেই ছাপ থাকবে। সৌন্দর্য যেহেতু ব্যক্তিত্বের প্রকাশ, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ব্যক্তিত্বের প্রকাশই যেহেতু শিল্প, সেহেতু শিল্প, সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্ব যেমন সমার্থক তেমনি সামগ্রিকও। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের সমগ্রতার মধ্যেই সৌন্দর্য চর্চার বিষয়টি অন্তর্গত ছিল। কামাল লোহানী তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘মানুষটাই নান্দনিক সুতরাং তিনি যা কিছু করবেন তার মধ্য নন্দনতত্ত্বের ছোঁয়া থাকবে সেটাই স্বাভাবিক।’
বহু ঝড়-ঝাপটার মধ্য দিয়ে তাঁর জীবন গেছে। কিন্তু কখনো জীবনের স্বাভাবিক সৌন্দর্যবোধ হারিয়ে ফেলার লক্ষণ তাঁর মধ্যে দেখা যায়নি। কারাগারে থেকেও যিনি অন্বেষণ করেন ‘অন্ধকারের রূপ’ তাঁর সম্পর্কে আর কী বলা যায়! কারাগারের রোজনামাচায় এক জায়গায় লিখছেন, জানালা দিয়ে অনেকক্ষণ বাইরে তাকাইয়া ছিলাম। দেখতে চেষ্টা করলাম ‘অন্ধকারের রূপ’, দেখতে পারলাম না। কারণ আমি শরৎচন্দ্র নই। আর তাঁর মতো দেখবার ক্ষমতা এবং চিন্তাশক্তিও আমার নাই। (কারাগারের রোজনামচা, ঐ, পৃ. ৮০)
এ কথা তিনি আরো কয়েক জায়গায় লিখেছেন, ‘আমি লেখক নই, সৌন্দর্য অনুভব করতে পারি, গুছিয়ে লিখতে পারি না’। ‘আমার দেখা নয়াচীন’-এ লিখেছেন, হংকংয়ের কাছে যখন গেলাম তখন মনে হতে লাগলো, আহা দূর থেকে দেখতে কী সুন্দর দেশ! পাহাড়ের উপর থেকে আস্তে আস্তে একটা দেশ নিচের সমুদ্র পর্যন্ত নেমে আসছে, মধ্যে মধ্যে নদী। একটা বাড়ি অনেক উপরে, একটা বাড়ি অনেক নিচে। সমুদ্রের পাড়ে জাহাজ ভিড়ে আছে, কোনো কোনো জাহাজ আবার ছেড়ে যাচ্ছে। আবার ছোট ছোট লঞ্চগুলো এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে।
আমি লেখক নই, আমার ভাষা নাই, তাই সৌন্দর্যটা অনুভব করতে পারছি, কিন্তু গোছাইয়া লেখতে পারি না। পাঠকবৃন্দ আমায় ক্ষমা করবেন। (‘আমার দেখা নয়াচীন’, শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলা একাডেমি, প্রথম প্রকাশ ১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, পৃষ্ঠা-২৪)
‘গোছাইয়া লিখতে পারি না’ বলেও তিনি যে কম কিছু গুছিয়ে লিখেছেন তা নয়। ‘আমার দেখা নয়াচীন’-এরই আরেক জায়গায় লিখেছেন, “সকালে আমরা বের হলাম দর্শনীয় স্থান দেখতে- যা দেখার যোগ্য। প্রথমেই আমরা গেলাম চীনের জাতীয়তাবাদী নেতা সান ইয়াৎ- সেনের কবর দেখতে এবং তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। আমরা ফুল কিনে নিলাম। সকলে তাঁর কবরে ফুল দিলাম। কবরটা শহর থেকে ২/৩ মাইল দূরে। অনেক উঁচু করে পাহাড়ের উপর কবরটা দেয়া হয়েছে। প্রায় ২শ সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে হয়। চারিদিকে ফুলের বাগান। ছোট ছোট গাছ। প্রায় ১ মাইলের ভিতর বাড়ি ঘর নাই। উপরে দাঁড়াইয়া এত সুন্দর মনে হয় যে তা ভাষায় প্রকাশ করা আমার পক্ষে কষ্টকর। কারণ আমি লেখক নই; অনুভব করতে পারি মাত্র, লেখার ভিতর দিয়া প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা খোদা আমাকে দেন নাই।” (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ৬৬)
প্রিয় পাঠক, তারপরও কি আমরা বঙ্গবন্ধুর সাথে একমত হবো যে তিনি কিছু গুছিয়ে লিখতে পারেন নাই! এর চেয়ে অপরূপ নিখুঁত বর্ণনা আর কী হতে পারে! পেশাদারি লেখকের মতোই তাঁর বর্ণনাভঙ্গি। নিঃসন্দেহে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে-বিদেশের মতোই হৃদয়গ্রাহী ভ্রমণ সাহিত্যের অংশ হবার দাবিদার বঙ্গবন্ধুর ‘আমার দেখা নয়াচীন’। এই বইতে তিনি একিট দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ, অর্থনীতি এবং মানুষকে তুলে এনেছেন। কী ঝকঝকে তাঁর ভাষা। সহজ সরল। নিজেকে লেখক হিসেবে দাবি না করার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর বিনয়ী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রখ্যাত লোক-গবেষক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান ‘বঙ্গবন্ধুর নান্দনিক ভাবনা’ বিষয়ক আমার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “বঙ্গবন্ধু যদি শুধু লেখকই হতেন তাহলেও সফল লেখক হতেন। তাঁর লেখার হাত পেশাদারি লেখকের মতোই। দুঃখের বিষয় তিনি আরো বেশি লিখলেন না।” আমাদের দুর্ভাগ্য তিনি তাঁর জীবদ্দশায় মাত্র তিনটি গ্রন্থই লিখে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন। আবার সৌভাগ্যও যে, তিনটি গ্রন্থই শেষ পর্যন্ত আমাদের হাতে আসতে পেরেছে। এর জন্য প্রথমেই ধন্যবাদ প্রাপ্য বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনিই কারাগারে খাতাগুলো পাঠিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘বসেই তো আছো, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী’। এরপর অশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ভাগ্যক্রমেই তিনি চারখানা খাতা হাতে পেয়েছিলেন। খাতাগুলো এত জীর্ণ হয়ে পড়েছিল যে সেগুলোর অর্থ উদ্ধার করতেও প্রচুর বেগ পেতে হয়েছে। অবশেষে তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায়, পরম যতেœ তিনটি গ্রন্থ এ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখতে পেরেছে। বঙ্গবন্ধু যে বড়মাপের লেখক ছিলেন তার পরিচয় আমরা পাই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়া চীন’ পড়ে। এমন ঝরঝরে ভাষায় তথ্যবহুল তিনটি বই উপহার দিয়েছেন বলেই এক বহুমাত্রিক বঙ্গবন্ধুর সন্ধান পাই আমরা। তিনটি গ্রন্থই ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণামূলক হলেও একটি মানুষের, একজন বিশ্বনেতার বিশ্ব দেখার দৃষ্টিভঙ্গি এর মধ্যে স্পষ্টতই প্রকাশিত।
চীনে যখন তিনি প্রথম যান তখন তাঁর বয়স ৩২। একজন তরুণ নেতা নতুন দেশে গেছেন, সেই দেশ সম্পর্কে কিছু খোঁজ-খবর নিবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কতদূর বিস্তৃত হতে পারে সেই অন্বেষণ? একজন পেশাদারি লেখকের মতোই তিনি নতুন দেশটিতে পা রেখেই তার সম্পর্কে গবেষণা শুরু করলেন। নয়াচীনের শিক্ষাপদ্ধতি, চিকিৎসাব্যবস্থা, শ্রমিকদের অবস্থা, নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা, কৃষি, শিল্প সব কিছু সম্পর্কেই তিনি খবরাখবর নিতে শুরু করলেন। সাধারণ মানুষের মনের অবস্থা জানার তাঁর নিরন্তর প্রচষ্টা দেখে সত্যি অবাক হতে হয়।
যেমন তিনি সাধারণ মানুষের খবর জানার জন্য উদগ্রীব ছিলেন তেমন উদগ্রীব ছিলেন সৌন্দর্য উপভোগের জন্যও। কোথাও কোথাও প্রকাশ পেয়েছে আবার অক্ষমতাও। ‘আমার দেখা নয়াচীন’-এ লিখেছেন, “কয়েকটা দোকানে মাছ বিক্রি করে। খাবার মাছ নয়, শৌখিন মাছ। ছোট ছোট কাচের পাত্রে রঙিন মাছগুলো রাখা হয়েছে। এক এক পাত্রে তিন চার রঙের মাছও রয়েছে। ইচ্ছা হলো কিনি, কিন্তু কিনে কী করবো! কোথায় চীন আর কোথায় পূর্ব বাংলা! নিতে যা খরচ হবে তা আমার দেওয়ার ক্ষমতা নাই। আর ভাড়া দিয়া নেবার মতো টাকাও নাই। রাখার মতো বাড়ি নাই। আর দেখভাল করার মতো লোকও নাই। কারণ সকল জিনিসেরই জন্য টাকার প্রয়োজন। ওইটার অভাবই আমার বেশি।” (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৮০)
অর্থনৈতিক অক্ষমতা থাকলেও মানবিক উদারতার তাঁর কোনো কমতি ছিল না। ওই নয়াচীনে ঘুরতে গিয়েই তিনি হঠাৎ এক মুশকিলে পড়ে গেলেন। বেড়াতে গিয়েছিলেন এক শ্রমিকের বাড়ি, গিয়ে জানলেন স্বামী বাড়িতে নেই। স্ত্রীর কাছ থেকে জানলেন তারা সম্প্রতি বিয়ে করেছে। এখন কোনো উপহার না দিয়ে তিনি আসেন কী করে! তাঁদের কী আপ্যায়ন করছে চীনের জনসাধারণ। “ইলিয়াসকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোর কাছে কিছু আছে? বললো, না। ফজলুল হককে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার কাছে কিছু? বললো, না। একটু সুবিধা ছিল বাংলা ও উর্দুতে কথা বললে বোঝার উপায় নেই। আমি ভাবছিলাম, হঠাৎ আমার হাতের দিকে খেয়াল পড়লো- দেখি আমার তো একটা আংটি আছে। আমি খুলে সেই শ্রমিকের স্ত্রীকে উপহার দিলাম। দোভাষীকে বললাম, পরাইয়া দিতে। কিছুতেই গ্রহণ করতে চায় না, তারপর নিলো।” (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৭২)
এটা শুধু সৌজন্যেরই প্রকাশ নয়, সৌন্দর্যেরই বহিঃপ্রকাশ। সৌন্দর্যবোধ যার নেই তার মধ্যে সৌজন্যই-বা আসবে কোত্থেকে! অক্ষমতাকে তিনি তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তাদ্বারা অসামান্য প্রীতির সম্পর্কে আবদ্ধ করলেন। প্রীতির চেয়ে সুন্দর আর কী আছে এ জগতে, মানবচরিত্রে! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন ধরেই সে প্রীতিময় সম্পর্ক গড়েছেন সবার সঙ্গে। তাই তো লিখতে পেরেছেন, “একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি।”

নান্দনিকতা পিয়াসী মানসলোক
বঙ্গবন্ধুর নিজের রচনায় তাঁর মানসলোকের প্রথম পরিচয় আমরা পাই তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়ে। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বঙ্গবন্ধুর প্রথম রচিত গ্রন্থ হলেও বই আকারে এটি আমাদের হাতে আসে সবার শেষে। এর আগেই, ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ- ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় গ্রন্থ-‘কারাগারের রোজনামচা’। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ প্রকাশিত হয় ২০২০ সালের একুশে বইমেলার প্রথম দিন।
‘আমার দেখা নয়াচীন’-এর তুলনায় ‘অসামাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামাচা’ অনেক বেশি গভীর, বৈচিত্র্যময়। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ তিনি লিখেন ১৯৫৪ সালে, কারাগারে রাজবন্দি থাকাকালে। তখন তাঁর বয়স ৩৪। তবে বঞ্চিতজনের মুক্তির প্রসঙ্গ এই বইটিতে অনেক বেশি প্রাঞ্জলভাবে এসেছে। ‘কারাগারের রোজনামচা’ আর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ লিখেন ১৯৬৬-৬৯ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দি থাকাকালে। তখন তিনি জীবনের মধ্যসায়াহ্নে পৌঁছেছেন। বয়স প্রায় ৫০। বিষয়ের কারণেই ‘কারাগারের রোজনামাচা’-এ প্রাধান্য পেয়েছে একটা নির্দিষ্ট সময়ের দৈনন্দিন জীবনযাপনের বর্ণনা। এ রোজনামচার সময়কাল ২ জুন ১৯৬৬ থেকে ২২ জুন ১৯৬৭ পর্যন্ত। আর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র বিস্তার তাঁর ছোটবেলা থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত। তাঁর পারিবারিক, রাজনৈতিক জীবন যেমন, তাঁর অন্তর্লোকেরও পরিপূর্ণ পরিস্ফূটন ঘটেছে এ-গ্রন্থে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে পুরো জীবনের একটা বিস্তৃত বিবরণ তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। দুর্ভাগ্যবশত পূর্ণ-আত্মজীবনী তিনি শেষ করে যেতে পারেননি।
‘আমার দেখা নয়াচীন’ যেমন কিছুটা ডকুমেন্টারি ঢং-এ লেখা, ‘কারাগারের রোজনামচা’ আর ‘অসামাপ্ত আত্মজীবনী’র রচনাভঙ্গি একটু ভাব-গাম্ভীর্য বজায় রেখে। তাছাড়া ‘আমার দেখা নয়াচীন’ একটি আকর্ষণীয় ভ্রমণ সাহিত্য হতে পেরেছে এই মেজাজের জন্যই। আর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ তাঁর জীবনের প্রতিচ্ছবি। ‘কারাগারের রোজনামচা’ তাঁর জীবনের খতিয়ান! সৌন্দর্যদর্শনের চেয়েও ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। আর কারাগার তো সৌন্দর্যদর্শনের জায়গাই না। অসহনীয় মানবেতর জীবন সেখানে। তাও কী আশ্চর্য, কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠেও হানা দেয় তাঁর জীবনের অপরূপ আলো! জেলখানায় বন্দি থাকা অবস্থায় তিনি ফুলের বাগান করেছেন। পায়রা পুষেছেন। পাখিদের খাবার দিয়েছেন। সহযোদ্ধাদের সাথে প্রীতিময় সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। আর নিজে ভালোমন্দ রান্না করে খেয়েছেন ও সহ-বন্দিদের খাইয়েছেন। কখনো শিশুর মতো সারল্যে বর্ণনা করেছেন জীবনের রূপ। অপরিসীম কৌতূহলের সাথে দেখেছেন কারাগারের বৈচিত্র্যময় জীবন। সৌন্দর্যপ্রিয় এ মানুষটির চোখ থেকে সুন্দর কখনো আড়াল সৃষ্টি করেনি। আলোচ্য অধ্যায়ের শুরুর অংশটি পুনর্বার স্মরণযোগ্য। কারাগারের জানালা দিয়ে তিনি ‘অন্ধকারের রূপ’ দেখেছেন। সারাজীবন ধরেই তিনি অন্ধকারের ভিতর দিয়ে জীবনের রূপ অন্বেষণ করে গেছেন। ঝুঁকি নিয়েই তিনি আলোর সন্ধান করেছেন। তাই তো ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দিল্লিতে বলতে পেরেছিলেন তিনি ‘অন্ধকার থেকে আলোর’ পথযাত্রী।
কারাগারের একঘেয়েমির জীবনকে তিনি সহনীয় করে নিয়েছিলেন নানাজনের সাথে গল্প করে, বাগান করে, বই পড়ে, রান্না করে। কারাগারের বাইরে থাকলেও মানুষ একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হয়। আধুনিক এ-সময়ে একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা, একঘেয়েমি বড় মারাত্মক রোগ। একাকিত্ব, একঘেয়েমিতা অনেকের মধ্যে অবসাদ, বিষণ্নতা, হতাশারও জন্ম দেয়। এসব থেকে পালানোর জন্য অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে ফেলে। বর্তমান পৃথিবীর এ এক জটিল সংকট। এর জন্য পশ্চিমা দেশে অনেককে নিয়মিত মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হয়, নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। মানসিক দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য প্রচুর বইপুস্তকও রচিত হচ্ছে। সত্যি বলতে ধর্ম-দর্শন-মনস্তত্বের অনেক বই শুধু মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্যই রচিত। একাকিত্ব, একঘেয়েমিয়তা কাটানোর জন্য বইপড়া, বাগান করা, রান্না করা এক প্রকার শৈল্পিক কাজ হিসেবেই বিবেচিত হয় এখন। অর্থাৎ সেই সৌন্দর্যবোধেরই প্রকাশ এর মধ্যে নিহিত। কারাগারের নিভৃতজীবনে বঙ্গবন্ধু স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এসব বেছে নিয়েছিলেন। তাই দেখা যায় দীর্ঘ কারাভোগেরও পরও তিনি মানসিকভাবে কখনো ভেঙে পড়েননি। কখনো কখনো শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়েছেন। কিন্তু তাঁর মানসিক শক্তি সব সময়ই ছিল অটল, অনড়। বঙ্গবন্ধুর নানা দিক নিয়ে নানাজন আলোচনা করেন। তাঁর যে এই সুস্থির, দৃঢ় মনোবল এ-নিয়েও স্বতন্ত্র্য আলোচনা করা যায়। একজন মহান নেতার কাছ থেকে এও এক শিক্ষণীয় বিষয়। টাঙ্গাইলের শামসুল হক কিন্তু জেলখানায় থাকতে থাকতেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক।
কারাগারে বঙ্গবন্ধু কীভাবে সময় কাটাতেন তার খুটিনাটি বর্ণনা দিলে সেখানেও তাঁর সৌন্দর্য-অন্বেষণের বিস্ময়কর সব উপাদান খুঁজে পাওয়া যাবে। ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের শুরুতে তিনি যে জেলখানার কয়েকটি শব্দকোষের বর্ণনা দিয়েছেন তা পড়লে কে না বুঝবে যে, জীবনতৃষ্ণা যার গভীর নয় তিনি কোনোদিনই এসবের নিখুঁত বর্ণনা দিবেন না। ‘রাইটার দফা’, ‘চৌকি দফা’, ‘জলভরি দফা’, ‘ঝাড়– দফা’, ‘বন্দুক দফা’, ‘পাগল দফা’, ‘শয়তানের কল’, ‘দরজি খাতা’, ‘মুচি খাতা’, ‘হাজতি দফা’, ‘ডালচাকি দফা’, ‘আইন দফা’ ইত্যাদি দফার বর্ণনা শুধু যে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপ তাই নয়, অনেক সরস-কৌতুকমিশ্রিত। এসবের কারণেই তাঁর এ বইটি অনন্য এক কারা সাহিত্যে রূপান্তরিত হতে পেরেছে। তিনি শুধু যে দীর্ঘকাল জেলে থাকার দরুণই তিনি এসব জেনেছেন তাই নয়, বোঝা যায় রসিয়ে রসিয়ে এসব গাল-গল্প তিনি শুনেছেন এবং আত্মস্থ করেছেন।
শুধু কি শব্দকোষ? এই শব্দকোষ তৈরি করেছে যেসব জেলের অধিবাসী তাদের কথাও রয়েছে এই বইতে। তিনি তাদের কথা লিখেছেন দরদ দিয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁর সাথে যুক্ত থাকা বা আশপাশের কয়েদিদের দুঃখ-ভরা জীবনের কাহিনী শুনতেন। তাদের সেসব কথাও স্থান পেয়েছে এই বইতে। মনে হয় এরা তাঁর কতই না আপনজন। উদাহরণ হিসেবে ‘লুদু’র কথা বলা যায়। ১৯৫০ সালে যখন জেলে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু, তখন পরিচয় হয় লুদু ওরফে লুৎফর রহমানের সঙ্গে। ১৯৫৪ ও ১৯৫৮ সালেও তাকে তিনি দেখেছেন জেলে। ১৯৬৬-তেও এসে পান তাকে। তার গল্প তিনি লিখেছেন অসীম মমতায়। চুরি ও পকেটমারাকে কেন পেশা হিসেবে নিয়েছিল লুদু? তার বাবার সাত বিয়ে ও নানা বদভ্যাসের ফসল লুদু। নানা বাড়ির পাশের বাড়ির গোপাল নামের এক যুবকের কাছে তার চুরি বিদ্যায় হাতেখড়ি। এরপর একা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লো লুদু। থানার পুলিশ ও দারোগার সাথে ‘দেখা সাক্ষাৎ করে’ কী করে আরো বড় পকেটমার হয়ে উঠলো সে কাহিনী বঙ্গবন্ধুর বইতে ফুটে উঠেছে। এরপর জিআরপি, সিআইডিসহ পুলিশের নানা পর্যায়ে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ‘বন্দোবস্ত’ করতে পারেনি এমন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ফের লুদু জেলে। জেলের ভেতরেও রয়েছে অপরাধ জগত। সেই জগতেরও পাকা সদস্য লুদু। গলায় ‘খোকড়’ কেটে জেলখানা থেকে বের হয়ে নানা জায়গায় পকেটমারি করে। ফের ধরা পড়ে। মাঝখানে বের হয়ে বিয়েও করেছে লুদু। তার স্ত্রীর জন্যে খুব মায়া অনুভব করে লুদু। একটা ছেলে ছিল। সেও মারা গেছে। লুদুর চিন্তা কী করে বাঁচবে তার স্ত্রী। ‘জীবনের উপর একটা ধিক্কার এসেছে’ লুদুর। এইভাবে একেবারে সাধারণ এক অপরাধীর কষ্টের কথা সযতেœ তুলে এনেছেন বঙ্গবন্ধু তাঁর লেখায়। লুদুর জীবন নিঃসন্দেহে মর্মান্তিক, কিন্তু, সেই জীবন তুলে আনার শিল্পী যিনি তিনি সুন্দরেরই সাধক। লুদুর জীবনকাহিনী তিনি আমাদের শুনিয়েছেন সুন্দরেই বাসনায়, যেন আর কারা জীবন লুদুর মতো না হয়। কবি-সাহিত্যিক যেমন জীবনের করুণকাহিনী লিখেই শিল্পী হন তেমনি বঙ্গবন্ধুও এখানে এক মহান শিল্পী বটেই।
তার শিল্পীর চোখ কতখানি গভীর তা জানা যাবে ১৪ জুন ১৯৬৬ সালের দিনলিপিটা পড়লে। তিনি লিখেছেন-“ভোরের দিকে বৃষ্টি হতেছিল। তাড়াতাড়ি উঠেছি জানালা বন্ধ করতে। বিছানা ভিজে যাবে। উঠে দেখি মেট উঠে জানালা বন্ধ করেছে। আমি আবার শুয়ে পড়লাম, বিজলি পাখা বন্ধ করতে বললাম, কারণ বেশ একটু ঠাণ্ডা পড়েছে। আবার ঘুমাইয়া পড়লাম, উঠতে অনেক দেরি হয়ে গেল। উঠেই দেখি চা প্রস্তুত। খেয়ে বাইরে হাঁটতে বেরুলাম। মুরগিটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাকে যেন কি কি ওষুধ খাইয়েছে বাবুর্চি। বলল, একটু ভালো। আমাকে বলল, মোরগটা জবাই দিয়ে ফেলি। বললাম, না দরকার নাই। ও বেশ বাগান দিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ওর চলাফেরার ভঙ্গিমা দেখে আমার ভালো লাগে।” (কারাগারের রোজনামচা, ঐ, পৃষ্ঠা-৮৮)
পড়লে প্রথমে মনে হতে পারে এ এক মামুলি ব্যাপার। প্রাত্যাহিক দিনের এক বিবরণ। কিন্তু, একটু খুটিয়ে পড়লেই এর থেকে অনেক কিছু আবিষ্কার করা যাবে। ভোগান্তির মধ্য দিয়েও তিনি একটি মোরগের সৌন্দর্য উপভোগের কথা ভাবছেন। মোরগটা না খেয়ে ফেলে তার বুক ফোলানো হাঁটা দেখবেন! রসিক শিল্পী না হলে কেউ এমন বর্ণনা দেয়! তিনি নিজেও যে বিরাট স্বাধীনচেতা এক মানুষ। তিনিও মাথা উঁচু করে বুক ফুলিয়ে হেঁটেছেন আজীবন।
কিছু কিছু দিনলিপি পড়লে মনে হবে নিছক রোজনামচা না, হুবহু যেন উপন্যাসের বর্ণনা। যেমন ১১ জুন ১৯৬৬ সালে লিখছেন, “জেলার সাহেবকে খবর দিলাম, আমি দেখা করতে চাই। তিনি খবর পাঠালেন নিজেই আসবেন দেখা করতে। তিনিও শুনেছেন মায়ের অবস্থা ভালো না। বাইরে বসে দেখতে লাগলাম, একটা মোরগ একটা মুরগি আর একটা বাচ্চা মুরগি আপন মনে ঘুরে ঘুরে পোকা খেতেছে। আমার বাবুর্চি খাবার থেকে কোনোমতে কিছু কিছু বাঁচাইয়া এই কয়টা মুরগি যোগাড় করেছে। ছোট ছোট যে মাঠগুলো পড়েছিল আমার ওয়ার্ডে সেগুলোতে দূর্বা ঘাস লাগাইয়া দিয়াছিলাম। এখন সমস্ত মাঠটি সবুজ হয়ে উঠেছে। বৃষ্টি পেয়ে তাড়াতাড়ি বেড়ে চলেছে। দেখতে বড় সুন্দর হয়েছে জায়গাটি। এরই মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় মুরগিগুলো। অনেকক্ষণ বসে রইলাম। ফুলের গাছ চারদিকে লাগাইয়াছিলাম, নতুন পাতা ছাড়তে শুরু করেছে। বড় চমৎকার লাগছে। আজকে সূর্যের জোর নাই, বেশ মেঘলা দিন। খুবই বাতাস বইছে।” (কারাগারের রোজনামচা, ঐ, পৃ. ৮০)
একদিকে তাঁর মায়ের অসুস্থতার জন্য তাঁর মন খারাপ, বাইরে বসে আছেন জেলারের অপেক্ষায়, এর মধ্যেও প্রকৃতির প্রতি তার কী গভীর মনোযোগ! মন খারাপের ক্লান্তিকর সময়টুকু সৌন্দর্য উপভোগের মধ্য দিয়েই অতিবাহিত করছেন। নিজের হাতে মাঠে ঘাস লাগিয়েছেন। সেই ঘাস যে সবুজ হয়ে উঠেছে তার কাব্যিক বর্ণনা দিয়েছেন। ফুলের গাছ লাগিয়েছিলেন, নতুন পাতা ছাড়তে শুরু করেছে। আজ সূর্যের জোর নাই, মেঘলা দিন, বাতাস বইছে খুব, সমগ্র প্রকৃতির সঙ্গে যেন তিনি এক হয়ে গেছেন। সত্যিই তো, প্রকৃতির সঙ্গে এক না হলে সেই বিষণ্ন নিঃসঙ্গ দিন তিনি কীভাবে পার করতেন! এটাই তো তাঁর গভীর শৈল্পিক মনের পরিচয়। যখন পাশে কেউ নেই তখন মুরগির ছানা, দূর্বা ঘাস, ফুল গাছের নতুন পাতা, বাতাস, মেঘ তাঁর বন্ধু। প্রকৃতির ভালোবাসায় তিনি আপ্লুত।
কারাগারে তাঁর সময় কাটতো না। ১৯৬৬ সালের ১৫ জুন-এর দিনলিপিতে এ কথা লিখেছেনও, “সময় কাটছে না, খবরের কাগজ পাঠাতে দেরি করছে। বসে আছি গেটের দিকে চেয়ে, কখন আসে, ১২টা, ১টা, ২টা বেজে গেল- কাগজ এল না।” (কারাগারারের রোজনামচা, ঐ, ৯১ পৃ.)।
১৮ জুন ১৯৬৬ সালে লিখছেন, “সূর্য উঠেছে। রৌদ্রের ভিতর হাঁটাচলা করলাম। আবহাওয়া ভালোই। তবুও একই আতঙ্ক- ইত্তেফাকের কি হবে! সময় আর কি সহজে যেতে চায়। সিপাহি, জমাদার, কয়েদি সকলের মুখে একই কথা, ‘ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ করে দিয়েছে।’
ঘরে এসে বই পড়তে আরম্ভ করলাম। এমিল জোলার-র লেখা ‘তেরেসা রেকুইন’ (তেরেসা রেকুইন) পড়ছিলাম। সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনটা চরিত্র- জোলা তাঁর লেখার ভিতর দিয়া। এই বইয়ের ভিতর কাটাইয়া দিলাম দুই তিন ঘণ্টা সময়।” (কারাগারারের রোজনামচা, ঐ, পৃ. ১০১)
আবার ১৯ জুন ১৯৬৬ সালের রবিবার দিন লিখছেন, “আমি বই নিয়ে বসে পড়লাম। মনে করবেন না বই নিয়ে বসলেই লেখাপড়া করি। মাঝে মাঝে বইয়ের দিকে চেয়ে থাকি সত্য, মনে হবে কত মনোযোগ সহকারে পড়ছি। বোধ হয় সেই মুহূর্তে আমার মন কোথাও কোনো অজানা অচেনা দেশে চলে গিয়েছে। নতুবা কোনো আপনজনের কথা মনে পড়েছে। নতুবা যার সাথে মনের মিল আছে, একজন আর একজনকে পছন্দ করি, তবুও দূরে থাকতে হয়, তার কথাও চিন্তা করে চলেছি। হয়তো বা দেশের অবস্থা, রাজনীতির অবস্থা, সহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের কাহিনী নিয়ে ভাবতে ভাবতে চক্ষু দুটি আপনা আপনি বন্ধ হয়ে আসছে। বই রেখে আবার পাইপ ধরালাম।” (কারাগারের রোজনামচা, ঐ, পৃ. ১০৭)
বইয়ে মন বসছে না। কারাগারের নিভৃত-নির্জন কোণে আনমনা হয়ে বসে ভাবছেন প্রিয় বন্ধুর কথা, সহকর্মীদের কথা। আপনজনের কথা। কোথায় তারা আজ সব? বাড়ির লোকজন কে কোথায় আছে তার খবরও তো ইচ্ছে হলেই জানতে পারছেন না। বসে বসে তাদের কথা ভাবা ছাড়া আর কী করার আছে? ঠিক যেন কোনো উপন্যাসের চরিত্র! প্রিয়জনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন। এর মধ্যে বহুপথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন, পাড়ি দিতে হবে আরো বহুপথ। মাঝে কিছুদিন তাঁর কেটে যাচ্ছে স্মৃতিকাতরতায়। স্মৃতিকাতরতা বেদনার, কিন্তু এর চেয়ে মধুরই-বা জীবনে কী আছে? দুদণ্ড অবসর না পেলে মানুষ কী করে ভাবতে পারে তার স্মৃতিবিজরিত দিনগুলোর কথা! বঙ্গবন্ধুর অবসর সময় ওই কারাগারেই যা, জেলখানার বাইরে যতদিন থেকেছেন খালি তো ছুটেছেন। পুরো স্বদেশকেই তাই তো এমন করে বুকে ধারণ করে কাটিয়েছেন।
এই অবসরে তিনি বন্ধুত্ব গড়েছেন গাছের সঙ্গে, পাখির সঙ্গে। ১৯৬৭ সালের ১১-১৩ এপ্রিল তাঁর দিনলিপির কিছু অংশ পড়া যাক: “সিভিল ওয়ার্ডের সামনে ছোট একটা মাঠ আছে। সেখানে কয়েকটা আম গাছ আছে। ফুলের বাগান করেছি। জায়গাটা ছাড়তে ইচ্ছে হয় না। আবার কোথায় দিবে ঠিক কি? রাতে যখন ঘুমাতে পারি না তখন মনে হয় আর এখানে থাকবো না। সকাল বেলা যখন ফুলের বাগানে বেড়াতে শুরু করি তখন রাতের কষ্ট ভুলে যাই। গাছতলায় চেয়ার পেতে বসে কাগজ অথবা বই পড়ি। ভোরের বাতাস আমার মন থেকে সকল দুঃখ মুছে নিয়ে যায়। আমার ঘরটার কাছের আম গাছটিতে রোজ ১০টা-১১টার সময় দুইটা হলদে পাখি আসে। ওদের খেলা আমি দেখি। ওদের আমি ভালোবেসে ফেলেছি বলে মনে হয়। ১৯৫৮ সালে দুইটা হলদে পাখি আসত। তাদের চেহারা আজো আমার মনে আছে। সেই দুইটা পাখির পরিবর্তে আর দুইটা পাখি আসে। পূর্বের দুইটার চেয়ে একটু ছোট মনে হয়।
১৯৫৮ থেকে ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাখি দুইটা আসত। এবার এসে তাদের কথা আমার মনে আসে, আমি খুঁজতে শুরু করি। এবারও ঠিক একই সময় দু’টা হলদে পাখি এখানে আসত। মনে হয় ওদেরই বংশধর ওরা। তারা বোধ হয় বেঁচে নাই অথবা অন্য কোথাও চলে গিয়াছে। ১০টা-১১টার মধ্যে ওদের কথা এমনি ভাবেই আমার মনে এসে যায়। চক্ষু দুইটা অমনি গাছের ভিতর নিয়া ওদের খুঁজতে থাকি। কয়েকদিন ওদের দেখতে পাই না। রোজই আমি ওদের খুঁজি। তারা কি আমার উপর রাগ করে চলে গেল? আর কি ওদের আমি দেখতে পাব না? বড় ব্যথা পাব ওরা ফিরে না আসলে। পাখি দুইটা যে আমার কত বড় বন্ধু যারা কারাগারে একাকী বন্দি থাকেন নাই তারা বুঝতে পারবেন না। আমাকে তো একেবারে একলা রেখেছে। গাছপালা, হলদে পাখি, চড়–ই পাখি আর কাকই তো আমার বন্ধু এই নির্জন প্রকোষ্ঠে।” (কারাগারের রোজনামচা, ঐ, পৃ. ২১৮-২১৯)

স্বতঃস্ফূর্ত সৌন্দর্যবোধ-তাড়িত মহামানব
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ টানা গদ্যে লেখা। কখনো কখনো মনে হয় এক দমে লেখা। কোথাও দিন-তারিখ উল্লেখ নেই। সাল উল্লেখ আছে। একই সালে কত ঘটনা! তিনি একটানা বলে যাচ্ছেন। বিশাল-বিপুল বৈচিত্র্যময় জীবন তাঁর। সেই ছোটবেলা থেকে তাঁর জীবনকাহিনী শুরু করে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত এসেছেন। তাতে বইয়ের পৃষ্ঠা ব্যয় হয়েছে মাত্র ২৮৮টি। তাঁর কর্মময় জীবনের তুলনায় সামান্যই বলা যায়। সুন্দর দেখার, কিংবা, আলাদা করে সৌন্দর্য নিয়ে মাতামাতি করার অবসর তাঁর ছিল না। সুন্দর প্রসঙ্গে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে পৃষ্ঠা ব্যয় হয়েছে কমই। তবুও জীবনতৃষ্ণার চাতক তিনি, ব্যস্ততার ফাঁকে চোক্ষে তাঁর ধরা দিয়েছে অধরা মাধুরী।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তাঁর অতুলনীয় সৌন্দর্যবোধের পরিচয় পাই মোঘলদের স্থাপত্য শিল্প ফতেহপুর সিক্রির যে অপরূপ বর্ণনা দিয়েছেন তার মধ্য দিয়ে। আগ্রা দুর্গ, মতি মসজিদ, নাগিনা মসজিদ, দিল্লির লালকেল্লা, তানসেনের বাড়ি, যোধাবাঈয়ের মহল একেবারে চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাজমহলের বর্ণনা দিয়েছেন তিন পৃষ্ঠা জুড়ে, ‘তাড়াতাড়ি আমরা গোসল করে কিছু খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম, মন মানছে না, তাজ দেখার উদগ্র আগ্রহ। টাঙ্গা ভাড়া করে তাজ দেখতে রওনা করলাম। প্রখর রৌদ্র। কি দেখলাম ভাষায় প্রকাশ আমি করতে পারব না। ভাষার উপর আমার সে দখলও নাই। শুধু মনে হলো, এও কি সত্য! কল্পনা যা করেছিলাম, তার চেয়ে এ অনেক সুন্দর ও গাম্ভীর্যপূর্ণ।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ২০১৯, ইউপিএল পৃ. ৫৭)
রাতের তাজের সৌন্দর্য দেখার জন্য তারা সারাদিন ওখানেই থেকে গিয়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে সেদিন পূর্ণিমা ছিল। পূর্ণিমার আলোতে ভেসে যাওয়া তাজমহলের সৌন্দর্য নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘সন্ধ্যার একটু পরেই চাঁদ দেখা দিল। চাঁদ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসছে আর সাথে সাথে তাজ যেন ঘোমটা ফেলে দিয়ে নতুন রূপ ধারণ করেছে। কি অপূর্ব দেখতে! আজো একুশ বছর পরে লিখতে বসে তাজের রূপকে আমি ভুলি নাই, আর ভুলতেও পারব না।’ (প্রাগুক্ত- পৃ. ৫৯)।
দিল্লি তিনি গিয়েছিলেন ১৯৪৬ সালে এপ্রিল মাসে। দিল্লিতে তখন জিন্নাহ সাহেব সমস্ত ভারতবর্ষের মুসলিম লীগপন্থি কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের কনভেনশন ডেকেছিলেন। তার চার মাস পরেই আগস্টের ১৬ তারিখ কোলকাতায় সংঘটিত হলো ভয়াবহ দাঙ্গা। সেই বীভৎস দৃশ্যও তাঁকে চোখের সামনে দেখতে হলো। তার করুণ বর্ণনা দিয়েছেন ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। কলকাতায় দাঙ্গা বন্ধ হতে না হতেই আবার দাঙ্গা শুরু হলো নোয়াখালীতে। ঢাকায় তো দাঙ্গা লেগেই আছে। সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে দাঙ্গা দমনে তিনি নানা জায়গায় ছুটে বেড়াতে লাগলেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে কলকাতায় খুলেছিলেন লঙ্গরখানা, এবার দাঙ্গার সময় মোহাজেরদের রক্ষার জন্য খুললেন বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প। মানুষ খেয়ে না খেয়ে থাকে, তিনি মানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, সুন্দর দেখার সময় কোথায়! এর এক বছর পরেই দেশভাগ হলো, তিনি কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পক্ষে আন্দোলন করায় সেখান থেকেও বহিষ্কৃত হলেন। যোগ দিলেন সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে। তারপর থেকে শুধু ছুটে চলা আর ছুটে চলা। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এক দমে তিনি ‘ভাষা-আন্দোলন’, ‘দাওয়াল-আন্দোলন’ ‘জিন্নাহ ফান্ড’-এর বর্ণনা দিয়ে যান। এক মুহূর্ত অবসরের, একটু সুন্দর সময় কাটানোর সময় হয় তাঁর ১৯৪৯ সনের ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে গিয়ে। এ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার নবীনগর থানার কৃষ্ণনগরে জনাব রফিকুল হোসেন এক সভার আয়োজন করেন। সেখানে গিয়েই দেখা হয়েছিল তাঁর কিংবদন্তিতুল্য গায়ক আব্বাসউদ্দিন আহম্মদের সাথে ফেরার পথে। নদীতে নৌকায় বসে আব্বাসউদ্দিনের গান শুনে তিনি যে অবিস্মরণীয় মন্তব্য করেছিলেন তা আজ বঙ্গবন্ধুর সৌন্দর্যবোধ প্রসঙ্গে উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে শিল্পী-সাহিত্যিকদের মুখে মুখস্ত বুলির মতো ফেরে। তাঁর মুখ থেকেই জানা যাক আব্বাসউদ্দিনের গানের তিনি কেমন পাগল ছিলেন, আর কী অপূর্ব উপমাতেই না তিনি তা প্রকাশ করেছিলেন। “আমরা উপস্থিত হয়ে দেখলাম এন এম খান ও আব্বাসউদ্দিন সাহবকে দেখবার জন্য হাজার হাজার লোক সমাগত হয়েছে। বাংলার গ্রামে গ্রামে আব্বাসউদ্দিন সাহেব জনপ্রিয় ছিলেন। জনসাধারণ তাঁর গান শুনবার জন্য পাগল হয়ে যেত। তাঁর গান ছিল বাংলার জনগণের প্রাণের গান। বাংলার মাটির সাথে ছিল তাঁর নাড়ির সম্বন্ধ। দুঃখের বিষয়, সরকারের প্রচার দপ্তরে তাঁর মতো গুণী লোকের চাকরি করে জীবিকা অর্জন করতে হয়েছিল। সভা শুরু হলো, রফিকুল হোসেন সাহেবের অনুরোধে আমাকেও বক্তৃতা করতে হলো। আমি জনাব এন এম খানকে সম্বোধন করে বক্তৃতায় বলেছিলাম, “আপনি দেশের এদেশের অবস্থা জানেন। বহুদিন বাংলাদেশে কাজ করেছেন, আজ ফুড ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর জেনারেল আপনি, একবার বিবেচনা করে দেখেন এই দাওয়ালদের অবস্থা এবং কি করে এরা বাঁচবে! সরকার তো খাবার দিতে পারবে না- যখন পারবে না, তখন এদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতেছে কেন?” দাওয়ালদের নানা অসুবিধার কথা বললাম, জনসাধারণকে অনুরোধ করলাম, স্কুলকে সাহায্য করতে। জনাব খান আশ্বাস দিলেন তিনি দেখবেন, কিছু করতে চেষ্টা করবেন। তিনি সন্ধ্যায় চলে যাবার পর গানের আসর বসল। আব্বাসউদ্দিন সাহেব, সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন সাহেব গান গাইলেন। অধিক রাত পর্যন্ত অসল চলল। আব্বাসউদ্দিন সাহেব ও আমরা রাতে রফিক সাহেবের বাড়িতে রইলাম। রফিক সাহেবের ভাইরাও সকলেই ভালো গায়ক। হাসনাত, বরকতও ভালো গানই গাইত। এরা আমার ছোট ভাইয়ে মতো ছিল। আমার সাথে জেলও খেটেছে। পরের দিন নৌকায় আমরা রওনা করলাম, আশুগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন ধরতে। পথে পথে গান চলল। নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলোও যেন তাঁর গান শুনছে। তাঁরই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন তাঁর নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, “মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।” আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ঐ পৃ. ১১১)
অন্তরের আকুলতা বোঝানোর জন্য একটি বাক্যই যথেষ্ট। আব্বাসউদ্দিনের গানের সঙ্গে নদী ঢেউগুলোর তিনি যেভাবে তুলনা করলেন তাতে শুধু তাঁর দেখার চোখটি নয়, তাঁর সাংস্কৃতিক বোধের গভীরতাও বোঝা যায়। আব্বাসউদ্দিন তাঁকে বলেছিলেন বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা শেষ হয়ে যাবে। তিনি তো তা আগে থেকেই জানতেন। যার ১৯৪৮ সাল থেকেই ভাষা-আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কোনো দেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতি আর ভাষা তো একই সঙ্গে জড়িত। আর স্বদেশকে ভালোবাসা বস্তুত সে-দেশের ভাষা-সংস্কৃতি-মানুষকেই ভালোবাসা। বুকের গভীরে একটি দেশের জন্য কতখানি ভালোবাসা লুকিয়ে থাকলে কেউ নিজের জীবন বিপন্ন করে তুলতে পারেন তাও সহজেই অনুমেয়। আর দেশপ্রেম মানেই সুন্দরের আরাধনা। পৃথিবীর এমন কোনো দেশপ্রেমিক পাওয়া যাবে যে তার দেশকে ভালোবাসে অথচ নিজের দেশের প্রকৃতি-সংস্কৃতিতে মুগ্ধ নয়? মাতৃভূমির প্রেমে মগ্ন থানার নামই নান্দনিকতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন তাঁর মায়ের ভাষার, মায়ের ভূমির প্রতি নতজানু ছিলেন। তাই তিনি হয়েছেন এ-মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
তাঁকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরাও তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত সৌন্দর্যবোধদ্বারা তাড়িত হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশেছেন, কাজ করেছেন এমন কজন গুণীজনের মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা। পূর্বের অধ্যায়ে তাদের কথা আমরা বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করেছি। বঙ্গবন্ধুর সৌন্দর্যবোধ সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁরা প্রত্যেকেই স্বীকার করেন, তাঁর দেখার চোখই ছিল আলাদা। যেমন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সংবিধানে সংসদ সদস্যদের স্বাক্ষর করার জন্য গোটা সংবিধানটি তিনি সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখিয়ে নিয়েছিলেন এ কে এম আব্দুর রউফকে দিয়ে। আবার সেটি শিল্পীদের দিয়ে অলঙ্করণ করতে বলেছিলেন। সংবিধানের বাংলা রূপান্তরের কাজে যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক সেদিনের সেই গল্প : ১৯৭২ সালে আমাদের সংবিধান রচিত হয়। স্থির হলো যে, এ কে এম আব্দুর রউফ গোটা সংবিধান হাতে লিখবেন এবং তার পর সংসদ সদস্যগণ তাতে সই করবেন। বঙ্গবন্ধু শিল্পী জয়নুল আবেদিনকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন যে-কপিটায় সই করা হবে সেটায় অলঙ্করণ করে দেয়ার জন্য। এটা আনমনেই এসেছিল তাঁর মাথায়। এর জন্য আগে থেকে কারো সাথে শলা-পরামর্শ করেছিলেন বলেও আমার জানা নেই। বঙ্গবন্ধু বলে দিলেন যে বাঙালি সংস্কৃতির রূপ যেন এর পাতায় ফুটে ওঠে। জয়নুল আবেদিন সে দায়িত্ব নিলেন, তাঁর সঙ্গে সমরজিৎ রায় চৌধুরী, হাশেম খান, আবুল বারাক আলভী, জনাবুল ইসলাম প্রত্যেকে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন। হাশেম খান চারদিকে অলঙ্ককরণ করলেন। এবং আবেদিন সাহেব বললেন যে, প্রস্থানিটা হবে নকশিকাঁথার একটা ছবি। সেটা হলো। অই সময় আমার মনে আছে আবেদিন সাহেব বঙ্গবন্ধুকে বলছেন যে একটা লোক সংস্কৃতি জাদুঘর করে দেওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন এবং এই আলোচনার ভিত্তিতে সোনারগাঁয়ে লোক-সংস্কৃতি জাদুঘর গড়ে উঠল। এটাও লোক-সংস্কৃতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে ভালোবাসা এবং বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তার যে সার্বিক ভালোবাসা তার অংশ।”
শিল্পী হাশেম খান যুক্ত ছিলেন এই অলঙ্করণের কাজে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতো করেই তিনি বললেন সেদিনের কথা: “ভাবার বিষয় হলো কয়টা রাষ্ট্রপ্রধান ভাবেন যে তার দেশের বড় কোনো শিল্পীকে দিয়ে সংবিধান অলঙ্করণ করাবেন। তাঁর ভাবনা ছিল অন্য সবার থেকে আলাদা। তাইতো তিনি ভিন্নধর্মী কাজ করতেন যা কিনা দেশের কল্যাণ বয়ে আনবেন। দেশের প্রতিটা মানুষ কাজ করছে শুধু বঙ্গবন্ধুর মুখের কথা শুনে। তারা কিন্তু অন্য কোনো কিছুই দেখেনি। সংবিধান করতে গিয়ে তিনি শিল্পীদের ভরসা করেছেন। তিনি আরও বলেছেন যে আমি শিল্পকলা করেছি এখন আমার ইচ্ছে বড়মাপের শিল্পীদের নিয়ে লোকশিল্প জাদুঘর করার। একটা আন্তর্জাতিক মানের করে তৈরি করা। তখনই বঙ্গবন্ধু জয়নুল স্যারকে বললেন যে, জয়নুল ভাই আপনি কাল থেকে শুরু করেন কারণ সাধারণ মানুষের এই শিল্পকে বাঁচিয়ে তুলতে হবে। তারপর তিনি জয়নুলকে বললেন যে আমি মাঝে মাঝে আপনার সাথে এসে থাকতে চাই। এটাই বলে দেয় একটা মানুষ কতটা নান্দনিক হলে তার এমন নান্দনিক চিন্তা ভাবনার জন্ম হয়। তিনি প্রকৃতপক্ষে নান্দনিক ব্যক্তিত্ব। এবং দেশটাকে সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য এর থেকে আর বেশি কী চাই। এক ব্যক্তি একসাথে রাজনীতিবিদ, রুচিশীল এবং চিন্তাশীল মানুষ পৃথিবীতে অনন্য।”
শুধু সংবিধান অলঙ্করণ নয়, সোনারগাঁয়ে লোকশিল্প জাদুঘর গড়ে তোলা নয়, শিল্পকলা একাডেমি গড়ে তোলা নয়, বাংলা সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করা নয়, তিনি যে আগাগোড়া একজন পরিপূর্ণ নান্দনিক মানুষ ছিলেন তার পরিচয় প্রতি মুহূর্তেই তাঁর চলনে-বলনে মেলে। এ-প্রসঙ্গে শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার জানালেন এক মজার স্মৃতি- “একদিন বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলতে গেলাম। বললাম যে আমি আপনার খুবই সাদামাটা কিছু ছবি তুলতে চাই। বাসার ভিতরে কিছু ছবি তোলার পর তিনি হঠাৎ করে বললেন, চলো একটু পুকুর ঘাটে যাই। ওখানে বসে গল্পও করা যাবে, বিকেলের আলোতে ছবিও ভালো হবে। আমি খুবই অবাক হলাম তার এই হঠাৎ সিদ্ধান্তে। তিনি ব্যস্ত মানুষ। ছবি তোলার জন্য যে একটু বাড়তি সময় দিবেন অতো সময় কোথায়? অনেকেই এসে বসে আছেন। কিন্তু ওই যে তাঁর সৌন্দর্যবোধ। পুকুর ঘাটে বসে টেলিভিশন নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। টেলিভিশন কীভাবে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া যায় সে নিয়ে অনেক কথা বললেন। বাংলা সংস্কৃতির প্রতি জোর দিতে বললেন।”
বাংলা সংস্কৃতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা কতটা গভীর ছিল তার উদাহরণ দিতে গিয়ে কামাল লোহানী তাঁদের জেলে থাকা সময়ের আলাপচারিতার কথা বলেন, “বাংলা সংস্কৃৃতিকে যে তিনি কতটা ভালোবাসতেন সেটা আব্বাসউদ্দিনের সাথে যে কথা তার থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি এটা প্রমাণ করেছেন বাংলা ভাষা ছাড়া আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তিনি জেলখানার মধ্য বসে আলাপ আলোচনা করতেন এ-দেশটাকে আমরা কী করে মুক্ত করবো, কীভাবে পাকিস্তানি দুঃশাসন থেকে ছাড়িয়ে আনবো? এ ব্যাপারে তিনি সবসময় চিন্তা করতেন। তিনি বলতেন খুব হালকা করে। কিন্তু খুব সিরিয়াস কথা আলোচনা করতেন। একটা কথা বলি, জেলখানার মধ্য তিনি বলেছিলেন, তোদের এই পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন এটা নিয়ে কী করবি কর! পিআইএ বন্ধ করে দিলে তো তোদের সব শেষ। তার মানে তাঁর এটাই চিন্তা বাংলাদেশ মুক্ত হলে পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের কী হবে! আমরা তখন বললাম, বঙ্গোপসাগর দিয়ে যে যুদ্ধজাহাজ আসবে তখন কী করবেন? তখন তিনি খুব হালকাভাবে বলছেন, ‘ভয় করিস না! ওরা সাঁতার জানে না ডুবে মরবে।’ এই যে কথাগুলা তাঁর অজান্তে হোক, কিংবা, ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধু জহির রায়হানকে একুশে ফেব্রুয়ারির ওপর ছবি করার কথা বলেছিলেন। ফতে লোহানী আলোচনা করেছিলেন তিনি একুশে ফেব্রুয়ারির ওপর বই করবেন। কিন্তু পরবর্তীকালে সেটা আর সম্ভব হয়নি। একটা জিনিস মনে রাখা দরকার ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ের পর আর্মানিটোলা ময়দানে বিশাল এক অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। মওলানা ভাসানী সভাপতিত্ব করেছিলেন। শুনলে অবাক লাগবে আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবর রহমান ওইদিন ওই অনুষ্ঠানে একটি ছোট গীতিনাট্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই যে রাজনীতির প্রয়োজনে তাঁরা নন্দনতত্ত্বকে ব্যবহার করেছেন এটাও একটা অসাধারণ ব্যাপার যেটা এখন আর আমাদের মধ্যে নেই। এটা খুব দুঃখের ব্যাপার এই জিনিসটা আমরা হারিয়েছি।”
বঙ্গবন্ধুর মধ্যে নান্দনিকতার ছোঁয়া ছিল ছোটবেলা থেকেই। বিশিষ্ট লোক-গবেষক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বলেন, “আমিতো দেখি বঙ্গবন্ধুর ভিতর সেই কিশোর কাল থেকে নান্দনিকতার ছোঁয়া রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে জড়িত থাকাটাও প্রমাণ করে তিনি কতটা নান্দনিক। তিনি যে খেলাধুলা করতেন, সবসময় প্রতিদিন পত্রিকা পড়তেন এটাও নান্দনিকতা। তিনি নিজেও বলতেন যে তার বাড়িতে আনন্দবাজার এবং বসুমতি এবং মোহাম্মদী পত্রিকা রাখা হতো প্রতিদিন। শুধু তাই নয় তিনি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও যথেষ্ট সচেতন ছিল, এটাও কিন্তু একরকম নান্দনিকতা। তিনি যে কতটা ফুটবল ভালেবাসতেন তার প্রমাণ হলো একদা তিনি তাঁর বাবার টিমের সাথে বাজি ধরলেন, পাঁচদিন পর্যন্ত ম্যাচ ড্র হতে থাকল। স্বদেশি আন্দোলনের সময় তিনি যুক্ত ছিলেন সুভাষ বসুর সাথে। বিশেষ করে তিনি যখন মাদারীপুরে থাকতেন। সুভাষ বসু যখন জেলে গিয়েছিলেন। জেল থেকে যখন মুক্তি পেলেন তখন কাজী নজরুল ইসলাম একটা কবিতা লিখলেন। নাম- ‘পূর্ণ অভিনন্দন’। এই কবিতাতে প্রথম ব্যবহৃত হলো ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ। তিনি সেটা মনে রেখে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে নিজের দেশ স্বাধীন করার সময় ব্যবহার করলেন, ‘জয় বাংলা’। চিন্তা করা যায়! আজ জয় বাংলা আমাদের প্রাণের স্লোগান।”
মানুষের সৌন্দর্যবোধ ছেলেবেলাতেই গড়ে ওঠে। শুধু যে সৌন্দর্যবোধ তাই না, ফ্রয়েডীয় তত্ত্বানুসারে মানুষের পুরো ব্যক্তিত্ব গঠনেই সবচেয়ে বেশি ছাপ থেকে শিশুকালের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবশ্য নিজের ছেলেবেলা নিয়ে খুব বেশি লিখেননি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে ছেলেবেলার কালটি শেষ কয়েছেন অল্প কয়েক পৃষ্ঠায়। তাতে খেলাধুলার প্রসঙ্গ এসেছে মাত্র তিনটি বাক্যতে, “আমি খেলাধুলাও করতাম। ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতাম। খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম না, তবুও স্কুলের টিমের মধ্যে ভালো অবস্থান ছিল। এই সময় আমার রাজনীতির খেয়াল তত ছিল না।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ঐ, পৃ. ১০)
পাঠ্যপুস্তকের বাইরে পত্র-পত্রিকা পড়ার কথা লিখেছেন, মারপিট যে করতেন তাও লিখেছেন। তাঁর ছেলেবেলার সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর বড়কন্যা শেখ হাসিনা। ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে লিখেছেন, “আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে। বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে, মাছরাঙা কিভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায় দোয়েল পাখির বাসা, দোয়েল পাখির সুমধুর সুর আমার আব্বাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করত। আর তাই গ্রামের ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে করে মাঠে-ঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সাথে মিশে বেড়াতে তাঁর ভালো লাগত। ছোট্ট শালিক পাখির ছানা, ময়না পাখির ছানা ধরে তাদের কথা বলা ও শিস দেওয়া শেখাতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন, তারা তাঁর কথা মতো যা বলতেন তাই করত।” (শেখ হাসিনা, শেখ মুজিব আমার পিতা, আগামী প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ-২০১৫, পৃষ্ঠা-২৬)
ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা নান্দনিক বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনচলার বাঁকে বাঁকে স্বদেশপ্রেমের এক মহাকাব্যিক রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্ন ছিল সেই সৌন্দর্যবোধের আবিরে রঞ্জিত। তাই তো তিনি হতে পেরেছিলেন রাজনীতির এক আমর কবি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়