করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

পাপ

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চোখ সরু হয়ে এলো রশিদের। গম্ভীর হলো চাহনি।
না, তারা আজ ওখানে নেই। কিন্তু আশা ছাড়ার মানুষ না সে। বামে তাকায়, হাঁটছে পথচারীরা। হুকা বারের সামনে তরুণ-তরুণীর একটা দীর্ঘ লাইন। প্রবল আগ্রহ নিয়ে ডানে তাকায় এবার। মানুষ গিজগিজ করছে ওই জায়গাটায়। ব্যান্ড সংগীত হচ্ছে ওখানে। ধুমধাম আওয়াজ আসছে ওখান থেকে। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই, উপভোগ করছে বেশ আনন্দ নিয়ে।
ম্যানহাটনের মেঘমুক্ত আকাশ, মোহনীয় সোনালি রোদ। নাইট শিফট করার কারণে রোদের দেখা পায় না রশিদ। সামারে বেলা শেষ হয় দেরিতে। আকাশে মেঘ না থাকলে রোদের ঝলকানি পায় এক-আধটু। এতেই আনন্দিত, পুলকিত হয় মন। একটু আগে, বিকাল পাঁচটায় ট্যাক্সি চালানো শুরু করেছে সে।
টাইম স্কয়ারে এলেই বরাবরের মতো কৌতূহলী হয় রশিদ। যাত্রীর জন্য না। তার চোখ খোঁজে অন্য কিছু, অনিন্দ্যসুন্দরীরা ওখানে ঘুরে বেড়ায় সাদা কপোতীর মতো।
আজ তারা ওখানে নেই। থাকলে সে টের পেত ঠিকই। আকাশ থেকে শকুন যেমন মাটিতে শিকার খুঁজে পায়, রশিদও তেমন। শত মানুষের ভিড়ে ঠিকই বের করতে পারত সে তাদের। ছবি-সেলফি তোলায় ব্যস্ত দর্শনার্থীরা। সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, মিকি মাউস সেজে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকেই। শিশু-কিশোরেরা তাদের সাথে ছবি ওঠায়। তাতে রোজগার খারাপ হয় না। দুই-তিনজন করে সুন্দরীও দাঁড়িয়ে থাকে তাদের আশপাশে, সুতোহীন শরীর, এ প্লেইন বিউটি। যুবকগণ তাদের সাথে ছবি তোলে, সেলফি তোলে। রশিদেরও ইচ্ছে আছে- সুযোগ পেলে একদিন তাদের জড়িয়ে ধরে সেলফি তুলবে। গল্পও করবে একটু।
আপাতত চোখের দেখায় তৃপ্ত সে, অনেকটা তুষ্টও।
চোখজোড়া আরো ব্যস্ত হয়ে ওঠে তার। পরের ব্লকে বামে তাকায়। চোখে পড়ে তাদের। ওই তো দাঁড়িয়ে আছে দুটো যুবতী। চিকচিক করে ওঠে রশিদের চোখ। যেন পৃথিবীর কাক্সিক্ষত জিনিসটি খুঁজে পেয়েছে সে। তাকিয়ে থাকে স্থির চোখে, অপলক দৃষ্টিতে। পেছনের গাড়ি হর্ন দেয়। তাতে কী! দু চোখ ভরে তাকিয়ে আস্তে আস্তে নিচের দিকে যেতে থাকে। একেবারে থেমে গেলে পুলিশ টিকেট দেবে। অনিচ্ছাকৃত তাকে যেতেই হয়, আলতো ড্রাইভে। আর ভাবে- কোনো যাত্রী পেয়ে আবার যদি এ দিকটায় আসত, প্রফুল্ল হতো মন, প্রীত হতো হৃদয়।
বয়স এগিয়েছে, চুল-দাঁড়িতে পাক ধরেছে, পরিবর্তন এসেছে চেহারায়, অর্থনৈতিক সামর্থ্যও বেড়েছে, কিন্তু চরিত্রের তারতম্য ঘটেনি রশিদ সরকারের। ওই যে, ‘জাত যায় না ধুলে, খাসলত যায় না মলে’।
সমবয়সি অনেক বন্ধু আছে রশিদের। ট্যাক্সি চালায় তারা, প্রার্থনাও করে পাঁচ ওয়াক্ত। নিউইয়র্কে বাড়ি কিনেছে অনেকে, ঈর্ষণীয় জীবন যাপিত করছে পরিবার নিয়ে। রশিদ একই তিমিরে রয়ে গেছে। রয়েই গেছে সেই খাসলত, সেই অভিরুচি। মদ, জুয়া, তাস, এই তিনে সর্বনাশ- এ তিনটি অভ্যাসই আছে তার। অথচ অন্যদের সাথে সে যখন কথা বলে, তখন মনে হবে তার চেয়ে ভালো মানুষ খুব কম আছে দুনিয়াতে।
বাম্পার টু বাম্পার ট্রাফিক ভেঙে সেভেনথ এভিনিউ দিয়ে ডাউন টাউন যাচ্ছে রশিদ। যাত্রী নেই গাড়িতে, কখন পাবে কে জানে! ব্যবসা নেই আর আগের মতো। আগে ডলার আর ডলার ছিল। ট্যাক্সির জন্য যাত্রীরা দাঁড়িয়ে থাকত লাইন ধরে। এখন রাস্তা ফাঁকা, নিদারুণ ফাঁকা। দুম করে এভাবে ব্যবসা পড়ে যাবে, ভাবেনি কেউই। নষ্টের গোড়া ওই উবার, মাঠে এসেই ওলটপালট করে দিয়েছে সবকিছু।
ফোরটি সেকেন্ড স্ট্রিট ক্রস করার একজন যাত্রী পায় সে, ডান পাশে। পুল ওভার করে তাকে তুলে নেয় রশিদ। যাত্রী বসলেন সামনের সিটে। হাতে পানির বোতল, সাথে কয়েকটি ওয়ান টাইম গøাস। সিটে বসেই তিনি বললেন, ‘আমার নাম অ্যালেক্স, সিটি হল যাব।’
সিটবেল্ট বাঁধলেন মানুষটি।
‘আমি রশিদ।’ স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বলল রশিদ।
‘আজ অনেক গরম?’ এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিলেন অ্যালেক্স নিজেই।
‘জি।’ গাড়ি টান দিলো রশিদ।
‘ব্যবসা কেমন আজ?’ রশিদের মুখের দিকে তাকালেন অ্যালেক্স।
‘ভালো না। যদিও একটু আগেই শুরু করলাম।’ দৃষ্টি সামনের দিকে রশিদের।
‘চালিয়ে যান, ভালো হবে আশা করছি।’
‘দেখা যাক।’ খিটখিটে শোনাল রশিদের গলা। সামনে একটা উবার হঠাৎ আস্তে চালানো শুরু করেছে। হার্ড ব্রেক না করলে ধাক্কা লাগত। লেন পরিবর্তন করে জোরে টান দিলো রশিদ, স্বস্তির একটা নিশ্বাস ছাড়ল তারপর।
‘পিপাসা লেগেছে, একটু পানি খাই।’ বোতলের ছিপি খুলে গøাসে পানি ঢাললেন অ্যালেক্স। ঢকঢক করে পানি ঢাললেন গলায়, ‘আপনাকে দেবো এক গøাস?’
‘জি।’ মনে মনে খুশিই হলো রশিদ। বেশ পিপাসা লেগেছে সুতোহীন শরীরগুলোর দিকে তাকিয়ে।
অ্যালেক্স বোতল উঁচু করে ধরলেন, ‘আর এক গøাস দেবো।’
‘না, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’ টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে নিল রশিদ।
‘গøাসটা আমাকে ফেরত দিন, ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছি।’ রশিদের দিকে হাত বাড়ালেন অ্যালেক্স।
অ্যালেক্সের হাতে গøাস দিলো রশিদ, ‘কাইন্ড হার্টেড আপনি!’
মৃদু হাসলেন অ্যালেক্স। কিছু বললেন না।
বৃষ্টি শুরু হলো হঠাৎ। ঝিরিঝিরি বাতাসও বয়ে যাচ্ছে। গরমটা কমে গেল বেশ। ড্রাইভ করার সময় বৃষ্টি হলে অসুবিধা হয় রশিদের। দেখা যায় না ঠিকমতো। চোখের সমস্যা আছে কি না, কে জানে। রাতে কাজ করায় এমন হয়েছে সম্ভবত। চোখের ডাক্তার দেখানো দরকার। যদিও সময় কম পায় সে।
সিটি হলে পৌঁছে গেল রশিদ। ভাড়া আর টিপস দিয়ে নেমে গেল অ্যালেক্স। যাত্রী খুঁজতে থাকে আবার রশিদ। বৃষ্টি থেমে যায়। বৃষ্টি হলে ট্যাক্সি ব্যবসা জমে। তবে রাশ আওয়ারে এমনিতেই জমজমাট থাকে।
আরেকটি যাত্রী তুলল রশিদ, ব্রুকলিনের। বেলা ডুবেছে। মানুষ অফিস-আদালতের কর্মব্যস্ততা শেষে ফেরা শুরু করেছে ঘরে। এ সময় যাত্রী পেতে তেমন সমস্যা হয় না ক্যাবের ড্রাউভারদের। ডাউন টাউন থেকে যাত্রীরা ব্রুকলিন যায় বেশি। যদিও এটা তেমন পছন্দ না রশিদের।
এ সময়টা শহরের আপ টু ডাউন আর ডাউন টু আপ টাউন যেতে পছন্দ করে সে। এতে পয়সা এগোয় তাড়াতাড়ি। ম্যানহাটন ব্রিজের সামনে যেতেই ফোন আসে ফোনে। রশিদ হেড ফোনটা ঠেসে দেয় কানে। ফোন দিয়েছেন আমজাদ হোসেন, ইয়োলো ক্যাব চালান তিনিও। এই মানুষটির প্রতি তার অনেক ঋণ। এই তিনিই শিখিয়েছেন ক্যাবের লাইসেন্স কীভাবে নিতে হয়, এমনকি ক্যাব চালানোর অনেক কৌশলও। দুজনই নাইট শিফটে ড্রাইভ করে। তাদের যোগাযোগটা বেশিরভাগ ফোনেই। দুনিয়ার যত কথা- রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, পররাষ্ট্রনীতি, সব তারা বলে যায় ধারাবাহিকভাবে। তবে শুরুটা হয় বরাবরই একই রকম।
‘হ্যালো।’ মুখটা হাসি হাসি করে ফেলে রশিদ।
‘কী অবস্থা ভাই, ব্যবসা কেমন?’ আমজাদের আন্তরিক প্রশ্ন।
‘এই তো ভাই চলছে।’
‘এত ট্রাফিক কেন আজ সিটিতে?’
‘আর বলবেন না, মিডটাউন থেকে সিটি হল আসতে পুরো চল্লিশ মিনিট লাগল।’
‘মিড টাউনে তো ঢোকাই যাচ্ছে না।’
‘ভাই, সামনের সপ্তাহে কোনো হলিডে আছে নাকি?’
‘না তো।’
‘তাহলে ব্যবসা এত সেøা কেন?’
‘এখন আবার হলিডে লাগে নাকি! ব্যবসা তো এমনিতেই সেøা।’
‘উবার দেখি যাত্রী ওঠাচ্ছে দেদারছে।’
‘দেখলাম তো।’
‘তাহলে আমরা পাচ্ছি না কেন?’
‘উবারই তো সর্বনাশটা করেছে।’
‘হ্যাঁ।’
‘ব্রুকলিন যাচ্ছি। নামিয়ে দিয়ে লাগোয়ার্ডিয়া এয়ারপোর্টে যাব নাকি?’
‘সিটিতে যে ট্রাফিক, সেটাই ভালো হবে।’
‘আপনাকে একটা কথা বলেছিলাম না আমজাদ ভাই?’ কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বলল রশিদ।
‘কী বিষয়ে?’
‘ওই যে প্রায়ই একটা গাড়ি আমাকে ফলো করে, মনে আছে?’
‘ও হ্যাঁ, তা তো আপনি রোজই বলেন।’
‘ওই গাড়িটা আজো আমার পিছু নিয়েছে।’
‘আচ্ছা-।’ একটু থেমে আমজাদ বলেন, ‘আপনি সিওর যে ওই একই গাড়ি আপনাকে ফলো করে?’
‘আমি সিওর।’
‘গাড়ির প্লেট নাম্বার লিখে রেখেছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী ধরনের গাড়ি?’
‘টয়োটা ক্যামরি।’
‘কালার?’
‘কালো।’
‘আন্ডারকভার নয় তো?’
‘না।’
‘আপনি কীভাবে বুঝলেন?’
‘আমারও ধারণা হয়েছিল যে, আন্ডারকভার পুলিশের গাড়ি হয়তো। তাই ভালো করে খেয়াল করেছি। যে কোনো পুলিশের গাড়ির পিছনের দিকে এক্সট্রা এন্টিনা থাকে। ওই গাড়িতে নেই।’
‘ও আচ্ছা। বাদ দেন তাহলে।’
ব্রুকলিনে যাত্রী নামায় রশিদ। লুকিং গøাসে পিছনে তাকিয়ে দেখে ওই গাড়িটি নেই। ফোনে কথা কন্টিনিউ রাখে সে। রাশ আওয়ার শেষের দিকে। তারপর শুরু হবে বাঁশ আওয়ার। অর্থাৎ, ব্যবসা সেøা হয়ে যাবে, তখন যাত্রী পাওয়া কঠিন। আবারো পরামর্শ করে আমজাদের সাথে। খালি গাড়ি টেনে শহরে যাবে নাকি এয়ারপোর্টে।
প্রতি রাতের ছন্দটা একই রকম রশিদের। মাঝরাতে কোনো এক বাঙালি রেস্টুরেন্টে খেতে যায়। সাধারণত কমবেশি পরিচিত ড্রাইভারের দেখা মেলেই। খাওয়াও হয়, আড্ডাও হয়। কে কত টাকা মেক করল কম্পেয়ারসহ কথা হয় নানা রকম।
ব্যবসাটা জমে ওঠে মাঝরাতেই। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ওয়েস্ট ভিলেজে একটা বারের সামনে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করে রশিদ। বার থেকে বের হচ্ছে অনেক মাতাল। কেউ ট্যাক্সি বা উবার নিচ্ছে, কেউ হেঁটে যাচ্ছে এদিক-ওদিক, কেউ গল্প করছে কেউ বা ধূমপানে ব্যস্ত।
পাতিহাঁসের মতো হেলে-দুলে একজন অসম্ভব সুন্দরী তরুণী এসে দাঁড়াল রশিদের ট্যাক্সির দরোজার পাশে। পাতলা টি-শার্ট ও হাফ প্যান্ট এতটাই পাতলা যে শরীরে কাপড় থাকা-না-থাকা সমান। মেয়েটি যেন গাড়িতে ওঠে, মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল রশিদ। খুব বেশি দেরি হলো না তার আশা পূরণ হতে। দরজায় হেলান দিয়ে সিগারেট টানলেন তিনি। কয়েক টান দিয়েই ফেলে দিলেন ওটা। পা দিয়ে নিভিয়ে দরজা খুললেন। গাড়ির ভিতরে মুখ ঢুকিয়ে বললেন, ‘আমি কি সামনে বসতে পারি?’
‘অবশ্যই।’ মিষ্টি হাসি ফুটল রশিদের মুখে।
সামনের সিটে বসে সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বললেন, ‘আমি ডানিয়েলা।’ সিটে হেলান দিলেন, ‘আপনার নাম?’
‘রশিদ।’ ভেটকি হাসি দিয়ে বলল সে।
ডানিয়েলা বাসার ঠিকানা বললেন কোনোমতে। বারে বন্ধুদের সাথে মদ খেয়েছেন পেট ভরে। এখন নিজের বাসার ঠিকানা মনে করাও যেন কঠিন হয়েছে তার। বারবার ঢেঁকুর তুলছেন তিনি।
‘আপনি ঠিক আছেন তো?’ বমি করে গাড়ি ভাসাতে পারে ভেবে প্রশ্ন করল রশিদ।
‘হ্যাঁ আমি ঠিক আছি।’
গাড়ি টান দিলো রশিদ। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন ডানিয়েলা। দু চোখে ভর করে আছে তার ঘুম আর ক্লান্তি। পেটে যে পরিমাণ মদ ঢুকেছে, ওলট-পালট না করে ছাড়বে না সম্ভবত। চোখ বন্ধ করেন একবার, আরেকবার খোলেন। রশিদ আড়চোখে তাকায় আর দোয়া পড়তে থাকে, যেন উগরে না দেয় গাড়িতে।
কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলেন ডানিয়েলা। তারপর ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করল হঠাৎ। ভয় পেল রশিদ, ‘কাঁদছেন কেন, কোনো সমস্যা?’ বামে মোড় নিতে নিতে জানতে চায় সে।
মাথা নাড়লেন ডানিয়েলা।
‘কী সমস্যা?’
‘আমার এক্স বয়ফ্রেন্ড আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।’ চোখ বন্ধ রেখেই উত্তর দিলেন ডানিয়েলা।
‘ও এই কথা!’ বিড়বিড় করে বলল রশিদ। কিছুটা স্বস্তি পেল সে। ভেবেই নিয়েছিল গাড়িতে বসে কোনো শারীরিক সমস্যা হয়েছে ডানিয়েলার। তা হলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হতো রশিদকে।
‘একজন গেছে আরেকজন আসবে, আপনি চিন্তা করবেন না।’ সান্ত¡না দিলো রশিদ।
‘থ্যাংকস।’ কিছুটা প্রফুল্ল দেখায় ডানিয়েলাকে।
হাইওয়েতে উঠে গেছে গাড়ি। ফাঁকা রাস্তা। মাঝরাতে গাড়ি চালানোর বিরাট সুবিধা এটাই। একটু যেতেই হড়হড় করে বমি করলেন ডানিয়েলা। জানালা খোলারও সুযোগ পাননি বেচারি। গন্ধে পেট ফুলে যাচ্ছে রশিদের।
গন্তব্যে পৌঁছতে পৌঁছতেই অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যান ডানিয়েলা।
‘আই লাভ ইউ, কারণ আমি অনেক বিরক্ত করেছি আপনাকে, কিন্তু আপনি রাগ করেননি।’ রশিদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন ডানিয়েলা।
প্রত্যুত্তরে একটা হাসি দিলো রশিদও। মনে মনে বলল- এত সহজে পটে যাও বলে সহজেই তোমাকে ছেড়েও যায় তোমার বয়ফ্রেন্ডরা।
নেমে যাওয়ার সময় নিজের ফোন নম্বর লিখে রশিদের হাতে দিলো ডানিয়েলা, ‘যে কোনো সময় তুমি আমাকে কল দিতে পারো।’
কাজ শেষে রশিদ বাড়ি ফেরে কোনোদিন মাঝরাতের একটু পর, কোনোদিন শেষরাতে। বাসায় খাওয়া-দাওয়া করে কোনোদিন ফোনে কথা বলে দেশে বউ-বাচ্চার সাথে, কোনোদিন টিভিতে নাটক-সিনেমা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে সোফাতেই।
সারাদিনের প্রায় পুরো সময়টা ঘুমায় রশিদ। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে গোসল-খাওয়া সেরে রেডি হয় কাজের জন্য। আবার শুরু হয় দৌড়।
মাস ছয়েক পর পোর্ট অথরিটিতে আবার যাত্রী হয়ে গাড়িতে ওঠেন অ্যালেক্স। গাড়িতে উঠেই তিনি বলেন, ‘আমি সেই আলেক্স। কেমন আছেন আপনি?’
‘ভালো, আপনি?’
‘ভালো। চিনতে পেরেছেন আমাকে?’
‘জি, অনেক দিন আগে গাড়িতে উঠেছিলেন?’
‘খুব বেশি আগে নয়, মাত্র ছয় মাস।’
কয়েক ব্লক যাওয়ার পর অ্যালেক্স বললেন, ‘গাড়িটা এক পাশে থামাবেন একটু?
‘অবশ্যই, কোনো সমস্যা?’
‘হ্যাঁ, একটু জরুরি কথা বলব আপনার সাথে।’
‘ওকে।’
গাড়ি থামাল রশিদ এক পাশে। অ্যালেক্স কিছুটা ধীর এবং দৃঢ় স্বরে বললেন, ‘ছয় মাস আগে আপনার গাড়িতে উঠেছিলাম। আমি ডিটেকটিভ পুলিশ অফিসার।’ রশিদের চোখের সামনে পুলিশের আইডি ও ব্যাজ উঁচু করে দেখালেন আলেক্স। তারপর হাতের ফাইল ওপেন করে বললেন, ‘আপনার বিরুদ্ধে ধর্ষণের একটি মামলা ছিল বছর দুয়েক আগে। সেই থেকে বিভিন্নভাবে আমরা ফলো করছি আপনাকে। কড়া নজরদারিতে রেখেছি আমরা। আপনার ফোনে আড়ি পেতেছি প্রতিদিন। আপনার গাড়ির নাম্বার দিয়ে ট্রাক করেছি সরাসরি। এমনকি রাতে মেয়ে যাত্রী নামালে আমরা তার সাথে কথাও বলেছি আপনার সম্পর্কে জানতে। তবে আমার দায়িত্ব ছিল ডিএনএ টেস্টের উপকরণ জোগাড় করা। আগের বার গøাসে করে পানি দিয়েছিলাম আপনাকে। খাওয়া শেষে ফেরত নিয়ে যাই ওটা। তারপর জমা দিই ফরেনসিকে টেস্টের জন্য। যে মহিলা আপনার নামে কেস করেছিল তার শরীরে পাওয়া উপাদানের ডিএনএ পরীক্ষা করে রাখা ছিল আগেই। তার ধর্ষণকারীর ডিএনএর সাথে আপনারটা মিলে যায়। ধর্ষণের এক বছর পর ফোনে একজনকে বলেছিলেন- আপনি এই ধর্ষণ করেছেন। আমরা ফোনে আড়ি পেতে শুনেছি। আমাদের কাছে রেকর্ড আছে। সবগুলো আলামত চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আপনি ধর্ষণকারী হিসেবে শনাক্ত। তাই এই মুহূর্তে অ্যারেস্ট করছি আপনাকে।’
কিছু বলার চেষ্টার করল রশিদ। অ্যালেক্স তাকে থামিয়ে বললেন, ‘আপনার কিছু বলার থাকলে আদালতে বলবেন।’ কয়েক মিনিটের মধ্যে কয়েকটি পুলিশের গাড়ি এসে ঘিরে ফেলল রশিদকে।
রশিদের মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা। বছর দুয়েক আগে মাঝরাতে এক সুন্দরী মহিলা তার গাড়িতে উঠেছিলেন, মাতাল। গন্তব্যে পৌঁছার আগে সে দেখেছিল পেছনের সিটে ঘুমিয়েছেন সেই মহিলা। নির্জনে গাড়ি থামায়, পেছনে গিয়ে ডাকে তাকে। বেঘোরে ঘুমোচ্ছেন। হঠাৎ বৃষ্টি, সঙ্গে ঝড়ও। মহিলার পাশে গিয়ে বসে সে।
বাইরে তুমুল ঝড়, ঝড় ওঠে রশিদের শরীরেও।
দিগন্তছোঁয়া আকাশটা নেমে এসেছে আরো একটু, ফুটন্ত একটা চাঁদও আছে সেখানে। ওটা ঝাপসা লাগছে এ মুহূর্তে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়