করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

সে

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ওরা তিনজন। সতের থেকে উনিশের মধ্যে বয়স সবারই। আমি রুমে পা রাখতেই তিনজনই চোখ তুলে তাকায়। তারপর নামিয়ে নেয় চোখ। আমি কাঁধের ব্যাগটা দিদিমার খাটে নামিয়ে রাখি। ঘরে ওরা ছাড়া কেউ নেই। নিজেদের আলাপ বন্ধ ওদের। পাশের রুমে দিদিমার গলা শোনা যায়। ওরা তিনজন পাশাপাশি বসে আছে। আমি একটা চেয়ার টেনে একটু দূরে বসে পড়ি। তক্ষুনি দিদিমা রুমে ঢুকেন। ‘আরে, শালা তুই কোত্থেকে’। বলে একেবারে ছোট বেলার মতো জড়িয়ে ধরেন দিদিমা।
: তোমাকে না দেখলে কি আমি থাকতে পারি বলো।
প্রণাম করতে করতে জবাব দেই আমি। দিদিমা হাসেন। ফ্যানের বাতাসে সাদা চুল উড়ে দিদিমার। আমি অবাক হয়ে দিদিমার মুখের দিকে তাকাই। এত আদর এত ভালোবাসা দিদিমার চোখে-মুখে। হঠাৎ করেই তপুর চিঠি পাই। ২২ ফাল্গুন কাঞ্চনের বিয়ে। হঠাৎ করেই ঠিক হয়েছে। গৌরাদা দেশের বাইরে। যে করেই হোক বিয়েতে থাকতে হবে। ওরা অপেক্ষায় থাকবে। আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। কীভাবে ম্যানেজ করি। বস বাইরে। নতুন চাকুরি। হুট করে চলে আসা যায় না। চারদিন পরই নতুন ট্যুর। সারারাত একফোঁটা ঘুম হয় না। অনেক কথা ভিড় জমায় মনে। মামাতো বোনদের মধ্যে সবার ছোট কাঞ্চন। সারাটা ছোট বেলা কেটেছে ঝগড়া-ঝাটি মারামারি আর নানান ঘটনায়। আমার যেন বিশ্বাসই হয় না। দু-একবার তন্দ্রা মতো এসেছিল। দেখলাম হাসছে কাঞ্চন। দু’গালে টোল ফেলে। সবার আদরের ও। শেষ রাতের দিকে উঠে পড়ি। একটা ছুটির দরখাস্ত লিখি। রাত কেটে যায়। সারারাতের ক্লান্তি নিয়ে স্নান সেরে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সাতটার আগে অফিসে পৌঁছে দারোয়ানের কাছে দরখাস্তটা দেই। তারপর সোজা সায়েদাবাদ। দুটোর দিকে ওদের বাড়িতে পৌঁছে যাই।
: যা, কাঞ্চনের সাথে দেখা করে আয়। কাঁদছে খুব। দিদিমার কথায় বাস্তবে ফিরে আসি আমি।
: যাচ্ছি।
আমি কাঞ্চনের রুমে যাই। শুয়ে আছে। কপালে টকটকে লাল সিঁদুর। আমি ওর হাত ধরি। চোখ মেলে তাকায়। আমাকে দেখেই হু হু করে কেঁদে ওঠে। আমি বুঝি আমার চোখ দুটোও জলে ভরে আসছে। নিজের মনটাকে শক্ত করে উঠে বসাই ওকে। চোখের জল মুছিয়ে দেই। তারপর বলি,
: কি পাগলামি করছিস। কান্নার কী আছে রে। তুই যে কি বুঝি না।
: না, কান্নার কী আছে। আচ্ছা তুই বলতো আমার বিয়ে এখন না দিলেই কি হতো না?
: হতো। আরো পাঁচ বছর পরে দিলেও হতো। কিন্তু কাঞ্চন বড় মামার দিকটাও তোকে দেখতে হবে তো। তোর বিয়ে দিলে তার একটা বড় দায়িত্ব পালন হয়ে যায়। বয়স হয়েছে তো। তা তোর স্বামী দেবতা কী করেন টরেন?
: জানি না
: কী?
: সত্যি জানি না। আমি কাউকে কিছু বলিনি। মেজদা নেই, আমার মনে হয়েছিল তুইও আসবি না। সত্যিই কিচ্ছু জানি না।
: ওকে বের করে নিচ্ছি।
: মেজদি মেজদি। মেজদি একটা হাঁড়ি হাতে কোথায় যাচ্ছিল আমার হাঁক শুনে কাছে আসে।
: আরে তুই। কখন এলি।
: ওসব পরে। হাঁড়িটা রেখে আমার পাশে এসে বসো তো।
: কেন রে।
: আহ বসোই না। মেজদি পাটিতে বসে। এবার বলো তো দেখি কাঞ্চনের বর সংক্রান্ত তথ্যাদি।
: সংক্ষেপে বলছি। নাম নিরঞ্জন। গ্র্যাজুয়েট। দুটো ফিলিং স্টেশনের মালিক। বাড়ি গাড়ি আছে। এবার আমি বিদায় নিতে পারি?
: পার তবে, কিছু খাবার দাবার পাঠিও। পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। মেজদি চলে যায়।
: কি শুনলি তো। এবার কেসটা কী হলো বল। তোর চন্দনদা রাস্তার পাশ ধরে হেঁটে যাচ্ছে। পয়সা নেই বাসে চড়ার। তুই দেবতা সহকারে যাচ্ছিস। হঠাৎ তোর চোখ পড়লো বাইরে। আরে ওটা চন্দন দা না? ততক্ষণে ক্রস। ঘাড় ফিরিয়ে তুই তাকাতেই তোর দেবতার গুরুগম্ভীর আওয়াজ। কী দেখছো? তুই বলবি, না, কিছু না। কি ঠিক বললাম? কাঞ্চন বেশ ওজনে একটা কিল বসায় আমার পিঠে।
: দে দিয়ে দে, লাস্ট চান্স। এরকম কিল মারার আর পিঠ পাবি না রে।
: আমি সত্যি আবার কাঁদবো।
: আরে ধ্যুত মজা করলাম। তা দিদিমার রুমে তিন ললনা কেরে?
: কেন, কোনটাকে মনে ধরেছে বুঝি?
: না, দেখিইনি এখনও ভালো করে। শহুরে মনে হলো।
: হ্যাঁ শহুরেই। তিনটিই মেজদির ননদ। দুটো আপন একটা কাকাতো।
: হুম কেস খারাপ হচ্ছে।
: ডাকবো নাকি,
: না। সময় নেই পরে হবে। এখন অনেক কাজ। এ মুহূর্তে বঙ্গ ললনার আঁচলে জড়ানোর ইচ্ছে নেই। তোর বিয়ে দিয়ে দেই তারপর। কাঞ্চন আরেকটা কিলের ব্যবস্থা করতেই পালাই আমি। কাপড় ছেড়ে কাজে লাগি।
সন্ধ্যের পরই বর আর বরযাত্রীরা চলে আসে। প্রচণ্ড কাজের চাপ। দেদার দৌড়–তে হচ্ছে। বরযাত্রীদের জলখাবার হয়ে যেতেই বিয়ে শুরু। বিয়ে শুরু হয়। প্রচণ্ড হৈ চৈ বাজনার মধ্যে বিয়ে চলতে থাকে। দেদার ছবি তুলি বিভিন্ন এংগেল থেকে। গৌরাদা কাছে নেই। ওর কাজটা যে আমাকে করতে হচ্ছে। এক সময় বিয়ে শেষ হয়ে যায়। অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার ফাঁকে বরযাত্রীদের ভাত খাওয়াতে লোক লাগাই। সব ঠিক ঠাক করে একটু রেস্ট নিতে দিদিমার রুমে আসি। সেই ত্রিরতœ। ক্যাসেটে মান্নাদে শোনা হচ্ছে।
: বসতে পারি। হালকা কণ্ঠে বলি আমি।
: নিশ্চয়ই। বসুন।
এক পাশে প্রথমে বসি তারপর একটা বালিশ টেনে পা বাইরে রেখে শুয়ে পড়ি। খুব আরাম লাগে।
: কী ব্যাপার বসতে বললাম, শুয়ে পড়লেন।
: কী করবেন বাঙালির অভ্যাস। বসতে পারলে শুতে চায়। তিন জনেই হাসে।
: তা নাম ধাম পরিচয় কিছু হবে।
: খুব দরকার নাকি। চঞ্চলটা বলে উঠে।
: না, খুব না, তবে অন্ধকারের চাইতে আলো নিশ্চয়ই ভালো। নাকি?
: নিশ্চয়ই। আপনার নাম জানা হয়ে গেছে। সম্পর্কও। আমরা হচ্ছি উমা, সীমা আর ও শীলু। এবারে তিনজনের দিকেই তাকাই। উমা সীমা আপন বোন বোঝা যাচ্ছে। শীলু অন্যরকম। তিনজনের মধ্যে উজ্জ্বল। দীর্ঘ চুল, টানা চোখ। প্রথম দেখায় ভালো লাগার মতো।
: তা কী করা হয়?
: তিনজনই এইচএসসি দেবো।
: তা পরীক্ষার তো দেরি নেই। এই মুহূর্তে বিয়ে খেতে আসার মানে।
: বৌদির আবদার। তা আপনি খুশী না মনে হয়।
: খুশী না আবার, তিন তিনটা সুন্দরী যুবতী মেয়ের সাথে পরিচয়। সম্পর্কে আবার বেয়াইন।
ওরা হাসে। আমি শীলুকে দেখি। শীলুর দাঁতগুলো আরো সুন্দর। ফলে হাসিটাও। মেয়েটাকে ভালো লেগে যায়। প্রথম দর্শনে প্রেম নাকি রে বাবা। খারাপ ব্যাপার তো।
: ঠিক আছে আমরা একটু আসছি। তিনজনেই বেরিয়ে যায়। আমি চোখ বন্ধ করে মান্না দের গান শুনি। মান্না গাইছেন, ‘মিষ্টি একটা গন্ধ রয়েছে ঘরটা জুড়ে।’ সত্যিই মান্না বাবু তিনটা মেয়ের মিষ্টি গন্ধ রয়েছে ঘরটা জুড়ে। আমার চোখগুলো অবলীলায় বন্ধ হয়ে যায়।
একটা শীতল, নরম হাতের ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙে আমার। খুব কষ্টে চোখ মেলি। উমা ডাকছে। ঘড়ির দিকে তাকাই আমি। রাত সাড়ে তিনটা।
: দাদা খাবেন না? আসুন।
: বরযাত্রীদের খাওয়া শেষ?
: ক-খ-ন। বাড়ির সবারও প্রায় শেষ।
: আপনারা খেয়েছেন।
: আপনারা না, বলুন তোমরা। উমার কথা শুনে হাসি আমি।
: এত তাড়াতাড়ি দাদা বানিয়ে ফেললে।
: আসলে বৌদির মুখে আপনার কত কথা শুনেছি। কিন্তু সেই ব্যক্তিই যে আপনি তা তো একটু আগে জানলাম। উঠুন।
উমার সাথে বাইরে আসি। সীমা আর শীলু বসে আছে। আমি আর উমা পাশাপাশি বসি। খুব সামান্যই খাই।
বরযাত্রীরা সামিয়ানার নিচে শুয়ে পড়েছে। সারি বেঁধে। যেন শরণার্থী শিবির। আমার হাসি পায়। গ্রামের বিয়েতে বরযাত্রী যাওয়া খুব কষ্টের। বুঝো বাবারা। খেয়ে ফিরে আসি দিদিমার রুমে। বিছানা খালি নেই। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা শুয়ে পড়ছে। উমা সীমা ওদের ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে যায়। শীলু আর আমার অবস্থা খারাপ।
: আপনারা বসেই কাটান দাদা। আমরা ঘুমালাম। আমি শীলুর চোখে তাকাই। শীলু হাসে। শিশুদের মতো পবিত্র হাসি তার মুখে। আমি ব্যাগ খুলে আমজাদ খাঁর সরোদের একটা ক্যাসেট লাগাই রেকর্ডারে। অপূর্ব এক মূর্চ্ছনা রাতের বাতাস ভরে যায়। উমাকে ঠেলে জায়গা বের করি তারপর পা তুলে বসে পড়ি।
: আসো।
: শীলু প্রথমে সংকোচ বোধ করে। তারপর পাশে এসে বসে। এবার তোমার কথা বলো।
: আমার কী কথা বলবো। হাসে ও।
: তোমার যা ইচ্ছা বলো।
: আমার কোনো কথা নেই। আপনার কথা বলুন।
: আমার কথা?
: হুম
: নেই। আমারও কোনো কথা নেই। কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটে। আমি শীলুকে দেখি। অন্যরকম। অন্য দশটা মেয়ে থেকে আলাদা। আমার মধ্যে যে কী হয় বুঝি না। মনে হয় এর জন্যই এতদিনের অপেক্ষা আমার। সরোদের মিষ্টি ঠোকাগুলো বুকের ভেতরে ঘা দেয় বারবার। একটা তন্দ্রাচ্ছন্ন পরিবেশ। নিরবতা ভাঙ্গি আমি।
: শীলু, আমি কিছু কথা বলবো তোমাকে। সত্যি জবাবটা দেবে। কী দেবে তো?
: শীলু মাথা নাড়ে।
: তুমি কাউকে ভালোবাসো?
: না। আমার চোখে শীলু চোখ রাখে।
: কেন?
: ভয় হয়, ভেঙে যাওয়ার ভয়। কাঁপা গলায় বলে শীলু।
: কেউ যদি না ভাঙায় নিশ্চয়তা দেয়, নির্ভরতা দেয়?
: জানি না।
: তুমি একটু চিন্তা করে দেখো।
সরোদটা থেমে যায়। ক্যাসেটের ওপর সাইড লাগিয়ে ফিরে আসি আমি। মূর্তির মতো বসে আছে শীলু।
: এই মেয়ে স্বাভাবিক হও। হাসে শীলু।
: আমি তো জোর করবো না শীলু।
তুমি চিন্তা করবে। তারপর তোমার মতামত দেবে। আমি অপেক্ষা করবো। রাত শেষ হয়ে যায়। কটা কাক ডেকে ডেকে ওড়ে যায়।

: চল বাইরে যাই। সারা বাড়ির মানুষ ঘুমে অচেতন। আমি আর শীলু বাইরে আসি। মাধবীলতার ঝাড়কে পিছনে ফেলে পুকুরের দিকে হাঁটি দুজন। শীলুর চেহারায় গতরাতে না ঘুমানোর ক্লান্তি। খুব ভালো লাগে আমার। পুকুরের বাঁধানো ঘাটে দুজন পাশাপাশি বসি। শীলু চুপচাপ জলের দিকে চোখ রেখে বসে আছে। আমি নীরবতা ভাঙ্গি।
: খুব চিন্তায় পড়েছো শীলু?
: না, চিন্তা কেন?
: এত চিন্তার কিছু নেই? তোমার সময় এলে তুমি বলো। কোনো তাড়া নেই আমার। তোমার জবাব হ্যাঁ না যাই হোক তোমার প্রতি বিশ্বাস আমার অটুট থাকবে কথা দিচ্ছি। আমি কথাগুলো বলি জলে চোখ রেখে। বুঝি, শীলু তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সারাটা দিন প্রচণ্ড ব্যস্ততায় কাটে। কাজ আর কাজ। বিকেলে চোখের জলে বিদায় দিতে হয় কাঞ্চনকে। সন্ধ্যের পর পরই শুয়ে পড়ি। চোখে রাজ্যির ঘুম। ঘুম জড়ানো চোখে দেখি শীলু এসে পাশে বসেছে। ওর ডান হাতটা আমার হাতে তুলে নেই। তারপর আর কিছু জানি না। পরদিন ভোরে যাত্রা শুরু আমার। চাকরি, অফিস, ট্যুর। সবার কাছ থেকে বিদায় নেই। শীলুকে কিছু বলি না, বলতে পারি না। আমি বুঝি, খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু করার কিছু নেই। পুকুর পর্যন্ত উমা আর শীলু আসে। বিদায় নেয়ার জন্য ফিরে তাকাই। কিছু বলবে শীলু। শীলু আমার ডান হাতটা ওর দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে তারপর ধীর গলায় বলে ‘আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।’ টলমল চোখে চোখ রাখি আমি। এই সকালটা আমার কাছে অন্যরকম মনে হয়। উমাকে বলি আমার শীলু তোমার কাছে রইলো, ওকে রেখো। উমা সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ে। বড় ব্রিজের ওপর ওঠে পিছনে তাকাই। পুকুর ঘাটের বাধানো সিঁড়িতে দুজন দাঁড়িয়ে আছে। শীলুর দীর্ঘ চুল উড়ছে মৌসুমী হাওয়ায়। এত দূর থেকেও আমি যেন স্পষ্ট দেখি শীলুর চোখে জল।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়