করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

জলডাঙার নোনাজল

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এক.
কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না আবরার জাহিদ। জীবনের এ-পথ ও-পথ পেরিয়ে সে অবশেষে এই এক জায়গায় থিতু হয়ে বসার সুযোগ পেয়েছে। কাজটাকে নিজের করে নিয়েছে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছে, যাদুর কাঠি সোনার কাঠি নিয়ে মানুষ জন্মগ্রহণ করে না। নিজেকে নিজের পথ তৈরি করতে হয়। সাধারণ ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তানদের বেলায় যা যা প্রযোজ্য, তার বেলায়ও তা।
নিজের যোগ্যতা যেটুকু, তা নিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছে। এই বেঁচে থাকার অনুষঙ্গগুলো মনের ভেতর বরফের মতো জমা আছে। অনেকটা ডিপ ফ্রিজে জমে থাকা জমাট খাদ্য সামগ্রীর মতো। মনের ভেতরের জমাট জলপ্রপাত নদীর প্রবহমানতা নিয়ে এগুতে পারছে না। আবরার জাহিদ নিজেই কাহিনীর গল্পকার। এবং সূত্রধর।
জাহিদ জেলেজীবনের ভেতর বাহির নিয়ে গবেষণা করা একজন উন্নয়নকর্মী। এখন সাধারণের কাছে জেলেজীবনের এফোঁড়-ওফোঁড় করা জীবনবাস্তবতা উপস্থাপন করতে পারলে সে নিজেকে দায়মুক্ত মনে করবে। ভাববে মুক্ত পাখি।
কিশোর বয়সে গৃহশিক্ষকদের তর্ক-যুক্তির ভেতর বাম রাজনীতির ঘারানার সাথে তার পরিচয়। যোগসূত্র স্থাপন। সেই থেকে জাহিদের ভেতরে নীতিবোধের সূ²ধারা বহমান। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ। পঁচাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ড। স্পর্শকাতর এই রাজনৈতিক বিষয়গুলো তার ভেতর আলোড়ন তোলে।
তার ভেতর ভাবনার পুকুরে মাছের মতো ঘাই মারে এক সময়ের পরিচিত মানুষের চরিত্রগুলো। হরিনাথ জলদাস, কালাচরণ জলদাস, জীবনহরি জলদাস, নির্মলা জলদাস, মনিমালা, প্রফুল্ল জলদাস, টুনটুনবালা, সুখলাল, শকুন্তলা, যুবরাজ, রতন, সুদর্শনা। আরো টোকা দেয় নাম না-জানা জেলেদের জীবনযাপন ও সংগ্রাম। সবাই জল দেবতার পূজারী। জলের দাস ওরা। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। জলের দেবতার কৃপায় বাঁচে এবং মরে। জলদাস পরিবারের সকলের এ ধারণা যুগ যুগ ধরে বহমান।
হরিনাথ জলদাস বলে, ‘আঁরার জীবন অভিশাপে’র। হরিনাথের মুখের এই কথা শুনে জাহিদ চমকে উঠেছিল।
‘বাবু, আঁরার মাছ মারা জীবন।’ হরিনাথের বিশ্বাস, জীবন হত্যা করে জীবিকা নির্বাহ। এক জীবনকে উৎসর্গ করেই অন্যজীবনের বেঁচে থাকা।
জেলেগ্রামে কিশোর বয়সে জাহিদ বহুবার গেছে সমবয়সীদের সাথে বৈকালিক দস্যিপনায়। সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে ভেসে আসা সমুদ্রের পাড়ে আঁটকে পড়া একটি দাবি জাহাজ দেখতে। এই সমুদ্রপাড় ভ্রমণবিলাসীদের খুব প্রিয় ছিলো। পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকেই আসতো বেড়াতে। বাড়তি পাওনা আটকে পড়া জাহাজ দেখা।
হরিনাথ জলদাস এই সৈকতঘেঁষা জেলেগ্রামের বাসিন্দা। আশি দশকে দিকে এই জেলেগ্রামে জাহিদের যাওয়া-আসা শুরু। কর্মক্ষেত্রের সূত্রে এই গ্রামে তার নিয়মিত যাতায়াত। পথে একদিন হরিনাথের কিশোরী মেয়ে নন্দিনীর সাথে দেখা। গাঢ় শ্যামলা হলেও বেশ মিষ্টি চেহারা। কাজে-কর্মেও আলো ছড়ানোর মতো। নন্দিনীর সাথে প্রায় দেখা হয়। কথা হয়, বাবা কোথায়, মা কি করে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে নন্দিনী নিজেই পরিবারে একটি সহযোগী হাত। মাছ ধরতে যায় সাগরে। কর্মের নিবিড়তায় অনেক সময় জীবন-জীবিকায়ও নিবিড়তা তৈরি হয়। উন্নয়নকর্মীর সমাজ উন্নয়ন যাত্রায় এটা একটা জীবনসমীক্ষার অভিজ্ঞতা।

দুই.
নন্দিনীর সাথে দেখা হতেই বললাম, ‘নন্দিনী, জালে যাও মাছ মারতে?’
‘যাই তো’। সহজ সরল। দৃঢ় উত্তর। এই উত্তর শুনে জাহিদ বিস্মিত হয়নি। সে জানে এটাই জেলেদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের কাহিনী। যেখানে যেজীবন সংগ্রাম চলমান, জীবন বাজি রেখে বেড়ে উঠার আলাদা গল্প কোনো কোনো জেলে পরিবারে এভাবেই জন্ম নেয়।
হরিনাথ জলদাসের সাথে দেখা, ‘মাইয়া না কি তোঁয়ার লয় জালত যাইব।’ ‘হ’ বলেই হাঁটতে শুরু করে। হরিনাথরা দলবদ্ধভাবে এবারের মাছের মৌসুমে এই প্রথম মাছ ধরতে সাগরে যাবে। মাছের ‘জো’ পড়েছে। চোখে মুখে ইলিশ মাছের রুপালি ঝিলিক। রঙের ছটা মনের আকাশে।
শহরে থেকে দশ-এগারো কিলোমিটার দূরে হরিনাথের গ্রামের নাম জলগ্রাম। ‘জাইল্যা’ গ্রাম। জলগ্রামের বাসিন্দা প্রায় হাজার হবে। বসতের ভিটাবাড়ি শতের ওপর। এখানে আলো-আঁধার খেলা করে। জীবনযুদ্ধের ক্ষয়িষ্ণুতা খর¯্রােতা নদীর মতো। সাগরের গর্জনেও ভাঙনের শব্দ। জাইল্যাদের চাষযোগ্য জমি নেই। পেশায় আদি জেলে। নি¤œবর্ণের হিন্দু জেলে। তামাটে গায়ের রং রোদে পুড়ে লোনা জলেভেজা চকচকে লাল চোখে বেঁচে থাকার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে থাকা স্বপ্ন। কিন্তু আলোর আশা নিয়ে জাইল্যাদের দিন শুরু হয়।
কাজের সূত্রে জাহিদকে প্রায় সকালে যেতে হয় জেলে গ্রামে। দেখে, সাগরে যাওয়ার আগে পূজার আয়োজন চলছে। দেবী মা মনসার নামে পূজা। দেবীর কুদৃষ্টি থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য। পুরোহিত ব্যস্ত মন্ত্রপাঠে। ব্যাখ্যাও করে। ব্যাখ্যাটা অনেকটা বর্ণনার মতো, মনসা নাগমাতা সর্বমন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী। বিষহরী মনসা। জালো আর মালো দুই ভাইয়ের বিরোধ। জালো সাগরে জাল ফেলে মাছ মারতো। দেবী মনসার অভিশাপ এখনো জেলেদের মধ্যে বহমান। অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তির জন্য ঘটা করে পূজার আয়োজন। ভালো মাছ পাওয়া এবং সাপের দংশন, ঝড়-বৃষ্টিসহ নানান বিপদ থেকে ঘরে ফিরে আসার আর্তি মনসা দেবীর কাছে। নারীরা মাথায় ঘোমটা টেনে উলুধ্বনি দিতে দিতে নৌকার চারদিকে ঘুরতে থাকে। ডালা-কুলা নিয়ে চাল, দূর্বাঘাস, জলন্তকুপি, লাল হলুদ ফুলসহ পূজার আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে। জাহিদ মুগ্ধের মতো শুনে আর ভাবে, এই বিশ্বাসেই এদের বাঁচিয়ে রাখে। এভাবেই লোনাজলের মানুষের বেঁচে থাকা।
বিকেলের আলো থাকতে থাকতে, আবার কখনও সন্ধ্যা নামতে নামতে- হরিনাথ, নন্দিনী, সুখলালরা ছোটে মাছ মারতে। দেশি নৌকা ও জাল নিয়ে।

তিন.
জাহিদ ‘হরি… হরি’ বলে ডাকে। দাবি বেশি তাড়া। কোনো দিকেই খেয়াল নেই। যে যার মতো করে ব্যস্ত। কেউ জাল, কেউ বরফ, ঝুড়ি, লগি, বাঁশ, প্রয়োজনীয় ওষুধ, কাপড়-চোপড় দেখে নিচ্ছে, নিয়েছে কিনা।
হরিনাথ জলদাস বিহুন্দী জাল দিয়ে দূর সাগরে মাছ ধরতে যাচ্ছে। ইঞ্জিন বোট নিয়ে জলগ্রামের আরও কয়েকজন তার মতোই মাছ মারতে যায়। ছয় থেকে আটজন কামলা নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। দাবি বিহুন্দী জাল নিয়ে। আর বছরের সবসময় সমুদ্র উপকূলে ও নদীর মোহনায় মাছ ধরে।
জাহিদ জিজ্ঞেস করে কখন ফিরবে?
হরিনাথ, ভগবানের কৃপা হলে, নৌকার খোল-ভরা মাছ নিয়ে ফিরবো ভোরে। একটু দেরিও হতে পারে। চোখে মুখে আশার আলো।
হরিনাথ জলদাসের সংসারে সুদর্শনার মতো কর্মঠ বউ থাকাতে, সংসারের নানা ঝুটঝামেলা সে সামলায়। মেয়ে নন্দিনী, বড় ছেলে দীননাথও জালে যায়। ছোট ছেলে জীবননাথ পাড়ার কমিউনিটি স্কুলে অ-আ শিখে অনেক দাবি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এদের স্বপ্ন একটা সময় বাস্তবতার প্রতিকূল হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। জীবনের অংক মেলে না। মাছ মারা পেশা এবং জাত-পাতের হিসাবেও নিজেদের গুটিয়ে রাখে। বিদ্রোহ বা বাঁধভাঙা জোয়ার এদের জীবনে খুব একটা দেখা যায় না। বাবার দেখা-দেখিতে, সমুদ্রে এরা দিনে দিনে সাহসী হয়ে উঠে। পাঠ নেয়। মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে। সাগরে ছুটে। সাগরের জেলে জীবনের বিশাল যুদ্ধ জয়ের মতো। উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে মানসিকতায় দৃঢ়, ইস্পাত কঠিন। অথচ পাড়ে ¤্রয়িমান। জাহিদের বিশ্বাসে কেমন একটা খটকার মতো লাগে সে এর ব্যাখ্যা খোঁজে। প্রতিবেশে। পরিবেশে। সবই আসলে অবস্থা ও নিরাপত্তার অভাবে।

চার.
জীবননাথ বলে, স্যার, আমি অনেক বড় হবো। এই বড় হওয়ার স্বপ্ন জীবননাথের চোখে-মুখে খেলা করে। যেন, ভবিষ্যতের আলোর লণ্ঠন। কমিউনিটি স্কুলের ভেতর বিশ-বাইশ ছেলেমেয়ে চিৎকার করে পড়ছে। ‘অ’-তে অজগর আসছে তেড়ে।
‘মাছ মারতে যাবে না।’
‘যাবো’। আমি যখন অনেক বড় হবো। নন্দিনী দিদি, যায়। মাছ মারতে যায় বাবার সাথে। একদিন আমিও যাবো।
জাহিদের মনে আলো ফেলে, এই ‘অজগর আসলে আসছে তেড়ে’। এই বুঝি নিয়ন্ত্রক সমাজের অন্ধকার। এই সমাজ জীবনকে গিলে খায়। শহুরে বাবুদের লকলকে জিহ্বা শুধু আমিষ চাটতেই জানে। দিতে জানে না। শোষক-শাসক আর দাদনদার মহাজনের মধ্যে আলাদা করা যায় না। ওঁতপাতা জালে জেলেদের আটকে ফেলে। জালে মাছ পড়লে হরিনাথরা যত খুশি, তার চেয়ে দাদনদাররা খুশি হয় বেশি। কম দামে আমিষ নেবে। বেশি দামে বিক্রি করবে। লাভ করবে। খাবে। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আয় করবে। অধিক লাভে ট্রাক ভর্তি মাছ নিয়ে শহরে নিলামে তুলবে। সাগর পাড়েও ডাক হয়। জেলেরা মাছের দাম কম পায়। এমনই আলো ছায়ার খেলা চলে জেলে পাড়ায় পাড়ায়। কত গুপ্ত কাহিনী। কত ঘটনা রটনা জাহিদও কখনো কখনো বিভ্রান্তির ধাঁধায় পড়ে যায়।
জাহিদকে দেখে জলহরি নমস্কার দিল। শফিক মিয়াও সালাম দিতে ভুললো না। ওরা দুজন আড়তদার-দাদনদারের মানুষ। ধুরন্ধর।
ভাই, কাজ কেমন চলছে?
ভালোই।
ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে, না দুষ্টামি করে?
জাহিদ আমি তো দেখলাম ছেলেমেয়েরা মন দিয়ে লেখাপড়া করছে। আপনি শুনতে পাননি?
‘শুনেছি।’
জলহরি জলদাস আর শফিক মিয়া বেড়ির দিয়ে হাঁটছে। গল্প করতে করতে ধীরগতিতে সামনের দিকে এগুচ্ছে। দুজনের চোখেও ঝিলিক। আশা, জালে মাছ পড়বে। সোনালি আলো শফিক মিয়ার চোখেও। শফিক মিয়া ছাড়াও, পাড়ে আরো দাদনদার-আড়তদার। ছোট ছোট মিনি ট্রাক নিয়ে সকাল থেকে ঝিমুচ্ছে।
‘আপনারা আসার পর গ্রামে ঢুকতেই নমস্কার দিয়ে বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়ে। ‘নমস্কার, নমস্কার’ বলে পাড়াশুদ্ধ মাতিয়ে তোলে। আমার ভালো লাগে। আগে ত ওদের আদব-কায়দা বলতে কিছুই ছিলো না।’ মুখে বললেও, ওদের চোরা চাহনিতে জাহিদ বুঝতে পারে শফিকের দৃষ্টিভঙ্গি। মনে মনে হয়তো গালাগালিও করে।
‘ছিল আগেও, আপনি দেখতে পাননি।’
জলহরি জলদাস আচমকা বলে উঠে, ‘আঁর মাইয়া অনারার স্কুলত পড়েত।’
‘অনে খুশি অইনত’?
‘খুশি খুশি, টুকটাক হিসাবপত্র লইত পারিবো ত’?
‘ন, পারিবার কি আছে। পারিবঅ, পারিবঅ।’
শফিক নিজেকে আর নিজের ভেতর চেপে রাখতে পারলো না। ‘চলন চলন হরিহরের দোয়ানত যাই, চা খাই।’

পাঁচ.
জাহিদ দক্ষিণ পাড়ার মণিবালার স্কুলের দিকে রওনা হলো। স্কুলের সামনে পেয়ে গেল সর্দার কালাচরণ জলদাসকে।
‘বাবু, আজ সকাল সকাল’।
‘স্কুলগুলো দেখার জন্য। মণিমালার স্কুল দেখলাম। ছেলেমেয়ের ভালো উপস্থিতি। মন ভালো হয়ে গেল।’
‘আমাদেরও ভালো লাগে যখন ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে হাতে বইখাতা নিয়ে স্কুলের দিকে ছুটতে থাকে। আনন্দে মন ভরে যায়। আগে ত আমাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতো না। ধুলোমাটির গড়াগড়িতে দিন কাটতো। মাছের সিজনে মাছ কুড়িয়ে দিন কাটতো। মা-বাবাও খুশি হতো। এখন স্কুলে যায়। এতে জেলে পরিবারগুলো খুব খুশি।’
গল্প করতে করতে মণিমালা স্কুল ছুটি হয়ে গেল। মণিমালাও যোগ দিল। মণিমালার জীবনে এটা নতুন দিগন্ত। তার সংসার আছে। এক ছেলে, এক মেয়ে। স্বামী মাছ ধরে। ছেলে তার স্কুলে পড়ে। মেয়ের এখনো স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। হাঁটতে শিখেছে। মণিমালা মাছের মৌসুমে একসময় মাছ বিক্রি করতো পাড়ায় পাড়ায়। এখন সে পড়ায়। সে অনেক গল্পকথা!
একটু ছোঁয়া, একটু আগুন। জাহিদ জানে, মানুষের মধ্যে জে¦লে দিতে পারে অন্য এক আলোর রেখা। মণিমালা সে আলোয় আলোকিত একজন মানুষ। উন্নয়নকর্মী আপাদের ডাকে সাড়া দিয়ে, মণিমালা বয়স্ক শিক্ষা পাঠ গ্রহণ করে। সে আলোকিত হয়ে ওঠে। পরিবার সামলে শিশুদের পড়ালেখা শেখাতে শুরু করে স্কুলে। এখন এটা মণিমালার জীবনের অংশ। এটাই আজ মণিমালার জীবনসত্য।
মণিমালা হঠাৎ তাড়া অনুভব করলো। ‘স্যার, যাই। ঘরে অনেক কাজ পড়ে আছে।’
এদের সবকিছুর পরেও ঘর-গৃহস্থালির কাজ করতে হয়। রান্না-বান্না, মাছ পাওয়া না-পাওয়ার জীবনে ভগবানে বিশ্বাস নিয়ে মণিমালাদের চলতে হয়। বিদায় নিয়ে মণিমালা ঘরের দিকে রওনা হয়।

ছয়.
কালাচরণ জলদাস সর্দার এখন জালে যায় না। ছেলে যায় জালে। কালাচরণ মণিমালার গল্প করতে শুরু করলো। এই মণি কোনোদিন নিজের নামও লিখতে জানতো না। সে একদিন সকালবেলা এসে বলে গেল, মনে আছে কাকা, আজ গ্রামে স্কুল করার জন্য হরিনাথের বারান্দায় বসা হবে।
যথাসময়ে গিয়ে দেখেই আমি অবাক। গ্রামের সবাই বসে আছে। আমিও হাজির বেলা এগারোটায়। দিদিমনিরা উপস্থিত। স্কুল করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। সবাই কথা দেয় তারা ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়তে পাঠাবে। আপাতত হরিনাথের বারান্দায় স্কুলের পাঠ দেওয়া শুরু হবে। হরিনাথও এককথায় রাজি হয়ে যায়।
কালাচরণ বলে অবাক হয়ে মণিমালার মুখে লেখাপড়ার কথা শুনছিলাম। সে ইতোমধ্যে কারা কারা স্কুলে পড়তে আসবে তার একটি তালিকা করেছে। তাতে আমার নাতির নামও আছে। খুব খুশি হলাম মনে মনে। জেলেদের অনেকেই এই ডাকে সাড়া দিয়েছে। মাছের মৌসুমের সময় কোনোকিছুর আলোচনায় অনেকেই সাড়া দেয় না। এবার দিয়েছে। জেলেদের মধ্যে একটা আলোড়ন উঠেছে তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর প্রয়োজন বুঝতে পেরে।
নীলচন্দ্র জলদাস প্রশ্ন তুলে ছিল, ‘ওয়া আঁরার পোয়া-মাইয়া পড়ি কি হইবো। স্কুল তঅ ভর্তি লইতো নঅ।’
জীবনহরি বল্ল, ‘আগে লেখাপড়া শুরু হই যগ্গোই তারপর দেখা যাইব।’
সভায় সিদ্ধান্ত হয়। পরের রবিবার থেকে স্কুলে পড়া শুরু হবে। সকাল ১০টা থেকে ১২টা। প্রথমে উত্তর পাড়ায় স্কুলটা শুরু হবে। পরে, দক্ষিণ পাড়ায়ও আরেকটি স্কুল খোলা হবে। জলগ্রামে লেখাপড়া শুরু হয় এভাবেই।
জাহিদ দেখল, কালাচরণসহ সকলে মণিমালার তারিফ করে। বিস্মিত হয় মণিবালার ভূমিকা দেখে, সে কখন দিদিমণিদের কাছে ‘অ আ ক খ’ শিখলো! পড়ানোর নিয়ম কায়দাও রপ্ত করে ফেলেছে এর মধ্যে। কালাচরণের কথায় বিস্ময় থাকলেও জাহিদ অবাক হয়নি। সমাজ পরিবর্তনের হাওয়া যে এভাবে শুরু হয়, তা সে জানে। ছেলেমেয়েরা যে লেখাপড়া করতে পারে না তার একটি যন্ত্রণা জেলেদের মধ্যে আগে থেকেই ছিলো। এমন হুট করে কিছু হয় না। দরকার পড়লে, মণিবালার মতো এক সাধারণ জেলেবধূও এভাবে রাজি হয়ে যায়। আর অন্যদেরও বা এমন অকুণ্ঠ সমর্থন কেন থাকবে না?
এই জিজ্ঞেসা দাদনদারের শফির মধ্যেও জেগে ছিল। অবাক হয়েছিলো সে, একটি আলোর রেখা জাহিদের চোখে-মুখেও ফুটে ওঠে। কালাচরণের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দক্ষিণ পাড়ার স্কুলের দিকে রওনা হলো জাহিদ।

সাত.
ঐ স্কুলে পড়ায় টুনটুনবালা। সেও মণিবালার মতো। দিদিমণিদের কাছে তার লেখাপড়ার অ আ ক খ শিক্ষা। জাহিদ স্কুলের দোরগোড়ায় দাঁড়াতেই সমস্বরে ছেলেমেয়েদের কণ্ঠে- ‘নমস্কার…নমস্কার’ শোনে। এমন আদব শিক্ষা দেখে মন ভরে গেল।
টুনটুনবালা জানায়, এখন স্কুল ছুটির সময়।
আমি জানি বলে জাহিদ, এমনই হাঁটতে হাঁটতে দেখা করতে চলে এলাম।
ছেলেমেয়েরা নিয়মিত আসে।
‘আইয়ে’।
পড়াতে কেমন লাগছে।
‘ভালো লাগে। আগে একটু কষ্ট হতো। এখন আর কষ্ট হয় না। ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই সময়টুকু ভালোয় কাটে।’
স্কুল ছুটির পর যখন হৈ চৈ করে স্কুলের ছেলেমেয়েরা ঘরে ফেরার জন্য ছুটছে, দেখে জাহিদের খুব ভালো লাগলো। স্বপ্নদেখা এই ছেলেমেয়েদের আগামী দিনগুলি হয়তো আঁকা ছবির মতো হবে না। তবে কিছু একটা হবে এমন বিশ্বাসই জাহিদের মধ্যে জাগরণ তুললো। অন্তত দু’একজনও যদি লেখাপড়ায় ঠিকে যায়, মন্দ নয়! বেশি হলে তো আরো ভালো। এই দু-একজনই হয়তো অন্যদের একদিন পথ দেখাবে।

আট.
সুখলাল জলগ্রামে কামলা খাটে। সে অন্য গ্রাম থেকে আসা সুঠামদেহী যুবক। আট-দশ বছর আগে জলগ্রামে সুখলালের প্রবেশ। ধীরে ধীরে জলগ্রামে সে সকলের প্রিয় হয়ে উঠে। উৎসব। পূজা। দাহ। বিবাহ। এমনকি স্কুল খোলায়ও তার উৎসাহের কমতি ছিলো না। সেই সুখলাল হঠাৎ করে অসময়ে কী রোগে যেন মারা গেল।
দেখা হলেই সুখলাল বলতো, কাজের তাড়া আছে। জালে যেতে হবে। বলেই হাঁটতে হাঁটতে শুরু করতো। আজও সুখলালকে মনে পড়ে জাহিদের। জাহিদ এসেছিলো সেদিনও পড়ন্ত বিকেল। সমিতির সাপ্তাহিক সভায় অংশগ্রহণ করার জন্য। আকাশে হালকা মেঘ। সাগর জলে যেন মাছের ঝাঁক দেখতে পাচ্ছে। গ্রামের জেলেরা। সবার মধ্যে তাড়া। জাল নৌকা নিয়ে ব্যস্ত। আকাশে মেঘ দেখলেই জেলেদের চোখে মুখে মাছের ঝাঁক ভেসে বেড়ায়। জাল বসানোর দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। রাতেই জাল বসাতে হবে। মেঘ ডাকছে। মাছ খেলছে। বেশি মাছ পাওয়ার স্বপ্ন। খাওয়া-দাওয়া শেষ। কেউ কেউ বিড়ি-সিগারেটে সুখ টান দিচ্ছে। একটু একটু বাতাসও বয়েছে। একে একে সাগরে নৌকা যাওয়া শুরু করলো। সকলেই মিলে-মিশে জাল বসাবে। পছন্দ মতো কেউ বসায় সাগরের কিনারে। কেউ একটু দূরে।
সুখলালরা একটু দূরে গিয়েই জাল বসালো। রাত যত গভীর হয়। জালে মাছের দাপাদাপি একটু একটু বাড়তে থাকে। সুখলালের জালও নৌকার মালিক নিরানন্দের চোখে মুখে হাসির রেখা ফোটে।
মাছের মৌসুম। সবার মধ্যে ব্যস্ততা। শরীরের ঘাম পড়ছে। মাছ ধরে একজন একজন করে মাথার উপর পুবের ভোরের রোদ নিয়ে ফিরেছে। ওরা সেই রাত দুপুরে আলো-আঁধারী মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি খেলার ভেতরে জাল বসিয়েছে। এক সময় জাল টানা শুরু করে। ইলিশ মাছের ঝিলিক দেখে সবার মন খুশীতে নেচে উঠে। তারপর নৌকার খোল ভর্তি মাছ নিয়ে সাগরপাড়ে নৌকা ভিড়ালো। মাছ বাছাবাছি শুরু। সাইজ অনুযায়ী। আলাদা আলাদা ঝুড়িতে মাছ উঠছে।
সুখলালের নৌকা আর জালের মালিক নিরানন্দ জলদাসের মনে আনন্দ আর ধরে না। চিৎকার করে সবাইকে ডাকছে। এতদিনে ভগবান নিরানন্দের দিকে ফিরে তাকিয়েছে। নৌকা ভর্তি মাছের রুপালি ঝিলিকের খুশিতে সুখলালের দিকে ফিরে তাকানোর সময় নেই। সুখলাল মাসিক বেতনে কাজ করে। খায়-দায়-ঘুমায়। সুখেই আছে। নিজেরে সংসারটাও পেতেছে এই গ্রামের মেয়ে সুরবালাকে বিয়ে করে। পছন্দের বিয়ে।
নিরানন্দ সুখলালকে খুব পছন্দ করে। মাছ না পেলেও তাকে প্রায় হাতখরচের টাকা দেয়। কখনো কখনো টাকা হাওলাত নেয়। এভাবে সুখলালের চলে। মাছের মৌসুম না থাকলে অভাবের সময় অন্যদের ফাই-ফরমায়েস খেটে যা আয় হয়, তা দিয়ে দুঃখ-কষ্টে সংসার চলে।
নিজের গ্রাম থেকে মা আর এক ভাই ও বোনকে নিয়ে এসেছে। বাবা নেই। ঘর করেছে জেলেপাড়ার লাগোয়া মুসলমান গৃহস্থ থেকে একটু জায়গা নিয়ে। সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে সাগরপাড়ের মানুষেরা এভাবেও জায়গা পায়। খুব বেশি টাকা পয়সা দিতে হয় না। স্থানীয় মুসলমানেরা মনে করে এটা একটা সওয়াবের কাজ। গ্রামটিতে মুসলমান ও হিন্দু জলদাসরা যেন একে অন্যের পরিপূরক। মাছধরার মৌসুমে নিরানন্দের সাথে চুক্তি করে মাছ ধরতে যায় সুখলাল। এভাবে চুক্তিতে কাজ করতে করতেই গ্রামের একজন হয়ে উঠেছে সে।

নয়.
নৌকা দুলছে। ঘুমে চোখ বুঁজে আসতে চাইছে। তখনই নিরানন্দ জলদাস ডাক দেয়, ‘ও সুখলাল .. সুখলাল ন ঘুমাইছ’, নৌকার অন্য কামলাদেরও তাড়া দেয়। আকাশে একটু একটু আলো দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি তোড়ও বেড়েছে। সকলেরই একটু একটু শীত শীত লাগছে। বাতাসে-বৃষ্টিতে ভিজে। সুখলালের একটু বেশি ঠাণ্ডা লাগছে। শরীরে কাঁপন ধরেছে। তবুও জাল ও নৌকার দিকে তার সজাগ দৃষ্টি। ধীরে ধীরে জাল টেনে নৌকায় তোলা হচ্ছে। মাছের অস্থির দাপাদাপি। জেলেদের মুখে হাসি। দেনার দায় থেকে মুক্তির। স্বপ্ন দেখছে সুখলালও। আনন্দে দেখবে ছেলের মুখে, ‘ও’ বাবা ডাকা শোনার কী যে সুখ। দোলা মনে প্রাণে। আপন মনে জাল টানছে সুখলাল। মাছ ভরছে, নৌকার খোলে। ক্লান্তিতে ক্রমশ সমস্ত শরীর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। সেদিকে খেয়াল নেই। মাছ দেখে মন ভরে গেছে সুখলালের।
সুখলাল খুব খুশি। জালে মাছ। নৌকার খোল মাছে। রুপালি আলো খেলা করছে। নিরানন্দের মনেও তার ঝিলিক। মাছ নিয়ে ফিরতে ফিরতে একটু বেলা হয়ে গেল। দুপুর ১২টা। বাজার ধরতে হবে। আড়তদাররা মাছের ডাক করে। ফিরে গিলে বিপদ। সকলেই আজ মাছ নিয়ে ফিরেছে দেরিতে। সাগরে একটু ¯্রােতের টান ছিল। সবারই একটু কষ্ট হয়েছে। অধিকাংশই দাঁড়টানা ও পাল তোলা নৌকা। জেলেগ্রামের ইঞ্জিন নৌকা মাত্র দুই একটা করে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। বৈঠা বেয়ে সবাই ক্লান্ত। পেটে ক্ষুধা।
নিরানন্দও হৈ চৈ করছে তাড়াতাড়ি জাল গুটিয়ে নেয়ার জন্য। সে ধীরে ধীরে জাল গুটাতে থাকে। তার মনে হয় জাল সমস্ত সাগর গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে। জাল গুটানো শেষ। নিরানন্দ চলে গেল অন্য কামলাদের দিয়ে। আড়তদার আর দাদনদারকে মাছ দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল। নিত্যদিনের মতো জাল-নৌকা সুখলালের জিম্মায়। বাড়ি ফিরে যায় নিরানন্দ জলদাস।

দশ.
একটু একটু করে হাঁটতে শেখা ছেলেকে নিয়ে সুখলালের স্ত্রী নিরানন্দের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ডাকে, ‘দাদা.. দাদা.. দাদা’। চিৎকার করতে থাকে। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলের আলো ঘরের চালে খেলা করছে। ডাক শুনে বুকের মধ্যে নিরানন্দের মোচড় দিয়ে উঠে। সুখলালের তো শরীর খারাপ ছিলো। ঘর থেকেই বেরিয়ে, কে?
সুখলালের স্ত্রী সুরবালা বলে, ‘সুখলাল বাড়িত ন ফিরে’।
‘না’,
নিরানন্দ উত্তর শুনে নিজেকে একটু গুটিয়ে নেয়। বলে, দেখি, ‘কন জাগাত পড়ি ঘুম যার মনে অর’।
সুখলালের স্ত্রীর বুকের ভেতর ভয়। এক অজানা আশঙ্কা খেলে গেল। সুখলালের ছেলের মুখে ‘বা..বা…বা’ বুলি। ছোট শিশু বাবার মুখ দর্শনে অস্থির। এই শিশুও বুঝে গেছে তার বাবার কিছু একটা ঘটেছে।
নিরানন্দের পা চলে না। হাঁটতে শুরু করে সমুদ্রের দিকে। সাথে আরো দুয়েকজনকে নিয়ে। এদিক ওদিক খোঁজ করতে করতে দেখে ভাঙা জালঘরে জালের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। নিরানন্দ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সুখলালের গায়ে হাত দেয়। অন্যদিনের মতো ‘সুখলাল…সুখলাল, বাড়ি চল বাড়ি চল’- বলে ডাকলো না। অন্যদের বলে, ‘ওকে তোল, সুখলালকে বাড়িতে নিয়ে যা। সুরবালা ওর জন্য অপেক্ষা করছে।’
সুখলালের মতো এক একজন জেলের জীবন এভাবেই ঝরে পড়ে। এভাবেই তাদের অনেকেই জাগে না। ছেলের মুখদর্শন হয় না। প্রিয় স্ত্রীর মুখ দেখা হয় না। সুখলালের এমন মৃত্যুতে গ্রামের মানুষ কাঁদছে। কাঁদছে পুরো জলগ্রাম।
স্ত্রী ও ভাই-বোন-ছেলের দিনকাল কেমনে কাটবে? সুখলালের ভাই যুগলচন্দ্র ও শ্মশানযাত্রীরা ‘হরি বোল হরি বোল’ বলতে বলতে ভাইয়ের মরদেহ সাগরপাড়ের শ্মশানঘাটের দিকে রওনা হলো। বৃদ্ধ মা ও স্ত্রী সুরবালা, বুক চাপড়াতে চাপড়াতে খাটিয়ার পেছনে হরি নাম জপতে জপতে ছুটছে। সুখলালের বোন ভাইপোকে কোলে করে ছুটছে। ‘ও ভাই, ও ভাই’। হাউ-মাউ করে কাঁদছে। নিরানন্দ জলদাসও নীরবে চোখ মুছে আর সুখলালের কথা ভাবছে। তারও পা চলছে না। ‘দাদা, দাদা’ বলে নীচু স্বরে সুখলালের ডাক আর শুনবে না।

এগারো.
‘দাদা, বাড়ি আছ, বাড়ি আছ’।
মনে পড়ে, এমনই একদিন বিকেলে এসে বলেছিল, সুরবালার কথা। দক্ষিণ পাড়ার কুঞ্জলালের মেয়ে। সুরবালা সহজ সরল মেয়ে। দু’জনে প্রেমে মগ্ন। সুখলাল সারাজীবন সুরবালাকে আগলে রাখবে কথা দিয়েছিল। কুঞ্জলালকেও। ওরা ভাবতে পারে না অচেনা কোনো এক রোগে এভাবে চলে যাবে সুঠাম দেহের সুখলাল। সুরবালাকে কি বলে সান্ত¡না দেবে।
সন্ধ্যা নামছে। পশ্চিমের আকাশে সূর্যের ডুবন্ত লাল আভা ধীরে ধীরে মরে আসছে। অন্ধকার নামছে। আর সুখলালের দাহের আয়োজন চলছে। সবাই শবদাহের চারদিকে গোল করে দাঁড়িয়ে আছে। মন্ত্রপাঠ শেষে ভাই যুগলচন্দ্র সুখলালের মুখাগ্নি করে। অন্ধকারে আগুনের আলোয় জলগ্রামের মানুষ নীরবে দাঁড়িয়ে। দূরে সাগরের গর্জন। কারো মুখে রা নেই। সমুদ্রের কান্না আর সুখলালদের জীবন একসূত্রে গাঁথা। আকাশ-সমুদ্র-অগ্নিকে সাক্ষী রেখে চলে গেল। জীবন-জীবিকার যুদ্ধে নিবেদিত একজন জল ও জালের মানুষ।
সুরবালার প্রথম জীবনের প্রেম ভালোবাসা বর্ণিল আলো চোখে এখনো স্পষ্ট। স্মৃতিতে কেবলি সুখলাল। সুখলালময়। এই গ্রামে দুর্গাপূজা হয় না বলে। পার্শ্ববর্তী হিন্দু গ্রামে দুর্গাপূজা দেখাতে নিয়ে যায়। ঢাক-ঢোলের আওয়াজ এখনো কানে বাজে। চারিদিকে আলো আর আলো। দুর্গার দশহাত। অসুরকে পরাজিত করে সুরের রাজ্য প্রতিষ্ঠার অধিষ্ঠাত্রী দুর্গা মা। জয় দুর্গা, জয় দুর্গা। ধূপের ঘ্রাণ। প্রতি বছরই সুরবালা আবদার ধরতো। পূজা দেখার। সুখলাল সুরবালা আর ছেলে অনলকে পাশের গ্রামে দুর্গাপূজা দেখাতে নিয়ে যায়। সাথে পুরো পরিবার। আহা, কি আনন্দ, আহা কি সুখ। আজ সুখের রাজ্যের অসুরের প্রবেশ ঘটলো। প্রস্থানের একটি রাস্তা নিশ্চয় ভগবান দেখাবেন। সেই পথেই হয়তো সুরবালার মুক্তি আসবে।

বারো.
ইলিশ মৌসুম এলেই জেলেপাড়ায় ঘরে ঘরে যেন নবান্ন উৎসবের আমেজ আসে। হরিনাথ, নিরানন্দ, সুখলাল, সুরবালা, প্রফুল্ল, জীবনহরি, নির্মলা, সুদর্শনার মতো জেলেপাড়ায় হাজারো নারী-পুরুষের চোখে-মুখে দেখা মেলে ইলশা রঙের আনন্দছটা। হরিনাথ জলদাস তাদেরই একজন। বয়স হয়েছে। তারপরও জাল নিয়ে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল সমুদ্রে ইঞ্জিন বোটের শব্দ তুলে গহীন সমুদ্রে মিশে যায়।
তার আগে হরিনাথ ছেলে দীননাথের নাম জপতে জপতে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য ডাক দেয়, ‘ওডা কতা-হুন। তেল লইয়োস না হিসাব গড়ি? মাছর লাই দরিয়ার কনডে জন পড়ে ঠিক আছে না।’
ছেলে দীননাথ বলে, ‘লই লই, অই যাইবোগই’।
ছেলে বিয়ে করেছে। ফুটফুটে নাতি ঘর আলো করে খেলে।
হরিনাথ জলদাসদের শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিন মাসের মাছের মৌসুমের এটাই প্রতিদিনের চিত্র। হরির বাইশ হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিন বোট ঢেউয়ের তালে তালে অনেকদূর চলে যায়। পানির রং দেখে মাছের অবস্থান বুঝে জাল ফেলে। মাছের ঝাঁক ঢেউয়ের বিপরীতে ছুটে চলা, পানির নাচন দেখেই হরিনাথ চিৎকার দিয়ে উঠে, ‘অডা তোরা তাড়াতাড়ি জাল ফেল, মাছ পানির নীচে খেলের। উরর মিক্কা যারগোই। ফেলা ফেলা, জাল ফেলা।’
এরপর শুধু জালে টান খেয়াল করা। আর, ঘণ্টার পর ঘন্টা বসে থাকা। অপেক্ষা করা। জাল কখন মাছে ভারী হয়ে উঠে। টান টান উত্তেজনা হরিনাথের। স্বপ্নের মৌসুম। আড়তদার ও দাদনদার টাকা ধার দিয়ে ছিপ ফেলে মাছধরার মতো সমুদ্রের পাড়ে বসে থাকে। জেলেরা মাছ নিয়ে ফিরবে। আর ওরা টাকার থলে নিয়ে ঘরে ফিরবে। মাছ মারা জীবনে এমন গল্পের শেষ নেই।
হরিনাথ জলদাসের মতো হাজার জেলেরও স্বপ্ন একই। চাই দাদনমুক্ত জীবন। তাই, জেলেরা একটি সমিতিও গড়ে তুলে। সমিতির একটি নামও দিয়েছে। ‘নিজেদের গড়ি’। হরিনাথসহ এই গ্রামের জেলেরা এ সমিতির সদস্য।
হরিনাথ জলদাসের ভাগ্য বেশ ভালো। সে সমিতি থেকে ঋণের পেয়েছে একটি বোট। এখন মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। হরির মতো এই গ্রামে, আরো দু’জন ইঞ্জিন বোটের ঋণ পেয়েছে। ওদেরও হরির মতোই বোটের মালিক হওয়ার স্বপ্ন।
হরিনাথ জেলের দুই ছেলে এক মেয়ে। বউ বেশ সুন্দরী। সুদর্শনাকে হরিনাথ, ‘সু..সু’ বলে ডাকে। জেলেগ্রামে এরকম সুন্দর ল²ী বউ খুব বেশি নেই। একটা অহংকার তাই হরি মনে মনে পোষণ করে। জমজমাট আড্ডায় মনে ফুর্তি আসলে বলেও ফেলে, ‘এই ডইল্লা বউ থাইলে মন তো এনেই ফুরফুইজা থাকে। কাজ কইত্তেও ভালা লাগে।’
আড্ডায় কালাচরণ জলদাসের আগমন ঘটার সাথে সাথে হরিনাথ ভোল পালটায়। মাছ মারার আদি কাহিনী আর জলগ্রামের পুরনো কথা শুরু করে। নৌকা কেমন ছিল। ইতিহাস ইত্যাদি ইত্যাদি। এতে যোগ দেয় কালাচরণও।
আলোত-অন্ধকারে মিশাল জীবন। পৃথিবী নামক বিশাল সমুদ্রেরও অংশ। বঙ্গোপসাগরের পাড়ে হরিনাথ জলদাসদের বসবাস। নদীবেষ্টিত বাংলা বদ্বীপের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশ পৃথিবী আর কোথাও দেখা যায় না। ঝড়-ঝঞ্জা নিয়ে বেঁচে থাকা। এখানে জীবন নিয়ে যেন খেলা করা হয়।

তেরো.
ইংরেজরা সমুদ্রপথে বাণিজ্য করতে এসে একসময় বাংলা দখল করে। বাংলা শাসন করা শুরু করে। উনিশশো একাত্তরে বাংলাদেশের জন্ম হয়। আমাদের নদীপথে চলাচল, সমুদ্র, বন-জঙ্গল পাড়ি দিয়ে ছুটে চলা ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসনে বিঘিœত হয়েছিলো। অবশ্য ব্রিটিশরা স্থল পথের জন্য রাস্তা তৈরি করে। পথে ইংরেজদের বিশ্রামের জন্য বাংলো হলো।
গরুগাড়ি দ্রুত বাড়তে লাগলো। ঘোড়াগাড়ি ছুটলো পথে-প্রান্তরে। নৌকায় চলাচল কমে আসতে শুরু হলো। রেলপথ হলো। নৌকায় মালামাল বহন কমে গেল। সে আমলে কত রকমের নৌকার চলছিলো বাংলায়। ডিঙি নৌকা। কমজলে ছিপ নৌকা দ্রুত চলাচলের জন্য। পেট মোটা বিরিজ নৌকো মালামাল বহন করার জন্য। এসবে অনেক মালপত্র ধরতো। ফলে বিরিজ নৌকারও কদর ছিলো। মাছধরার জন্য ছিলো, কোনোটার গলুই লম্বা এবং কোনোটার খোল বড়। আরো ছিল বজরা, পিনিস ইত্যাদি।
নবাব সিরাজদ্দৌল্লার শাসন, ব্রিটিশ শাসন এবং পাকিস্তানি শাসনের শেষে বাংলাদেশ এলো একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। বাঙালির স্বাধীন দেশের স্বপ্নের সুখপাখি হাতের মুঠোয় ধরা দিলো। জেলেদের জীবনে বিশেষ কোনো পরিবর্তন এলো না। এখনো জলের অধিকার নিয়ে বহমান সংগ্রামে জেগে আছে জলদাসরা, নিজস্ব ধর্ম-কর্ম নিয়ে। তাদের জীবনে ‘জাল’ এবং ‘জ¦ালা’ যেন একসূত্রে গাঁথা। একটি দৃশ্যমান, অন্যটি অদৃশ্য। এটাই জীবনের বাস্তবতা। শুধু নীরবে সহে যাওয়া। সেই গল্পের এক একজন মানুষ হরিনাথ জলদাসরা। আর, কালের সাক্ষী কালাচরণ জলদাসেরা।
হরিনাথ আসলে খুব বুদ্ধিমান। কোনো কিছু শুনলে খুব সহজে মনে রাখতে পারে। সুযোগ পেলে বিভিন্ন আসরে ওইসব গল্প করে। জাহিদের কাছে শোনা গল্প নিজের মতো চালিয়ে দেয়।
হরিনাথ একটু কথা বেশি বলে। এটা সবাই জানে। বাইরে থেকে এসে আড্ডায় বসতে বসতে কালাচরণ বলে, ‘হরি তোঁয়ারে কি কঅজ্জে’।
‘না, কাকা আঁই-ই অন্য কিছু ন কইয়র। কইজ্জে ইংরেজ কেনে আইস্যে, কেনে দখল কইজ্জে এইদেশ।’
‘কাকা, আঁকাশত মেঘ দেখা যার। মাছ পড়িব মনে হয়। সাগরের পাড়ে ঢেউয়ের তালে নৌকা দুলছে।’
কালাচরণ কথা শুরু করে। তখন সাগরের পাড়ে ঢেউয়ের তালে তালে নৌকা দুলছে। বাতাসে লবণাক্ত ঘ্রাণ। নোনা ইলিশের মৌসুমের আগাম বার্তা। পুরনো দিনের মাছ মারার কথা বলতে বলতে কালাচরণের নিজের ছেলের কথা বলতে শুরু করে।
এই রকমই মাছের মৌসুম। শিয়ালের ডাক। বাতাসে যেন মানুষের নি¤œস্বরে কথা বলার শব্দ। বাতাসের ধেয়ে আসছে। অন্ধকার। কুপি বাতির আলো। আকাশে মেঘ। জীবনের জন্য মাছ মারা। রতনচরণ জলদাস কালাচরণের বড় ছেলে। রতনচরণরা বংশপরম্পরায় মাছ ধরার জীবিকায় ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সাগরে ছুটে।
এ রকমই একদিন রতন নৌকা-জাল নিয়ে মাছ মারতে সাগরে যায়। আরো পাঁচ নৌকার সাথে। রতনরা আটজন। বৈঠা টানতে টানতে ঢেউয়ের সাথে লড়াই করতে করতে।
সেই রতনের ফেরা না-ফেরা গল্প শুনতে শুনতে হরিনাথদের কাছে নিñিদ্র নিস্তব্ধতার মধ্যে জগৎ-সংসারকে বালির বাঁধের মতো মনে হতে লাগল। জেলেরা মাছ মারা জীবনের অভিশাপ নিয়ে মাছ মারতে যায়। জীবিকার বাধ্যবাধকতায়। ভগবানের প্রতি বিশ্বাসে।

চৌদ্দ.
‘রতন, ও রতন।’
‘কি বাবা।’
‘মাছের মৌসুম আইয়ের। জালের ছেড়া-পাটাগুওন ঠিক করি ল। পরে সময় পাতি-ন।’
‘বাবা, তোঁয়ার চিন্তা করন ফইত্ত ন। কালিয়াতুন ব্রজহরি, শান্তিসহ পাঁচ-ছয়জন কাজত লাগি যাইবো।’
‘রতন, ঠেঁয়া-পয়সার কি লাইবো হিসাব করিছ।’
‘কিছু ঠেঁয়া দাদনদার তুন ধার করন পড়িব।’
‘হিসাব করি লইছ।’
‘না-না, তুঁই টেঁয়া-পয়সা লই চিন্তা ন করজ্জ, আড়তদারের লয় কতা কই রাক্কি।’
রতন যেদিন মাছ ধরতে গেল। সতেরো বছর আগের কথা। রাতের আকাশে তারা আর মেঘের লুকোচুরি খেলা। মাঝে মধ্যে চাঁদও উঁকি দিয়ে মুখ লুকোচ্ছে। কালোমেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে। কখনো উত্তরে, কখনো দক্ষিণে। আকাশে বিদ্যুৎ চমক। গুড়– গুড়– শব্দ। রওনা হলো। আটজনের দল বৈঠা টানতে টানতে ছুটে চলা।
মাছ আসবে দাদনদারের চোখে-মুখে হাসি। লাভের আশায় চক চক করা চোখগুলি রতনের বুকের মধ্যে ক্রোধের আগুনে জ¦লে আর নিভে। বিদ্রোহ নেই। আবার তো মাছের মৌসুমের সময় হাত পাতা জীবনের ছবি ভেসে উঠলেই জেলেদের মতোন রতনও দমে যায়।
ভোরে খবর আসে।
‘কাকা, কাকা’ অস্থির ডাকে কালাচরণ জলদাসের ঘুম ভাঙে। কে, কে?
কাকা আমি, জবাব দেয় হরিনাথ। কাল শেষরাতে ঝড়ো হাওয়ায় ঢেউয়ে চার-পাঁচটি নৌকো ডুবে গেছে।
রতন ফিরে নাই?
না। সে তো দুপুরের পর পর ফেরার কথা।
কালাচরণ জলদাস সেই থেকে সাগর পাড়ে। থির বসে আছে। মুখে কথা নেই। এমনিতে তার দেহমনে প্রৌঢ়ত্বের ছাপ। সেই ছাপ আরো স্পষ্ট হলো। কয়েক বছর ধরে মাছ ধরতেও যায় না। ছেলেকে এটা ওটা পরামর্শ দেয়।
‘বাবা’, ডাক শুনে পেছন ফিরে তাকায়। দেখে রতনের স্ত্রী সুনন্দা বিষণ্ন চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে। কালাচরণের চোখে ফুটে উঠে সুনন্দার সমস্ত শরীর সাদা শাড়ি দিয়ে জড়ানো। কল্পনা ঢুঁ-মারতেই সে নিজের অস্তিত্বে ফিরে আসে।
নিজেকে সামলে বলে :
‘মা, যাও। আমি আসছি। আরেকটু দেখি, কোনো খবর পাই কিনা।’ সুনন্দার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। আশা-নিরাশার দোলায়।
ধীরে ধীরে যত সময় যাচ্ছে ততই বাড়ছে দুশ্চিন্তা। আগেও কয়েকবার এমন ঝড়ে পড়ে রতন ফিরে এসেছে। আশা, এবারও ঠিক ঠিক ফিরে আসবে। এর মধ্যে কয়েকজন ফিরে এসেছে। ঝড়ের ধকল সয়ে। দুয়েকজন সঙ্গী হারিয়েছে।
‘নিলয়, নিলয়, … আঁর পোয়ার নৌকা দেখ্যাছ না। ফিরের না।’
‘কাকা, নঅ দেখি। হয়তো অন্য মিক্কা গিয়ে ভাসতে ভাসতে।’
‘আইবো আইবো’।
‘ঝড়ো হাওয়া ঢেউয়ে সবই ওল্টা-পাল্টা হই গেয়ো গই বেগকিছু। কন কণ্ডে গিয়েও গোই, ঠিক নাই। নৌকার ভাঙা কাঠ যে যা পাইয়ে ধরিয়েনে বাঁইছে। অন্য মাছধরার নৌকা আঁরারে তুলি লইয়ে। রতনদের হয়তো অন্য নৌকা তুলি লইয়ে। কাকা, চিন্তা ন-গইজ্জন আই যাইবো।’
হাফপ্যান্ট পরা, মায়ের কোলে নবজাতক শিশু, নেংটা ছেলেটি, ফ্রক-পরা ছোট্ট মেয়েটি, যে যার স্বজনের জন্য বসে আছে। কেউ কেউ হয়তো বাবার নৌকা ফিরলে মাছ বাছাবাছির কাজে হাত লাগাবে। আজ অনেকের জীবনের সব ভেস্তে গেল। স্বামী না ফেরা বউগুলোর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ভাইয়ের ও বাবার প্রতীক্ষারত মুখগুলোও। সবার চোখ সাগরের দিকে। যতটুকু দৃষ্টি সীমানা ছাড়িয়ে যায়। কারো চোখের পলক পড়ে না। মুখে কথা নেই। কোনো নৌকা ফিরে এলে আশার আলো নিয়ে ছোটে। আশার প্রদীপ জ¦ালিয়ে বসে থাকে। আশা, ওরা ফিরবে।
কালাচরণ, আর বাড়ির দিকে গেল না। এক একটি জেলে নৌকা পাড়ে ফেরে। আর পরিবারের সবাই সেই নৌকার দিকে ছুটে যায়। কাদা মাড়িয়ে এক অনন্ত শূন্যতা নিয়ে। কারো আশা পূর্ণ হয়। কারো হয় না। হাউ মাউ কান্নার রোল আকাশে-বাতাসে মিলিয়ে যায়। জীবনের শূন্যতায় কেউ কেউ বুক ছাপড়িয়ে বিলাপ ধরেছে।
ওই পাড়ার যোগেন আর ফিরবে না। সাগরের বুকে হারিয়ে গেছে। তাই, তার স্ত্রীর এই বিলাপ। শুধু একটি কথাই শোনা যাচ্ছে, ‘আঁই কারে লই দিন কাটাইয়ুম। পোয়া কারে বাপ ডাকিব।’
সবাই এই শূন্যতায় ভাসছে। প্রতীক্ষা আর প্রতীক্ষা। বিকেল গড়িয়ে। সন্ধ্যা নামছে।
‘অকা’ বলতেই হরিনাথ ডাকে। কালাচরণের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
‘কি কইয়ুম’, সেদিনের কথা। রতনসহ সাতজন ফিরে আসেনি। রাত হয়, দিন যায়। রতন তো আর ফিরেনি।
‘আঁরা আঁরার বাপ-দাদার মুখতুন এন ঘটনা বহুত ওন্নি’।
‘তোরা হুনিবি, তোরার বাপ-দাদার কাছে।’
‘সন-বছরও মনত থাইকত-ন, দুয়েকজনর নাম মনত থাইবো।’
‘অডা আঁধার অইয়ে, যা যা বে গোন বাড়িত যা’, বলে কালাচরণ আড্ডার নীরবতা ভেঙে সবাইকে ঘরে ফিরে যাবার তাগাদা দিল। সবাই বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
আঁধারের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠে, ‘আঁরার জীবন এই ডোইল্যা। সাগরত যাইয়ুম, মাছ মাজ্জুম, তুফানে মইরজুম। ভগবান ছাড়া আঁরার কেউ নাই’।
জেলেজীবন, জলের দাসের জীবন। থেমে থাকে না।
এখন কালাচরণের হারানো রতনের পুত নিরঞ্জন মাছ ধরতে যায়।

পনেরো.
উন্নয়নকর্মী আবরার জাহিদের জীবনে ২৯ এপ্রিল ১৯৯১-এর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াস ভিন্নমাত্রা যোগ করে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মহাসড়কের পথের ধারে জলগ্রাম। শহরের তুলনায় পিছিয়ে পড়া এক জেলেগ্রাম। সপ্তাহে ওই গ্রামে অন্তত দুইবার যাওয়া হতো তার। যে টি-স্টলে বসে গ্রামের মানুষজনদের সুখ-দুঃখের কাহিনী শুনতো, ভালোলাগা মন্দলাগা নিয়ে আলাপ হতো, জেলেদের কাছে তাদের উন্নয়ন ভাবনা নিয়ে নানা কিছু জাহিদ জানতে চাইতো, সে টি-স্টল ঝড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সমিতি ঘরও। ছেলেমেয়েদের কয়টি বইও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঘর-গেরস্থালির টুকিটাকি জিনিসপত্রের সাথে। জাল, নৌকো সবই চিৎকাত হয়ে পড়ে আছে। ভাঙাচোড়া-ছেঁড়া অনেকটা পরিত্যক্ত বস্তু হিসেবে। নিশ্চিহ্ন হয়ে ধুয়ে মুছে যাওয়া একটি গ্রাম। দুটি মাত্র পাকা মন্দির দেখে বোঝা গেল- সেই গ্রাম। ওই গ্রাম ২৯ এপ্রিল সকালেও মুখর ছিলো। পরিবার-পরিজন নিয়ে জেলেরা বসবাস করতো। কোন্টা হরিনাথ জলদাসের ঘর। কোন্টা বা কালাচরণের ঘর এখন চেনার কোনো সুযোগ নেই।
জাহিদ গ্রামের ভেতরে ঢুকতেই দেখে একটি পত্রহীন খুঁটির মতো গাছে হেলান দিয়ে কালাচরণ বসে আছে। চোখে-মুখে শূন্যতা নিয়ে ভিটার দিকে তাকিয়ে আছে। জীবনদায়িনী সাগর আজ তাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। জাহিদ কিছু একটা প্রশ্ন করতে গিয়ে থমকে যায়। কি জিজ্ঞেস্য করবে? উত্তরই বা কি আছে?
দূরে দাঁড়িয়ে মণিমালা। স্কুলের ছেলেমেয়েরাও। সবার চোখে-মুখে আতংক আর ভয়। সারা রাতের ঝড়-ঝাপটার ঘোড় এখনো কাটেনি। হয়তো কিছু এখনো খাওয়া হয় নি। জাহিদ শুধু হাত তুলে জানান দিলো আসছি। দেখা হবে।
জাহিদ হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগোলে দেখে, দূরে ভিটার মধ্যে কি যেন খুঁজছে একজন জেলে। কাছে যেতেই দেখে হরিনাথ জলদাস। জাহিদকে দেখে হাউ-মাউ করে উঠে। কাঁদার ভাষাও যেন হারিয়ে ফেলেছে। কি বলছে জাহিদ বুঝার চেষ্টা করলো।
‘বাবু আঁরার আর কিছু নাই, বেয়াগ গিয়েগোই, কানাকড়িও নাই।’
নৌকাটা বেড়ির উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে, তাদের জীবনের প্রতীকী চিত্র হয়ে।
‘খাড়া জীবনর উৎ টাডারা পইজ্জে।’
জাহিদ দেখে জলগ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়া হাইওয়ে উপর একটি গাড়ি এসে থামলো। এগিয়ে গিয়ে দেখলো উন্নয়ন সংস্থার প্রধান খায়রুল আলম। সকলের প্রিয় খায়রুল ভাই। স্যারের চেয়ে ভাই ডাক তাঁর বেশি পছন্দ। জেলেদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখা একজন মানুষ। একনিষ্ঠ উন্নয়নকর্মী।
আলম ভাই একজন উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ। দীর্ঘদিন জেলেদের সাথে কাজ করতে করতে জেলেদের চাওয়া-পাওয়াগুলো সহজে অনুভব করতে পারেন। তাঁকে দেখে জেলেগ্রামের ছেলেমেয়ে, নারী-পুরুষ সকলে মিলেই জড়ো হয়। তাঁকে সকলেই চেনে। জানে তিনি তাদেরই লোক।
হরিনাথ ও কালাচরণ একসাথেই বলে উঠে, ‘আঁরার বেক্কুন ধুই মুছি লই গেইয়োগোই, কনডে যাইয়ুম কি খাইয়ুম।’
খায়রুল ভাই নিঃশব্দে ঠাঁই দাঁড়িয়ে, বিধ্বস্ত জেলেগ্রামের ভিটায়। কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আর ভাবেন, মানুষ প্রকৃতির তাণ্ডবের কাছে কতই না অসহায়। এক মুহূর্তে ঝড়ে দুমড়ে-মুচড়ে ধুয়ে-মুছে একাকার করে দিয়েছে একটি পুরো জনপদ।
সেই মুহূর্তে কোনো উত্তর না দিয়ে, ‘ভাঙা ভাঙা চাঁটগাইয়া ভাষায় বললেন, আঁরা অনারার লগে আছি। কি করিত পারি, চাইয়োম।’
হরিনাথ আর কালাচরণ, তাঁকে জড়িয়ে ধরে নীরবে কাঁদছে। পুরো গ্রামই আসলে কাঁদছে। খায়রুল ভাই আর জাহিদের চোখও ছল ছল করে উঠলো। ‘কাল আবার আসবো বলে’। হাঁটা শুরু করলো।
গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখলো। কোনোটা কার বাড়ি, কার ঘর, নৌকা-জাল কার কার গেছে- এ সবই কথার ফাঁকে ফাঁকে আলম ভাই সবার ক্ষতির পরিমাণটা জেনে নিলো। সবাই যার যার ঘরের সীমানা ঠিক করছে। কিছু পরিবার যা কিছু আছে তা দিয়ে ঘরের কাজ শুরু করেছে।
বৃদ্ধরা অনেকে দূরে স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে। শিশুরাও। জেলেরা জলের মানুষ। এপ্রিলের এই আঘাত এত যে ভয়ংকর রূপ নেবে বুঝতেও পারেনি। গ্রামের কেউ মারা যেতো না। সাথে করে যাকিছু নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে গেছে, সেইটুকুই সম্বল আছে।
খায়রুল আলম পরদিনই অফিসে সহকর্মীদের জরুরি বৈঠক ডাকলেন। তিনি শুরুতেই বলেন, ‘আমি পরের দিন সকালে একা গিয়ে দেখলাম, আমরা-যে জেলেগ্রামটার জন্য কত স্বপ্ন দেখেছিলাম। ২৩৫ কিলোমিটার বেগের ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াস মুহূর্তে ধুয়ে-মুছে ভিটাটুকু ছাড়া আর কিছু রাখে নাই। এই গ্রামের উন্নয়ন নিয়ে আমরা যে গর্ব অনুভব করতাম, তার কোনো চিহ্ন এখন আর নেই। আলো যেন ভুবনহারা হলো।’
‘সকালে রওনা দেওয়ার সময় পথে পথে অনেককিছু ভেবেছিলাম, যাওয়ার পর গ্রামের অবস্থা দেখে আমি ভীষণ হতাশায় ডুবে গেলাম। গ্রাম ও জানমালের ক্ষয়-ক্ষতি স্বচক্ষে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মর্মাহত। দিশেহরা হয়ে পড়লাম। ভাবলাম, এই মুহূর্তে জেলেদের উঠে দাঁড়ানোর জন্য, মাথা গোঁজার জন্য, কিছু খাবার যোগাড় করার জন্য কী করা যেতে পারে? আমরা পরবর্তী সময়ে জেলেদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারবো বলে বিশ্বাস করি।’
সভার পরপরই সংস্থার ক্রয়, বিতরণ এবং সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় এলাকা ভিত্তিক স্থায়ী উন্নয়নকর্মীদের সাথে কিছু ভল্যান্টিয়ার নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। উপকূলের এই জলগ্রামসহ মোট তেত্রিশটি গ্রামে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
খায়রুল আলম ভাইও বলেন, আমি মনে করি, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও প্রশাসনের জন্য অপেক্ষা না করে আমরা প্রাথমিকভাবে মানুষগুলোর উঠে দাঁড়ানোর জন্য কি কি সহযোগিতা করতে পারি। তা দেখা যাক।
সংস্থা কর্মকর্তা উন্নয়নকর্মী সুকমল গুপ্তকে প্রধান করে ত্রাণ কার্যক্রম চালানোর জন্য অতঃপর একটি কমিটি করা হয়। সকল কর্মকর্তা ও উন্নয়নকর্মীর মধ্যে যারা কমিটির সদস্য নয় তারাও একযোগে কাজে নেমে পড়ে। সুকমলের নেতৃত্বের পরে একটা দল ঘূর্ণিবিধ্বস্ত কুতুবদিয়াই সরকারের সহায়তায় একটি জাহাজ নিয়ে ত্রাণ বিতরণ করে।
ত্রাণের মধ্যে ছিলো চাল, ডাল, আলু, গুড়, বিস্কুটসহ শাড়ি, লুঙ্গি, শিশুদের জামা কাপড়। এর সাথে ছিলো মৃতদের দাফন, আশপাশের গ্রামের মৃত পশু মাটি ছাপা দেওয়া। রান্নাকরা খাবার বিতরণ এবং জেরিকেন করে খাবার পানি সরবরাহ করারও ব্যবস্থা করা হয়।

ষোলো.
সাংবাদিক বন্ধুকে সাথে নিয়ে জাহিদ কিছুদিন পর এক সকালে জলগ্রামে যায়। ওরা দেখে, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কিছু প্রচেষ্টা চললেও শহরের কাছে এরকম একটি বিধ্বস্ত জনপদ অবহেলায় পড়ে আছে। অবাক হয়। প্রায় ঘরের দাওয়ায় কেউ কেউ মাথায় হাত দিয়ে বসে আসে। অনেকের একবেলা খাওয়াও জুটছে না এখনো। অনুভব করলো ভিন্ন নি¤œ সম্প্রদায়ের জন্য কেউ নেই। অথচ ভোটের সময় কতো প্রতিশ্রæতি। রাজনীতির ভেলকিবাজির শুধু প্রতিশ্রæতিটুকুই তাদের পাওনা। জাহিদের সাংবাদিক বন্ধু বিধ্বস্ত অঞ্চল ঘুরে এক মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন লিখে ফেলে। পরের দিনই স্থানীয় দৈনিক ছাপা হয়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এই প্রতিবেদনের জন্য আলম ভাইয়ের উন্নয়ন সংস্থাকে দায়ী করে। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। এতে বোঝা গেল, রাজনীতি কিন্তু সবসময় ক্ষমতার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। আর, সামাজিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো উন্নয়নকর্ম করে তাদের দায়বদ্ধতা থেকে।
সাংবাদিক ইকবাল গ্রামে গিয়ে জানতে চেয়েছিলো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ত্রাণ নিয়ে এসেছিলো কি না। উত্তরে গ্রামে সকলই বলে, ‘এলাকার ক্লাবের পোলা-পাইন, আর এনজিও সংস্থাসহ, স্থানীয় মানুষ আঁরারে দুইবেলা ভাত পানি চা-বিস্কুট খাওয়াইয়ে।’ উপোস করে অনেকের দিন গিছে। রাত গেছে। সকাল হয়েছে।
সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে জেলেরা জানায়, পতেঙ্গা থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত সমুদ্র উপকূলের ২৮টি জেলেপল্লী ঝড়-জলোচ্ছ¡াসে প্রায় মুছে গেছে। তারা ক্ষোভের সাথে এও জানাতে ভুলেনি, সরকারি হিসাবে মাত্র ১৮ জেলে হারিকেন-জলোচ্ছ¡াসে প্রাণ হারিয়েছে। অথচ বেসরকারি হিসাবে পুরো উপকূলের অনেক জেলে প্রাণ হারিয়েছে, যা হিসেবে আনা হয়নি।
বিধ্বস্ত জেলেগ্রামে জাল ও নৌকার অবশিষ্ট বিশেষ কিছু নেই। জীর্ণ জেলে কুটিরের খড়-কুটোর ভেসে গেছে। প্রায় হাজার দুই পরিবার এখন প্রকৃতই পথে বসেছে। পরিবারগুলোর সদস্য সংখ্যা প্রায় দশ সহ¯্রাধিক। আশ্রয় কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করায় জেলেরা এখন তাদের নিজ নিজ পল্লীতে ফিরে যেতে শুরু করেছে। সেখানে তাদের কোনো ঘর নেই। জাল নেই। নৌকা নেই। এমনকি, গৃহহীন শূন্য ভিটেগুলো চেনারও কোনো জো নেই। জলোচ্ছ¡াস ভিটের মাটি খাবলে নিয়ে গেছে।
এমনই অবস্থা যে, চেনা একটি উপকূলীয় ছোট জেলেপল্লীতে গিয়ে তা চিনে নিতেও বেগ পেতে হয়। জলগ্রামের অপেক্ষাকৃত

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়