করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

কবির সঙ্গে কবির সম্পর্ক : সেকাল ও একাল

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ সাল।
মা চলে যাবার ঠিক ১ মাস পূর্ণ আজই।

আমাকে ঘিরে রেখেছে মায়ের পত্রে-পুষ্পে ঠাসা স্মৃতিবাহী এক অতলান্তিক মায়াবী নদী। এক জীবনে এর অবগাহন শেষ হবার নয়। মা চলে যাবার পরে আমাকে দেখতে এসেছে কেউ কেউ। আমাকে মনে করে শূন্যগৃহ দেখে ফিরে গেছে কোনো কোনো প্রিয়জন। যেহেতু আমি খুব দ্রুতই সন্তানদের অনুরোধে আবার চলে এসেছি টরন্টোতে। কাজেই অনেকেই পায়নি আমাকে। তবে এই করোনাক্রান্ত সময়ে কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক নিজের নিরাপত্তা অগ্রাহ্য করে কবি পিয়াস মজিদসহ আমাকে যেদিন দেখতে এসেছিলেন আমি তার এই মধুর মহানুভবতায় বিমুগ্ধ হয়েছি এবং তার প্রতি আমার ঋণ যেমন বেড়েছে আরো, তেমনি চিরকালের কৃতজ্ঞতায় মনে হয় আরো গভীরভাবে বাধা পড়েছি। যেমন অপর এক হৃদয়-ঋণের বোঝায় আমাকে ভারাক্রান্ত করে রেখেছেন কবি আসাদ চৌধুরী।
২০১৬ সালের ১২ মার্চ মুক্তিযোদ্ধা ও কবি রফিক আজাদের প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে আমার মাথায় যে সান্ত¡নার হাতখানি রেখেছিলেন বড় ভাইয়ের মতো নির্বাক সেই ছায়াময় সান্ত¡নার স্পর্শ আজো অনুভব করি। কবির চল্লিশ দিনের আয়োজন উপলক্ষে স্বউদ্যোগে গুণীগ্রামে আসাদ ভাইয়ের সশরীর অবস্থান এবং সকল কাজে তার পরামর্শ আমাদের আয়োজনটি সুনিপুণভাবে সম্পন্ন করতে শক্তি জুগিয়েছে শোকের সেই অধীর সময়ে। কাজেই আমৃত্যু তার সঙ্গে দেখা করা আমার পরম দায়িত্ব-কর্তব্যের অংশ বলেই মনে করি। ফলে কবি ফেরদৌস নাহার যেদিন আমাকে ফোনে বললো, আপা যাবেন নাকি, আমি আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবো তার অশোয়ার বাড়িতে। আমাদের বহন করে নিয়ে যাবে অপর কবিভক্ত ও আবৃত্তিকার হিমাদ্রি রায়-তার নিজস্ব বাহনে। আপনাকে এবং আমাকে তার বাহনে বহন করে নিয়ে যাবে বলে কথা দিয়েছে।
আপনিও তো চেনেন ওকে। ওহ, তাহলে তো কোনো কথাই নেই ফেরদৌস। এক বাক্যে ওকে আমি হ্যাঁ বলে দিলাম। কেননা, দীর্ঘদিন আমিও যাবো যাবো করে করোনার দাপটে, ভয়ে, পরস্পরের নিরাপত্তার কথা ভেবে অশোয়া যাবার আর নাম করিনি সন্তানদের সামনে। ধন্যবাদ ফেরদৌসকে, ওর এই পরিকল্পনার জন্যে। তবে এ যাত্রায় অশোয়া যাওয়া হয়নি, হিমাদ্রির টরন্টোর বাড়িতে দেখা হবে আমাদের। অনেকদিন পরে হলেও তবু দেখা হলো আমাদের। দীর্ঘদিন টরন্টোতে আছে আবৃত্তিকার হিমাদ্রি রায়। আজ তার লাল টুকটুকে গাড়ির চালকের সিটে সে নিজেই। পাশে বসে আছে কবি ফেরদৌস নাহার। গাড়িটি থামলো এসে ২১নং আইসবোট টেরেসের কন্ডোর সমুখভাগে। আমি আগে থেকেই চেস্টনাট গাছের ছায়ায় মৃদুমন্দ শীতের বাতাসে বসে ওদের জন্যে অপেক্ষায় ছিলাম। এই বয়সে তো ‘অপেক্ষা’ শব্দটি বিশেষ কোনো তাৎপর্য বা অর্থ বহন করে না, তবু একজন কবির জন্যে অপর কবির অপেক্ষার সময়টুকু যেন অস্তগত প্রণয়ের শেষবিন্দুর শিশির বারিতে সজীব ও সতেজ হয়ে দেখা দিলো এই পড়ন্ত বেলায়। এখনো মনে হয় কবিদের পরস্পরের জন্যে রোমান্সকর ভালোবাসাটুকু শেষ হয়ে যায়নি। কবি ছাড়া অপর কবি কাকে ভালোবাসবে আর? একজন প্রকৃত মানুষ কিংবা কবি ছাড়া মিহিমায়া সুরে কথা সে বলবে আর কার সঙ্গে? টরন্টোর ডাউন টাউনের বিখ্যাত সিম্বল হলো ‘সিএন টাওয়ার’- এই টাওয়ার সংলগ্ন স্টেডিয়াম ‘রজার্স সেন্টার’ যা একদা স্কাইরুম হিসেবেও পরিচিত ছিলো।
এই সিএন টাওয়ারের প্রায় পাদদেশের একটি রাস্তার নাম নেভি ওয়ার্ফ, অপরটি আইসবোট টেরেস।
এই আইসবোট টেরেসে নির্মিত পঞ্চাশতলা কন্ডোর পঁয়তাল্লিশ তলায় আমাদের প্রথম সন্তান অভিন্নের ৪৫০৭ নম্বর ফ্ল্যাট এদেশে আমার জন্যে এক রাজকীয় রাজ্য অতিথি ভবন। যতদিন থাকি ওর সমাদরে আদরে অনুপ্রেরণায় উৎসাহে লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকি।
মাঝে মধ্যে আবার ঝগড়া-ঝাটি, মনোমালিন্য, মান-অভিমান, দেশে ফিরে যাবার অস্তিরতাও থাকে।
বাকি সময় মিউজিক পার্কের বনে বাদারে ঘুরি নিঃসঙ্গতার সঙ্গ লাভ করি। সুবোধ বালিকার মতো হাঁটাহাঁটি করি। অভিন্নের কথামতো কম খেয়ে সুস্থ ও সুস্বাস্থ্যে বেঁচে থাকবার আরাধনা করি।
নেভি ওয়ার্ফে থাকে অহমসোনা এবং তার বোন অবনী মনোবীণা।
তারা দুজনে আমার পূর্বরাগ, অনুরাগ-ভালোবাসা, প্রেম ও প্রেরণার উৎসকণা।
তার পরিবারের সান্নিধ্যে থাকা মানে গভীর ঘন বনাঞ্চলে সবুজের বন। সেই সবুজ আলোর মাধুরীকণায় পাখির কুজন ওকলতানমুখর সময়টুকু আমার জন্যে জীবনদায়ী অনন্য এক কটেজবাসের সুরভিত অক্সিজেন-প্রবাহ যেন।
তবু দেশের জন্যে মন কেমন করে।
মন কেমন করে!
রফিক আজাদের সমসাময়িক শ্রদ্ধেয় কবি আসাদ চৌধুরী এ শহরে বাস করছেন, তিনি পাশে আছেন বলে মাঝে মধ্যে এদেশটিকে আপন বলে ভুল করি।
টরন্টোতে এখন লক্ষ দুয়েক বাঙালির বসবাস বলে শুনে থাকি। ডাউন টাউন থেকে এক ঘণ্টা ড্রাইভে স্কারবোরো এবং দেড় ঘণ্টা ড্রাইভে ব্রামটোন যাওয়া যায়। আপাতত এই দুই অঞ্চলেই বাঙালি পরিবারের আধিক্য। উপরন্তু বাঙালিপাড়া বলে খ্যাতড্যান ফোর্থ ইন্টারসেকশন এবং ভিক্টোরিয়াতেও বাংলাদেশি বাঙালিদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।
হিমাদ্রি রায় এবং কবি ফেরদৌস নাহার দু’জনেই বাঙালি অধ্যুষিত স্কারবোরো এলাকার নিকট প্রতিবেশী। এই দুজন মিলে আমাকে তুলতে এসেছে হরিণ বাতাসে শীতের আগমনী বার্তা উড়িয়ে।
পুনরায় সেখানেই যাচ্ছি হিমাদ্রির সদ্যকেনা নতুন বাড়ির অতিথি সেবা পেতে এবং সেখানে হিমাদ্রির জীবনসঙ্গী বাঙালি নারীর মতোই অসীম ধৈর্যশীলা একজন ফিলিপিনো মেয়ে জিনা আছে। তাকেও আজ প্রথম দেখবো, একজন বাঙালির নয়নাভিরাম বিদেশি বধূ হিসেবে।
কবি ফেরদৌস নাহার ডাউন টাউন দেখতে ভালোবাসে একথা হিমাদ্রিও জানে। হিমাদ্রি তাই একা না এসে ফেরদৌসকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছে পাশাপাশি বসিয়ে এই জার্নিটুকু উপভোগ করতে।
কথাটি শুনে প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো।
মনে মনে ভাবলাম হিমাদ্রি নিশ্চয় এও ভেবেছে যে, কবি
ফেরদৌস নাহারকে দেখে আমিও প্রাণ ফিরে পাবো। এদেশের সবুজ আমার দু’চোখে আরো একটু বেশি সবুজ হয়ে ধরা দেবে। কবিতা প্রেমিক বুদ্ধিমান ছেলে যাকে বলে।
কবিদের প্রতি এই মমত্ববোধ ও ভালোবাসাটুকু কম কিসে?

দুই.
কাঠের দেয়াল ঘেরা হিমাদ্রির বাংলো টাইপের বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্র কবি আসাদ চৌধুরী পরিবারের আগমন
বার্তা ভেসে এলো বাতাসে।
শাহানা ভাবীর সপ্রাণ উপস্থিতি বলে দিচ্ছিলো আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন তারাও। দুপুরে হিমাদ্রির বাড়ির বাঙালি ভোজের পরে আসাদ ভাই, শাওলি, নাদিমও ভাতঘুমে তখনো বিভোর।

আমাদের বারণ সত্ত্বেও শাহানা ভাবী কবিকে তক্ষুনি ঘুম থেকে ডেকে তুললেন।
প্রাথমিক কুশলাদির পর পরেই কবি ফেরদৌস নাহার আসাদ ভাইয়ের হাতে ওর দুটো বই যথাক্রমে প্রেম-অপ্রেম যাবতীয় সাক্সফোন (কবিতা সমাবেশ) ও পশ্চিমে হেলান দেয়া গদ্য (প্রবন্ধ) তুলে দিলো।
বছরখানেক আগেই ওর থেকে এই বই দুটো উপহার পেয়ে আমিও পাঠে দারুণ মুগ্ধ হয়েছি।
আসাদ ভাই বই দুটো উল্টোপাল্টে দেখে বললেন, আমি পড়বো ফেরদৌস।
গত বছর বইমেলায় আমার কবিতাসমগ্র বেরিয়েছে। আসাদ ভাই তা আগে থেকে জানতেন। বইটি আসাদ ভাইকে শুধু এক নজর দেখালাম, বিশেষ কারণে বইটি তার হাতে তুলে দিতে পারিনি। তবে অচিরেই বইটি একদিন তার অশোয়ার বাড়িতে গিয়ে যেন দিতে পারি সেজন্যে আরো একবার কবি-সন্দর্শন বাহানায় অশোয়ার বাড়ির জানালা দরোজার পথ খুলে রাখতে বললাম শাহানা ভাবীকে।
ইতোমধ্যে স্যুইমিংপুল সাইটে চা-কফি-নাস্তাসহ কবিদের জন্যে প্রাণখোলা এক বাঙালি আড্ডার ডগমগ পরিবেশ রচনা করে আমাদের ডাকছে হিমাদ্রি। তার সঙ্গে আরো আছে আসাদ ভাইয়ের একমাত্র কন্যা শাওলি ও তার জামাতা আমাদের প্রিয় নাদিম ইকবাল।
নাদিম ইতোমধ্যেই আলোকচিত্রিশিল্পী ও স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা হিসেবে বেশ নাম করেছে।
২০১৮ সালে টরন্টোতে নির্মিত তার প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘মাদার টাং’ বাংলাদেশে রায়ের বাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী চত্বরে বসে দেখেছিলাম।
যেখানে বাংলা ভাষার ইতিহাস ও তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মাতামহ কবি আসাদ চৌধুরী কথা বলছেন তার নাতনি মিষ্টির সঙ্গে।
প্রবাসে বেড়ে ওঠা নবীন প্রজন্মের নাতনি মিষ্টিসহ নবীন প্রজন্মের সকলের জন্যে বাংলা ভাষা শেখা ও জানার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে এই ছবির মূল চরিত্রে কবি আসাদ চৌধুরী অসাধারণ অভিনয় করেছেন। মাদার টাং দেখে মনে হয়েছে কবি যেন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায়িত্বই পালন করেছেন অধিকন্তু।
নাদিম শাওলির কন্যা প্রবাসী প্রজন্ম কবি-পৌত্রী মিষ্টির চমৎকার অভিনয় এবং তাকে উদ্দেশ্য করে বাংলার ভাষার এই ইতিহাস বলে যাওয়ার অপূর্ব কৌশলে ছবিটি যেমন দর্শকনন্দিত হয়েছে, তেমনি দেশে-বিদেশে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে। এরপর ‘বিদ্যাভুবন’ এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ?উপলক্ষে নাদিমের তৃতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘শিকড়ের ভাষা’ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বেশ সাড়া ফেলেছে।
নাদিমকে যখনই দেখি তখনই খুব চুপচাপ শান্তশিষ্ট, নিজে বলে কম, অন্যদের শোনে বেশি।
ওর আনন্দময় উপস্থিতি, বিনয়, সৌজন্যবোধের প্রকাশে যে কেউ আপ্লুত ও বিমোহিত হবে, আমি তো বটেই।
কলকল করে চারপাশ মাতিয়ে রাখে আমাদের প্রাঞ্জল শাওলি মেয়েটা। ওর উপস্থিতিতে পাখি ডাকে, বনে বনে ফুল ফোটে যেন।
হিমাদ্রিসহ ওদের দুজনের ডাকাডাকিতে বাইরে এসে দেখি, উঠোনের আকাশ আর স্যুইমিংপুলের নীলজল মিলেমিশে একাকার। আটকে গেলো নয়ন।
চমৎকার কাঁথা বিছিয়ে আসন পাতা হয়েছে, হেলানের জন্যে কতগুলো কুশানও আছে। হাঁটু সমস্যা যাদের, ভয় নেই, তাদের জন্যে চেয়ারও রাখা হয়েছে।
আসাদ ভাই বসবার আগে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কাঁথার সুই-সেলাইয়ের রঙিন ফোঁড়গুলো নিরীক্ষণ করে বুঝে নিলেন এ আমাদের বাংলাদেশের আসল কাঁথাই বটে।
তারপর শিশিরের গায়ে হাত রাখার মতো গভীর মমতা ও খুব স্নেহ-আদরের সঙ্গে কাঁথার গায়ে নিজের স্পর্শ মাখালেন।
আহা দেশ, সংস্কৃতি এভাবেই বোধ হয় একজন স্পর্শকাতর কবি-হৃদয়ে হারানো কড়ির মতো ফিরে ফিরে আসে। করোনাকালের নিষ্ঠুরতায় দুবছরের বেশি সময় তিনি দেশে যেতে পারছেন না।
সে দীর্ঘশ্বাস তো গোপনেই আছে।
ফেবু মিডিয়ার যুগে আজকাল যা হয়, ছবিতেই যেন সব কথা বলবার একটা চেষ্টা থাকে, ফলে ছবি তোলা আর শেষ হয় না। তবে ছবির ক্লিকে ক্লিকে গল্পও এগিয়ে চলতে থাকে সময় ও পরিবেশ বাস্তবতার পথরেখা ধরে।
নাদিমের দক্ষ হাতে ওর চলচ্চিত্রের মেধাবী ক্যামেরা এবং আমাদের ব্যক্তিগত মোবাইলও শৈল্পিকগুণে প্রকৃত ক্যামেরার মতো কাজ করছিলো। একদিকে ছবি তোলায় মনোযোগ অন্যদিকে গল্পের রশি ধরে কফির পেয়ালার চুমুক। সুমধুর আড্ডার এরকম সময়ে বয়স তার সীমারেখা মানে না যেন।
যে কোনো বয়সের কবি, শিল্পী-সাহিত্যিক আজকাল নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন টেক পৃথিবীর পরিমাপে।
আজকের আড্ডার শুরুতেই গল্পের আলো ঠি করে পড়লো গিয়ে কবি ফেরদৌস নাহারের মায়াবী চোখে-মুখে।
সাধারণত এরকম কবি সমাবেশে আড্ডাপ্রিয় মানুষের সংখ্যা বেশি হলে ফেরদৌস নাহার সুতো হয়ে যায়,কান পেতে শোনে শুধু। নিজে প্রায় কিছুই বলে না।
স্বল্প সমাগমে আজই তাকে অন্যরকম দেখছি, পৃথিবী বিখ্যাত পেইন্টারদের পেইন্টিং নিয়ে কিভাবে যেন কথা উঠলো। আসাদ ভাই এবং ফেরদৌস দু’জনেই জগৎবিখ্যাত পেইন্টারদের বিভিন্ন প্রদর্শনী দেখার অভিজ্ঞতা শেয়ার করলো।
শিল্পী রুবেন্সর পেইন্টিং নিয়ে কথা বললেন আসাদ ভাই।
পিটার পল রুবেন্স ছিলেন একজন ফ্লিমিশ ব্যারোক চিত্রশিল্পী, যিনি তাঁর অমিতব্যয়ী ‘ইউরোপীয়’ চিত্রকর্মের জন্য সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন।
পেইন্টিংয়ের প্রতি আসাদ ভাইয়ের প্রীতিও অসাধারণ। যখন যেখানে থাকেন, সুযোগ পেলেই তিনি সেসব দেশের
যে কোনো চিত্র প্রদর্শনীতে ঢুকে শিল্পের সহবত লাভ করেন সহজে।
চিত্রশিল্পীদের কাজগুলো দেখেন কবির মনশ্চক্ষু দিয়ে, উপভোগ করেন নিজের কাব্যচিত্তের মাধুরি-মদিরায়।
কবি ফেরদৌস নাহারকে চিনি দীর্ঘকাল।
আশির দশকে প্রথমে চিনেছিলাম আমার ইডেনের প্রিয় ছাত্রীদের অন্যতম একজন হিসেবে।
একই সঙ্গে দুজনেই কাব্যচর্চার সঙ্গী ছিলাম।
পরবর্তী সময়ে রফিক আজাদ ও আমার পরিবারের সঙ্গে
ঘনিষ্ঠজন হয়ে ওঠে।
কাব্য সহযাত্রী, সতীর্থ এবং অনুজপ্রতিম বন্ধু তো বটেই।
সেই থেকে জানি, নানা বিষয়ে ফেরদৌসের শিল্প পিপাসাও আকণ্ঠ।
শুধু কবিতার জন্যে এক জীবন ব্যয় করা উন্মত্ত প্রাণ এক।
সুযোগ বুঝে সে একাই ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশ ও তার শিল্প-সংস্কৃতি জানবার দুর্বার আকাক্সক্ষাকে সঙ্গী করে। নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে যারা ভালোবাসেন ফেরদৌস তাদেরই সহোদর।
নিউইয়র্কের ঞযব গঁংবঁস ড়ভ গড়ফবৎহ অৎঃ সেন্টার ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা, বিশেষভাবে ভ্যানগঘের ‘দ্য স্টারি নাইট’ দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে ফেরদৌস দারুণ প্রাণবন্ত এক আলোচনা উৎসমুখ খুলে দিলো যেন। মনে করিয়ে দিলো, ‘দ্য স্টারি নাইট’ এর মূল ছবির পরিমাপ হলো
(ঝঃধৎৎু হরমযঃ- ংরুব : ২৯”ঢ ৩৬”)। কিন্তু এ্যানিমেশনে দেখায় অনেক বৃহৎ করে।
কিছুদিন আগে এ্যানিমেশন মুভি ‘লাভিং ভিনসেন্ট’ দেখে ফেরদৌসের মতো আমারও মনে হয়েছিলো এ্যানিমেশন করা দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বিশালকার ‘স্টারি নাইট’ দেখে মূল ছবির স্বাদ খুঁজে পাওয়া আসলেই দুরূহ।

ভ্যান গঘের আঁকা বিখ্যাত ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ‘দ্য স্টারি নাইট’। ১৮৮৯ সালে ‘দ্য স্টারি নাইট’ এঁকেছিলেন তিনি দক্ষিণ ফ্রান্সের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে বসে, ব্যক্তিগত জীবনে তখন টালমাটাল সময় পার করছিলেন শিল্পী।
সেই সময়টায় নিজেই গিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ওই আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানেই সৃষ্টি হয় ‘দ্য স্টারি নাইট’।
অধিকাংশ চিত্র সমালোচকের মতে, ছবিটি গঘের আঁকা সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি।
পেইন্টিংয়ের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসায় আপ্লুত আর একজন শ্রদ্ধেয় মানুষের কথা জানি আমি। যিনি আমাদের জাতীয় অধ্যাপক, সদ্য প্রয়াত আনিসুজ্জামান স্যার। আমাদের দেশের অধিকাংশ বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের পেইন্টিং দিয়ে সাজানোছিলো স্যারের বাসার ড্রইংরুমে।
২০১৯ সালে স্যারের আশিতম জন্মদিন উপলক্ষে ‘রফিক আজাদ স্মৃতিপর্ষদের’এর পক্ষ থেকে স্যারকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিলাম তার গুলশানের বাসায়। এর ক’দিন আগে রফিক আজাদের ৭৮তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তিনিও প্রধান অতিথির দায়িত্ব পালন করতে এসেছিলেন।
আমাদের ধানমন্ডির বাসায়। আমার সঙ্গে স্মৃতি পর্ষদের পক্ষে আরো ছিলেন সদ্য প্রয়াত কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, কবি রুবী রহমান, পিয়াস মজিদ, অভিন্ন আজাদসহ আমার পরিবারের আরো অনেকেই।
স্যারের মতো এমন শিল্প সমঝদার খুব কম চোখে পড়েছে আমার।
কবি রবিউল হুসাইনও উঁচু মাপের একজন আর্ট ক্রিটিক ছিলেন। কালি ও কলমে আমি তার অনেক সমালোচনায় পড়ে ঋদ্ধ হয়েছি।
পেইন্টিং নিয়ে আসাদ ভাই এবং ফেরদৌসের সরস আলোচনার এক ফাঁকে আমিও খুব স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছিলাম ব্যক্তিগতঝরণাতলে।

তিন.
অন্যমনস্ক আমি তখন ভাবছিলাম ২০১২ সালের কথা। তখন আমি নিজে অসম্ভব কর্মব্যস্ত।
সরকারি তিতুমীর কলেজের পঞ্চাশ হাজার ছাত্রের অধ্যক্ষ হিসেবে ছাত্র পড়ানো, সামলানো ছাড়াও সরকারি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের অর্পিত দায়িত্ব পালনেই ভারাক্রান্ত রাত্রি-দিন। তবু দিনশেষে সন্তানের স্বপ্নাকাক্সক্ষা এবং সেই ইচ্ছে পূরণও মা-বাবার অন্যতম দায়িত্ব-কর্তব্যের অংশ বিশেষ হয়ে দেখা দিলো। অভিন্ন অব্যয়ের অনুরোধ ফেলতে পারলাম না কিছুতে। পিতা রফিক আজাদও দেখি সন্তানদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাচ্ছে। আমার অনুপ্রেরণা, শক্তি, সাহস, ভালোবাসার মিহি সুর-সব যখন এক তারে বেজে উঠছে,
তখন আমি একলা বাইরে থাকি কি করে?
পরিশেষে অভিন্নের উদ্যোগে এবং অনুরোধে কুড়িদিনের ছুটি নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম সপরিবারে। ছোট ভাই হাবীবের নিমন্ত্রণে স্যুইজারল্যান্ডের ডেলিমন্ড শহরে তার বাড়িতে অতিথি হয়েছিলাম।
জীবন সংগ্রামের এক পর্যায়ে স্যুইজারল্যান্ডের একমাত্র বাঙালি ডেভেলপার হিসেবে আমার ভাইটিও তখন বাঙালি, অবাঙালি এমনকি স্যুইস নাগরিকের কাছেও প্রিয় হাবীব ভাই হিসেবে সমাদৃত ও প্রশংসিত। বলাবাহুল্য যে, সুপ্রসন্ন ভাগ্যের সূর্য তার তখন মধ্যগগনে।
তার নির্মিত বাড়ি বানানো শেষ হতেই বিক্রি হয়ে যায় সব স্যুইস নাগরিকদের মধ্যেই।
দীর্ঘকাল বাদে এরকম সুসময়ে আমরা প্রথম তার অতিথি হয়েছিলাম। কবি (দাদাভাই) রফিক আজাদ, বোন, ভাগনে অভিন্ন অব্যয়কে নিয়ে স্যুইসের দর্শনীয় স্থান দেখাতে কোথায় কোথায় নেবে, কি খাওয়াবে দাদাভাইয়ের প্রিয় পানীয় ব্ল্যাক লেবেল এবং সিভাস রিগাল, সঙ্গে বরফকুচি জল নিয়ে যেন-আনন্দ উদযাপনের প্রহর গুনছিলো।
ডেলিমন্ড শহরে তার বাড়ির মনোমুগ্ধ আতিথেয়তায় দুদিন কাটাতেই অভিন্ন তার ইচ্ছের কথা জানালো মামাকে। ইউরোপ ও ভূস্বর্গের বিস্ময় আলেপ্স পর্বত দর্শনের আগে প্রথমে সে রোমের ভ্যাটিক্যান সিটির সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিং আঁকিয়ে বিখ্যাতচিত্রশিল্পী মিকেলেঞ্জেলোর পেইন্টিং দেখতে চায়।
অভিন্নের ইচ্ছের মূল্য দিয়ে তার মামাও আমাদের চারজনের জন্যে প্লেনের টি কেটসহ হোটেল বুক করে দিলো এবং পরেরদিন গাড়ি চালিয়ে জেনেভা এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে এলো। ব্যবসায়িক ব্যস্ততার জন্যে এ যাত্রায় সে আমাদের সঙ্গী হতে পারলো না।
সন্ধ্যারাত নাগাদ আমরা রোমে পৌঁছুলাম। বিখ্যাত প্রবাদ বাক্য- রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল।
এই সেই রোম?
ইতিহাসের সেই শহর এটি?
রোমান সাম্রাজ্যের পঞ্চম সম্রাট নিরোর দেশ, এই সেই রোম।
অজানা এক রোমান্সে গা আমার ছমছম করছিলো।
রোম শহরের বীভৎস অগ্নিকাণ্ডের পর সেই ধ্বংসস্তূপের ওপরই নিরো তার স্বপ্নের ডোমাস অরিয়া বা স্বর্ণগৃহ নির্মাণ করেছিলেন। আর এই ডোমাস অরিয়া স্থাপত্যকলারও অবিস্মরণীয় এক অনন্য নিদর্শন।
বিস্ময়ের ঘোর কাটছিলো না কিছুতেই। আমি আজ প্রত্যক্ষ করছি নিজে এবং সপরিবারে এমন আনন্দঘন সময় আমাদের ভাগ্যে অপেক্ষা করছিলো এ যেন আমার কল্পনাতেও উঁকি দেয়নি কখনো।
গরিব কবি বাবা-মাকে নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণের উচ্চবিলাসী এই স্বপ্ন-বাস্তবায়নের জন্যে এককভাবে উদ্যোগ নিয়েছিলো আমাদের পরম সন্তান অভিন্ন। বন্ধু শায়েরর কাছ থেকে পাঁচ হাজার ডলার ধার নিয়ে এসেছিলো তার একরোখা জেদের জন্যে সম্ভব হয়েছিলো অদেখাকে দেখা এবং অজানাকে জানার এমন মাহেন্দ্রক্ষণ।
ফলে স্মৃতি বিহবল অবিস্মরণীয় একটি রাত কাটিয়েছিলাম রোম-শহরে। কবি রফিক আজাদ এতটাই চঞ্চল আর অস্তির হয়ে উঠেছিলো যে, যেভাবেই হোক এই রোম শহরে বসে তার প্রিয় পানীয় ব্ল্যাকলেবেল পান করতেই হবে। কিন্তু আমাদের হোটেল সংলগ্ন বিভিন্ন বার রেস্তোরাঁয় শুধু ওয়াইন পাওয়া যায়। রেড কিংবা হোয়াইট ওয়াইন যাই চাও না কেন।
ফলে অর্ধরাত্রি অনুসন্ধানেও সেদিন কোনো হার্ড ড্রিংস পাওয়া যায়নি।
রেস্তোরাঁর মালিক, ম্যানেজার অধিকাংশ ইতালীয় ভাষায় কথা বলে, ইংরেজি প্রায় বলে না। ৩/৪টি রেস্তোরাঁয় পছন্দমতো খাদ্য ও পানীয় না পেয়ে অভিন্ন অপর একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকেছে আমাদের নিয়ে।
সেখানে কিছু ইন্ডিয়ান খাবার পাওয়া গেলেও ব্ল্যাকলেভেল জাতীয় কিছু নেই শুনে রফিক আজাদের অস্তিরতা যেন পাগলামী পর্যায়ে পৌঁছে গেলো।
বাংলাদেশের পটভূমিতে রফিক আজাদকে নিয়ে একটা প্রবাদের মতো কথা প্রচলিত ছিলো যে, রফিক আজাদ কখনো ভাতের নিমন্ত্রণে যায় না।
কিন্তু যেখানেই যায়, সেই সব নিপাট অঞ্চলেও রফিক আজাদ চাইলে মাটি থেকেও ফিনকি দিয়ে মদ বেরোয়।
তো, এই প্রবাদ নিরোর রোম শহরে খাটছে না কিছুতেই।
রেস্তোরাঁর ম্যানেজার ছেলেটি অগত্যা ভাঙা ইংরেজিতে অভিন্নের কাছে জানতে চাইছে, পাপা প্রবলেম, পাপা প্রবলেম, এ্যানিপ্রবলেম?
হুম, তুমি বুঝবে না এই বাঙালির প্রবলেম। বরং তোমার রেড লেভেলের তলানীতে যেটুকু পড়ে আছে, সেটুকু আপাতত দাও আমার বাবাকে। শান্ত করি তাকে।
এভাবেই সেদিন কবি ও পিতার সামান্য ইচ্ছে পূরণ করতে অভিন্ন আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো।
আমাদের হোটেল সংলগ্ন এলাকায় যেহেতু অন্য কোনো ড্রিংস পাওয়া যাচ্ছিলো না-কাজেই ফেরার সময় অভিন্ন অগত্যা হোয়াইট ওয়াইনের দুটো বোতল সঙ্গে নিয়ে বাবাকে শান্ত করলো। রাত দুটো নাগাদ আমাদের নিয়ে হোটেলে ফিরে এলো।
এই বিদেশ বিভূঁয়ে এসে হঠাৎ করেই আবিষ্কার করতে পারলাম যে, মা-বাবা দু’জনকেই টেককেয়ার করার মতো সন্তানটি আমাদের বড় হয়েছে, হঠাৎ করেই যেন সপ্রাণ,
সহমর্মী এক অভিভাবক হয়ে উঠেছে আমাদের মাথার উপরে।
মনে হচ্ছিলো নির্ভরতা ও আশ্রয়ের একটা নতুন দ্বীপ জেগে উঠেছে আমার জন্যে।
একথা ভেবে সেই রাতে মা হিসেবে আনন্দে যেন বুকটা ভরে গেলো আমার।
রফিক আজাদ ঋষিতুল্য মানুষ বটে, কবি হিসেবে ততোধিক মানবিক, স্পর্শকাতর, নির্মোহ, সাধক এবং ভবিষ্যৎ দ্রষ্টাও বটে।
কিন্তু স্বামী হিসেবে?
একে তো কবি স্বামী, অতপর সংসার উদাসী, নির্মোহ, বিষয়হীন, উপরন্তু তিনি সারাজীবন বিশ্বাস করেছেন বিষয়ই বিষ- ওদিকে তাকাতে নেই।
টাকা হলো হাতের ময়লা অনর্থের একশেষ,
এই শিক্ষা তার দুজন সন্তানকেই দিয়েছেন তিনি।
কাজেই সংসারের দীর্ঘ যাত্রায়, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কখনো তাকে ভরসা করতে পারিনি, যতটা ভরসা করেছি স্বয়ং আল্লাহকে এবং নিজের বুদ্ধি-মত্তা, শক্তি ও সাহসের। এতকাল পরে সংসার যাত্রায় হাত বাড়াবার মতো একটা বলিষ্ঠ কাঁধ যেন খুঁজে পেলাম সন্তানের।
মাতৃত্বরসের অতুলনীয় এই অনুভূতি একজন মা-ই শুধু উপলব্ধি করতে পারেন।
একথা সত্যি যে, সেই রাতেই আমার সকল ব্যর্থতারবোধ ঘুচে গেছিলো।
মনে হয়েছিলো একটি স্বয়ং সম্পন্ন পরিবার গড়তে আমি সমর্থ হয়েছি।
একজন মা হিসেবে আমি বিজয়ী।
আমার সকল শ্রম-ঘাম-কষ্ট, অনিশ্চয়তা সব? সব সার্থক আজ।

চার.
ভোরের সূর্যোদয় হতেই অভিন্ন প্রথমে কলোসিয়াম দেখার টি কেট বুক করলো অতপর ৫০১ জনগণ নিয়ে গঠিত বিশ্বের ক্ষুদ্রতম সিটি ভ্যাটিক্যান সন্দর্শনে সারা দিনমান কাটানোর প্ল্যান করে আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
অজানাকে জানার অতুলনীয় এক সুযোগ সৃষ্টি করে দিলো অভিন্ন। সিস্টিন চ্যাপালের প্রবেশমুখ থেকেই পৃথিবী বিস্ময়ের পর্দা এক এক করে খুলে যাচ্ছে আমাদের সামনে। নয়ন সমুখে যেন দেখতে পাচ্ছি জীবন্ত মিকেলাঞ্জেলোকে।
রেনেসাঁস যুগের ইতালীয় এই শিল্পী, যিনি ছিলেন একাধারে ভাস্কর, চিত্রকর, স্থপতি, কবি ও প্রকৌশলী।
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ছাড়া তার বহুমুখী প্রতিভার সঙ্গে তুলনীয় কেনো শিল্পীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
১৫০৮ সালে শুরু করে ১৫১২ সালে পর্যন্ত মিকেলাঞ্জেলো কোনো সাহায্যকারী ছাড়াই সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিংয়ের ফ্রেস্কো আঁকার কাজ শেষ করেছিলেন।
চ্যাপেলের প্রবেশপথ থেকে আঁকতে আঁকতে পেইন্টিং শেষ করেছেন উপাসনা বেদির উপরে গিয়ে।
সিলিংয়ের কেন্দ্রের কাছাকাছি আঁকা ঈৎবধঃরড়হ ড়ভ অফধস. যেটা কিনা চিত্রকলার জগতে অন্যতম শ্রেষ্ঠকীর্তি আর সবচেয়ে বেশিবার আঁকা একটা চিত্রকর্ম।
এই চিত্রে বাইবেলের জেনেসিস বা সৃষ্টিতত্ত্বের ঘটনা অনুসারে পৃথিবীর প্রথম পুরুষ আদম এবং ঈশ্বরকে দেখা যাচ্ছে। মূলত এই ছবিতে চিত্রিত হয়েছে মানবজাতি সৃষ্টির অনন্য এক পরম মুহূর্ত।
কাজেই উপাসনা বেদির এই কক্ষে ছবি তোলা একদম নিষিদ্ধ।বার বার বাঁশি বাজিয়ে এই বেদিকক্ষে ছবি না তুলতে সতর্ক করা হচ্ছিলো দর্শনার্থীদের।
অধিকাংশ খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের দর্শনার্থী প্রার্থনায়রত ছিলো, পরিবেশও শান্ত স্নিগ্ধ যে কোনো ধর্ম উপাসনালয়ের মতো-নীরব, সুনসান।
নিষেধ থাকা সত্ত্বেও আমাদের তিনজনের আড়ালে ঢুকে নিচু হয়ে সিলিং তাক করে অভিন্ন টুক করে ২/৩টা ছবি তুলে নিলো তার ক্যামেরায়।
স্রষ্টাও সৃষ্টির অপরিমেয় এই চিত্রকর্ম নিজের ক্যামেরায় নিজের হাতে তোলার বোধ করি আনন্দই আলাদা, সেজন্যে অভিন্ন এইসুযোগটি হাতছাড়া করেনি বলেই মনে হলো আমার।
তবে পরিদর্শন শেষে ঈৎবধঃরড়হ ড়ভ অফধস এর একটি রেপ্লিকা পেইন্টিং কিনে এনেছিলাম আমি। যা বাঁধাই করে রেখেছি ধানমন্ডির বাসার বারান্দায়।

পাঁচ.
রোম থেকে ফিরে এসে পরের সপ্তাহে গেছিলাম ফ্র্যান্সে।
সেখানে থাকে ছোট বোন রানুর একমাত্র পুত্র রনি। তাকে দেখবার আকুল বাসনা যেমন ছিলো তেমনি প্যারিসের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অতীত খুঁড়ে দেখবার স্বপ্ন তো লুকানো ছিলোই বুকের খুব গভীর তলদেশে।
ইতিহাস বিধৌত জলের ছিঁটায় জেগে উঠেছে সেই অজানা তৃষিত প্রাণ। প্রবল তৃষ্ণায় যেন কাঁপছে ঠোঁট।
প্যারিসের যে পথে হেঁটেছেন কবি শার্ল-পিয়ের বোদলেয়ার (১৮২১-১৮৬৭), সেই পথে হাঁটবো আজ আমি ও রফিক আজাদ বাংলাদেশের দু’জন কবি।
যিনি পঙ্কে ফোটাতে চেয়েছিলেন পদ্ম, যিনি আধুনিকতার পুরোধা কবি হিসেবে আজো সারাবিশ্বে সমান সমাদৃত। বাঙালি কবিদেরও তিনি প্রভাবিত করেছেন তুমুলভাবে- এমনকি আধুনিকতার গতিপথকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন তিনি। এই কবির শহর প্যারিস বা প্যারী। তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, কাব্যচর্চার সেই ফসলি মাঠে তার পদচ্ছাপ এতকাল পরে খুঁজে পাবো কি?
এই অনুভূতি যেন স্বপ্নের চেয়ে বেশি বিস্ময়ের ঘোরলাগা এক জ্যোৎস্নালোক।
এই যাত্রায় আমরা এক পরিবার নই শুধু, ভাই হাবীবের পরিবারও সঙ্গী হবে। সবচেয়ে কাক্সিক্ষত এবং আনন্দময় ভ্রমণ যাত্রা।কাজেই তার প্রস্তুতিতে রয়েছে ভিন্নতা।
ডেলিমন্ডের পাশের শহর ‘বাসেল’ থেকে ভাই হাবীব ১২ সীটের একটি এসইউভি গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে এলো আগের দিন সন্ধ্যায়।
পরেরদিন খুব সকালেই ফ্র্যান্সের উদ্দেশে যাত্রা করলাম ভাই-বোনের দুই পরিবারের আটজন সদস্যের একটি ইউনিক গ্রুপ। ভাইয়ের স্ত্রী রেণু প্রয়োজনীয় কিছু খাবার আগেরদিন তৈরি করে রেখেছিলো সেসব জল-খাবার নিয়ে উঠে পড়লাম খুব সকাল করেই।
ব্রেকফাস্ট হবে গাড়িতে বসে, শুধু কাফে খেতে নামবো আমরা পথের ধারের যে কোনো কফিশপে।
ড্রাইভং সিটে এককভাবে ভাই হাবীব ক্লান্তিহীন। তার পরিবারের চারজনই চমৎকার গাড়ি চালায় কিন্তু এই ভ্রমণ যাত্রায় সেই আমাদের একমাত্র ভরসা।
পথিমধ্যে কফিবারে থেমে ডাবল শর্ট এক্সপ্রেসো পান করলেই ফুল অ্যানার্জিতে আবার ড্রাইভিং সিটে বসে যায় ভাইটি আমার।
দুপাশে সর্ষে ক্ষেত দেখে অবাক বিস্ময়ে আমি অভিভূত।
ঠিক যেন বাংলাদেশের সর্ষে ফুলের মতো একটু ঝাঁঝালো সুগন্ধের সঙ্গে স্বদেশের আবির মাখা সময়- যা আমাকে বারবার আনমনা করে দিচ্ছিলো।
ফ্রান্সের বর্ডার সংলগ্ন মাইল মাইল সর্ষেক্ষেতে হলুদ ফুলের বিস্তারে আমার এমন বিস্ময় দেখে ভাই হাবীব একটা গ্যাস স্টেশনচেইনশপ মার্সের পাশে থামলো।
নেমে কফি ও ক্রোঁসো খেলাম সবাই।
আমাকে কিনে দিলো বিভিন্ন প্রকারের কয়েকটি ডিজন মাস্টার্ড স্যাম্পল। এদেশের লোকেরা সর্ষের ব্যবহার কিভাবে করে বা খায়- হাতেনাতে তার উত্তরটি যেন দিয়ে দিলো আমার ভাই।
গাড়ি পুনরায় চলতে শুরু করলে অভিন্ন গান ধরলো, গ্রাম ছাড়া এই রাঙামাটির পথ আমার মন ভুলায় রে’।
স্যুইজারল্যান্ডেই জন্ম এবং বেড়ে ওঠা আমার ভাইয়ের কন্যা অনন্যা এবং পুত্র প্রীতম মন প্রাণ দিয়ে গানের বাংলা সুর ওকথাগুলো যেন বুঝতে চেষ্টা করছিলো।
এই সময় ডিজন মাস্টার্ডের কৌটাগুলো আমার হাত থেকে নিয়ে রফিক আজাদ নেড়ে চেড়ে দেখলেন। এর মধ্যে আমরা ফ্রান্সের বর্ডারের কাছাকাছি চলে এলাম।
প্যারিস থেকে ভার্সাইয়ের দূরত্ব দশ মাইলের মতো।
কাজেই সিদ্ধান্ত হলো ভার্সাইয়ের বিখ্যাত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ভার্সাই প্রাসাদ দেখবো আগে, পরে রনির বাসার ক্যান্ডেল ডিনারের নিমন্ত্রণ রক্ষা করবো। খেতে খেতে ভাগনে রনির নতুন বৌয়ের মুখ মুখবো।
পাঁচ ঘণ্টার জার্নি শেষে আমরা পৌঁছে যাই ভার্সাই প্রাসাদের সমুখে গাড়ি পার্কিং লটে।
সেখানে গাড়ি রেখে হাবীবসহ আটজনই আমরা প্রবেশ করি ভার্সাই প্রাসাদে। ভাতিজা প্রীতম টি কেট কেটে নিয়েছিলো আগেই। দলবদ্ধভাবে আমরা প্রাচীন এই প্রাসাদের রূপ-সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম বিভিন্ন কক্ষে ঢুকে ঢুকে এবং থেমে ছবিও তুলছিলাম।
ভার্সাই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রাজপ্রাসাদের মধ্যে একটা এবং এর দেয়ালে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির নিজের হাতের আঁচড়ে তৈরি শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে। না, পেইন্টিং হিসেবে নয় বরং ওয়ালপেপার হিসেবে।
রফিক আজাদ কিছুক্ষণ দেখার পরেই ক্লান্ত হয়ে গেলেন, জানি এসব ঝলমলে বৈষয়িক ব্যাপার-স্যাপার তার পছন্দ নয়।
তবে এর ইতিহাস যে কাউকে কৌতূহলী করে বৈকি।
ফরাসি সম্রাট ত্রয়োদশ লুই সর্বপ্রথম ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দে ইট ও পাথর দিয়ে ভার্সাইয়ে একটি হান্টিং লজ নির্মাণ করেন। সেটিই ছিলশাতো দ্যু ভার্সাইর সূচনা। তার মৃত্যুর পর প্রায় ১৮ বছর এই প্যালেস অব্যবহৃত ছিল।
এরই ধারাবাহিকতায় ফরাসি নৃপতি লুই চতুর্দশ নিজের বাস ভবন হিসেবে বিশাল প্রাসাদ ও উদ্যান সম্প্রসারণ
করেন। ফ্রান্সের অসীম ক্ষমতাধর রাজতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ভার্সেই রাজপ্রাসাদ।
এই প্রাসাদে আছে দুই হাজার কক্ষ। এর চেয়ে কয়েকগুণ দরজা-জানালাবিশিষ্ট এ প্রাসাদটির সংগ্রহে আছে ছয় হাজার ১২৩টি পেইন্টিং ও দুই হাজার ১০২টি ভাস্কর্য।
অথচ ৪৫০ বছর আগে ভার্সাই মূলত প্যারিসের অদূরের একটি সাধারণ গ্রাম ছাড়া আর কিছু ছিল না। প্রথমে সম্রাট ত্রয়োদশলুই এর চারপাশে চল্লিশ হেক্টর জমি ক্রয় করেন। ইতিহাস-খ্যাত বিখ্যাত স্থপতি ‘লুই লা ভাউ’ প্রাসাদটির ডিজাইন এবং নির্মাণকাজ তদারকি করেছিলেন।
একথা অস্বীকার করা যায় না যে, ঝলমলে আলোকখচিত রাজপ্রাসাদটি যেন সোনালি উর্মিমালার মতো ঢেউ খেলে যাচ্ছিলো নয়ন থেকে নয়নে। বিস্মিত, বিস্ফারিত নয়নে নয়ন রেখে দেখছিলাম সেসব।
স্থাপত্য কলার অনন্য নিদর্শন ছাড়াও প্রাসাদটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব কম নয়। ১৭৮৩ সালে ‘পিস অব প্যারিস’ চুক্তি এখানে সম্পাদিত হয়, ১৯১৯ সালে ‘ভার্সাই চুক্তি’ দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হয় এই রাজপ্রাসাদ থেকেই।
চতুর্দশ লুইয়ের হাতে গড়া এই প্রাসাদটি ১৬৮২ সাল থেকে ফ্রান্সের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় যা ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অবলুপ্তি ঘটে।
বারবার মনে পড়ছিলো এই ভার্সাই নগরে একদা বাস করেছেন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। একবার যদি তার বাসস্থানটি দেখতে পেতাম নয়ন মেলে- আহা, বাংলা সাহিত্য পাঠ যেন আমার সার্থক হতো চিরজনমের মতো।
কিন্তু জানি, এই অল্প সময়ে তা সম্ভব হবে না। কাজেই এই রাজপ্রাসাদ পেছনে বাগানের শেষদিকে পুরনো দিনের একটি ছোট ‘ক্যাফে বার’ আছে। এখানেই আসতেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সেই ক্যাফে বারটি হন্যে হয়ে খুঁজছিলাম তখন। খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে চোখে পড়লো সবুজ বৃক্ষবেষ্টনীর মধ্যে এক অপরূপ অপেরা হাউস- যা নির্মিত হয়েছিলো পঞ্চদশ লুইয়ের সময়ে।
রাজপ্রাসাদের পেছনে এসে দেখলাম মনোরম এক লেক, ঝর্ণা, বিচিত্র সব ভাস্কর্য অব্যয় প্রতিটি ভাস্কর্যে হাত বুলিয়ে অনুভব করছিলো শিল্পের মহিমা। আর মাঝে মধ্যেই তার বাবার সঙ্গে দুষ্টুমি করছিলো সেসব মানবমূর্তির আকৃতি প্রকৃতি নিয়ে। অভিন্ন এবং অনন্যা অবশ্য খুব সিরিয়াস ইতিহাস প্রেমীর মতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো বেশ সময় নিয়ে। পরিতৃপ্ত শিক্ষার্থীর মতোজ্ঞানের আনন্দে কিছুটা উদ্বেলিত, একই সঙ্গে বিস্ময়ে বিমোহিতও বটে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিলো যেন অতীত ইতিহাসের মৃদুমন্দ সুরভিত সুন্দর। জ্যামিতিক ফুলের বিছানা এবং কালারফুল সব ফুলের সাজ-সজ্জা দেখে আমি তো সবিস্ময়ে হতবাক।
কত যে ছবি তুলেছিলাম পাগলের মতো ভাবা যায় না।
গাছের খাঁজে খাঁজে সজ্জিত বাগান সেও এক পরম বিস্ময়। নানা রকম ফলের গাছে ফল ধরে আছে, বিচিত্র রঙের বিভিন্ন পাখির কল-কাকলিতে মুখর হয়ে আছে চারপাশ।
দীর্ঘ লেকটি চলে গেছে দক্ষিণের প্রান্ত পর্যন্ত। এই বাগানের পথ ধরেই কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে খুঁজে পেলাম পুরনো দিনের একটি ছোট ‘ক্যাফে বার’।
এই ক্যাফেতে মধুসূদন এসে বসতেন। সময় কাটত প্রকৃতির অপরূপ শোভা দেখে। নিশ্চয় মনে পড়ত তার বাংলার পথ-প্রান্তরের কথা।
বঙ্গ ভান্ডারে বিবিধ রতনের কথা ভেবে নিশ্চয় আকুল ও উন্মনা হতেন তিনি।
রফিক আজাদ হঠাৎ বলে উঠলেন, আমিও তো এই মাইকেল ঘরানার কবি। যে কিনা শেষ পর্যন্ত মোমের দুধারের সলতে আগুন দিয়ে সবকিছু শেষ করে দিলেন দ্রুত। প্রকৃত কবির ভাগ্য এমনি হয়!
আহা, সনেটের কবি। বাংলা ভাষার কবি।
আধুনিক মহাকাব্যের এক বাঙালি কবি।
যিনি এই রাজপ্রাসাদের আঙিনায় চরম কষ্টের মধ্যেও ঘুরে বেরিয়েছেন। হয়তো সন্তানদের নিয়েও এসেছেন। লেকের পাশে বসেগল্প শুনিয়েছেন তার নিজের বাংলা প্রকৃতির।
হয়তো হেনরিয়েটাও তখন কবির পাশে বসে মনোবল উৎসাহ দিয়েছেন কাব্য রচনায়।
মেঘনাদবধ মহাকাব্যে রাবনের লঙ্কাপুরীর প্রমোদ উদ্যানের যে বর্ণনা পাই, এতেই বুঝি কতটা প্রকৃতি পূজারি ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত নিজেই।
এই সাজানো প্রকৃতির চিরকালীন সংগীতের মূর্ছনায় তিনিও নিশ্চয় জেগে উঠেছেন বারবার।
তাই তো সহজেই পরাজয় মেনে নেননি। তার পাশে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মহৎ প্রাণের মানুষ।
সংগ্রাম করে জয়ী হয়েছেন বলেই একজন বঙ্গভাষার কবি আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন বিশ্ববাসীর কাছে।
শত দর্শনার্থীর ভিড় এড়িয়ে বাংলাদেশের আরো দুজন কবি এই ভার্সাই প্যালেসের ছোট্ট একটি ক্যাফে বারে
এসে তাকেই খুঁজে ফিরছে।
একেই কি বলে শতবর্ষ পরেও কবির বেঁচে থাকা?

ছয়.
বিশ্বের বৃহত্তম শিল্পকলা জাদুঘর প্যারিসের এই ল্যুভর মিউজিয়াম। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের সেন নদীর ডান তীরে অবস্থিত। একটি ঐতিহাসিক স্থাপনাও বটে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সৃষ্ট প্রায় ৩৮ হাজার শিল্পবস্তু প্রদর্শন করা হয় এই মিউজিয়ামে। ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী ল্যুভে মিউজিয়াম বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিদর্শিত শিল্পকলা জাদুঘর। এ বছর ৯ কোটি ৬ লাখ দর্শনার্থী ঘুরতে আসেন।
কাজেই এ রকম একটি শিল্পভাণ্ডার দেখার স্বপ্ন সকলের হৃদয়ে বসত করবে না তো কি?
মোনালিসার রেপ্লিকা দেখতে দেখতে চোখ অন্ধ তবু তো বাসনা মরে না। চিত্রকর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি!
জগদ্বিখ্যাত চিত্রশিল্পী, মোহনীয় তার পেইন্টিং ‘মোনালিসা’। এই মোনালিসার অরিজিনাল বা মৌলিক ছোট এক টুকরো ছবির সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন যে হৃদয়-কম্পন অনুভব করেছিলাম সেই অচেনা কম্পন অনুভূত হতো শুধুমাত্র পরীক্ষা হলে বসে। নয়তো হঠাৎ প্রেমিকের দেখা পেলে।
পৃথিবীর সারা জাগানো মোনালিসার এই মূল ছবিটি দেখতে সেখানেও লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে রফিক আজাদ এবং আমি দুজনেই গলদঘর্মে নাকাল হয়েছিলাম। যদিও সামনে-পেছনে অভিন্ন ও অব্যয় আমাদের স্কট করে নিয়ে যাচ্ছিলো। আধা ঘণ্টায় বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ করে মোনালিসার হাসির সমুখে এসে যেই না তাকালাম, মনে হলো ঘন আঁধারের পটে দাঁড়িয়ে পূর্ণিমায় ভেসে যাওয়া একটি চঁাঁদমুখ দেখছি আমি। কিন্তু দর্শনের সময় সর্বসাকল্যে মাত্র পাঁচ মিনিট। খুঁটিয়ে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া খুব কাছে গিয়ে দেখাও নিষেধ- লাখো কোটি মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসে ছবিটি যেন অচিরেই নষ্ট হয়ে না যায়- সেজন্যে ছবি থেকে অন্তত ১০/১২ হাত দূরে দর্শক সারিতে দাঁড়িয়ে যেটুকু দেখা যায়, এতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিলো সেদিন। তবে বিষণ্ন প্রকৃতির কবি রফিক আজাদও সেদিন সত্যিকার অর্থেই উচ্ছ¡সিত আনন্দে উদ্বেলিত ছিলেন। পরম-আরাধ্য কিছু প্রাপ্তি ও সন্দর্শনের আহ্লাদে যেন শিশির-ভেজা এক মাঠ। সোনালি শিশির পানে যেমন খুশি থাকেন, আনন্দে টলমল, নিমিলিত আঁখি- সে রকম অদ্ভুত মুখ মায়া চোখে তাকিয়েছিলেন তিনি আমার মুখপানেও।
কেন?
তা কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয়নি সেদিন।
তবে সেদিন এভেন্যু দ্যু শঁজেলিজে ধরে দীর্ঘক্ষণ দুজন হেঁটেছি হাতে হাত রেখে। হৃদয়তন্ত্রীতে বার বার বেজে উঠেছেন কবি শার্লবোদলেয়ার। এই পথেই তো হেঁটেছেন তিনি। তাই না?
যেমন আমরা বাংলাদেশের দুজন কবি তাকে স্মরণ করে এতদূর এসেছি, আজো খুঁজে চলেছি তার মুদ্রিত পদচ্ছাপ।
রফিক আজাদ ও আমি দুজনেই এক সঙ্গে আবৃত্তি করেছিলাম তার বিখ্যাত সেই কালজয়ী পঙ্ক্তিমালা।
‘প্রিয়তমা, সুন্দরী তমারে,
যে আমার উজ্জ্বল উদ্ধার
অমৃতের দিব্য প্রতিমারে,
অমৃতেরে করি নমস্কার।
বাতাসে সত্তার লবণে
বাঁচায় সে জীবন আমার,
তৃপ্তিহীন আত্মার গহনে
গন্ধ ঢালে চিরন্তন’।
জগদ্বিখ্যাত শঁজেলিজে নামের এই সড়কটির ওপর বহু চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহ, ক্যাফে, বিশেষ শৌখিন দ্রব্যের দোকান যেমন আছে তেমনি নামিদামি ব্র্যান্ডের শপিংমল দাঁড়িয়ে আছে অপলক ভঙ্গিতে।
এই রাস্তায় হেঁটেছেন শার্ল বোদলেয়ার বহু দিবস ও রজনী। নিশ্চয় প্রেমিকা জান দ্যুভালকে নিয়ে শার্ল বোদলেয়ার এখানকার কোনো ক্যাফেতে বসেই কফি খেতেন।
এই ভাবনা মাথায় নিয়ে আমরা দুজনে একটা ক্যাফেতে বসে রেগুলার সাইজের দুটি কফি নিলাম আর সঙ্গে দুটি ক্রোঁসো। কবিকে স্মরণ করেই কফিমগে চুমুক দিলাম দুজনে।
কফির সঙ্গে ক্রোঁসো খেতে খুব উপভোগ করতেন রফিক আজাদ। এ কারণে ২০১৫ সালে যখন আমরা টরন্টোতে যাই, অভিন্ন মন্ট্রিয়েলের নামকরা ‘আমা খুইয়াম’ নামের একটি বেকারিতে নিয়ে নানা পদের, নানা স্বাদের ক্রোঁসো আর কফি খাইয়েছিলো তার বাবাকে।
ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়া শঁজেলিজে সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে গ্রিক পুরাণ অনুসরণে- যার অর্থ ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা’।
এই শঁজেলিজে নামের সড়কটি যেখানে শেষ হয়েছে সেখানেই রয়েছে প্যারিসের অন্যতম দর্শনীয় সৌধ (প্যারিস গেট) আর্ক অফট্রায়াম্ফ।
ভাই হাবীবের অনুরোধে কিছু মার্কেটিং করেছিলাম। রেণু চমৎকার একটি ব্যাগ কিনে দিয়েছিলো সেদিন।

সাত.
উনিশ শতকের পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থাপনাটির নাম ছিলো আইফেল টাওয়ার। যদিও বর্তমানে পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থাপনা বুর্জ খলিফা। এ কথা মানতেই হবে যে, আইফেল টাওয়ার একটি বিশ্ববিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক, যেটি প্যারিসের প্রায় সমগ্র জায়গা থেকে দেখা যেতে পারে।
ফরাসি বিপ্লবের শতবর্ষ স্মরণীয় করে রাখতেই ১৮৮৯ সালে প্যারিসে নির্মিত হয়েছিলো আইফেল টাওয়ার।
১ হাজার ৫০ ফিট উচ্চতার এই টাওয়ারটি কেবল প্যারিস শহরের আকর্ষণ নয়, গোটা বিশ্বে পরিচিত এক নাম।
প্যারিসের সেন নদীর তীরবর্তী এলাকায় গোস্তাব আইফেল ১৮৮৯ সালে এটি নির্মাণ করেছিলেন।
ফ্রান্স মানেই নতুন দর্শনার্থীর কাছে প্রথমে ল্যুভর জাদুঘর, আইফেল টাওয়ারের পর ভার্সাই রাজপ্রাসাদ সর্বাধিক পরিদর্শনকৃত স্মৃতিস্তম্ভ। আইফেল টাওয়ারের স্থানীয় নাম ‘লা দামে দি ফার’ অর্থাৎ লোহার নারী।
এই লোহার নারীকে দেখতে প্রতি বছর প্রায় কোটির ওপরে দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে।
আমাদের ছোট পুত্র অব্যয় রাজধানী প্যারিস শহরের আইফেল টাওয়ার দেখবার আনন্দে যেন কাঁপছিলো সেদিন।
বাংলাদেশ থেকে ৭ হাজার ৯০৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই আইফেল টাওয়ারে উঠে অব্যয় আজাদের আনন্দ যেন আর ধরে না। খুশিতে তার নয়নদ্বয় যেন চিকচিক করছিলো। তার অভিনব ভাবনা থেকে নিজের নামটি স্বাক্ষর করে এসেছিলো টাওয়ারের লোহার শরীরে।
তারপর যথারীতি দুই ভাই মিলে ভবিষ্যতে কোনো একদিন তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে যখন সে আইফেল টাওয়ার ঐ উচ্চতায় উঠবে, নিশ্চয় সেদিন তার স্বাক্ষরটি খুঁজে বের করে দেখাবে তার সন্তানদেরকে।
নিশ্চয় কবি পিতা-মাতা এবং ভাইকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম আইফেল টাওয়ার দর্শনের স্বপ্ন-শিহরণের গল্পটিও মনে পড়ে যাবে সেই নদীর জলপ্রবাহের দিকে তাকিয়ে।
২০১২ সালের সেই স্বাক্ষর-চিহ্ন দেখে নিশ্চয় পিতা হিসেবে অব্যয়েরও মনে পড়বে সম্রাট শাহজাহানকে নিয়ে রচিত রবীন্দ্রনাথের অবিস্মরণীয় কবিতার অমর কিছু পঙ্ক্তিমালা।
সফল মানুষের চিত্তেও চিরকালের যে শূন্যতা ও হাহাকারের আর্তি অপরিমেয় এক আকাক্সক্ষা ডেকে আনে,
‘তাই
চিহ্ন তব পড়ে আছে, তুমি হেথা নাই।
যে প্রেম সম্মুখপানে
চলিতে চালাতে নাহি জানে,
যে প্রেম পথের মধ্যে পেতেছিল নিজ সিংহাসন,
তার বিলাসের সম্ভাষণ
পথের ধুলার মতো জড়ায়ে ধরেছে তব পায়ে

দিয়েছে তা ধুলিরে ফিরায়ে।’
চিত্রশিল্পের রেনেসাঁস যুগের অন্যতম আর এক প্রধান শিল্পী রাফায়েলের সৃষ্ট তার বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘ব্রিজওয়াটার’ দেখে একইভাবে বিস্মিত ও বিমোহিত হয়েছিলাম এই ভ্যাটিক্যানে।
আট.
আত্মঘাতী করোনার তাণ্ডবে গৃহবন্দি হয়ে আছে পৃথিবী। কাজেই অতি প্রিয়জনদের সঙ্গেও দেখা হয় না কতকাল। মানুষ বেঁচে আছে শারীরিকভাবে, মন, মানবিকতা সবই যেন প্রকৃতির ধুলায় গড়ায় আজ। মানবিকতার নতুন সংজ্ঞায় আগামী পৃথিবী নিশ্চয় পথ করে নেবে নিজের মতো করে, আমরা তখন থাকবো না নিশ্চয়।
ভাগ্যিস ফেরদৌস আর হিমাদ্রির উদ্যোগে বছর দুয়েক পরে হলেও আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। মুহূর্তেই যেন স্কারবোরোতে উঠে এলো বাংলা একাডেমির গন্ধমাখা এক খণ্ড বাংলাদেশ।
কবি আসাদ চৌধুরী এদেশেও সমান জনপ্রিয় কবি ব্যক্তিত্ব।
শুধু কি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় কবি?
না, আরো নানা গুণে গুণান্বিত খুবই ইতিবাচক মানুষ তিনি। একদা জার্মানি এবং বাংলাদেশের মিডিয়া কাঁপানো জনপ্রিয় কণ্ঠস্বরটিও যেন সকলেরই চেনা আপনজনের এক অদম্য কণ্ঠস্বর।
স্বরচিত তার কবিতা আবৃত্তির ঢংটিও নিজস্ব সৃজনশৈলীতে ভাস্বর। কারো মতোই নয় কোনোমতে।
বলা যায় যে, আমাদের কাব্যভুবনে একজনই কবি, যিনি আসাদ চৌধুরী।
কবি রফিক আজাদও খুব সমীহ করতেন তার কাব্যিক সততা, সৃষ্টিশীলতাকে।
নির্বিরোধ, নির্মোহ কবি আসাদ চৌধুরীর ব্যক্তি-মানস সর্বত্র প্রংশসিত।
তবে এই প্রশ্নও অবান্তর নয় যে, কে না ভালোবাসেন এই কবিকে?
নির্মোহ এই কবিও জানেন, ‘তবক দেয়া পান’ খেতে খেতে কীভাবে এক এক করে ধীরে, অতি ধীরে খুলতে হয় সোনালি অতীতের প্রিয় গল্পের পাপড়িসমূহ।
প্রিয় ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দিতেই হঠাৎই যেন মনে পড়ে গেলো তার বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের কথা।
মৃদুকণ্ঠে বললেন, দিলারা, মনে আছে তোমাদের, ২০০৯ সালের আজকের এই দিনে অর্থাৎ ১২ সেপ্টেম্বর বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। জানো তো, তার একটি গান ইদানীং খুব মনে পড়ে-
‘আগের বাহাদুরি এখন গেল কই
চলিতে চরণ চলে না দিনে দিনে অবশ হই
আগের বাহাদুরি এখন গেল কই \
মাথায় চুল পাকিতেছে মুখের দাঁত নড়ে গেছে
চোখের জ্যোতি কমেছে মনে ভাবি চশমা লই \
বুঝতে পারি সঙ্গত কারণেই বিশেষ এই গানের বাণী আজকের দিনে ভর করেছে আসাদ ভাইকে।
তিনি স্বগোক্তির মতো করেই বলে চলেছেন, অনেকদিন থেকে ভাবছি এই গানের ভাব-সম্পদের উপর ভর করে তাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখবো।
কিন্তু কিছুতেই হয়ে উঠছে না।
এই সময় হিমাদ্রি বাউল সম্রাটের একটা গানের কলিতে সুরারোপ করে গুনগুন করছিলো। হিমাদ্রির আবৃত্তির কণ্ঠ চমৎকার। ও যে গাইতে জানে তা জানা ছিলো না।
বাউল স্মরণে আমি ওকে একটা গান গাইতে অনুরোধ করছিলাম যখন, তখনই আকাশ ভাঙা বৃষ্টির ছিঁটা হুড়মুড়িয়ে আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে এলো ড্রইংরুমে।
‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ আর গাওয়া হলো না।
নতুন পরিবেশে গল্পের আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুও পাল্টে গেলো দ্রুত।
আগেও শুনেছি কথাটি আসাদ ভাইয়ের মুখে, আজ দ্বিতীয়বারের মতো বললেন তিনি, শোন দিলারা এবং ফেরদৌস, আমাদের সময়ে না কবিদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি একটা শ্রদ্ধাবোধ ছিলো, সহমর্মিতা ও ভালোবাসা ছিলো। আমরা একজন আর একজনের ভালো কবিতার প্রশংসা করতে জানতাম। পরস্পরকে সম্মান করতাম।
একটা/দুটো ঘটনা বলি শোন, আল মাহমুদের সন্তান সংখ্যা তো জানাই আছে তোমাদের। একবার তার কোনো এক সন্তান খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে, ওষুধ কেনার টাকা নেই।
খুব দিশাহীন অবস্থায় আমার কাছে এসেছে টাকার জন্যে। আমার হাতেও তেমন টাকা নেই। ওকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম ওষুধের দোকানে। বাকিতে ওষুধ কিনে দিলাম।
পরে আস্তে আস্তে পরিশোধ করেছি ওষুধের সেই মূল্য। কেন যেন সবাই বিশ্বাস করতো আমাকে।
আমি আর কি করতে পারি, বলো?
অন্য আরেকজনের কাছে টাকা পেতাম, যার একটা প্রেস ছিলো। সে কিছুতেই আমার টাকা ফেরত দিতে পারছে না। কিন্তু বই ছাপিয়ে দিতে পারবে বলে যখন জানালো তখন আমি প্রথমেই রফিক আজাদকে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপিটি দিতে বললাম।
রফিক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়