করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

অতল অন্ধকারে

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

লাউয়ের মাচানটা ধরে দাঁড়িয়েছিলো ফুলবানু। ভাবছিলো কয়েকটা দিন আগেও লাউয়ের ডগাগুলো কেমন সবুজ-সতেজ ছিল। এখন আর তেমন নেই। কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছে। পাতাগুলো কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে। আগে ভোরের সূর্যের আলোতে পাতাগুলোর উপর শিশির বিন্দুগুলো হীরের মতো ঝকমক করে হেসে উঠতো যেন। ফুলবানু ঘাটে যাবার পথে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতো। ফুলবানুর দুচোখ বেয়ে অশ্রæ গড়িয়ে পড়ে।
কার জন্যে! গাছটির জন্য নাকি ওর বিবর্ণ জীবনটার জন্য! হঠাৎ শাশুড়ির বাজখাঁই গলা ভেসে আসে … ‘আরে ও অবাগী, পোড়াকপালি অহনও গরুর খাওন দেয়া অয় নাই। হেই কহন থ্যাইকা ডাকতাছি। কোন রা নাই। আর কতো জ্বালাবি তুই। বিহান বেলা যায়। রান্ধন-বাড়নের কোনো খবর আছেনি…’ বুড়ি শাশুড়ি রাগে গজগজ করেই চলে। এসব গঞ্জনা এখন ফুলবানুর গা সওয়া হয়ে গেছে। গত ছয় মাস ধরে ওর শরীর মন কেমন যেন অনুভূতিহীন হয়ে গেছে। পৃথিবীর সব রং কেমন যেন বিবর্ণ মনে হয়। ঘাসের উপর শিশির বিন্দুগুলো এখন আর হীরে মনে হয় না। মনে হয় রাতের অশ্রæপাত, না বলা ব্যথার কান্না। কার কাছে যেন শুনেছিল হীরা এমন ঝকমক করে। নদীর স্রোতের মতো বহতা জীবনটা যেন হঠাৎ থমকে গেছে। শাশুড়ি, ননদের গঞ্জনায় এতোদিনে হয়তো চলেই যেতো কিন্তু বুড়ো শ্বশুরের স্নেহে এখনো পড়ে আছে এখানে। শ্বশুরের স্নেহটাও ওর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শাশুড়ি, ননদ একেবারেই সহ্য করতে পারে না ফুলবানুকে।
ফুলবানুর বাবা আর ওর শ্বশুর বাল্যবন্ধু ছিল। ফুলের মতো মেয়ের নাম রাখে বশির ফুলবানু। রহিমুদ্দি অনেক কষ্টে রাজি করায় বশিরকে ফুলবানুরকে তার পুত্র হালিমের সাথে বিয়ে দিতে। ফুলবানুর তখন বারো আর হালিমের কুড়ি। শাশুড়ি প্রথম থেকেই এই বউ আনতে রাজি ছিল না কারণ, এতো ছোট মেয়ে সংসারের কাজে সাহায্য করতে পারবে না, তাছাড়া নিজের বোনের মেয়েকে পছন্দ করে রেখেছিল মনে মনে। ষোলো-সতেরো বছরের। মোটাসোটা রহিমা সোমত্ত মেয়ে। গায়ে-গতরে খাটতে পারে প্রচুর। তাই ওই মেয়েকেই ছেলের বউ করে আনতে চেয়েছিল। কিন্তু রহিমুদ্দি বন্ধুর পুতুলের মতো মেয়েটিকেই ছেলের বউ করে ঘরে তুলে এনেছিল। নিজের মেয়ের মতো আদর করে। ফুলবানুর রূপও শাশুড়ি-ননদের হিংসার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রথম থেকেই গঞ্জনার শিকার হতে থাকলো। স্বামী হালিমের ভালোবাসায় ধীরে ধীরে তরুণী হয়ে উঠলো। শ্বশুর শাশুড়ি-ননদের ছোবল থেকে আগলে রাখতো ফুলবানুকে।
পাশের গ্রামেই বাড়ি ফুলবানুর। ঘরে সৎ মা। তার অত্যাচারও কম ছিল না। সময় মতো খেতে দিত না। কাজ করাতো। দিনে-রাতে গঞ্জনা দিতো। গঞ্জনা সইতে সইতেই বড়ো হয়েছে ফুলবানু। সময় বয়ে যায় নদীর মতো। বারো বছরের ফুলবানু একদিন ষোলো বছরের তরুণী হলো। রূপ যেন অঙ্গে আর ধরে না। ননদের হিংসা আরো বেড়ে গেল। গঞ্জনা এখন আর গায়েই মাখে না। স্বামী সোহাগে গরবিনী সবকিছু তুচ্ছ করে একা হাতেই ঘর-সংসার সামলায়। সংসারের সব কাজ একা হাতেই করে কোনো অনুযোগ ছাড়া। শ্বশুরকে ওজুর পানি এগিয়ে দেয়া, জায়নামাজ বিছিয়ে দেয়া, স্বামী বাড়ি ফিরলে যতœ করে পাশে বসে খাওয়ানো, সবই করে যেতো মনের আনন্দে। শাশুড়ির জন্য করেও কোনোকিছুতেই মন পেতো না। হালিমতো ছিল চোখের মণি। যতক্ষণ মাঠ থেকে না ফিরতো ততক্ষণ ফুলবানু না খেয়ে পথের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতো। চাঁদনী রাতে দাওয়ায় বসে দুজনে কত না গল্প করতো, মাঝে মাঝে চাঁদনী রাতে ডিঙ্গি নৌকায় নদীতে ঘুরে বেড়াতো। অনেক খুনসুটিতে কাটতো ওদের দিনরাত্রি। জোয়ান পুরুষ হালিম ক্ষেত-খামারি করে ভালোই আয়-রোজগার করতো। প্রায় সন্ধ্যায় হাট থেকে হালিম রেশমিচুড়ি, নাকের ফুল, চেকশাড়ি, কাজল ইত্যাদি নিয়ে আসতো। রাতের খাওয়া সেরে ফুলবানুর হাতের পান মুখে দিয়ে হালিম বলতো- ‘যাওতো ফুলু, লাল চেকশাড়িটা পইরা আইসো। দুই চোক ভইরা দেহি তোমারে।’ লজ্জায় রাঙা হয়ে যেতো ফুলু। হালিমের নাকটা টেনে দিয়ে দৌড়ে যেয়ে শাড়ি পরে, চোখে কাজল টেনে, পান মুখে সামনে এসে দাঁড়াতো ফুলু। হালিম বেসামাল হয়ে যেতো। এমনি ছিল ওদের সুখের সংসার। হঠাৎ এক বৈশাখে ফুলুর জীবনে যেন বৈশাখী ঝড়ের দাপটে ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেল সুখের সংসার। ফুলবানুর জীবনটা একরাতেই তছনছ হয়ে যায়। বৈশাখের এক বৃষ্টিমুখর রাতে হালিমের বুকে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে যায়। ব্যথাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। ফুলবানু তাড়াতাড়ি পানি খাওয়ায়। সূরা পড়ে বুকে ফুঁ দেয়। কিছুতেই কিছু হয় না। রহিমুদ্দি সরকারি ডাক্তার ডাকতে ছুটে যায়। ছটফট করতে করতে ফুলুর কোলে মাথা রাখে… ‘ফুলুরে আমি আর বাচুম নারে’।
– ‘নাগো না, অমন কতা কইয়োনাগো তুমি’। কাঁদতে কাঁদতে বলে ফুলবানু। হঠাৎ নির্জীব হয়ে মাথাটা এলিয়ে পড়ে ফুলুর কোলে। চিৎকার করে ওঠে ফুলবানু। শাশুড়ি কপাল চাপড়ে কানতে থাকে। ডাক্তার এসে মৃত ঘোষণা করে। ফুলবানু অজ্ঞান হয়ে যায়। পাড়াপড়শিরা এসে সবাইকে সান্ত¡না দেয়। একটু পরে চোখেমুখে পানির ঝাপটায় যখন জ্ঞান ফিরে আসে ফুলবানু চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। স্বজনেরা ওর নাকের ফুল, চুড়ি, গলার মালা সব খুলে সাদা শাড়ি পরিয়ে ফুলবানুকে বুঝিয়ে দেয় ও এখন থেকে বিধবা। উচ্ছল, প্রাণবন্ত তরুণী নিরাভরণ সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পাথরের মূর্তির মতো। এরপরের দিনকাল বড়োই বেরহম। গঞ্জনা নিত্যসঙ্গী। ভেজা চোখেই কাজ করে চলে। উঠতে-বসতে ‘অপয়া’ শব্দটি শুনতে শুনতে কান পচে গেছে। মুখে কুলুপ এঁটে কাজ করে। শাশুড়ির সেই এককথা- ‘যে গাছে ফল ধরে না, সে গাছের কোনো কদর নাই বুঝলা রহিমের মা, জোয়ান পোলা খাইছে রাক্ষসী। ওহন আমারে না খাইয়া যাইবো না।’
– ‘কি যে কন বুজান, এই জোয়ান বয়সে কই যাইবো ফুলু। বাপটাও তো মইরা গেছে।’
– ‘যেহানে খুশি যাউক। ওরে দেখলে জোয়ান পোলাডার দুঃখ আমার তুষের লাহান জ্বলে।’
হালিম মারা যাবার পরে ছয়টা মাস সহ্য করেছে। এখন আর পারছে না এতো কষ্ট নিতে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় গলায় দড়ি দিতে। কিন্তু ধর্মের ভয়ে তাও পারে না। আর কতদিন… নিজের মনকে নিজেই জিজ্ঞেস করে। এদিকে ওরই বয়সি ছোট দেবর বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও ফুলবানুকে বিয়ে করতে চায়। ফুলবানু এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। এবার পথে নামে ফুলবানু। বাপের বাড়ি যেয়ে ওঠে। বাবা মারা যাবার পরে এখন ভাই-ভাবির সংসার। ফুলবানুকে দেখে কেউ খুশিতো হয়নি বরং উটকো ঝামেলা মনে করে বিরক্ত হলো। দিনে দিনে সৎ মা আর ভাবির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো।
একদিন ভাবির এক ফুফাতো ভাই এলো ঢাকা থেকে। শহর আলী। ঢাকায় কোন এক মিলে নাকি কাজ করে। ফুলবানুর এহেন দুরবস্থার দেখে শহর আলী ফুলবানুকে ঢাকা শহরে যাবার প্রস্তাব দেয়।
– ঢাকা গেলে ম্যালা কাম। ম্যালা টেকা। এইহানে এতো কতা হুইন্যা লাভ আচেনি? ঢাকায় গেলে কাম কইরা কড়কড়া টেকা গুনবা। আর একখান কতা, তোমার যা চেহারা সুরত, মাশাল্লাহ চাওতো ফিল্মের নায়িকা হইতে পারবা।’
– ‘কী যে কন না শহর আলী ভাই। নিজের মান, ইজ্জত লইয়া ভালোভাবে বাঁচতে চাই।’ পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো বার করে হাসতে থাকে শহর আলী। লোকটার চাহনী এতো কুৎসিত যে ফুলবানুর গায়ে কাঁটা দেয়। – ‘ঢাকার কাম-কাইজ কি করতে পারুম।’ – ‘কেন পারবা না। এই গেরামের কতোজনেরে আমি ঢাকায় নিয়া কাম দিছি। অহন কতো সুখে-শান্তিতে আছে। আমারে জিগায়নি?’
– ‘হাছানি!’ ফুলবানু বলে। – ‘আমার লগে যাইবা?’ – ‘ভাইবা দেহি’। ভাই-ভাবির সাথে প্রতিদিন ঝগড়া ফুলবানুকে কেন্দ্র করে। অভাবের সংসারে আর একটা মুখ বাড়লো। ভাবি কথায় কথায় ভালো করে বুঝিয়ে দেয়। ফুলবানু অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। কতদিন অন্যের গলগ্রহ হয়ে থাকবে। এমন করে চলে না। ওর নিজের কিছু করতে হবে। তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা যাবার। মামাতো বোন মর্জিনা ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করে। ওর বাসার ঠিকানা জোগাড় করে শহর আলীর সাথে একদিন ঢাকাগামী লঞ্চে উঠে বসে। শহর আলীর দেঁতো হাসি দেখলে ফুলবানুর কেমন ভয় লাগে। ভয়ে জড়সড় হয়ে এক বৃদ্ধ মহিলার পাশে হাঁটুতে মাথা রেখে বসে থাকে। শহর আলী এসে দু-একবার পাশ ঘেঁষে বসার চেষ্টা করেছে। ফুলবানু সরে বসেছে। অচেনা শহরে মর্জিনার ঠিকানা শহর আলী নাকি ভালোভাবেই জানে, তাই কিছুটা ভরসা ফুলবানুর। শুধু একবার মর্জিনার বাড়িতে পৌঁছাতে পারলেই আর শহর আলীর ছায়াও মাড়াবে না ফুলবানু। খুব ভোরে সদরঘাটে লঞ্চ ভেড়ে। শহর আলীর পিছুপিছু হাঁটতে থাকে ফুলবানু। একটা রিকশায় উঠে ঘোমটা টেনে জড়সড় হয়ে বসে ফুলবানু। শহর আলী হাসে তার কুৎসিত হাসি। ফুলবানু আঁচলের গিট খুলে শহর আলীকে মর্জিনার ঠিকানাটা দেয়। শহর আলী বলে- ‘ঠিকানা লাগবো না, আমি চিনি বাসা।’ বেশ কিছুদূর যাবার পরে রিকশা থামে একটা ভাঙা বাড়ির সামনে। আঙ্গুলি নির্দেশে দেখায় সামনে এগিয়ে যেতে। ফুলবানু বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে দ্বিধাভরে। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে শহর আলী ফুলবানুকে অপেক্ষা করতে বলে কলিংবেল টেপে। শহর আলী ভেতরে ঢোকে। বিশ মিনিট পরে বেরিয়ে এসে বলে- ‘যাও, ভেতরে যাও। তোমার মর্জিনা বুবু ডাকতাছে। বুঝাইয়া সব কইলামতো তাই দেরি হইলো। ঢাকা শহরে কেউ কেউরে না জিগাইয়া আহে না। যাও, যাও।’ ফুলবানু দ্বিধাভরে ভেজানো দরজায় যেয়ে হাত দিয়ে দরজাটা খুলে ডাক দেয়- ‘মর্জিনাবু’। হঠাৎ একটা লোমশ হাত ওর মুখে রুমাল চেপে ধরে। ফুলবানু অজ্ঞান হয়ে যায়। যখন ওর জ্ঞান ফিরে তখন দেখে একটা অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে আছে। উঠে বসতে যায়। সর্বাঙ্গে ব্যথা অনুভব করে। ছোট্ট একটা জানালার ফাঁক দিয়ে একটুখানি আলো আসছে। ওর সমস্ত জিভ শুকিয়ে আসে। গলা দিয়ে কথা বের হয় না। অনেক কষ্টে উচ্চারণ করে- ‘পানি’। একটা লোমশ হাত এক গøাস পানি এগিয়ে দেয়। ফুলবানু ঘৃণায় গøাসসুদ্ধ হাতটা ধাক্কা দেয়। সশব্দে ঝনঝন শব্দে গøাসটা ভেঙে যায়। সেই সাথে ফুলবানুর স্বপ্নগুলো।
– টেকা দিয়া কিনছি তরে। শহর আলী আমাগো কাছে তরে বেইচ্যা দিছে। অত দেমাগ দেখাবি না। আমাগো কতা হুনলে রাজরানি বানাইয়া দিমু…।
সব কথা ফুলবানুর কানে পৌঁছায় না। ও যেন হারিয়ে যেতে থাকে অন্ধকারে। অতল অন্ধকারে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়