করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

পরার্থপরতা : ব্যক্তি ও সংগঠনে দায়বদ্ধতা

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পরার্থবাদ দ্বারা অপরের জন্য দুঃখ-কষ্ট সহ্য করা বা ত্যাগ স্বীকারের মনোভাব বোঝায়। পরার্থবাদ (ইংরেজি : অষঃৎঁরংস) বা ‘অলট্রুইজম’ শব্দের উৎপত্তি ফরাসি ভাষা থেকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁত তার মতবাদের ব্যাখ্যায় অষঃৎঁরংস শব্দের ব্যবহার করেন। স্বার্থপরতার বিরোধিতা করে এমন এক ধঃঃরঃঁফব বা মনোভাব নির্ধারণ করার জন্য দার্শনিক অগাস্ট কোঁত এই শব্দের ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে শব্দটি এমন ব্যক্তি রূপে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যিনি সর্বদাই নিজের স্বার্থের বিষয়ে প্রথমে চিন্তা করেন এবং এর আগে কখনো অন্যদের চিন্তা করেন না।
বাংলায় পরার্থবাদের অর্থ হলো পরোপকারিতা। পরার্থবাদ হচ্ছে সেই নীতি বা প্রথা যা অন্যের কল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ নিজের চেয়ে অন্যের প্রয়োজনকে সবসময় বড় করে দেখা এবং প্রয়োজনে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করার প্রবণতাকে পরার্থবাদ বলে। সহজ কথায় পরার্থবাদ হচ্ছে, অন্যের কল্যাণে যতœবান হওয়া ও অন্যের সাহায্যার্থে উপকার করা। পরার্থবাদ মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। যেমন : একজন প্রতিবন্ধী শিশুর মা সারাজীবন তার শিশুকে সহায়তা করে, ব্যয়বহুল চিকিৎসার জন্য অর্থ ব্যয় করে তাকে বিশেষ শিক্ষকের কাছে নিয়ে যায় অথচ বিনিময়ে কোনো কিছুই প্রত্যাশা করে না। এটা জিনগত পরার্থপরতা। এছাড়া বাচ্চাদের পড়াতে স্বেচ্ছাসেবক, বয়স্ক লোকদের নিজের যতœ নিতে সাহায্য করা, পাড়া প্রতিবেশি, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনকে সাহায্য করা, পরিবারের সদস্যকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করা ইত্যাদিকেও সামাজিকভাবে পরার্থপরতা বলে। সুতরাং পৃথিবীতে প্রতিটি জীবের জীবন প্রস্ফুটিত হয় পরার্থপরতার মূল্য দিয়ে। জীবজন্তুর জগতেও পরার্থপরতার আচরণ পরিলক্ষিত হয়। পরার্থপর প্রাণীর উদাহরণ হলো ডলফিন, যা একজন আহত সঙ্গীকে বাঁচাতে সহায়তা করে এবং এটিকে খাওয়ায় এবং শিকারিদের আক্রমণ থেকে আহত সঙ্গীকে রক্ষা করে (যেমন হাঙ্গর)। পোকামাকড়, মৌমাছি, পিঁপড়া সন্তানকে রক্ষা করার জন্য নিজে বিপদ বরণ করে। এভাবে আমরা মানুষ ও প্রাণী প্রত্যেকে প্রত্যেকের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়েই পৃথিবীতে বসবাস করছি। পরার্থপরতা বা অন্যের জীবনে উন্নতিতে স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে সহায়তা করছি। অর্থনীতিবিদরা মানুষের দান খয়রাতের অর্থনীতির নাম দিয়েছেন ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ (বপড়হড়সরপং ড়ভ ধষঃঁরংস)। আর স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে এরা বলেন লাভের সঙ্গে সম্পর্কহীন (হড়হ ঢ়ৎড়ভরঃং) প্রতিষ্ঠান। পরার্থপরতার প্রতিশব্দ স্বার্থপর এবং স্বার্থকেন্দ্রিক।
আমাদের জীবনের প্রতিটা দিন আমরা অন্য ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসি আমাদের পারস্পরিক জীবনযাপন এবং একে অন্যের চাহিদা বা প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। আলোচনা থেকে কখনো কখনো আমরা লক্ষ্য করি যে, অন্যের জীবনে সুখ অর্জনে ও সুস্থতার লক্ষ্যে সচেতনভাবে স্বেচ্ছাসেবী মনোভাব, ভালোবাসা, সেবা সহানুভূতির প্রয়োজন রয়েছে। তখন আমরা ব্যক্তিগতভাবে অথবা সাংগঠনিকভাবে (হড়হ ঢ়ৎড়ভরঃ) অরগানাইজেশন হিসেবে স্বাভাবিকভাবে নির্দিষ্ট কিছু চাহিদাভিত্তিক ইতিবাচক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার প্রদান করে সহায়তা করি। এগুলো নৈতিক পরার্থপরতা। এ ক্ষেত্রে সহায়তা করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ মানবিক মূল্যবোধ, উদারতার মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থপরতার প্রবণতাগুলো আমরা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করি। এমনকি কোনো পুরস্কার/স্বীকৃতি ছাড়াই দুর্যোগ বা ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে মানুষকে ত্বরিত সহায়তা করি। ফলে মানুষ নিজস্ব ব্যক্তিত্ব, নতুন অনুভূতি, মানসিক তৃপ্তি লাভ, ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, সংহতির মূল্য সম্পর্কে সচেতন হয়। পক্ষান্তরে সংগঠনগুলো সামাজিকভাবে সক্রিয় লোকদের নিয়ে ইস্যুভিত্তিক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি বাস্তব ও কার্যকর পরার্থপরতা জাগিয়ে তোলে। অনেক লোক আর্থিকভাবে সহায়তা করে এবং দেশ, শহর, অঞ্চলজুড়ে সংগঠন (হড়হ ঢ়ৎড়ভরঃ) তৈরি করে পরার্থপরতার জন্য কাজ করে। এমনকি আর্থিক সহায়তার সঙ্গে তাদের শক্তি, জ্ঞান, সময়কে ব্যয় করে। সংগঠনগুলো সমাজের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বা অন্তর্ভুক্ত করে, কাউকে বাদ না দিয়ে সহানুভূতির সঙ্গে সম্মানের সঙ্গে কাজ করে বা সেবা করে দুর্যোগকালীন সমাজের ইতিবাচক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা সক্রিয়ভাবে কার্যকর ও বিস্তৃত করে।
অনেক মানুষ বা সংগঠন কোনো আর্থিক পরিকল্পনা না করেই পরার্থপর কাজ করে। যেমন : দুর্যোগকালীন, কোনো দুর্ঘটনা ইত্যাদির সময়। কারণ মানুষ সে পরিস্থিতিতে বিশ্বাস করে যে, এ কাজটি বা সাহায্য-সহযোগিতা তার তখনি করা উচিত। কেননা পরোপকারী আচরণগুলো সামাজিক রীতিনীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় এবং সামাজিক প্রত্যাশার ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়। পরার্থবাদের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নিয়ম হলো পারস্পরিক প্রতিদানের আদর্শ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা। পরার্থবাদের সামাজিক তত্ত্ব অনুযায়ী, পারস্পরিক নিয়ম বিধি অনুসারে আমরা যখন কোনো ব্যক্তিকে সহায়তা করি তখন আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে যখন আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন হবে তখন তারাও আমাদের সহায়তা করবে। কিংবা তারা আমাদের সাহায্য করতে না পারলেও তারা আমাদের ক্ষতি করবে না। সামাজিক দায়বদ্ধতা অনুযায়ী আমাদের অবশ্যই তাদেরই সহায়তা করতে হবে কেবলমাত্র যার সহায়তা প্রাপ্য বা প্রয়োজনীয়। বাস্তবে অনেকে খ্যাতি-প্রতিপত্তি, লোভ, অর্থের আকাক্সক্ষায় নিজের মর্যাদা বাড়াতে অন্যকে সাহায্য করে। যা এক ধরনের স্বার্থপরতা বলে গণ্য হবে।

প্রসঙ্গত: পরার্থপরতায় ব্যক্তি সংগঠনের ভূমিকা কোভিড ১৯ বাস্তবতা প্রসঙ্গে আসি
সমাজ বিজ্ঞানীরা পরার্থপরতার বিভিন্ন রূপের কথা বলেন। যেমন : দৈনন্দিন পরার্থপরতা, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জরুরি পরিস্থিতিতে পরার্থপরতা ইত্যাদি।
কোভিড-১৯ লকডাউন চলাকালীন দুঃসময়ে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও স্থবির হয়ে যায় মানুষের জীবন। রুদ্ধ হয়ে পড়ে তৃণমূল থেকে সাধারণ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন স্পন্দন। এই করোনা দুর্যোগের প্রথম লকডাউনে ‘আমরা বাইরে আছি, আপনারা ঘরে থেকে সংক্রমণ রোধে সহযোগিতা করুন’ সরকারের এই রকম পরার্থপর পদক্ষেপে দেশের মানুষ ও বিভিন্ন সংগঠন স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে সংক্রমণ এড়াতে বিভিন্নভাবে ভূমিকা রেখেছে। পরার্থপর জীবনের অর্থবহ চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে অসংখ্য মানুষ কোভিড-১৯ লকডাউন চলাকালীন দুঃসময়ে ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ এই মর্মার্থ অনুধাবন করে স্বেচ্ছাব্রতী মনোভাব থেকেই পরের কল্যাণে কাজ করেছে। এসব মহৎ ব্যক্তিরা শুধু নিজের কথাই ভাবেননি। ভেবেছেন লকডাউনে কর্মহীন হয়ে দুর্ভোগে পড়া মানুষ ও পরিবারগুলোর জন্য। নিঃস্বার্থভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে সমাজের ভাসমান, তৃণমূল, দরিদ্র, অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত আয়ের মানুষদের তরে। এই জাতীয় সংকটে অনেক ব্যক্তি রয়েছে যারা সংকট মোকাবিলায় সহযোগিতা করার জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এগিয়ে এসেছে। তারা স্ব-উদ্যোগে তহবিল গঠন করেছে। বিপদগ্রস্তদের তরে সমবেদনা জানাতে খাদ্যপণ্য, ওষধ, নগদ অর্থ, করোনা সচেতনতার লিফলেট, মাস্ক, সাবান, জীবাণুনাশক স্প্রে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইত্যাদি সরঞ্জাম বিতরণের মাধ্যমে পাশে থেকেছে। সারাদেশে রান্না করা খাদ্যসামগ্রী বিতরণ ও মানুষের দ্বারে পৌঁছে দিয়েছে ও ফিল্ড হাসপাতাল চালু করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানা গেছে, অনেক ছোট্ট শিশু তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে জন্মদিনের উপহার নেয়নি, তা দান করেছে অসহায়দের জন্য। অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যারা ডাক্তার নার্সদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) দিয়েছেন। কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভাসমান প্রাণীদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন। আর্ত-মানবতার সেবায় সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে ভ্রাম্যমাণ ‘মানবতার বাজার’ নামে বিনামূল্যের বাজার। কোথাও কোথাও এক টাকায় খাদ্যপণ্য কিনতে পেরেছে মানুষ। অসহায়দের সহায় হয়েছে ‘মানবতার ঘর’ সংগঠন। যেখানে দাতারা পোশাক ও খাদ্যসামগ্রী দিয়েছে, সেখান থেকে পথচারী ও নিম্ন আয়ের মানুষ বিনামূল্যে পোশাক ও খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করেছে। কিছু ব্যক্তি বা কোথাও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো পানির টেপ ও বেসিন বসিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেছে। কোনো কোনো সংগঠন লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় সব ধরনের রোগীকে হাসপাতালে নিতে এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেছে। করোনার উপসর্গ নিয়ে বা করোনায় মৃতদের মরদেহ গোসল, কাফন, দাফনের পাশাপাশি করোনা রোগীর বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবায় হাসপাতাল চালু করেছে। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এভাবে সমাজের নানা স্তর থেকে মানুষ স্ব স্ব উদ্যোগে সামর্থ্য অনুযায়ী পরার্থপরতায় আর্ত-মানবতার সেবায় মুক্তমনে এগিয়ে এসেছে। ব্যক্তি, সংগঠকরা এই ধরনের বিনিয়োগ বা দান ওই মুহূর্তে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিবেচনা করেছে। ফলশ্রæতিতে এই অতিমারির প্রথম ঢেউকে বাংলাদেশ সামাল দিতে পেরেছে অল্প ক্ষতির বিনিময়ে। কিন্তু জীবনের অনিবার্য প্রয়োজনে দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে বাংলাদেশের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। যে কোনো কঠিন, ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি ও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ব্যক্তি বা উন্নয়ন সংগঠনগুলো হাল ছেড়ে না দিয়ে অসহায়দের পাশে থেকে করোনা ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনও অতিক্রম করে চলেছে। যদিও বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত গবেষণা, চেষ্টা ও পরিশ্রমে ভ্যাকসিন পেয়েছে মানুষ। এভাবে পরার্থপরতায় মানুষ মানুষের জন্য সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছে সকলের তরে সকলে, পাশাপাশি মানসিকভাবে শক্তি থেকে ইতিবাচক আদর্শ সৃষ্টি করেছে।
ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, করোনা ভাইরাস আমাদের জীবনযাপনের সঙ্গী হয়ে যাবে। তাই আমাদের সচেতন ও সংযমী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। শারীরিক দূরত্ব, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, মাস্ক ব্যবহার এসব কঠোর কর্তব্য জ্ঞানে মানতে হবে। সর্বার্থে আমাদের এমনভাবে চলতে হবে যাতে আমার জন্য অন্যের এক বিন্দু পরিমাণও ক্ষতি না হয়।
যে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি বা করোনা সংকটে প্রথম ঢেউয়ের অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমানে কী ধরনের দান বা পরার্থপরতা গ্রহীতার জন্য প্রয়োজন বা কল্যাণকর তা আমাদের অনুধাবন করা প্রয়োজন। যে কোনো ধরনের পরার্থপরতার আগে আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে এই সহায়তা করা যায়, কাকে আমাদের প্রয়োজন এবং এজন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় গরিব, অভাবী লোকদের সাহায্য সহযোগিতার কর্মসূচিগুলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপব্যবহার হয়েছে, দানের ক্ষেত্রে দেখা গেছে অনেক দুর্নীতি। বিষয়টি স্পষ্ট যে, অনেক সময় দেখা গেছে, যাদের জন্য এসব সাহায্য সহায়তা দেয়া হয়েছে সেগুলো তাদের কাছে পৌঁছায়নি। কারণ যারা এসব দানের উপযুক্ত নয় তারা সিংহভাগ নিয়ে যায়। এজন্য সর্বাগ্রে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে মানবিকভাবে সাহায্য সহায়তাগুলো উপযুক্ত লোকদের কাছে পৌঁছায়। দ্বিতীয়ত: গরিবদের উপকার করার জন্য নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা হলো বাজারভিত্তিক সমাধান। দান বা ত্রাণের প্রকৃতি এমন হতে হবে যা প্রকৃত অভাবীদের কাজে লাগবে। তা যেন ধনীদের আকৃষ্ট না করে। এজন্য অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুসারে তিন প্রকারের পণ্য রয়েছে। যেমন : বিলাসজাত দ্রব্য, স্বাভাবিক পণ্য ও নিকৃষ্ট পণ্য। বিলাস দ্রব্য শুধুমাত্র ধনীরাই ভোগ করে। লোকের আয় বাড়লে যে পণ্যের চাহিদা বাড়ে তা হলো স্বাভাবিক পণ্য। লোকের আয় বাড়লে যে পণ্যের চাহিদা কমে তা হলো নিকৃষ্ট পণ্য। নিকৃষ্ট পণ্য যা শুধুমাত্র অভাবী লোকদের ভোগেই লাগে। আবার গরিব বা অভাবী লোকের আয় বেড়ে গেলে তাদেরও নিকৃষ্ট পণ্যের জন্য চাহিদা কমে যায়। নৈতিক দিক থেকে ধনীরা যে পণ্য ভোগ করে সেই পণ্যই অভাবীদের দান করা উচিত। কিন্তু সেক্ষেত্রে দেখা যায়, যারা ত্রাণ পাওয়ার উপযুক্ত নয় তারাও পণ্য আত্মসাতের জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠে। তাই দরিদ্রদের নিকৃষ্ট পণ্য দান করা নিষ্ঠুর মনে হলেও তাদের দানের জন্য অধিকতর উপযোগী। নগদ টাকা দিলে আত্মসাতের পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। সরকারিভাবে কোনো ভর্তুকি দিলে তা গরিবদের ভোগে না লেগে ধনীদের আরো ধনী করে তোলে।
টেকসই পরার্থপরতা হলো দান, যার সঙ্গে মানুষের জীবনধারণের মৌলিক প্রয়োজনের সম্পর্ক থাকে। গরিবের ভালো করার ইচ্ছাই যথেষ্ট নয়। এমনভাবে ভালো করতে হবে, যাতে গরিব লোক উপকৃত হতে পারে। এজন্য পরার্থপরতা কার্যকর করার জন্য প্রয়োজন বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা। গরিবদের এমন সাহায্য করতে হবে, যা তাদের কাজ করতে উৎসাহিত করবে এবং তাদের জন্য টেকসই ব্যবস্থা হবে। দ্বিতীয়ত: যতক্ষণ পর্যন্ত ধনীদের আধিপত্য আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত গরিবদের জন্য নিকৃষ্ট পণ্য ত্রাণসামগ্রী হিসেবে অধিকতর উপযোগী হবে। কারণ নিকৃষ্ট পণ্য গরিবদের ক্ষুধা মেটায়। ধনীদের আকর্ষণ করে না। তৃতীয়ত: গরিবদের কর্মসূচি সমাজের অন্যান্য কর্মসূচি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে হবে। সকলের জন্য অভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করলে গরিবরা তার সুফল পাবে না। এ প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেছেন : ‘গ্রেশামের সনাতন বিধির মতো এটি মনে রাখা ভালো যে, উন্নয়নের জগতে একই কর্মসূচিতে যদি গরিবদের সঙ্গে যারা গরিব নয় তাদের একত্রিত করা হয়, তবে যারা দরিদ্র নয় তারা দরিদ্রদের এবং যারা দরিদ্র তারা হতদরিদ্রদের বঞ্চিত করবে এবং এ পরিস্থিতি অনির্দিষ্টভাবে চলতেই থাকবে যদি প্রথমেই উপশমমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়। যা ঘটবে তা হলো গরিবদের নামে যারা গরিব নয় তারা সকল সুবিধা ভোগ করবে।’
ব্যক্তিগত বা জাতীয় জীবনে সত্যিকারের পরার্থপরতা একটি ইতিবাচক শক্তি বা আদর্শ হিসেবে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। সবাই চায়, যে কোনো ব্যক্তিগত বা জাতীয় সংকট বা দুর্যোগকালীন সময়ে সমাজের ওপর দরিদ্র, অসহায় শ্রেণির নির্ভরশীলতা কমাতে। এ ক্ষেত্রে দান নয়, বরং সকলেই যাতে কাজ করে খেতে পারে এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই সামাজিক নিরাপত্তার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। যে চ্যালেঞ্জ আমরা কোভিড-১৯ এর লকডাউনের সময় স্ব-আগ্রহী হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেছি। লক্ষ্য রাখতে হবে মানুষের মৌলিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কার্যকর টেকসই পরার্থপরতা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
কেবল নিজের স্বার্থ রক্ষাই মানবজীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। পারস্পরিক কল্যাণ ও উপকারের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে আজকের মানবসভ্যতা। পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতাই মানব জাতির সমাজ বন্ধনের ভিত্তি। এই বন্ধনের মাঝে যথার্থ পরার্থপরতার মহৎ আলোকে সমাজ ও দেশের অগ্রগতি হোক, মানুষের জীবন সার্থক হোক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়