জাপার ঢাকা দক্ষিণ কমিটির সভাপতি বাবলা

আগের সংবাদ

নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হুংকার রাশিয়ার : মার্কিন নাগরিকদের অনতিবিলম্বে কিয়েভ ছাড়ার নির্দেশ বাইডেনের

পরের সংবাদ

রেকর্ড আমদানি, দামেও রেকর্ড : ব্যবসায়ীদের হিসাবেই রোজায় ভোগ্যপণ্য সরবরাহে ঘাটতির আশঙ্কা নেই

প্রকাশিত: মার্চ ১৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : দেশে নিত্যপণ্যের বাজার অনেক দিন ধরেই অস্থির। এ অস্থিরতাকে আরো উসকে দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যেন ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’ অবস্থা। দুই দেশের যুদ্ধে মাঝখান থেকে করুণ দশা বাংলাদেশের মানুষের। এক দফা জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, এখন আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সামনে রমজান মাস। ওই সময় চাহিদার শীর্ষে থাকা প্রধান কয়েকটি পণ্যের মধ্যে রয়েছে- চিনি, ডাল, ছোলা, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ এবং খেজুর। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে এসব পণ্যেরও দাম বেড়েছে কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা। অথচ এসব পণ্যের দাম বাড়ানোর সঙ্গে যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই। আবার বাজারে এসব পণ্যের কোনো সংকটও নেই। সাধারণত রোজা উপলক্ষে যেসব পণ্য বেচাকেনা হয়, তা আমদানি হয় এর আগের দুই থেকে আড়াই মাসে। রমজানকে ঘিরে দেশে যেসব ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে সেসব পণ্যের রেকর্ড পরিমাণে আমদানি বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের হিসাবে এবার রমজানের প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য, যেমন- ছোলা, ভোজ্যতেল, চিনি ও মসুর ডালের প্রচুর সরবরাহ আছে। ফলে রোজায় ভোগ্যপণ্য সরবরাহে ঘাটতির আশঙ্কা নেই। এরপরও রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকবে কিনা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যে ভোজ্যতেলের দামে অস্থির সময় পার করছে দেশবাসী। রমজানে অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দাম কোথায় গিয়ে ঠেকে তা নিয়ে চিন্তার ভাঁজ ভোক্তার কপালে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোজা উপলক্ষে পণ্য দেশে আসার পর বিশ্ববাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে। এ সুযোগে দেশের বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম আরো বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ববাজার পরিস্থিতির কারণে বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমদানি

বেশি পরিমাণে হয়েছে আবার বাজারে নিত্যপণ্যের দামও বাড়ছে। তাই সরকারকে এ বিষয়ে নজরদারি করা প্রয়োজন। আমদানিকৃত যেসব পণ্য দেখানো হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে ওই সব পণ্য আসছে কিনা, এর আড়ালে টাকা পাচার হচ্ছে কিনা- তা ভালোভাবে যাচাই করে দেখতে হবে বলেও মনে করেন তারা।
দেশের অন্যতম বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের পরিচালক তারিক আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে গেøাবাল মার্কেটেই অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। আমরা গত ৩০ বছরে বাজারে এমন পরিস্থিতি দেখিনি। করোনা মহামারির আগে যে তেল ৭০০ থেকে সাড়ে ৭০০ ডলারে ছিল, এখন তা প্রায় ১৯শ ডলারে পৌঁছে গেছে। যুদ্ধের আগে রাশিয়ার গমের দাম ছিল ৬০-৭০ ডলার, সেটা এখন প্রায় ৪৮০-৪৯০ ডলার। যুদ্ধ শুরুর আগেই পণ্য আমদানি করা হয়েছে এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা আশা রাখছি যে পণ্য আমাদের রয়েছে তা দিয়ে রমজানে চালিয়ে নেয়া সম্ভব। তাই রমজানে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। তবে এ যুদ্ধ যদি আরো দীর্ঘ হয় তবে ‘ফুড সিকিউরিটি’ আরো বাড়াতে হবে। না হলে বিশ্ববাজার থেকে আমদানি করা কঠিন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ছোলা আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার টন, যা গত বছরের চেয়ে মাত্র দুই হাজার টন কম। যদিও চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এসেছে আরো প্রায় ২৮ হাজার টন ছোলা। চলতি মার্চের প্রথম সপ্তাহে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস হওয়া ছোলার গড় দাম পড়েছে প্রতি কেজি ৫৫ টাকা, যা আগের দুই মাসের তুলনায় কেজিপ্রতি মাত্র ১ টাকা বেশি। বাজারে এখন সাধারণ ছোলা বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৭০ টাকায়। একটু ভালো ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা দরে, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৭৫ টাকা। গত বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় এ বছর একই সময়ে সয়াবিন তেল, পাম তেল, সয়াবীজ, গম, চিনি, মসুর ডাল ও পেঁয়াজের আমদানি বেড়েছে। গত বারের তুলনায় এ বছর জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মাসে মসুর ডালের আমদানি ৫০ হাজার টন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার টন। সব মিলিয়ে গত বছরের চেয়ে এ বছর মসুর ডালের গড় আমদানি মূল্য কেজিপ্রতি ৩২ টাকা বেড়েছে। খুচরা বাজারে বড় ও মাঝারি দানার মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৯৫ থেকে ১১৫ টাকা দরে। দেশে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৮৮ হাজার টন, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ লাখ ৬০ হাজার টন বেশি। অপরিশোধিত চিনির আমদানি মূল্য প্রতি কেজি গড়ে ১১ টাকা বেড়ে প্রায় ৩৯ টাকা দাঁড়িয়েছে। খুচরা বাজারে এখন চিনির দাম কেজি ৭৮ থেকে ৮০ টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ১০ থেকে ১৩ টাকা বেশি।
গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে সয়াবিন ও পাম তেল মিলিয়ে ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৮৮ হাজার টন, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬০ হাজার টন বেশি। সয়াবিন তেল উৎপাদনের কাঁচামাল সয়াবীজও ৩৯ হাজার টন বেশি আমদানি হয়েছে। এক বছরে খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিনের দাম বেড়েছে লিটারপ্রতি প্রায় ৫৪ থেকে ৫৫ টাকা। আর বোতলের তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দুই মাসের হিসাবে গত বছরের তুলনায় পাম তেলের আমদানি মূল্য বেড়েছে লিটারপ্রতি ৩২ টাকা। বাজারে দাম বেড়েছে ৫০ টাকার বেশি। এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে লিটারপ্রতি ১৫৩ থেকে ১৬৫ টাকায়। এখন খোলা সয়াবিন ও পাম তেল পাওয়া যাচ্ছে না বলে বাজারদরের তালিকায় উল্লেখ করছে টিসিবি।
গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় পেঁয়াজ আমদানিও দ্বিগুণ হয়েছে, পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৩ হাজার টন। এদিকে এখন থেকেই বাজারে লাগাম টানতে নতুন করে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি (ইমপোর্ট পারমিট- আইপি) দিয়েছে সরকার।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা সব সময় সুযোগের সন্ধানে থাকেন। তারা বর্তমানে যে উচ্চমূল্যে জিনিসপত্র বিক্রি করছেন তা কিন্তু অনেক আগেই আমদানি করা হয়েছে। তখন জিনিসপত্রের দাম এত বেশি ছিল না। তিনি বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে দাম বৃদ্ধির যে কথা বলা হচ্ছে তা পুরোপুরি সঠিক নয়। বাংলাদেশের বাজারে যুদ্ধের প্রভাব আরো ১-২ সপ্তাহ পরে পড়ার কথা। ব্যবসায়ীরা যুদ্ধের কথা বলে অসদুপায়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিছু পণ্যের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হচ্ছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়ছে। আমদানিকৃত পণ্যের শুল্ক, আন্তর্জাতিক মূল্য, বিনিময় মূল্য সাপেক্ষে যে দাম হওয়ার কথা তার থেকেও বেশি দাম নেয়া হয়। তিনি বলেন, বাজার ব্যবস্থায় সিন্ডিকেট, মধ্যস্থতাকারী, নৈরাজ্য, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, স্টক ও প্রবাহের মধ্যে পার্থক্য, মজুতদারিসহ নানান সমস্যা আছে। বাজার ব্যবস্থাপনা এবং তদারকি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের যে নিয়মনীতি, তা ভালোভাবে কাজ না করলে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেন। সরকারের যে স্টক আছে সেগুলো বাজারে ছাড়তে হবে। যাতে করে বাজারে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকে। বাজার তদারকি করে অগ্রিম আমদানি করতে হবে। আমদানি মূল্য এবং খুচরা মূল্যের যে পার্থক্য সেখানে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, সরকারের আমদানি বাড়ানো, স্টক পণ্য বাজারে ছাড়া, বাজার তদারকি, ভোক্তা অধিদপ্তরের যে কাজ তা সঠিকভাবে করা দরকার। আমাদের ভোক্তা অধিদপ্তর কাজ করছে না এবং ব্যবসায়ীরা বাজার কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকারের যে ধরনের নজরদারি দরকার সেটি তেমনভাবে হচ্ছে না বলে মনে হচ্ছে। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, যথাসময়ে আমদানি, শুল্ক, পণ্যের মজুতসহ সরকারের হাতে যেসব বিষয় আছে সেগুলোও তেমনভাবে কাজ করছে না। তিনি বলেন, সরকারকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং বাজার ব্যবস্থাপনা -এ দুটোকেই এখন কাজে লাগাতে হবে। কারণ এ সময় বাজার ব্যবস্থাপনা এবং সামষ্টিক ব্যবস্থাপনা- দুটোই গুরুত্বপূর্ণ।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, আমদানি বেশি পরিমাণে হয়েছে আবার বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। তাই সরকারকে এ বিষয়ে নজরদারি করা প্রয়োজন। কারা আমদানি করছে, কোথায় কোথায় স্টক আছে- এসব খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি বলেন, আমদানিকৃত যেসব পণ্য দেখানো হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে ওই সব পণ্য আসছে কিনা, নাকি এর আড়ালে টাকা পাচার হচ্ছে কিনা তা ভালোভাবে যাচাই করে দেখতে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়