এফএএস ফাইন্যান্সের ৭০ কোটি টাকা লোপাট : দুদকের দুই মামলায় পি কে হালদারসহ আসামি ৩৫

আগের সংবাদ

ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান, প্রথম দিনেই দুই পক্ষে হতাহত শতাধিক : কিয়েভ ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ

পরের সংবাদ

সিন্ডিকেটে জিম্মি মধ্যপ্রাচ্যগামীরা > বিমান ভাড়া নেয়া হচ্ছে তিন গুণ, অনুরোধ রাখছে না এয়ারলাইন্স : বিমান প্রতিমন্ত্রী

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কামরুজ্জামান খান : বৈশ্বিক মহামারি করোনার ধকল অনেকটা কাটিয়ে পরিস্থিতি যখন প্রায় স্বাভাবিক তখন ঢাকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিমান ভাড়া আকাশছোঁয়া। টিকেট সংকট ও কয়েকগুণ দাম বাড়ায় ছুটিতে দেশে আসা প্রবাসীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। আকাশ পথে যাত্রীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে- এয়ারলাইন্স কোম্পানিগুলো এমন দাবি করলেও তা কেউ বিশ্বাস করছে না। মধ্যপ্রাচ্যগামী এয়ারলাইন্সগুলোর অস্বাভাবিক আচরণের কারণে অনেকে যাত্রার তারিখ পিছিয়েছেন। তবে ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট শেষ হয়ে যাচ্ছে, এমন অবস্থাতেও দেশে আসা প্রবাসীরা পাচ্ছেন না টিকেট নামের সোনার হরিণ। গত ডিসেম্বর থেকে উদ্ভব হওয়া এই পরিস্থিতি এখনো বিদ্যমান। কয়েকটি সিন্ডিকেট পাসপোর্ট ও ভিসা ডকুমেন্টস ছাড়াই পালাক্রমে এয়ারলাইন্সগুলোর ৮০ শতাংশ টিকেট অগ্রিম কিনে চড়া দামে বিক্রি করছে। বাকি ২০ শতাংশ বিক্রি করছে এয়ারলাইন্স। এতে টিকেটের ঘাটতি দেখিয়ে নেয়া হচ্ছে কয়েকগুণ বাড়তি টাকা। সিন্ডিকেটে আছে দেশি-বিদেশি চক্র। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও টিকেট সিন্ডিকেটের তথ্য রয়েছে। বেসরকারি বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, সিভিল এভিয়েশন ও বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কাছেও সিন্ডিকেটের ব্যাপারে খবর রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিমান ভাড়া অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বেশ কিছুদিন আগেই অসন্তোষ প্রকাশ করলেও তার সুফল মেলেনি। তারপরও অজ্ঞাত কারণে সিন্ডিকেটগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
মধ্যপ্রাচ্যে সাধারণত ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা বাংলাদেশ বিমান, বেসরকারি এয়ারলাইন্স ইউএস বাংলা, এমিরেটস এয়ারলাইন্স, ইতিহাদ এয়ারলাইন্স, ফ্লাই দুবাই, সৌদি অ্যারাবিয়ান, কাতার এয়ারলাইন্স, কুয়েত এয়ারলাইন্স ও ওমান এয়ারলাইন্স।
একাধিক ট্র্যাভেল এজেন্সি মালিক জানিয়েছেন, প্রতিবেশী একটি দেশের একাধিক সিন্ডিকেট পাসপোর্ট নম্বর ও ভিসা ছাড়াই গ্রুপ ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর আগাম টিকেট কিনে

রাখছে। পরে তারা পর্যায়ক্রমে সেগুলো বেশি দামে বিক্রি করছে। এর সঙ্গে দেশি অনেক ট্র্যাভেল এজেন্সিও জড়িত। স্বাভাবিক সময়ে ঢাকা থেকে রিয়াদ বিমান ভাড়া ছিল ৩০-৪০ হাজার টাকার মধ্যে। কিন্তু বর্তমানে সেই ভাড়া গিয়ে ঠেকেছে এক লাখের উপরে। ঢাকা-দুবাই রুটে রিটার্ন বিমান ভাড়া ছিল ৪০ হাজার টাকা। সেই ভাড়া এখন ৯০ হাজারে গিয়ে পৌঁছেছে। এছাড়া বাহরাইন, কাতার, কুয়েত, আমিরাতসহ বিভিন্ন রুটে ভাড়া বেড়েছে তিন গুণ পর্যন্ত। যেমন- ঢাকা থেকে আবুধাবি আগে বিমান ভাড়া ছিল ৩৫ হাজার টাকা, সেটা এখন গিয়ে ঠেকেছে ৯০-৯৫ হাজার টাকায়। তাও টিকেট মিলছে না। ঢাকা থেকে বাহরাইন আগে বিমান ভাড়া ছিল ৩৫ হাজার টাকা, যা এখন ৭০-৮০ হাজার টাকা। ঢাকা থেকে ওমান বিমান ভাড়া আগে ছিল ৩০ হাজার টাকা, যা এখন ৭০-৭৫ হাজার টাকা। ঢাকা থেকে রিয়াদ বিমান ভাড়া আগে ছিল ৩৫ হাজার টাকা, যা এখন ৯৫ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। ঢাকা থেকে কাতার আগে বিমান ভাড়া ছিল ৩০ হাজার টাকা, যা এখন ৯০ হাজার টাকায় গিয়ে পৌঁছেছে। তারপরও টিকেট মিলছে না।
সূত্র জানায়, মার্চ পর্যন্ত সৌদি আরবের টিকেট নেই ট্র্যাভেল এজেন্টগুলোর কাছে। সরাসরি এয়ারলাইন্সগুলোতে এ রুটের ভাড়া দিতে হয় ২-৩ গুণ বেশি। ৪০ হাজার টাকা ঢাকা-রিয়াদ রুটে বিমান ভাড়া ৬৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা হলেও টিকেট মিলছে না। ৪৫ হাজার টাকার ঢাকা দুবাইয়ের রিটার্ন ভাড়া ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, তাও ইচ্ছেমতো দিনে পাওয়া যাচ্ছে না। বাহরাইন, কুয়েত, কাতার ও আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব রুটের ভাড়া নিয়ে চলছে অরাজকতা। তবে যে সব দেশ থেকে রেমিটেন্স কম আসে; সেই ইউরোপ, কানাডা, আমেরিকাগামী এয়ারলাইন্স ভাড়া বাড়ানো হয়নি।
টিকেটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে এয়ারলাইন্সগুলোর বিরুদ্ধে। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে প্রবাসী কর্মীরা। মতিঝিলের বিমান অফিসে টিকেট কিনতে আসা একজন যাত্রী বলেন, এখন আমাদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। টিকেটের দাম প্রায় ১ লাখ টাকা হওয়ায় অনেকেই ঋণ করে বিদেশে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
এ বিষয়ে আটাব সভাপতি মনছুর আহমদ কালাম বলেন, এয়ারলাইন্সগুলো সিন্ডিকেট করে মধ্যপ্রাচ্যগামী টিকেটের দাম তিন গুণ বাড়িয়েছে। বর্তমানে জিডিএস সিস্টেমে সৌদি ও দুবাইগামী টিকেটের উচ্চমূল্য দেখানো করছে। মধ্যপ্রাচ্যের টিকেট ৮০ হাজার, ৮৫ হাজার ও ৯০ হাজার টাকা দিয়ে কিনতে বাধ্য হচ্ছে প্রবাসী কর্মীরা। এতে বিদেশগামী কর্মীরা সর্বস্বান্ত হচ্ছে। যে বিদেশগামী কর্মীদের রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে; সেই গরিব অসহায় প্রবাসী কর্মীর প্রতি সুদৃষ্টি দেয়ার কাউকে চোখে পড়ছে না।
রিক্রুটিং এজেন্সিজ ঐক্য পরিষদের সভাপতি এম টিপু সুলতান বলেন, টিকেট না পেয়ে মধ্যপ্রাচ্যগামী হাজার হাজার কর্মীর ভিসা ও ছুটির মেয়াদ শেষ হবার উপক্রম। বিদেশের কর্মস্থলে দ্রুত পৌঁছতে ওপেন স্কাই ঘোষণা করে ফ্লাইট সংকট নিরসনের আহ্বান জানান তিনি।
বিদেশগামী কর্মীদের টিকেটের মূল্য আকাশচুম্বীর ঘটনায় সম্প্রতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ। তিনি বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যগামী কর্মীদের বিমানের টিকেটের উচ্চমূল্য সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রীকে বলতে বলতে হাঁফিয়ে উঠেছি। তারপরও কাজ হচ্ছে না। আসলে বিমান ভাড়া সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণের দায়িত্ব বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ওপর।
এ বিষয়ে বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী গত মঙ্গলবার বিকালে ভোরের কাগজকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্য রুটে বাংলাদেশ বিমানের ভাড়া কমানো হয়েছে। এর চেয়ে আর কমানো সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি বলেন, সবকটি এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষকে আলাদাভাবে ডেকে কথা বলে ভাড়া কমানোর অনুরোধ করা হয়েছে। উল্টো তারা ভাড়া বাড়ানোর জন্য নানা যুক্তি উত্থাপন করছে। অনেকে তিন মাস আগে টিকেট কাটার পরামর্শ দিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে। প্রবাসী শ্রমিকদের দুর্ভোগ ও সাধ্যের কথা বিবেচনা করে বিমান ভাড়া কমানোর চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি। তবে ভাড়া কমানোর সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে বসে ভাড়া সমন্বয় বিষয়ে আলোচনা করতে সিভিল এভিয়েশনকে বলা হলেও সুরাহা হয়নি।
বিমান টিকেট সিন্ডিকেটের অবসান চায় আটাব ও বায়রা : বিমান টিকেট সিন্ডিকেট বন্ধের দাবি জানিয়েছে এসোসিয়েশন অব ট্র্যাভেল এজেন্ট অব বাংলাদেশ (আটাব) এবং বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব অব রিক্রটিং এজেন্সিস (বায়রা)। তাদের দাবি, সিন্ডিকেটের কারণে এই মুহূর্তে বিমান টিকেটের অস্বাভাবিক মূল্য বিরাজ করছে।
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে আটাবের সাবেক সভাপতি এস এন মঞ্জুর মোর্শেদ মাহবুব বলেন, ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে এই সংকটময় অবস্থা শুরু হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে টিকেটের দাম সর্বকালের সেরা রেকর্ড অতিক্রম করেছে।
তিনি বলেন, টিকেটের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় প্রবাসী, শ্রমজীবী বিদেশগামী যাত্রী, ওমরাহ্ যাত্রী, রিক্রটিং এজেন্সি, ট্র্যাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটরসহ সবাই ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ও বিমান মন্ত্রণালয়কে ভাড়া কমানোর জন্য ওপেন স্কাই ঘোষণা করাসহ এয়ারলাইন্সের টিকেট বিপণন ব্যবস্থা তদারকি এবং এয়ার টিকেট সিন্ডিকেটকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের সর্বোচ্চ মহলকে সতর্ক থাকতে অনুরোধ করেন তিনি।
বিমানের টিকেট সিন্ডিকেটের হাত থেকে বিদেশগামী কর্মীদের বাঁচানোর আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব অব রিক্রটিং এজেন্সিস (বায়রা)। অবিলম্বে বিদেশগামী টিকেটের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণের আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। বায়রার অভিযোগ, সিন্ডিকেট চক্র বিমানের টিকেট ব্লক করে বিদেশগামী কর্মীদের কাছে গলাকাটা হারে ভাড়া আদায় করছে।
বায়রার সাবেক সভাপতি আলহাজ আবুল বাসার ও সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, প্রতিবেশী দেশ নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কার তুলনায় বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিমানের ভাড়া কয়েকগুণ বেশি। ঢাকা থেকে ৬ ঘণ্টার জার্নি রিয়াদে যেতে ভাড়া লাগে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। অথচ ঢাকা থেকে নিউইয়র্ক ২৩ ঘণ্টার জার্নিতে ভাড়া লাগছে মাত্র ৬৫ হাজার টাকা।
সংকট দ্রুত নিরসনের লক্ষ্যে অতিরিক্ত বিশেষ ফ্লাইট চালু এবং অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনার লক্ষ্যে লেবার ফেয়ার চালু করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন বায়রার সাবেক সভাপতি আলহাজ আবুল বাসার।
প্রসঙ্গত, বহির্বিশ্বে এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি কর্মীর রেমিট্যান্সের দেশে অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোপূর্বে বলেছেন, প্রবাসী বাংলাদেশিরা এত দিন আমাদের দিয়েছেন। এখন তাদের দেয়ার সময় আমাদের। গরিব অসহায় প্রবাসী কর্মীদের বিমান ভাড়া সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়