ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

সাত মার্চের ভাষণ : একটি অমর মহাকাব্য : যুক্তিযুক্ত বিচার

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এই স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে যিনি বটবৃক্ষের মতো ছায়া বিলিয়ে বিস্তাররূপে দাঁড়িয়ে আছেন তিনিই হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একাধারে তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, বাঙালির জাতির জনক এবং অবিসংবাদিত নেতা। তিনি হিমালয়সদৃশ, বাঙালির জাতিসত্তা, বাঙালির আত্ম-অহংকার। বঙ্গবন্ধুই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, যা পৃথিবীতে এমন নজির আর খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু ‘ক্যারিসম্যাটিক লিডার’ ছিলেন। তিনি মানুষের মনের মাঝে স্থান করে নিতে পারতেন এবং সবাইকে কাছে টেনে নিয়ে ¯েœহ ও ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধে রাখতেন। এত বড় ব্যক্তিত্বের অধিকারী পৃথিবীতে খুব কমসংখ্যক মানুষই ছিলেন। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশে তিনি ছিলেন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনায় তিনি অপরিসীম এবং অতুলনীয় ভূমিকা পালন করেছেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা আজো পৃথিবীর ইতিহাসে অমলিন, চিরভাস্বর। সাধারণ মানুষের মুখে মুখে সবসময় উচ্চারিত হয়। জাতির জনক তার হৃদয় উৎসারিত যে বজ্রকণ্ঠ স্বাধীনতাকামীদের মধ্যে ধ্বনিত করলেন তা মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ্রবণ করলেন। দিকে দিকে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বিজয়ের পতাকা উড্ডীনের জন্য বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হলেন। সমগ্র জাতি এই ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে একতাবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং বিশ্বের বুকে স্বাধীন একটি দেশ প্রতিষ্ঠা করলেন। যার মহানায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আমাদের নাগরিক জীবনের কবি শামসুর রাহমান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত ‘ধন্য সেই পুরুষ’ কবিতায় বলেছেন- ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর রোদ্র ঝরে চিরকাল গান হয়ে/ নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা/ যাঁর নামের ওপর কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া/ ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর পাখা মেলে দেয়/ জ্যোৎ¯œার সারস/ ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর পতাকার মতো দুলতে থাকে স্বাধীনতা/ ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর ঝরে মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি…
কবি নির্মলেন্দু গুণ রচিত ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতায় বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ মার্চের ভাষণের স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে- শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/ হৃদয়ে লাগিল দোলা/ জনসমুদ্রে লাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
কবি অসীম সাহা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘স্বীকৃতি’ কবিতায় লিখেছেন- যতোদিন যাবে, ততোদিন তুমি, উজ্জ্বল হয়ে ফুটবে ফুল/ তোমার দানের মহিমায় জেনো, বিপদে এ-জাতি পাবেই কূল/ যে ৭ই মার্চ জাতির মন্ত্র, মহানায়কের প্রেরণার সুর/ সেই মন্ত্রেই বাঙালিরা যাবে সময় পেরিয়ে অনেক দূর…

আমরা জানি, ৭ মার্চের ভাষণ এক অমর কালোত্তীর্ণ শিল্পিত মহাকাব্য। কী কারণে আমরা এটিকে মহাকাব্য বলি, সেই কথায় আসা যাক। আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, বঙ্গবন্ধু এই ভাষণ দেয়ার আগে মুখস্থ করে আসেননি বা লিখে আনেননি। তিনি অনর্গল এই বাণীগুলো জনতার কাছে সঁপে দিয়েছিলেন এবং জনতাকে, অতি আপন করে বলেছিলেন, ভাইয়েরা আমার! জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ‘ইউনেস্কো’ এই ভাষণটিকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা আমাদের জন্য এক অতি গৌরবের বিষয়।
তাহলে, আগে আমাদের জানা দরকার- মহাকাব্য কী? মহাকাব্য হলো শ্রবণকাব্যের একটি অংশবিশেষ। এটা দীর্ঘ ও বিস্তৃত কবিতাবিশেষ। যে কাব্যে দেবতা বা অসাধারণ গুণসম্পন্ন পুরুষের কিম্বা একোবংশোদ্ভব বহু নৃপতি বা রাজা-বাদশাহর বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয় তা মহাকাব্য নামে পরিচিত। সাধারণত দেশ কিংবা সংস্কৃতির বীরত্বগাথা এবং ঘটনাক্রমের বিস্তৃত বিবরণ এতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরা হয়। গীতিকাব্যোচিত বাঁশির রাগিনী নয়, এটি যুদ্ধসজ্জার তূর্যনিনাদ। যিনি মহাকাব্য রচনা করেন তিনি হলেন মহাকবি। ঐতিহাসিক পটভূমি বা প্রাচীন বীরত্বপূর্ণ কিংবদন্তি অথবা পৌরাণিক কাহিনী মহাকাব্যের অন্যতম শর্ত। মহাকাব্যে নায়ক বিজয়ী হয়ে থাকে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- কালে কালে একটি সমগ্র জাতি যে কাব্যকে একজন কবির কবিত্বশক্তি আশ্রয় করিয়া রচনা করিয়া তুলিয়াছে, তাহাকেই যথার্থ মহাকাব্য বলা হয়।
এখানে মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণগুলোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণের বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণগুলোর বিচার-বিশ্লেষণ করে কী দাঁড়ায়?- সেগুলো এই আলোচনায় আনা হলো এবং আপনাদের সামনে তুলে ধরা হলো।

এক.
মহাকাব্যের আখ্যানবস্তু হবে পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক। প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চের ভাষণের একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। জন্মের অব্যবহিত পরেই এবং প্রথমেই পাকিস্তান সরকার আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ওপর আঘাত হানে। এটি আমাদের দামাল ছেলেরা এবং আপামর জনসাধারণ মেনে নিতে পারেনি। এরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির আর দ্বিতীয়টি নেই। পরে ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং সর্বশেষ ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচন। এগুলো তো ইতিহাসের স্বাক্ষর বহন করে। আমরা বাঙালি জাতি। আমাদেরকে পাকিস্তান সরকার শিক্ষা, অর্থনীতি, চাকরি, রাজনীতি, সাংস্কৃতিক সবক্ষেত্রেই অবহেলিত এবং বঞ্চিত রাখত। উল্লিখিত ব্যাখ্যাগুলোর ধারাবাহিকতায় ৭ মার্চের ভাষণকে মহাকাব্যের আসনে অধিষ্ঠিত করা যায়।

দুই.
মহাকাব্যের একজন নায়ক থাকে। ৭ মার্চের ভাষণের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি জন্মগ্রহণ করেন উচ্চ বংশজাত শেখ পরিবারে। যাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন ইরাকের বাগদাদ থেকে চট্টগ্রামে আগত দরবেশ হযরত বায়েজিদ বোস্তামীর শিষ্য শেখ আউয়াল। এই শেখ আওয়ালই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অষ্টম পূর্বপুরুষ। বঙ্গবন্ধু এই উচ্চবংশজাত পরিবারে জন্মেছিলেন। তাঁর হৃদয় ছিল ¯িœগ্ধ-কোমল। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন জনদরদি। মানুষের কল্যাণের জন্য সর্বদা ব্যাকুল থাকতেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের বড় একটি মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। কী উদ্দেশ্য? উদ্দেশ্যটি হলো ধর্মান্ধ পাকিস্তান থেকে আলাদা একটি ভাষাভিত্তিক, জাতিভিত্তিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠন করা। সেখানে শোষণ থাকবে না, বঞ্চনা থাকবে না, ক্ষুধা থাকবে না, দারিদ্র্য থাকবে না। এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করা হবে যেখানে, সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে। ন্যায়ভিত্তিক, কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রত্যেক ধর্মের মানুষ যার যার ধর্ম পালন করবে। এই রাষ্ট্র গঠনের জন্য জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করাই ছিল এই ভাষণের মূল উদ্দেশ্য।

তিন.
এই ভাষণটি তেরোটি সর্গে বিভক্ত। কাব্যশৈলীর বিচারে এই ভাষণটির অধিকাংশ অংশ গদ্যছন্দ বা অমিত্রাক্ষর বা গৈরিশছন্দ বা মুক্তকছন্দে রচিত। কিছুটা অংশ স্বরবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্ত বিদ্যমান। যেমন উদাহরণ হিসেবে দেয়া যাক: ‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।
আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি।’
‘আজ দুঃখের সাথে বলতে হয়, তেইশ বছরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস।’ উল্লিখিত পঙ্ক্তিমালা গদ্যেছন্দে রচিত।
এছাড়াও ভাষণটি প্রকৃতিতে স্বাধীন ও স্বেচ্ছাবিহারী, সচ্ছন্দ ও সর্বত্রগামী। বন্ধনমুক্তির বাসনা এই ভাষণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। গদ্যছন্দ ভাষণটির বৈশিষ্ট্য হলেও এটি একটি মহাকাব্য। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, গদ্যছন্দ হলো পদ্যের রংলাগা গদ্য। এই রং লাগানো বা ছন্দস্পন্দ সৃষ্টির জন্য কবিকে শব্দ বা বাক্যাংশকে এমনভাবে সাজাতে হয় যাতে তা গদ্য হলেও তার মধ্যে পদ্যছন্দের একটি অস্পষ্ট ছাঁচ বা আভাস ফুটে ওঠে।
কাব্যের ছন্দের আলোচনায় ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে সাত মার্চের ভাষণটি একটি সফল মহাকাব্যের অন্তর্ভুক্ত। এটা নিঃসন্দেহে বলতে পারি।

চার.
১৯৭১ সালের সাত মার্চের এই ভাষণ বঙ্গবন্ধু প্রথমেই দৃপ্ত পায়ে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়ে ‘ভাইয়েরা আমার’ সম্বোধন করে আঠারো মিনিটের এই বস্তুনিষ্ঠ ভাষণটি জনতার উদ্দেশে হাত উঁচিয়ে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আদায়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়ে যান। লাখ লাখ জনতা হাত উঁচিয়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে করতালি দিয়ে স্বাগত জানান ও শপথ করেন। প্রকৃতপক্ষে ভাষণটি ছিল আপামর জনসাধারণের স্বাধীনতার জন্য পথনির্দেশ এবং বীজমন্ত্র। বাঙালি জাতির জন্য মুক্তির এক মহাবাণী। যার জন্য সমগ্র বাঙালি একসঙ্গে হাতে হাত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১৯৭১ সালে যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলার স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনেন।

পাঁচ.
১৯৭১ সালে সাত মার্চের ভাষণটি সারা বিশ্বের মিডিয়া জগতে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্র বিশ্ব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের কার্যকারিতা বা বাস্তবায়নের কীভাবে সম্ভব? সেই দিকে। বাংলার প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি ঘরে সবার মধ্যে এই ভাষণের প্রেক্ষিতে যা যা করা দরকার তাই তারা করার জন্য পথে নেমে পড়েন। প্রতিটি মানুষ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলেন। যুদ্ধ শেষে বাংলার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজয়ী হবে বা বাঙালি জাতিই স্বাধীন দেশের পতাকা ছিনিয়ে আনবে এটা তাদের মধ্যে বিশ্বাস হয়ে যায়। এই ভাষণের কারণেই বাংলাদেশ নামে স্বাধীন একটি দেশের জন্ম হয় এই বিশ্বের বুকে।

ছয়.
সাত মার্চের ভাষণটি ছিল ঐতিহাসিক পরম্পরার অনিবার্য পরিণতি। এই ভাষণটির তাৎপর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তৃত। যে ভাষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। বাংলাদেশের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তিত হয়। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের ফলে ৩০ লাখ লোক শহীদ হয় এবং পুরো বাংলাদেশ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। এদেশের অবকাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। মহাকাব্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ, মিলন-বিরহ, প্রকৃতিজগৎ, ঐতিহাসিক পটভূমি উপস্থিত থাকে। বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণের মধ্যেও এগুলো সুপ্ত, গুপ্ত ও বহিরঙ্গেও
প্রকাশিত রয়েছে।

সাত.
বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণে রূপ, রস, ভাব, অলঙ্কার, ছন্দ সবকিছুই বিরাজমান। ভাষণটিতে বীর রস প্রধান। আরো দুটি রসের উপস্থিতি দেখা যায়। শৃঙ্গার ও শান্তরস। যেমন : রক্তের রাজপথ, রঞ্জিত হওয়া, কলকারখানা, নিরস্ত্র, অস্ত্র, কসাইখানা, রাউন্ডটেবিল, ব্যারাক, আরটিসি, শিল্পের মালিক, শ্রমিক ভাইয়েরা, আত্মকলহ, লুটতরাজ, রক্তের দাগ, বেতন, মাইনেপত্র, ব্যাংক, টেলিফোন, শত্রæর মোকাবিলা, টেলিগ্রাম, অস্ত্র, গরুর গাড়ি, রেল, রক্তের উপর পাড়া দিয়ে, কনফারেন্স, বাংলার মানুষ, শাসনতন্ত্র, মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদ, দুঃখ ভারাক্রান্ত মন এগুলো এই ভাষণ-মহাকাব্যের উপমা, অলঙ্কার। যেমন : ‘কী পেলাম আমরা? আমরা পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রæর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি।’
‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না, সাতকোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’
‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।

আট.
ইতিহাসের সবচেয়ে উদ্দীপক ও প্রেরণাদায়ী ভাষণটি হলো বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। এটি বিশ্বের সবচেয়ে রাজনৈতিক অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে সবার কাছে স্বীকৃত। এই ভাষণের বাণীগুলো ছিল ওজস্বী এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ। এটি সব মানুষ তন্ময় হয়ে শোনেন। ভাষণটি বস্তুনিষ্ঠ। এখানে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রস্তুত থাকার জন্য যা যা করা দরকার তার নির্দেশনা রয়েছে। মহিমাময় এই ভাষণটিতে বীর রসমিশ্রিত ওজস্বীপূর্ণ বাণীবিন্যাস বিদ্যমান, যা বাঙালি জাতিকে এক কাতারে এবং একসঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সাহস জুগিয়েছে। ভাষণটি যারাই শুনেছে তারাই দেশমাতৃকা রক্ষার জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

নয়.
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন বীরোচিত স্বপ্নের মহানায়ক। তিনি অন্তরে ধারণ এবং পোষণ করতেন একটি স্বাধীন স্বদেশ। যার নাম বাংলাদেশ। সমগ্র বাঙালির আজীবনের লালিত স্বপ্ন ও সাধনা। এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের জন্য ১৯৭১ সালের ২ মার্চ বঙ্গবন্ধু সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের সাত মার্চ বঙ্গবন্ধু বিশ্বের ইতিহাসের সেরা ভাষণটি দিয়েছিলেন। এই ভাষণটির মহানায়ক বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নিজেই। তিনি সমগ্র বাঙালিকে একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য বাংলার জনতাকে প্রস্তুত করেছেন। তাঁর এই বীরোচিত ভাষণকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ (নভেম্বর ১৮৬৩) ভাষণের সঙ্গে তুলনা করা হয়। লিংকন দাসপ্রথা চিরতরে নির্বাসনের জন্য গৃহযুদ্ধ থামাতে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। যদি প্রশ্ন তোলা হয়? দাসপ্রথা কি আর নেই? এখনো যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গরা আজো অবহেলিত, লাঞ্ছিত এবং ধুঁকে ধুঁকে মরছে। উদাহরণ হিসেবে দেয়া যেতে পারে, এ বছরই কৃষ্ণাঙ্গ ‘ফ্রয়েড’ নির্যাতনে প্রাণ হারান।
এখানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নায়কোচিত যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেই ভাষণের মাধ্যমেই সমগ্র বাঙালি একতাবদ্ধ হয়ে আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। মহানায়কের বিজয় অর্জিত হয়েছে। বীরের বেশে আজ দিকে দিকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

দশ.
মহাকাব্যের নায়ক বিজয়ীবেশে বীরদর্পে আসনে অধিষ্ঠিত হবে। প্রকৃতপক্ষে সাত মার্চের ভাষণের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বলা যেতে পারে ঠিক এই সময়ের ভাষণটি ছিল অধিকতর যুক্তিযুক্ত। অসহযোগ আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। সমগ্র বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর মুখের দিকে চেয়ে ছিল। ঠিক এই মুহূর্তেই ১৯৭১ সালের সাত মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ভরা জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু যে মহামন্ত্র উচ্চারণ করলেন, তা এক বজ্রকণ্ঠের সমান। বঙ্গবন্ধুই একমাত্র নেতা যিনি সবার কাছে এক অনিবার্য নাম হয়ে উঠেছিল। তার মুখনিঃসৃত বাণীই হলো আমাদের বাঙালিদের একমাত্র বীজমন্ত্র। তিনি এই ভাষণের মাধ্যমে বিজয়ী বীর হয়ে উঠলেন এবং ভাষণটি পৃথিবীর ইতিহাসে এক অমর অমৃত মহাকাব্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেন।
উল্লিখিত বিচার বিশ্লেষণে বলা প্রসঙ্গত যে, বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণটি একটি অমর মহাকাব্য। এই মহাকাব্যের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাঁর অসাধারণ নেতৃত্বের গুণে আমরা পেয়েছি আমাদের নিজস্ব ঠিকানা লাল সবুজের পতাকায় শোভিত নিজস্ব ভূখণ্ড স্বাধীন বাংলাদেশ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়