ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

সংকীর্ণতা থেকে উত্তীর্ণ হতে পারলেই মুক্তি

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। কিছুদিন আগে এক ভদ্রমহোদয়ের সাথে তার নিমন্ত্রণে অর্ধঅভিজাত এক কফি-শপে বসেছিলাম কয়েক চেনাজনের সঙ্গে। যৎসামান্য প্রয়োজন আর অনেকদিন দেখা হওয়া না-হওয়াকে ঝালাই করাই ছিল উদ্দেশ্য। পুরনোরা একসাথে হলে যা হয়, তা-ই হলো; কথার গতি শব্দের গতিকে ছাড়ালো। রাজ্যের রাজা উজির থেকে পাইক-পেয়াদা হয়ে রাম-সাম-যদু-মধু কেউ বাদ পড়ল না আলোচনা-সমালোচনার ঝাঁঝালো বান থেকে। তখন চলতি শিল্পী-সমিতির নির্বাচনও বাদ পড়ল না ওই কথালাপ থেকে। আর সেখানে যখন উচ্চমার্গিয় শিক্ষিতজনেনা থাকে তখন-তো কথাই থাকে না। একের পর এক কফি আসতে থাকল, আলাপের ঘোড়া পিঠে তাড়া পেয়ে দৌড়ালো। কথা উঠল চিত্রনায়ক জায়েদ খানের জয়, নায়িকা নিপুণের পরাজয় ও অভিযোগের বিষয়ে। পীরজাদা সাহেবের অনৈতিক আবদারের কথাও ঝাঁপিয়ে পড়ল এ কথার মধ্যে। তখনো বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়নি। অথচ কথার যাত্রাশুরুতেই সভাস্থলের সবচেয়ে ভদ্রশোচিত ও জ্ঞানী আর বিবেকনির্দেশক বলে যাদের আমরা মান্য করি- এমন এক সুজন আচমকা মন্তব্য করে বসলো যে, ‘আরে ওই মেয়েটারই দোষ। এসব মেয়ের কোনো পরিচয় আছে নাকি? ওরা স্বার্থের জন্য সব করতে পারে, যত ইচ্ছা নিচে নামতে পারে।’ তাজ্জব হলাম তার কথায়। কার মুখ দিয়ে কী কথা! যাকে পথপ্রদর্শক, প্রাজ্ঞ মানি আর তিনি এ কী বলে উঠলেন। তৎমধ্যে নিজেকে সবচেয়ে অজ্ঞ ও মূর্খ ভাবি বিধায় সে ক্ষেত্র ছেড়ে উঠে আসার ধৃষ্টতা হলো না, তবে তীব্র প্রতিবাদ করলাম। কারো পক্ষ পেলাম, কারো পক্ষ পেলাম না। অতিদ্রুত সেস্থল ত্যাগ না করা পর্যন্ত দম বন্ধ হয়ে আসছিল। দ্বিতীয়বার ওই গুণীজনদের সাথে আমার আর দেখা হবে কিনা জানি না। হবে না বলেই স্থির করেছি। যা বিতর্ক শুনেছিলাম, তা ভুলতে সময় লাগবে বেশ।
এই যে দেখুন, সেদিনের প্রসঙ্গটি নিপুণ ছিল, নিপুণকে ভালো-না বলায় ব্যক্তিগত কোনো লাভ বা ক্ষতি আমার হয়নি। নিপুণ ভালো কি মন্দ, কোন পরিবার থেকে উঠে আসা তা আমি জানি না। জানার ব্যস্ততাও নেই। আমার ব্যস্ততা, যে সচেতন ও বিজ্ঞজনের মুখ দিয়ে নিপুণ সম্পর্কে কথাটি লাফিয়ে পড়েছিল, আমি জানি তিনিও নিপুণকে কোনোদিন দেখেননি। নিপুণ তার পরিচিত না। পরিজনও না। আমার বলার বিষয়, নিত্য সংবাদ নিয়ে নৃত্য করা একজন অভিজ্ঞ লোক কী করে একটি মামলারত নিষ্পত্তিহীন বিষয় বা অভিযোগ বহালরত একটি বিষয় নিয়ে চটজলদি মন্তব্য করেন! এবং একপেশে মতামত দেন! যিনি সংবাদ নিয়ে কাজ করেন, যিনি আরো দশজনের অভিযোগ রফা করে দেন তিনি কেমন করে না জেনে, অজানা একটি বিষয় নিয়ে তর্কে লিপ্ত হন এবং লিঙ্গবৈষম্যজাতীয় কথা উগ্রে দেন!
একটি পত্রিকায় একটি ধর্ষণ সংবাদ প্রকাশিত হলো। টেলিভিশনের খবরেও তা প্রচারিত হলো। প্রত্যক্ষ করবেন, একদল লোক কিছু না জেনে, না বুঝে, না শুনে মন্তব্য করতে থাকবে, ‘ঠিকই আছে, বেপর্দা হয়ে বের হও ক্যান, পোলাগো সামনে যাও ক্যান, রাইতে বাইরে থাকো ক্যান, শর্ট কামিজ পরো ক্যান? ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ খবরটি ছিল, বাড়িতে ফাঁকা পেয়ে এক তরুণীকে কয়েক বখাটের শারীরিক নির্যাচন (ধর্ষণ)।’ ধরুন, পথ দিয়ে যাবার সময় দেখলাম কিছু লোক একটি লোককে আঘাত করছে, অপদস্ত করছে। ওই সময়ে বিপদগ্রস্ত লোকটিকে উদ্ধারের চেষ্টা না করে অনায়াসে বলে দিচ্ছি, হবে হয়তো চোর, না হয় পকেটমার! অথচ আমরা জানিই না প্রকৃত ঘটনাটি কি। মনে আছে সেই ঘটনাটি- রামপুরা-বাড্ডার দিকে স্কুলে বাচ্চাকে ভর্তির তথ্য জানতে যেয়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে ‘রেণু’ নামক এক নারীর হৃদয়বিদারক মৃত্যুর কথা? রোড অ্যাকসিডেন্ট হলে একের দোষে অন্যের গাড়িতে দাউ দাউ আগুন দেয়া? কিছুদিন আগে নির্বাচনী সহিংসতায় হৈ হৈ করে ঘরের পর ঘর পুড়িয়ে দেয়া, মানুষের পর মানুষ নিহত আহতের কথা? অথবা মসজিদে কুরআন নিয়ে কটু কথা বলার সন্দেহ থেকে একব্যক্তিকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা? এমন শত শত ঘটনা? আসলে প্রত্যেকটি ঘটনা কি হাজার হাজার মানুষ নিজ চোখে দেখেছে বা প্রমাণ পেয়ে সে কাণ্ডগুলো ঘটিয়েছে? অবশ্যই না। শুনে শুনে, না দেখে, না বুঝে, বোধ বিচারহীনে তারা কেবল ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেখাদেখি, কারো প্রভাবে বা মদদে। অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার পর হয়তো অনুশোচনায় ভুগেছে কিন্তু কী লাভ হয়েছে? ক্ষতির পর কান্নায় কি কোনো লাভ হয়? ফিরে আসে আর- যা হারিয়ে যায়? মানহানির পর- আর কি ফিরিয়ে দেয়া যায় তার মান?
এই সময়টি একটি অদ্ভুত ভ্যাবাচেকা সময়। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের, তারহীন যুগের উপকার ব্যবহারের চেয়ে অপকার ব্যবহার করে অনেকে যেন উন্মাতাল; তার গায়ে গা ভাসিয়ে শিক্ষিত, জ্ঞানীরাও বারবার সংকীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছে জ্ঞান হারিয়ে। আপেলে রং মাখিয়ে আপনি যদি আম বলে তা কৌশলে একবার বিশ্বাস করিয়ে দিতে পারেন; অন্ধের মতো হামলে পড়ে অলৌকিক আম বলে ভাইরায় হয়ে যাবে রংমাখানো আপেলটি আম পরিচয় নিয়ে। একবার কেউ ক্ষতিয়ে দেখতেও চাইবে না, কী করছি আমি! কেন করছি আমি! এ কাজ কি আমার! আমরা যে-যা-না তা-ই নিয়ে সময় অপচয় করছি বেগতিকহারে। ¯্রােতের সাথে ভাসিয়ে দিচ্ছি ভারি গা। আমরা বিবেচনা করছি না, পরখ করছি না, বোধে নিচ্ছি না, শিখছি না, গবেষণা করছি না, পড়ছি না, পড়াচ্ছি না। আমরা শুধু গা ভাসাচ্ছি। অন্ধ আলোর দিকে ছুটছি আলোর আলো রেখে। আমরা নিজেদের বুদ্ধিজীবী বলে চালিয়ে দিচ্ছি অথচ নিজেদের বুদ্ধিকে মাপছি না। বুদ্ধির বোধ ধরে রাখছি না। বুদ্ধিদীপ্ত কাজ করছি না। চোখ বন্ধ করে লাভের দিকে হাঁটছি, ক্রোধের দিকে হাঁটছি। যাচাই-বাছাই করতে আমাদের এত অনীহা কেন? অনীহার খেশারত দিয়েও আমাদের মাথা জাগছে না। মাথাহীনের মতো মাথা নিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছি জড়তা নিয়ে, সংকীর্ণতা নিয়ে, অনুদারতা নিয়ে, সীমাবদ্ধতা নিয়ে, অপরিসরতা নিয়ে, ধর্মান্ধতা নিয়ে, অশিক্ষা নিয়ে, কুসংস্কার নিয়ে, গোঁড়ামি নিয়ে, স্বার্থপরতা নিয়ে!
লক্ষ্য করলে দেখব, সময়ের এত পর এসেও সংকীর্ণতা, জীর্ণতা আমাদের চারপাশে অক্টোপাসের মতো প্যাঁচিয়ে আছে। আমরা বড়মুখ করে সভায়, সেমিনারে, পরিষদে উদারতার কথা বলছি, মুক্তির কথা বলছি, স্বাধীনতার কথা বলছি, বিশ্বায়নের কথা বলছি অথচ কখনো নিজের বেলায়, কখনো অপরের বেলায় সুবিধা মতো নিজেরই বক্তৃতা, বয়ান থেকে আলগোছে সরে আসছি। আমার খুব মনে পড়ছে আমার সপ্তম, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ের কথা। তখন আমাদের বিজ্ঞান বইয়ে, দুই এক চ্যাপ্টার পর পর কিছু অংশ এগিয়ে লেখা থাকত, এসো নিজে করি। আর এখন ওই কথাটিরই উলটো দেখতে পাই দুই-এক পা এগুলেই যে, তুমি করো, এসো তোমাকে শেখাই! যেন সকল উপদেশ, সকল সৎকথা, সাধুকথা, ভালোকথা অপরের জন্য আর নিজের জন্য বদমনোবৃত্তি লুকিয়ে রাখা রঙির পোশাকের তলে। প্রবল এক দুঃসময় যাচ্ছে এখন, আমরা পিয়নকে সুন্দর থাকতে বলছি, কলঙ্কহীন থাকতে বলছি, সৎরুজি করতে বলছি, অধীনস্তকে কাজের দোষ ধরছি, মনোযোগ দিতে বলছি আর নিজে গায়ে তা-লাগিয়ে সব ভায়োলেট করে চলছি সব চোখের আড়ালে। আমরা সন্তানকে বড় মানুষ হতে তাগাদা দিচ্ছি, ভালো মানুষে হতে মৌলবির কাছে পাঠাচ্ছি, ক্রিয়াবিদের ক্রিয়া দেখাচ্ছি অথচ নিজে দু-হাত ভরে ঘুষের টাকা ঘরে আনছি। অন্যের হকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছি, আবার তা থেকে দান করে সমাজ সেবক সাজছি। কী ধ্বংস আমাদের! কী পতন আমাদের! আমরা কন্যাকে বলছি সাহসী হও। পুত্রবধূকে বলছি, নিচু হয়ে চলতে হয় বৌ! ছেলেকে বলছি, খরচ কমাও, জামাতাকে বলছি, মান রক্ষা করতে শেখ। আশ্চর্য আমাদের চরিত্র। আশ্চর্য আমাদের ক্ষীণতা, হীণতা। কোন পথে উদ্ধার?
নীচুতা, কুসংস্কারতা, সীমাবদ্ধতা আজকে আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, সবখানে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে। রাজনৈতীক প্রেক্ষাপটের দিকে অ-সরু দৃষ্টিতে তাকালে একই অবস্থা দেখতে পাই বিস্তীর্ণ মাঠ পেরিয়ে দিগন্ত জুড়ে আছে; জুড়ে আছে প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, কথা না রাখা, ঠকানো, হানাহানি, মারামারি, অমান্যতা, ভব্যতা, আঘাত, প্রতিঘাত, হিংসা, বিদ্বেষ, ভুবাজি, ভণ্ডতা, মনোগত অনুদারতা। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছি না। বদনাম আর বদনাম ছড়াচ্ছি, অপ্রীতি বাড়াচ্ছি, দস্যু দস্যুভাবে তাকাচ্ছি, রাজনীতিকে ব্যবহার করে পরপারে স্থান কেনার চেষ্টা করছি, একদল আরেক দলকে সুযোগ পেলেই ঘাই মারছি। গালি দিচ্ছি। একটেবিলে বসতে প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে, কেউ কারো বাড়িতে যাচ্ছি না, কেউ কাউকে আবার বাড়িতে জায়গা দিচ্ছি না! আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ পাঠাচ্ছি না, গ্রহণ করছি না! কম বেশি আছে কিন্তু তার প্রভাব পড়ছে সর্বত্র। বহুভবিষ্যতে। আপাতদৃষ্টিতে আমাদের কাছে তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। রাগ ক্ষোভকে প্রধান্য দিচ্ছি, একরোখামিকে ধরে রাখছি, আদতে একটি প্রজন্ম শিখে নিচ্ছে, মননে তুলে নিচ্ছে এই মত-বিমতের বিষবাষ্প, দ্বিধান্বিতের ধারালো ছুরির কতলবাজি। তারা শিখছে কী করে কতল করতে হয় একে অন্যের সম্মান, মান। কী করে কাচের টুকরো মতো ভাঙতে হয় সিদ্ধান্ত। কেমন করে অপমান করতে হয় পরস্পর পরস্পরকে। কেমন করে অপদস্ত করতে হয় জনসম্মুখে, কত জোরে গালমন্দ করতে হয় আসরে বসে, মঞ্চে উঠে। অপরিসরতা দেখতে দেখতে নতুন প্রজন্ম আটকা পড়ে যাচ্ছে অপরিসরতার বেড়াজালে। মানসিকতার একটা চৌবাচ্চার ভেতর বাঁধা পড়ে বন্দি হয়ে যাচ্ছে তাদের বিচার বিবেচনা। ব্যতিক্রম আছে, তা উদাহরণ না। এদের মুক্তির দায় কার? লাল দলের, নীল দলের, সবুজ দলের, সাদা দলের নাকি সব দলের? সবার? সত্যি বলতে দ্বিধা নেই, বড় বড় দালান উঠছে আমাদের বুক চিড়ে কিন্তু মানবিকতার, মানসিকতার, দয়ার, মায়ার, শ্রদ্ধার, শুদ্ধতার, সুবোধের কতটা উঁচু দালান উঠছে পড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায়, হাটে হাটে, গঞ্জে গঞ্জে? রাজনৈতিক শাখা-উপশাখা খোলা হচ্ছে কয়েক পা দূরে দূরে, সুরাজনীতি চর্চার পাঠশালা কয়টি হচ্ছে? রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছে দলে দলে যোগ্য অযোগ্য, কচিকাঁচা, যুবক, তরুণ, বৃদ্ধ! পাঠাগারে যোগ দিচ্ছে কতজন? কতজন জানে রাজনীতির নীতি-আদর্শ? চেতনা ও চেনার জন্য ওরা আগ্রহী হচ্ছে নাকি সংকীর্ণতার ঘোর মেঘ কাঁধে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সুবিধাভোগপ্রত্যাশী বুকে উঁচিয়ে? নিয়মের মধ্যেও কি উদার রাজনীতি আছে? কাঁটা বিছানো যেন বিশাল সজ্জায়। পাহারাদার ছাড়া তাই চলতে ভয়, কী জানি কী হয়। যদি বুকে বুক পেতে একদল আরেক দলকে টেনে নেয়ার চর্চা হতো তবে ভয় যেত উবে, রাষ্ট্রের মুখ উদিত হতো- যেমন সূর্য উদিত হয় পূর্বে। এ কি শুধু দেশে, বিশ্বমুখের মুখও এর চেয়ে উত্তম কতটুকু? অধিক না।
রাজনীতির দোষই বা অগ্রে আনছি কেন! আমাদের সমাজ, সংসার, ব্যক্তি-আমরাও কি গাঢ়সংকীর্ণতা থেকে উত্তীর্ণ কেউ? আমাদের সমাজের দিকে তাকালে, উপরতল থেকে

একটু গভীরে ডুব দিলে রেখায় রেখায় আঁকা সংকীর্ণতা, সংকোচতা। তাই তো এখনো আমরা ভাই ভাইয়ের হাতে খুন হওয়ার সংবাদ পাই। বোন বোনের হাতে লাঞ্ছিত হবার খবর পাই। জানতে পাই পুত্রের হাতে মায়ের প্রতি নিষ্ঠুরতার কথা, কন্যার ঘর থেকে পিতাকে তাড়িয়ে দেয়ার নির্দয়তা। প্রতিবেশীল চলার পথে বেড়া দিতে শুনি আমরা অহরহ। জ্বালিয়ে দিতে শুনি স্বজনের ঘর স্বজনে। লুট করতে দেখি পরিজনের ধন পরিজনে। জ্ঞানগর্বে ভারি লোককেও দেখি জ্ঞানহীন কার্য করতে, গর্বিতের হাতেও দেখি অপরাধের দাল লাগতে। কেন দেখি? অশিক্ষার করণে, অদীক্ষার জন্য, অজ্ঞতার বশিকরণে? না। সংগোপনে সংকীর্ণতার অবদানে এমন অবয়ব দেখি আমরা। আমরা শিক্ষা নিই, দীক্ষা নিই, জ্ঞান নিই, অভিজ্ঞান নিই কিন্তু সংকীর্ণতা পরিহারের যে বিশদ বিচরণ, জ্ঞানের দরবারে সেই বিচরণটি আমরা করতে পারি না। আমাদের করানো হয় না। না সামাজিকভাবে, না রাষ্ট্রীয়ভাবে, না পারিবারিকভাবে, না আমরা ব্যক্তিগতভাবে তা গ্রহণ করতে আগ্রহী হই। আমরা অনেক কিছু জানি কিন্তু আমরা জানি না আমাদের সীমাবদ্ধতা কোথায়। আমাদের অপারগতা কোথায়। আমাদের আবদ্ধতা কোথায়। আমাদের অজ্ঞতা কোথায়। না জেনেই আমরা পাহাড় ঠেলে সরিয়ে দিতে চাই এক গাঁ থেকে আরেক গাঁ এ।
পরিবার থেকে বেরিয়ে পরিবারে বৃহৎ হচ্ছি আমরা কেবল। সংখ্যায় বাড়ছি। আমাদের বাড়ন্ত সময়ে পরিবার কতটুকু দায়িত্ব নেয় আমাদের প্রতি? দায়সারা দায়িত্ব আর কর্তব্য পালন করে গর্বিত পিতা-মাতা হয় আমাদের পিতা-মাতারা। অর্থের পেছনে, বিত্তের পেছনে, পদের পেছনে, রোল নং ১ এর পেছনে, জিপিএ ৫ এর পেছনে ছুটতে ছুটতে আমাদের পরিবারগুলো বড় ক্লান্ত আজ। তারা আর পারছে না। তারা এত কিছুর দিকে নজর দিতে গিয়ে শীর্ণতার দিকে তাকাবে কখন? তাদের তো জিপিএ চাই, বিসিএস চাই, ঘুষ চাই, দালান চাই, জমি চাই, স্যুট চাই, বুট চাই, টাই চাই, মোজাইক করা ঘর চাই, ছাদওয়ালা বাড়ি চাই, নগর চাই… তাদের উদারতা চাই না, উন্মুক্ততা চাই না, মুক্তি চাই না। আমারা নিজের মেয়ে উত্ত্যক্ত হলে সমাজ সংসার দেশ ধুইয়ে দিই অথচ নিজের ছেলে কারো মেয়েকে বিরক্ত করছে কিনা তা কোনোদিনও গোপনে খোঁজ করি না। মেয়ে পরের ঘরে কতটুকু সুখ পেল তা নিক্তি দিয়ে মাপি অথচ নিজের ঘরে আসা মেয়েটি ঠিকঠাক আনন্দে আছে কিনা তা পাত্তা দিই না। ছেলেকে বুঝাই, শেখাই না। মেয়েকে শেখাই, বুঝাই না। অন্যকে সাধু হতে বলি নিজে সাধু হই না। অন্যকে চুরি থেকে বিরত থাকতে বলি নিজে চুরি থামাই না। শুধু দুই বেলা ভালো খাবারের আশায়, লোক দেখানোর অহংকারে বিচ্যুৎ পথে চলে যেতে আমরা দ্বিধা করি না। আমাদের যেন আরো চাই, আরো চাই। ও-মানুষ, কতটুকু হলে আর লাগে না?
শিক্ষায় গলদ রয়েছে আমাদের পাটাতনের তলে। সেল্ফসেন্সরহীনতার কারণে অপরাধ বিবেচিত হতে পারে! যে কেউ মামলা ঠুকে দিতে পারে অতিগণতান্ত্রিক এই সময়ে; যে কেউ তেড়ে এসে মারতেও পারে সুবিচারের ফাঁকফোঁকর দিয়ে তবু বলতে বাধ নেই যে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা, পাঠদান বা শিক্ষা কি প্রকৃতই মুক্তশিক্ষার চর্চা করায়? উন্মুক্ততা শেখায়? প্রশস্ততা শেখায়? সহজতা শেখায়? যথাযথতা শেখায়? বিস্তীর্ণতা শেখায়? মক্তব থেকে উচ্চশিখর পর্যন্ত যে শিক্ষা আমরা গ্রহণ করি তা কি অন্ধতা দূর করে আমাদের? গোঁড়ামিকে তাড়িয়ে তাড়ানোর পথ কি দেখায়? নাকি বস্তা ভরে সার্টিফিকেট আর কেরানি বানানোর উত্তম পথ প্রশস্ত করে? করলে আমাদের ছেলে-মেয়েরা কেন বিদেশ চয়ে যায়, কেন আমরা পাঠাই বোয়ালমাছেরা? কেন আমরা ওই পর্যায়টিকে তৈরি করতে ব্যর্থ? কেন আজো পারছি না? পারতে আর কতদিন লাগবে? কি লাগবে? কাকে লাগবে? আর যদি জোর করে কেউ বলেন, এখানেই আছে তো! তবে আমাদের কালো বর্ণের কন্যাটিকে কেন একা কাঁদতে হয়, কেন তাকে লোকে কালো বলে কথা শোনায়? কেন গায়ের রং দিয়ে অনেক কাজে তাকে কাজ দেয়া হয়? অনেক কাজে তাকে নির্বাচন করা হয় না। কেন আমাদের ছেলের বউ খুঁজতে ফর্সা নামক মেয়েটিকে বাছাই করি! কেন আমরা ভালো পদে চাকরিতে গিয়ে উপঢৌকনের আশায় তাকিয়ে থাকি পরহস্তের দিতে? কেন আমরা ত্যাগের চেয়ে ভোগে অভ্যস্ত বেশি? কেন দানের চেয়ে ঋণ করি অধিক? কেন বুক খুলে আকাশের দিকে বুক চিতেয়ে দিতে ভয় হয় আমাদের সর্বোচ্চ শিক্ষার সার্টিফিকেট অধিকার করেও। যৌতুকের জন্য আমাদের দেশে বছরে কতজনের মৃত্যু হয়, কতজনের ঘর ভাঙে, কতটি ডিভোর্স হয়, কতটা অশান্তি বাসা বাঁধে তা কতটা জানি? আমরা কি এখনো ছেলেকে ছেলের সাথে খেলতে পাঠাই আর মেয়েকে মেয়ের সাথে খেলতে পাঠাই না! পাঠানোর আগে তাদের কানে কানে অনেক কথা বলে দিই না! আমাদের এখন অনেক অনেক কিছু আছে শুধু সংকীর্ণতার শেকল আমাদের পিছন থেকে এমনভাবে টেনে রেখেছে যে, আমাদের অনেক উজ্জ্বল তারা মলিন দেখাচ্ছে সরুতার কারণে। চিপা মনোবৃত্তি আর মনোভাবের দায়ে। ছোটোতা ও স্বার্থপরতার সীমাহীন অসীমতার দায়ভারে।
সংকীর্ণতা থেকে উত্তীর্ণ হতে না পারলে আমাদের অনেক কিছু হবে, অনেক অনেক কিছু হবে সত্য কিন্তু মুক্তি আসবে না। মনের মুক্তি ঘটবে না। মানসিকতার মুক্তি হবে না, মানবিকতার মুক্তি নাগাল নেবে না। আমাদের প্রান্তরে রোদ উঠবে ঠিক কিন্তু আলো জ্বলবে না। সূর্যের তাপ লাগবে কিন্তু শীতলতা যাবে না। ককিয়ে কোঁকিয়ে কাটবে আমাদের দিন, রাত। কেউ কেউ অহম করতে পারব, বাজি ধরতে পারব শেষাংশে হেরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। আমাদের চলনে, বলনে, কথায়, ভাবে, অভিব্যক্তিতে, শিক্ষায়, জ্ঞানে, জানায়, বুঝায়, সামাজিকতায়, রাষ্ট্রব্যবস্থায় অনেক ক্ষেত্রে সংকীর্ণতা আছে, লতিয়ে উঠেছে। তা দূর করতে হবে। রাষ্ট্র পর্যায় থেকে ব্যক্তিপর্যায় পর্যন্ত এর জন্য পরিশ্রমী না হলে কাল এসে ঠেসে ধরবে টুঁটি, তখন শ্বাস আটকে গেলে বিপদ নয় কি? আমরা যদি আমাদের অনুদারতাগুলো চিহ্নিত করে…, অন্ধতাগুলো দাগ দিয়ে তাতে আলোর রেখা মাখাতে পারি, বিশ্বমজলিশে মুক্তবিহঙ্গ হয়ে উড়তে আমাদের সময় লাগবে না, কেননা, সীমাবদ্ধতা থেকে যে যত বেরিয়ে গিয়ে আকাশের দিকে তাকাতে পেরেছে সাহসের বুজ উজিয়ে সে কেবল সম্মানিতই হয়েছে, অপমানিত হয়নি একবিন্দু। এতে মুক্তি এসেছে হাতের মুঠোয়, আঙুলের গডায় বসে মুক্তি লাফিয়েছে ফড়িংয়ের মতো। আর না হলে অন্যের তালু তলে কলুষ কথায় বেয়ে যেতে হবে আপন পবন পাল, যেখান থেকে কিছুতেই মুক্তি মেলানো সম্ভব হবে না কোনোদিন। তবে এই পণ, আমরা এগিয়েছি, নাতিদূরেই পূর্ণউত্তীর্ণও হবো, সে-ও দূরে নয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়