ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অসাধারণ অগ্রযাত্রা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে সদ্য স্বাধীন হিসেবে জন্ম নেয়া বাংলাদেশ ছিল অপ্রতুল সম্পদ, দুর্যোগপ্রবণ আর দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশ। তদুপরি, ঘাড়ে চেপে বসেছিল বিপুলসংখ্যক অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী। সেখান থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন এখন অসামান্য। বিশ্বব্যাংক ও তার অনুসারীদের উন্নয়নের মানদণ্ড অনুযায়ী বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে এখন গর্ব করা যায়।
মাত্রই কয় মাস আগে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অনুমোদন পেয়েছে। এর আগে ২০১৭-এর মাঝামাঝি এসে প্রয়োজনীয় লক্ষ্যসমূহ (সূচক) অর্জন করে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছে যায়। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত সুখবর। অন্যদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর শেষে দেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় দাঁড়াবে দুই হাজার সাতশো পঁচাশি ডলার। আগামী অর্থবছরে সেটা তিন হাজার ডলারের ল্যান্ডমার্ক অতিক্রম করবে।
অদম্য গতিতে এগিয়ে যাওয়া এই বাংলাদেশকে দেখে পৃথিবীর প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদদের পাশাপাশি এখন আশ্চর্য হচ্ছেন একাত্তরে হেরে যাওয়া পাকিস্তান এবং বৃহৎ প্রতিবেশি ভারতের অর্থনীতিবিদরাও। সম্প্রতি বাংলাদেশের বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে পাকিস্তানি দৈনিক ডনে ‘বাংলাদেশের গল্প’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও নীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ইশরাত হুসাইন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, প্রতিবেশী ভারত এবং পাকিস্তানকে সামাজিক-অর্থনৈতিক বেশিরভাগ সূচকে কীভাবে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে, গত বছর পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনালে ‘এইড ফ্রম বাংলাদেশ’ শিরোনামের এক নিবন্ধে পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক উপদেষ্টা আবিদ হাসান লিখেছেন, ২০ বছর আগেও চিন্তা করা যেত না যে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের দ্বিগুণ হবে। বাংলাদেশের বর্তমান অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে এটি ২০৩০ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হবে। তিনি আরো লিখেছেন, পাকিস্তানের এখনকার পরিস্থিতির পরিবর্তন না ঘটলে ২০৩০ সালের দিকেই হয়তো বাংলাদেশের কাছে সাহায্য চাইতে হবে।
তবে অপ্রাপ্তিও আছে অনেক। উচ্চ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। পাশাপাশি শেয়ারবাজারে কারচুপি, সরকারি সম্পদ লুটপাট এবং বিদেশে অর্থ পাচারসহ বেশকিছু অনাচার চলছে, যা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। এতসব অপ্রাপ্তির মাঝেও ১৯৭১-এ কোথায় ছিলাম আর আজ আমরা কোথায় আছি, এ প্রশ্নে উন্নয়নের হিসাব নিতে গেলে কিছুটা বিস্মিতই হতে হয়। জন্মের শুরুতেই যে রাষ্ট্রের টেকসই না হওয়ার আশঙ্কার কথা বলেছিলেন বিশেষজ্ঞরা, সেই রাষ্ট্রটিই সব সংশয়কে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে গত পাঁচ দশকে। এই অর্জন কিন্তু সহজ ছিল না মোটেই।
জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা, সামরিক অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান, সেই সঙ্গে বিকৃত ইতিহাস আর ঔপনিবেশিক চেতনায় ঘেরা পরিবেশে কেটেছে এক লম্বা সময়। তবে জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার শাসনামলে গত একযুগের ইতিহাস ছিল ভিন্ন। মূলত এই সময়েই অর্থনীতি বিকশিত হয়েছে, আকারে বড় হয়েছে, গঠন কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। চার গুণেরও বেশি বড় হয়েছে জিডিপি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নতুন রেকর্ড অর্জন করেছে। ছাড়িয়েছে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক। নির্মাণ হচ্ছে বড় বড় অবকাঠামো। আর্থসামাজিক এবং অবকাঠামো খাতে হয়েছে বিস্ময়কর উন্নয়ন। এর ফলে দ্য ইকোনমিস্টের ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নবম স্থান দখল করেছে। বিস্ময়কর উত্থানের কারণে বাংলাদেশকে এখন ‘এশিয়ান টাইগার’ নামেও অভিহিত করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের এমন অর্থনৈতিক সাফল্যে অভিভূত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল মন্তব্য করেছে যে, বাংলাদেশ আজ আর ‘বাস্কেট কেস’ নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া সম্পাদকীয় নিবন্ধে শিরোনাম করেছে, ‘ভারত, পূর্ব দিকে তাকাও : বাংলাদেশ ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে পেছনে ফেলে দিচ্ছে।’
এক যুগ আগের বাংলাদেশের সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের পার্থক্যটা পরিষ্কার। এ সময় মানুষের জীবনযাত্রার মান যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে সক্ষমতা। স্বপ্নের মেট্রোরেল হচ্ছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে, পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে। এইচএসবিসির সর্বশেষ গেøাবাল রিসার্চে বলা হয়েছে, বর্তমানে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এই ধারা অব্যাহত থাকলে, ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপির নিরিখে বিশ্বের ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুরের মতো দেশ যেখানে বাংলাদেশের পেছনে থাকবে। অপরদিকে, সুইজারল্যান্ড-ভিত্তিক বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইউবিএস জানিয়েছে, উন্নয়নের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ ২০৫০ সালে ১২তম বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হবে। বাংলাদেশের এই যে রূপান্তর এটা কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। গত এক যুগের দৃঢ় রাজনৈতিক নেতৃত্ব আর সঠিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক পদক্ষেপে ধাপে ধাপে এসেছে এ অর্জন। তবে এটাই শেষ নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশের পরবর্তী লক্ষ্য স্থির করেছে, ‘ভিশন’-৪১, মানে ২০৪১ সালের ভেতরে উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা। সে লক্ষ্য পূরণে হাতে আছে ১৯ বছর। এই ১৯ বছরে ‘ভিশন’-৪১ বাস্তবায়নে কী কী করণীয়, তার কৌশলগত অবস্থান এখনই ঠিক করে ফেলতে হবে। কারণ, মনে রাখতে হবে, উন্নত দেশের কাতারে প্রবেশ করার পথ আরো কঠিন হতে পারে। তাছাড়া উন্নত দেশের সোপানে প্রবেশ করতে হলে আগে জাতিসংঘ নির্ধারিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হবে। আর সেই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে প্রয়োজন শিল্প-অবকাঠামো, অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে ব্যাপক উন্নয়নের। এজন্য ২০১৬ থেকে ২০৩০ পর্যন্ত অতিরিক্ত আনুমানিক ৯২৮.৪৮ বিলিয়ন ডলার অর্থের প্রয়োজন। মানে প্রতি বছর গড়ে বার্ষিক ৬৬.৩২ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে, যা একই সময়ের জিডিপির ১৯.৭৫ শতাংশ।
আরো বেশ কিছু কারণে এই সময়ের ভেতরে উন্নত দেশের কাতারে প্রবেশ চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। কারণ, এলডিসি থেকে উত্তরণের সুফল হিসেবে বেশকিছু সুবিধা যেমন পাওয়া যাবে তেমনই হারাতেও হবে বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা। যে সুযোগ-সুবিধাগুলো হারাতে হবে তার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বেশ কিছু উন্নত দেশ ও জোটের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করে ফেলতে হবে দ্রুত। এর পাশাপাশি সামনের বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নে দক্ষ জনশক্তি অর্জনেও জোর দিতে হবে। এর কারণ হচ্ছে, ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের বিভিন্ন খাত যেমন, তৈরি পোশাক, আইসিটি, নির্মাণ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, পর্যটন, হালকা প্রকৌশল, স্বাস্থ্য সেবা, জাহাজ নির্মাণ আর ওষুধ তৈরি খাতে প্রায় ৭ কোটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ জনশক্তি এবং ব্যবস্থাপকের প্রয়োজন হবে। বর্তমানে অভাব পূরণের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুরসংখ্যক বিদেশি পেশাদার এবং প্রযুক্তিবিদ আমদানি করা হচ্ছে।
দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই দেশের অভ্যন্তরে মানবসম্পদ তৈরির পাশাপাশি অন্য কোনো কৌশলে মানবসম্পদ আহরণ করা সম্ভব কিনা সে ভাবনাও জরুরি। এর একটি সমাধান হতে পারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অভিবাসী বা প্রবাসী হয়ে বসবাস করা বাংলাদেশিরা। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এক কোটি বিশ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এদের অনেকেই দক্ষ, বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। এই প্রবাসীদের মধ্যে রয়েছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অর্থনীতিবিদ, কৃষিবিদ, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক, ব্যবস্থাপনা এবং আইটি বিশেষজ্ঞ। এদের বড় একটি অংশই বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়ে আর দেশে ফেরেনি। যা বাংলাদেশের মতো দেশের অর্থনীতি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিরাট ধাক্কা। আগামীর লক্ষ্য অর্জনে ও আজকের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই উৎস থেকে মেধা আহরণে গুরুত্ব দিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
শেখ হাসিনার গত এক যুগের শাসনামলে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে দুর্বার গতিতে। বেশকিছু সামাজিক সূচকের পাশাপাশি অর্থনীতির সূচকেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। এমডিজি সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে, উন্নত দেশের কাতারে প্রবেশের সোপান হিসেবে বিবেচিত এসডিজিও বাস্তবায়নের পথে। সাফল্যের এই ধারায় উজ্জীবিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নের জন্য ‘ভিশন’-৪১ অনুযায়ী যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে- আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী দুই দশকের ভেতরে একটি উন্নত দেশে পরিণত করার উদ্দেশ্যে সচেষ্ট হওয়া। যে পথ নকশার পথ ধরেই অর্জিত হবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়