ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

রাষ্ট্রভাষা বাংলা রক্ষা আন্দোলন : জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাভাষা বাঙালি জাতির মুকুল। এই ভাষাকেই কেন্দ্র করে জেগেছে একটা সভ্যতা, সংস্কৃতি, জাতিসত্তা এবং নিজস্ব স্বকীয়তা। যুগে যুগে মানুষ তার সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন সংগ্রাম করেছে, জীবন দিয়েছে। হাজারও বছর ধরে বাঙালি জাতির পূর্বসূরিগণ বাংলাভাষাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধ করেছে, দেশান্তরিত হয়েছে, অস্পৃশ্য হয়ে লোকালয় ছেড়ে নির্জনে আবাস গড়েছে, ভাষার লিখিত রূপকে লুকিয়ে রেখেছে সেই ঐতিহাসিক যুগ থেকে।
দাসত্বের শিকল বাঙালি জাতির ভাষা-সংস্কৃতিকে বোবা করে রেখেছিল। সেই শিকল ছিঁড়ে বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলন শুরু হয় সাধারণ ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী প্রতিবাদ প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে। আর সেই পথ ধরে ১৯৭১-এ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে বাঙালি জাতি অর্জন করে স্বাধীনতা।
প্রাচীন যুগ থেকে বহুদাবিভক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের নানা জাতিগোষ্ঠীর ভাষাভাষীর মানুষকে একটি ভূখণ্ডের গণ্ডিতে আবদ্ধ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার প্রবক্তা, স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছাত্রনেতা থাকাকালে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ আন্দোলন শুরু হয়। ছাত্রজনতার কাতারে থেকে দেশব্যাপী নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাভাষা রক্ষার সপক্ষে জনমত গড়ে তুলে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকার যৎ সামান্য চালচিত্র নিয়ে এই অবতারণা।

এক.
১৯৪৭ খ্রি. ১৪ এবং ১৫ আগস্ট ভারত ভাগের পর পূর্ববাংলা হয় পূর্বপাকিস্তান। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তখন বাংলা ভাষাভাষীর। শাসকগোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাগণ নয়া পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার উদ্যোগ গ্রহণ করলে, পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, বাংলাভাষী রাজনীতিকগণের একাংশ পাকিস্তানের উদ্যোগের বিরোধিতা করেন। এই অবস্থায় তৎকালীন পূর্ব পকিস্তান ছাত্রলীগ, পুরাতন ছাত্রলীগ, অন্যান্য ছাত্র সংগঠনসহ তমদ্দুন মজলিস (সাংস্কৃতিক সংগঠন) জোটবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং আন্দোলন গড়ে তোলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের মধ্য দিয়ে। এঁদের সঙ্গে শামিল হয় সরকারি কর্মচারী এবং সাধারণ জনতা।

দুই.
রাজনৈতিকভাবে ১৯৪৮ খ্রি. ফেব্রুয়ারি মাসে করাচিতে সংবিধান প্রণয়ন সভার বৈঠকে রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ বিষয়ে আলোচনা উঠলে তৎকালীন এমএলএ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু পাকিস্তানের অধিকাংশ মুসলিম লীগ সদস্য রাজি হননি। এ অবস্থায় বাংলাকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগকে পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাভাষা আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে।
এ বিষয়ে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, ‘ফেব্রুয়ারি ৮ই হবে ১৯৪৮ সাল। করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার (কন্সটিটিউয়েন্ট এ্যাসেম্বলী) বৈঠক হচ্ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেই বিষয়ও আলোচনা চলছিল।’ …‘কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা হল বাংলা।’ ‘আমরা দেখলাম বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।’ ‘আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করল।…তমদ্দুন মজলিস যার নেতা ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাশেম সাহেব।…সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চকে ‘বাংলাভাষা দাবি দিবস’ ঘোষণা করা হলো।’ এই দাবি দিবসকে সফল এবং আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমান (ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ/মার্চ ১৯৪৮-এর প্রথম সপ্তাহে) খুলনা দৌলতপুরসহ দক্ষিণাঞ্চল ঘুরে ছাত্র সমাবেশ করেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম। আমি ফরিদপুর যশোর হয়ে দৌতলপুর খুলনা ও বরিশালে ছাত্র সভা করে ঐ তারিখের তিনদিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলাম। দৌলতপুরে মুসলিম লীগ সমর্থক ছাত্ররা আমার সভায় গোলমাল করার চেষ্টা করলে, খুব মারপিট হয়। কয়েকজন জখমও হয়। এরা সভা ভাঙতে পারে নাই, আমি শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা করলাম।’ উল্লেখ্য, ভাষা আন্দোলনকে গতিশীল এবং কমিটি গঠন করার লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজে ছাত্রছাত্রী সমাবেশ করে ভাষণ দিয়েছিলেন। এই বিষয়ে সমাজ গবেষক ড. খ ম রেজাউল করিম উল্লেখ করেছেন, ‘২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে খুলনা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। খুলনার দৌলতপুরে আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বাঙলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি এবং দেশব্যাপী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলা হয়।’ শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে ১১ই মার্চ বাংলাভাষা দাবি দিবসকে সফল করার জন্য সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে পিকেটিংয়ের এলাকা নির্ধারণ ও কে কোথায় নেতৃত্ব দিবে সে বিষয়ে নির্দেশনা দিলেন। তিনি বলেছেন, ‘১১ই মার্চ ভোরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোষ্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল।…সমস্ত ঢাকা শহর পোষ্টারে ভরে ফেলা হল।…সকাল ৮টায় জেনারেল পোষ্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের উপর ভীষণভাবে লাঠিচার্জ হলো।…ফজলুল হক হলে আমাদের রিজার্ভ কর্মী ছিল।…নয়টায় ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনের দরজায় লাঠিচার্জ হলো। খালেক নেওয়াজ খান, বখতিয়ার শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াদুদ গুরুতর রূপে আহত হলো।…আমি জেনারেল পোষ্ট অফিসের দিক থেকে নতুন কর্মী নিয়ে ইডেন বিল্ডিং এর দিকে ছুটেছি, এর মধ্যে শামসুল হক সাহেবকে…পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। …তখন আমার কাছে সাইকেল। আমাকে গ্রেফতার করার জন্য সিটি এসপি জীপ নিয়ে বার বার তাড়া করছে। ধরতে পারে না।…(পরে) চার পাঁচজন ছাত্র নিয়ে ইডেন বিল্ডিং এর দরজায় আমরা বসে পড়লাম।…আমাদের উপর কিছু উত্তম মধ্যম পড়ল এবং ধরে নিয়ে জিপে তুলল।…বহু ছাত্র গ্রেফতার ও জখম হলো।’ ‘আমাদের প্রায় সত্তর/পঁচাত্তর জনকে বেঁধে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিলো সন্ধ্যা বেলায়।’
১৯৪৮-এর ১১ মার্চ সকাল ১০টায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় ছেড়ে দেয়া হয়। আটক দিনগুলো সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘জেলের … দেয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচদিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল ১০টায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে শ্লোগান দিতে শুরু করত আর চারটায় শেষ করত। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হতো না। ‘রাষ্ট্রা ভাষা বাংলা চাই’ ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই’ ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’ নানা ধরনের স্লোগান।’

তিন.
১৯৪৮-এর ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত আমতলায় শেখ মুজিবের সভাপতিত্বে বাংলা ভাষার দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মিটিং শেষে তিনি ছাত্রদের নিয়ে স্মারকলিপি দেন। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘১৬ তারিখ সকাল দশটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র সভায় আমরা সকলেই যোগদান করলাম। হঠাৎ কে যেন আমার নাম প্রস্তাব করে বসল সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য। সকলেই সমর্থন করল। বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হলো।…অনেকেই বক্তৃতা করল।…সভাশেষে এক শোভাযাত্রা করে আমরা হাজির (আইন সভায়) হয়ে কাগজটা ভিতরে পাঠিয়ে দিলাম খাজা সাহেবের কাছে।’ এদিন তিনি সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাত্রদের খণ্ড খণ্ড সমাবেশে বক্তৃতা করেছিলেন। আইন সভা থেকে এমপি, মন্ত্রীগণ বেরুলেই ছাত্ররা তাঁকে ধরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার সপক্ষে জোর করে লিখিত স্বাক্ষর নিচ্ছিলেন, সেই দিন এমনই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। এই পর্যায়ে ১৯৪৮-এ পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম ঢাকায় এলে তাকে ব্যাপকভাবে সংবর্ধনা জানানো হয়। তিনি রেসকোর্স মাঠ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখেন, বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকায় আসলে হাজার হাজার লোক তাকে অভিনন্দন জানাতে তেজগাঁ হাওয়াই জাহাজের আড্ডায় হাজির হয়েছিল। ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল।…আমরা সকলেই ভিজে গিয়েছিলাম। জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঘোড়দৌড় মাঠে বিরাট সভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হবে।’ আমরা প্রায় চার পাঁচশত ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল, ‘মানি না’। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন, ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’ তখন ছাত্ররা তাঁর সামনেই বসে চিৎকার করে বলল, না-না-না। জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করে ছিলেন, তারপর বক্তৃতা করেছিলেন।’ জিন্নাহ সাহেব চলে যাওয়ার কয়েকদিন পর ফজলুল হক হলের সামনে এক সভায় ভাষা বিষয়ে বক্তব্য প্রদানকালে এক ছাত্র বলেছিলেন, জিন্নাহ যা বলেছেন আমাদের তাই মানতে হবে। শেখ মুজিব তার প্রতিবাদ করে বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘কোন নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে।’ তিনি ঐ সভায় আরো বলেন, ‘বাংলা ভাষা শতকরা ছাপান্নজন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন আমরা প্রস্তুত আছি। সাধারণ ছাত্ররা আমাকে সমর্থন করল।’ এরপর ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জেলায় জেলায় গিয়ে তিনি প্রতিবাদ সভা সমাবেশ অব্যাহত রাখেন। ১৯৪৯-এ দিনাজপুরে ছাত্র গ্রেপ্তার এবং নির্যাতন করলে ছাত্ররা শেখ মুজিবুর রহমানকে কনভেনর করে ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালন করার জন্য কমিটি গঠন করে। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘পূর্ব বাংলার সমস্ত জেলায় জেলায় এই দিবসটি উদ্্যাপন করা হয়। কমিটির পক্ষ থেকে বন্দিদের মুক্তির দাবি করা হয়। এই প্রথম পাকিস্তানে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আন্দোলন এবং জুলুমের প্রতিবাদ। এর পূর্বে আর কেউ সাহস পায় নাই।’ এই পর্যায়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঞ্চিত কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের দাবিতে ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেয়ায় পুলিশ তাকে বন্দি করে এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবকে বহিষ্কার করে। এখানে উল্লেখ্য, সরকারের চাপের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থামিয়ে দেওয়ার জন্য আন্দোলনকারীদের শর্তসাপেক্ষে বহিষ্কার করে। পরবর্তীতে কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীরা কর্তৃপক্ষের চাপের মুখে একে একে নির্দেশ মেনে কর্মস্থলে এবং শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু শেখ মুজিব দাবির প্রতি অনড় থাকেন ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর বহিষ্কার আদেশ বহাল রাখেন। শেখ মুজিব সাধারণ কর্মচারীদের বেতনভাতা বাসস্থানের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য আইন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হন তবুও নত হয়ে কথা বরখেলাপ করেননি। এই কর্মচারী আন্দোলন ধর্মঘটে আরও যারা বন্দি হন, ‘খালেক নেওয়াজ খান, কাজী গোলাম মাহাবুব, আজিজ আহমেদ, অলি আহাদ, আবুল হাসানাত, আবুল বরকত, কেজি মোস্তফা, বাহাউদ্দিন চৌধুরী আরও অনেকে।’ …‘আমার কাছে বরকত থাকত। রাতে বরকত গান গাইত।’ ‘এদিকে ১৯৪৮ সালে ছাত্ররাই একক ভাবে বাংলা ভাষার দাবির জন্য সংগ্রাম করেছিল।’ (আ: আ: পৃষ্ঠা- ১৯৭) এই আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার সপক্ষে দেশব্যাপী জনমত সৃষ্টি এবং সংগঠন তৈরি হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫১ খ্রি. রাষ্ট্রভাষা দিবস উদযাপন উপলক্ষে আব্দুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।

চার.
১৯৪৮ খ্রি. ১১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যু হয়। ১৯৫১ খ্রি. খাজা নাজিমুদ্দীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন নুরুল আমীন। ইতোপূর্বে ছাত্র আন্দোলনের মুখে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যাবতীয় দাবি মেনে নিতে তিনি সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হয়ে ১৯৫২ খ্রি. জানুয়ারি মাসে ঢাকায় এসে পল্টনের জনসভায় ঘোষণা দিলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’ এই ঘোষণার প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হরতালের ডাক দেওয়া হয় এবং মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা খালেক নেওয়াজ খানের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সমাবেশ করা হয়। এ বিষয়ে শেখ মুুজিব বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী হয়ে ২৬ জানুয়ারি পল্টনের জনসভায় খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করলেন উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হবে। তখনই প্রতিবাদের ঝড় উঠল।

পাঁচ.
জেলে থাকাকালে ২১ ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে
শেখ মুজিবের নির্দেশনা :
‘আমি হাসপাতালে আছি, সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমার কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। আমি ওদের রাত একটার দিকে আসতে বললাম।…পিছনের জানালায় ওরা পাঁচ সাতজন এসেছে।…বারান্দায় বসে আলাপ হলো এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদের ও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হলো। অলি আহাদ ও তোয়াহা বললো যুবলীগও রাজি হবে।’ …‘তোমরা আগামীকাল রাতে আবার এসো।…পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হলো আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে।’ …‘আমি আরও বললাম আমিও আমার মুক্তির দাবি করে অনশন ধর্মঘট শুরু করব। আমার ছাব্বিশ মাস জেল হয়ে গেছে।’ শেখ মুজিবের নির্দেশ অনুযায়ী ১৯৫২ খ্রি. ৩১ জানুয়ারি মাওলানা আব্দুল হামিন খান ভাসানীর সভাপতিত্বে ঢাকা বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। উক্ত কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন মুসলিম ছাত্রলীগের সহসভাপতি কাজী গোলাম মাহবুব। ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আওয়ামী মুসলিম লীগ নবাপুরস্থ অফিসে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির মিটিংয়ে কর্মসূচি সফল করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে।’ ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় গাজীউল হকের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ‘সভার সিদ্ধান্তক্রমে ছাত্রছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে’ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিয়ে মিছিল বের করলে পুলিশের বাধার মুখে সংঘর্ষ শুরু হয়। একপর্যায়ে মেডিকেল কলেজ গেটের হোস্টেলের সামনে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে পুলিশ গুলি চালালে ‘২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ হন ১। আব্দুস সালাম, ২। আব্দুল জব্বার, ৩। আবুল বরকত, ৪। রফিক উদ্দীন, আহত হয়েছিলেন অনেকেই।’ ‘২২ ফেব্রুয়ারি শোক মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান, আওয়াল ও অজ্ঞাত এক কিশোর।’

শেখ মুজিবুর রহমান উল্লেখ করেছেন, ‘২১ শে ফেব্রুয়ারি আমরা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালাম, রাতে সিপাহিরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। ফরিদপুরে হরতাল হয়েছে, ছাত্রছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে জেলগেটে এসেছিল। তারা বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই। আরও অনেক স্লোগান।’ …‘খবরের কাগজে দেখলাম, মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ এমএলএ, খয়রাত হোসেন এমএলএ, খান সাহেব ওসমান আলী এমএলএ এবং মোহাম্মাদ আবুল হোসেনসহ শত শত ছাত্র ও কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। দু’একদিন পরে দেখলাম কয়েকজন প্রফেসর, মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক সাহেব ও বহু আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। …নারায়ণগঞ্জে বৃদ্ধ খান সাহেব ওসমান আলী সাহেব ও তাঁর ছেলেমেয়েদের ওপর অকথ্য অত্যাচার হয়েছে।’

ছয়.
আন্দোলন সংগ্রামের সপক্ষে মিছিল মিটিং প্রতিবাদ সমাবেশ করে ছাত্র জনতাকে উসকে দেয়ার অপরাধ খাড়া করে পুলিশ শেখ মুজিবকে ১৯৪৯-এর ডিসেম্বরে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে সাজা দেয়ার প্রতিবাদে আমরণ অনশনের ঘোষণা দিয়ে অনশন শুরু করলে পাকিস্তান সরকার তাঁকে এবং জনাব মহিউদ্দীন সাহেবকে ঢাকা কারাগার থেকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তর করে। তিনি ১৬ ফেব্রুয়ারি ৫২-তে ফরিদপুর কারাগারে পৌঁছান।
১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ থেকে এক টানা ১২ দিন তিনি আমরণ অনশন পালনকালে সরকার বাধ্য হয় তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে। ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে মুক্তি আদেশ পড়ে শুনানোর পর ফরিদপুর জেলে অনশন সঙ্গী মহিউদ্দীন সাহেব ২ চামচ ডাবের পানি মুখে দিয়ে তাঁর অনশন ভঙ্গ করান। তিনি এতো অসুস্থ হয়েছিলেন যে বাঁচার মতো আশা ছিল না। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান অতিকষ্টে কয়েকদিন ধরে বাড়ি নিয়ে যান। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘পাঁচদিন পর বাড়ি পৌঁছালাম। মাকে তো বোঝানো কষ্টকর। ‘হাসু আমার গলা ধরে প্রথমেই বলল, “আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই।” ২১ শে ফেব্রুয়ারি ওরা ঢাকায় ছিল, যা শুনেছে তাই বলে চলেছে।…আমি খুব দুর্বল, বিছানায় শুয়ে পড়লাম।’ এই সময় দীর্ঘ কারাভোগের পর জাতির পিতার কাছে তাঁর মমতাময়ী রতœগর্ভা মা সায়েরা খাতুন প্রশ্ন করে বলেছিলেন, “বাবা তুইতো পাকিস্তান পাকিস্তান করে চিৎকার করেছিস, এদেশের মানুষ তো তোর কাছ থেকে পাকিস্তানের নাম শুনেছিল। আজ তোকে সেই পাকিস্তানের জেলে কেন নেয়?…যে তোকে জেলে নেয়, আমাকে একবার নিয়ে চল, বলে আসব তাকে মুখের উপর।’ (কারাগারের রোজনামচা)

সাত.
ভাষার দাবিতে ১৯৫২ খ্রি. মে মাসে শেখ মুজিব একাই পাকিস্তান যান। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহমুদুল হক ওসমানী এবং জেনারেল সেক্রেটারি শেখ মঞ্জুরুল হক দলবল নিয়ে তাকে অর্ভ্যথনা জানান। তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ সতীর্থ রাজনীতিকগণের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষা আন্দোলন, নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন বিষয়গুলো তুলে ধরেন এবং কয়েকস্থানে সভা করেন ও প্রেস কনফারেন্স করে নির্যাতন বন্ধ এবং তদন্ত ও বিচারের দাবি জানান। তিনি (তৎকালীন) প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনে জেলে আটককৃত নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি জানিয়ে বলেন, ‘আমি তাকে অনুরোধ করলাম, মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক, আবুল হাশিম, মাওলানা তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, খান সাহেব, ওসমান আলীসহ সমস্ত কর্মীকে মুক্তি দিতে। আরও বললাম, জুডিশিয়াল ইনকোয়ারি বসাতে, কেন গুলি করে ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছিল।’ (অঃ আঃ পৃ- ২১৩)
সৎ, নির্ভীক, আত্মপ্রত্যয়ী সে দিনের ছাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমানই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বাংলা ভাষার জন্য ভাষা শহীদগণের হত্যার বিচার চাইলেন, হত্যাকারী পাকিস্তানের রাষ্ট্র প্রধান খাজা নাজিমুদ্দীনের মুখোমুখি হয়ে। এই বিরল দৃষ্টান্ত এবং ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তাঁর কর্মকাণ্ড থেকে বুঝা যায় যে, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্দোলনের অনন্যপুরোধা নেতৃত্বদানকারী নেতা। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে তাঁরই যোগ্য নেতৃত্বে ১৯৭১-এ বাঙালি জাতি হাজারও বছরের পরাজয়ের গøানি মুছে অর্জন করে আত্মসম্মান বোধের স্বাধীনতা।
শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে ফিরে ১৯৫২-এর জুন, জুলাই আগস্ট মাস জুড়ে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে সংগঠন মজবুত করার জন্য জেলায় জেলায় কমিটি গঠন করেন। পরে ঢাকায় ফিরে এসে পূর্ব পাকিস্তান শান্তি কমিটির মাধ্যমে চীনে যান।
আট.
১৯৫২ খ্রি. বঙ্গবন্ধুর চীন সফর এবং শান্তি সম্মেলনে বাংলায় ভাষণ।
১লা অক্টোবর চীনের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সে দেশের সরকারের আমন্ত্রণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে শান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানসহ পাঁচজন মনোনীত হন। উক্ত সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাংলায় ভাষণ দেন। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে আতাউর রহমান খান ও আমি বক্তব্য করলাম। আমি বাংলায় বক্তব্য করলাম। আতাউর রহমান ইংরেজি করে দিলেন। ‘৩০ …১৯৪৯ সালে ১লা অক্টোবর এরা (চীন) স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল।… এবার ১লা অক্টোবর তৃতীয় স্বাধীনতা দিবস।… এগারো দিন সম্মেলন হয়।’ ৩১ শান্তি কমিটি সফরকারীদের বিভিন্ন এলাকায় স্বাগত জানান এবং ঘুরিয়ে দেখান। তিনি ২৫ সেপ্টেম্বর চীনে যাত্রা শুরু করে সম্ভবত অক্টোবরের ১৬/১৭ তারিখে দেশে ফিরে আসেন। এই সম্মেলনে উল্লেখিত দু’জন ছাড়া ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া), খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, উর্দু লেখক ইবনে হাসান এই পাঁচজন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে অংশগ্রহণে অনুমতি পান। এই সম্মেলনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাঁইত্রিশটা দেশ থেকে তিনশত আটাত্তর জন সদস্য যোগদান করেছিলেন।
১৯৫২-তে মাতৃভাষা বাংলা রক্ষার দাবিতে বাঙালির সূর্য সন্তানগণ জীবন দিয়ে বিশ্বে যে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, সেই ভাষাতেই চীনের শান্তি সম্মেলনে ভাষণ দিয়ে সে দিনের তেজোদীপ্ত যুবক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষার বার্তা বিশ্ব নেতাদের জানিয়ে দিলেন। এটিই বঙ্গবন্ধুর বহিঃবিশ্বে কোনো বৃহৎ পরিসরের সভায় বাংলা ভাষণ এবং কোনো বাঙালির প্রথম বাংলা ভাষণ।

নয়.
১৯১৩ খ্রি. নোবেলপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে বিশ্ব কবির ‘গীতাঞ্জলি (ঝড়হম ড়ভভবৎরহম) বাংলাকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছে। বাংলা গানের পঞ্চভাস্কর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) অতুল প্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪) রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০) দিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৮-১৯৭৬) অপ্রতিরুদ্ধ সৃষ্টি বাংলা ভাষাকে বিংশ শতাব্দীতে করে তুলেছিল জাজ¦ল্যমান।’ সেই বিশ শতকে, যখন গুটিকয়েক ভিনভাষী শাসক রক্তচক্ষু দেখিয়ে বাংলাভাষাকে স্তব্ধ করার চেষ্টা করেছে তখনই বাঙালি জাতির কাণ্ডারি রূপে শেখ মুজিবুর রহমান পারিবারিক সুখ স্বচ্ছন্দ উপেক্ষা করে, জেল জুলুম মাথায় ধারণ করে বাংলা ভাষার মিষ্টি মধুর কথা বাংলা ভাষণের মাধ্যমে নানা ভাষাভাষীর মানুষের কানে পৌঁছে দিয়ে মাতৃভাষা প্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
চীন সম্মেলন থেকে ঢাকায় ফিরে তিনি নেতাকর্মীদের কারামুক্তির জন্য এবং সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য জেলা, মহাকুমায়, থানা ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে সাংগঠনিক কার্যক্রম দ্বারা আওয়ামী লীগের কর্মীবাহিনী গড়ে তোলেন এবং শাসনতন্ত্র তৈরি করতে জনমত সৃষ্টি করেন। এরই মধ্যে ১৯৫৪ খ্রি. সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘১৯৫৫ সালে নতুন কেন্দ্রীয় আইনসভায়- আওয়ামী লীগ ১২(বার) জন সদস্য নিয়ে ঢুকল এবং তাদের সংগ্রামের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বাধ্য হলো ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে।’ ‘আওয়ামী লীগ যখন ১৯৫৬ সালে ক্ষমতায় বসল তখন ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করল। ১৯৫৭-৫৮ সালে এই দিবসটা সরকারিভাবেও পালন করা হয়েছে।’

ভাষা আন্দোলন শুরু হলে ছাত্রনেতা শেখ মুুজিব ১৯৪৮-এ ১১ মার্চ বাংলাভাষা দাবি দিবসকে সফল করার জন্য বিভিন্ন জেলায় অঞ্চলে সভা করেছেন, ১১ মার্চ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে ১৫ মার্চ পর্যন্ত জেল খেটেছেন। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাবেশে সভাপতিত্ব করে সরকারের কাছে দাবি আদায়ের জন্য স্বাক্ষরিত প্রতিবাদ লিপি প্রদান করেছেন। পরে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন এবং সাংগঠনিক কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৪৯ খ্রি. নানা বাধা অতিক্রম করে ‘ভাষা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, জনতা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দেশব্যাপী জেলায় জেলায় ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালন করেছে। ১৯৫২-তে জেল হাসপাতালে থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালন এবং সংগ্রাম পরিষদ গঠনের তাগিদ দিয়েছেন। একই সঙ্গে বিনাবিচারে বন্দি রাখার প্রতিবাদে তিনি মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত আমরণ অনশনের ঘোষণা দিয়ে সরকারকে তাঁর কথা মানতে বাধ্য করেছেন। একই বছর মে মাসে একাই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের মুখোমুখি হয়ে আন্দোলনকারী ছাত্রদের হত্যার বিচার এবং রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি জানান। ১৯৫২-এর অক্টোবরে চীনের জাতীয় সম্মেলনে আত্মপ্রত্যয়ী বাঙালি শেখ মুজিব ভাষণ দিয়ে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কর্মজীবনে ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন, দেশপ্রেমিক, সৎ, ন্যায়, সত্য সুন্দর এবং অবহেলিত, দুঃখী বঞ্চিত মানুষের প্রবক্তা। তাঁরই যোগ্য নেতৃত্বে হাজার হাজার বছরের তিতিক্ষিত বাঙালি জাতি, ভাষা আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে কঠিন বন্ধুরপথ অতিক্রম অন্তে আজকের বাংলাভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি; বাংলাদেশ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে লাখো শহীদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়