ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

ভাষার আঞ্চলিক রূপের সংরক্ষণ প্রয়োজন

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ভাষা আন্দোলন (১৯৫২) বাঙালি জাতির গৌরবময় ঐতিহ্য ও চেতনার নাম। যে চেতনা আলোয় আমরা মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন দেখেছি স্বাধীন স্বদেশ পেয়েছি। বর্তমানে আমাদের দেশে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হয় মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। আমরা প্রতি বছর অঙ্গীকার করি আগামীতে রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের। জাতিসংঘের সহযোগিতায় আমাদের দেশে স্থাপিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। বাংলা একাডেমি গ্রন্থমেলা বিস্তৃত হচ্ছে। অনলাইনে ঘরে বসে মেলার দরে (২৫% কমিশনে) বই কেনা যাচ্ছে। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসেই প্রকাশ পাচ্ছে হাজার পাঁচেক নতুন বই। বিভাগীয় শহরেও বইমেলা হচ্ছে। বই কেনায় আমাদের আগ্রহ বাড়ছে। মিডিয়ার কল্যাণে প্রভাতফেরিতেও বাড়ছে লোক সমাগম, বাড়ছে চাকচিক্য। ফলাও করে প্রচারিত হচ্ছে আমাদের মাতৃভাষাপ্রীতি; বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের আবেগ-ভালোবাসা। আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারি; এ আমাদের অহঙ্কার।
অন্যদিকে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান নিয়ে যাঁরা প্রাণ দিলেন তাঁদের প্রাণের দাবি পঁচাত্তর বছরেও পূরণ করতে পেরেছি কি? না, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও পারিনি দেশের সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় প্রয়োগ ঘটাতে। আমরা সংবিধানের প্রথমভাগের তৃতীয় অনুচ্ছেদে লিখেছি : ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। আমরাই আবার দেশে বাংলা মাধ্যমের পাঠ্যবই ইংরেজি মাধ্যমে রূপান্তর করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিলি করছি। মাদ্রাসায় আরবি ভাষায় শিক্ষা দিচ্ছি। দেশের নাগরিককে এ দেশে বসে বিদেশি ও লেভেল, এ লেভেল পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছি। সম্প্রতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীয় জন্য তাদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার আয়োজন করছি। অভিজাত শ্রেণির জন্য ইংরেজি ভাষায় বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে এ দেশের রাষ্ট্রীয় কাজে যোগদানের একচেটিয়া অধিকার দখলের আয়োজন হচ্ছে।
গানে আছে, ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’। আসলে কি তাই? না। হাজার বছর আগে থেকেই এ বঙ্গ জনপদের মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। বৌদ্ধ পাল শাসন আমলে রাষ্ট্রীয় কাজ চলছে পালি ভাষায় হিন্দু সেন আমলে সংস্কৃত ভাষায় আর চারশ বছর মুসলিম শাসনের সময়ে ফারসি ভাষায়। ১৮৩৭ সালে ইংরেজরা আদালতের ভাষা ফারসিকে বাতিল করে ইংরেজি করে দেয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠালগ্নে জিন্না সাহেব ‘পাক-পবিত্র’ ভাষার কথাও কিন্তু ঘোষণা করেন ইংরেজিতেই : ‘ঊর্দু এন্ড ঊর্দু উইলবি দ্যা স্ট্যাট লেঙ্গুইজ অব পাকিস্তান’। পরের কথা সবই জানি। তবে মুখের ভাষা বা মায়ের ভাষা কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। পুলিশের ভয় দেখিয়েও না, পরকালের স্বপ্ন দেখিয়েও না। চর্যাপদের যুগে যেমন : ‘ভুসকু বাঙ্গালী ভইলী’, তেমনি এ যুগের করিও বলেন: ‘আমি বাংলায় গান গাই’। মাতৃভাষা বাংলা বাঙালির সমান বয়সী। সে বাঁচবে যতকাল বাঙালি বাঁচে।
১৯৫২তে পাকিস্তানিরা পরাজিত হলেও ১৯৬২তে বাংলা ভাষার লিপি সংস্কার ও আরবি হরফে বাংলা লেখার অপপ্রয়াস চালিয়েও সফল হয়নি। ওরা সফল হলে রাষ্ট্রীয় কাজে আমরা বাংলা বর্ণমালা আর দেখতে পেতাম না। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ‘ডিজুউস’ হুজুগ তোলে সেলফোনে রোমান হরফে বাংলা লেখার মাধ্যমে বাঙালিকে ও তার ভাষাকে শেকড়চ্যুত করার অপপ্রয়াসও সচেতন বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে বর্জিত হয়। এখনো অনেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা লেখার ক্ষেত্রে রোমান, আরবি কিংবা নাগরি বর্ণমালা ব্যবহারের যুক্তি দাঁড় করাতে চাইছেন। এ কথা সত্যি যে বর্তমান বাংলাদেশের একমাত্র সিলেট বিভাগে সতেরো-আঠারো শতকে নাগরি লিপিতে ‘সিলেটি’ ভাষায় সাহিত্য চর্চা হয়েছে- পুঁথি-সাহিত্য মুদ্রিত হয়েছে। বর্তমান গবেষক গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন- সে ‘সিলেটি’ ভাষাও বাংলা ভাষার একটি দূরবর্তী উপভাষা মাত্র; পৃথক ভাষা নয় (দ্র. সিলেটের উপভাষা : ব্যাকরণ ও অভিধান)। আমাদের মনে রাখতে হবে ভাষাবিজ্ঞানী চমস্কি বলেছেন : ‘উপভাষা হচ্ছে ভাষার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্বরূপ’। সুতরাং, আমাদের মাতৃভাষা হচ্ছে যার যার আঞ্চলিক ভাষা। তবে তার বিকাশ প্রমিত বাংলা ভাষা বা রাষ্ট্রভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নয়।
রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে বাঁচাতে হলে বাংলা ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপের সংরক্ষণের পাশাপাশি প্রমিত বাংলার অনুশীলন অব্যাহত রাখতে হবে। সাহিত্যের পাশাপাশি বাংলা ব্যাকরণের চর্চা করতে হবে। আর এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের উক্তি স্মরণীয় : ‘বাংলাদেশের ভিন্ন ভিন্ন অংশে যতগুলো উপভাষা প্রচলিত আছে তাহারই তুলনাগত ব্যাকরণই যথার্থ বাংলার বৈজ্ঞানিক ব্যাকরণ।’ সুতরাং, বাংলার উপভাষার প্রতি আমাদের প্রচলিত উন্নাসিকতা দূর করতে হবে- বাংলাভাষা বিকাশের স্বার্থেই। এক অর্থে উপভাষাগুলোই আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের লোকসাহিত্য, লোকভাষায় রচিত সাহিত্য বা আঞ্চলিক ভাষার সাহিত্য মুদ্রণের সময় এগুলো যে বাংলার উপভাষা একথা ভুলে গেলে চলবে না। যথাসম্ভব বাংলা বর্ণমালা দিয়ে এগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সমন্বয় সাধন করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সকল কাজে বাংলা ভাষায় ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। বাংলা ভাষার অর্থনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি করতে হবে। বাংলাদেশের চাকরিতে প্রবেশের পূর্বশর্ত হিসেবে বাংলা ভাষার দক্ষতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যাতে করে প্রত্যেক বাঙালি স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে প্রমিত বাংলার বিকাশে সক্রিয় হয়। তবেই বাংলাভাষা পাবে তার যোগ্য মর্যাদার আসন। বাঙালি পরিণত হবে মর্যাদাবান জাতিতে বাংলাদেশ দাঁড়াবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়