ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন ও বঙ্গবন্ধুর জন্ম

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীতে কিছু মানুষ জন্মায়, যাঁরা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সংকীর্ণ-সীমা অতিক্রম করে সামাজিক মানুষ হয়ে ওঠেন। কেউ আবার সমাজ ও সমকালীন-গণ্ডি অতিক্রম করে হয়ে ওঠেন বিশ্বজনীন- তাঁরা শাশ্বতকালের পথনির্দেশক হয়ে ওঠেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ- আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ। তিনি দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম আর কারাভোগসহ নানামুখী নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে বাঙালি জাতিকে রাজনৈতিকভাবে তার জাতিসত্তার পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন- তিনি বাঙালি জাতিকে এনে দিয়েছেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং তাদের জন্য বিনির্মাণ করেছেন স্বপ্রশাসনিক, স্বঅর্থনৈতিক ও স্বসাংস্কৃতিক বিকাশমান রাষ্ট্রীয় একটি অবকাঠামো।
ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে, এই ভূখণ্ডে এক হাজার বছর পূর্বকালে চর্যাপদের অপভ্রংশ মিশ্রিত বাংলা থেকে ক্রমশ বিকশিত বাংলার মতো সংকরায়নের কলুষমুক্ত হয়ে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশক্রমের সূত্রপাত ঘটেছিল। কিন্তু বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিসত্তার পূর্ণ বিকাশের পূর্বেই এ ভূখণ্ড ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বে দুর্ধর্ষ পাঠান যোদ্ধাদের করতলগত হয়েছিল। তারপর ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির আকস্মিক মৃত্যুর পর তাঁর সেনাপতিদের ক্ষমতার লড়াই চলে। অস্থির সেই সময়টায় বাঙালি জাতিসত্তার সাহিত্যের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকাল থেকে সুলতানি শাসনামলে শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ব্রাহ্মণ্যবাদের কঠোর অভিঘাত থেকে মুক্ত হয়। উল্লেখ্য, ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হাজী শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ এক ধরনের স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা ‘ইলিয়াস শাহী সালতানাত’ নামে (মাঝে কিছুকাল ছাড়া) দীর্ঘ দুইশ বছরের অধিককাল স্থায়ী ছিল। এই সময় কয়েকজন সুলতানের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তাদের সৃষ্ট কবি-সমাজকে পৃষ্ঠপোষকতা করার রাজকীয় রেওয়াজ ও ঐতিহ্য প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করায় বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটে- বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক বিকাশ ও অগ্রগতি ঘটে। কবি আব্দুল হাকিম লিখতে পারেন :
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশে ন যায়।
সুলতানি শাসনামলে শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ব্রাহ্মণ্যবাদের কঠোর অভিঘাত থেকে মুক্ত হয়ে খানিকটা অগ্রগতি লাভ করলেও বাঙালি জাতি অসাম্প্রদায়িকভাবে তাঁর জাতিসত্তার পরিচয়ে পরিচিত হয়ে উঠতে পারেনি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তারপর ইংরেজ বণিকদের শক্তিমত্তা ও চক্রান্ত্রের আঘাতে প্রায় সাড়ে পাঁচশ বছর পর বাংলা মুসলিম শাসকদের হাত ছাড়া হয়। ১৭৫৭ সালে নবার সিরাজের পরাজয়ের পর থেকে ক্রমশ বাংলার শাসন ইংরেজদের করতলগত হতে থাকে।
ইংরেজ বণিকরা বাংলা দখল করার পর থেকে পরিকল্পিতভাবে সুলতানি শাসনামলে অর্জিত বাঙালি জাতিসত্তার অসাম্প্রদায়িক অগ্রগতি বিনষ্ট করে। তারা বাংলার হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয়-সংকীর্ণতাবোধ সৃষ্টি করে দিতে তৎপর হয়। বণিকদের শাসনের পরবর্তীকালে একটি সভ্য জাতি ও শাসকগোষ্ঠী হিসেবে দাবিদার স্বয়ং ব্রিটিশ সরকার ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেও তাদের রাজনৈতিক হীন-সিদ্ধান্তের কারণে ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতাকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক চেতনায় আচ্ছন্ন একটি শিক্ষিত একটি এলিট সমাজও তৈরি হয়ে যায়। ফলে প্রায় দুইশ বছরের ইংরেজ শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ তো ঘটেইনি, বরং এ সময় বাঙালি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও শত্রæতা নতুন মাত্রা লাভ করেছে। বিশেষ ১৯০৫ সালে ভারতীয় ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গ আইন গ্রহণ এবং ১৯১১ সালে তা বাতিল করার মধ্য দিয়ে তারা সে অবিশ্বাস ও শত্রæতা পূর্ণতা পেয়েছে। সে অবিশ্বাস ও শত্রæতার কারণে ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়কে আলাদাভাবে বসবাসের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের রাজনৈতিক চক্রান্তমূলক পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত ভারতবাসী আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মুসলিম জাতীয়তাবোধ ধারণ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠালাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের সেই সুসংহত মুসলিম জাতীয়তাবাদে ১৯৪৭ সালেই ফাটল ধরায় পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকরা। তারা কোটারি রাজনীতি শুরু করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় মুসলিম লীগের বাঙালি নেতাদের অবিস্মরণীয় ভূমিকাকে অবমূল্যায়ন করে এবং মুসলিম লীগকে কুক্ষিগত করে। পূর্ব পাকিস্তানে তাদের কোটারিভুক্ত লোকদের ক্ষমতায় বসায়। সর্বোপরি সে বছরই দেশীয় ভাষাসমূহ থেকে তারা উর্দুকে এককভাবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাভাষা করার ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে বিষয়টি পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর আঁতে লাগে। বাঙালি শিক্ষিত সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ লেখনীর মাধ্যমে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাভাষা করার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। কিন্তু পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকরা সেসব সম্মানিত ব্যক্তির যুক্তকেও মূল্য দেয়নি। ফলে কেন্দ্র করে ১৯৪৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করানোর দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ১১ মার্চ হরতালও পালিত হয়। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার উন্মেষ ঘটে- যা ছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিপরীতে নগণ্য হলেও একটি আঘাত।
বাঙালি জাতীয়বাদ উন্মেষের সূচনাকালের আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আন্দোলনের শিরোভাগে। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুসলিম লীগের বিপরীতে ছাত্র ও জাতীয় রাজনীতি গতিশীল করতে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের উদ্যোগ নেন। ফলে সে সময়ই তিনি সরকারের টার্গেট হয়ে যান। সাম্প্রতিক সময়ে প্রাপ্ত তৎকালীন গোয়েন্দা রিপোর্ট সে বিষয়টি নিশ্চিত করে।
১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গড়ে ওঠার সময় জেলবন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল একই ভবনে হওয়ায় প্রতিনিয়তই ছাত্রনেতাদের বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে করণীয় বিষয়ে নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু তাঁদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। কখনো চিরকুট লিখে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগে তাঁর বলয়ের নেতাকর্মীদের আন্দোলনে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান করেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি কারামুক্তি লাভ করেন। তারপর তিনি আবার রাজনীতিকে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৫৪ সালে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠনের পর সরকারতে পরাজিত করার জন্য তিনি ২১ দফা কর্মসূচি প্রচারে আত্মনিবেদন করেন।
১৯৫৪ সালের ৮ থেকে ১২ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে ‘যুক্তফ্রন্ট’ বিপুলভাবে বিজয়লাভ করে। ‘যুক্তফ্রন্ট’ নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক মন্ত্রিসভা গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালের ১৫ মে সে মন্ত্রিসভার ‘কৃষি ও বন’ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হন।
১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের লজ্জাজনক পরাজয় এবং যুক্তফ্রন্টের অকল্পনীয় বিজয় পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকদের লেজুড়বৃত্তিহীন বাঙালি রাজনীতিবিদদের উত্থানকে তারা মেনে নিতে পারেনি। তারা ভেবেছেন, তাতে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাদের বিকাশ ঘটতে পারে এবং তাদের শোষণ ও শাসনের একচেটিয়া আধিপত্য ক্ষুণ্ন হবে। ফলে ‘অশুভ সকালে বিনাশ জরুরি’ মনে করে ১৯৫৪ সালের ৩০ মে পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকেরা চক্রান্ত করে সে মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন এবং সেদিনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অকল্পনীয় বিজয়লাভের পর পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকরা অস্ত্রের জোরে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল করে দিয়েছেন যে, তাদের ইচ্ছানুয়ায়ী না চললে এবং না বললে তারা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনক্ষমতার নিকটবর্তী হওয়ার সুযোগও পাবেন না। ফলে ক্ষমতালাভের মোহে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের মাঝে ইঁদুর দৌড় শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকদের ইচ্ছানুযায়ী যুক্তফ্রন্টের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও কৃষক শ্রমিক পার্টি আলাদাভাবে দুটি জোট করে একে অপর জোটকে ঘায়েল করার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। ফলে বারবার পূর্ব পাকিস্তানে মন্ত্রিসভার বদল হয়েছে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। ১৯৫৮ সালের ৮ অক্টোবর অবাঙালি শাসকদের চক্রান্তে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে পূর্ব পাকিস্তানের গণতন্ত্র ও রাজনীতির সব সম্ভাবনা নস্যাৎ করা হয়েছে। ১০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। একের পর এক মামলা দিয়ে তাঁকে বিপর্যস্ত করে ফেলা হয়।
পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকদের পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চলমান একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণাধিকার পরিবর্তন করা ছাড়া বাঙালি জাতির মুক্তি সম্ভব নয়। তিনি কারাগারে বসেই নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে থাকেন।

১৯৬২ সালের ৮ জুন সামরিক শাসন তুলে নেয়া হলে তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে নিজেকে জাতীয় নেতা হিসেবে বিকশিত করে তোলেন। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতে চিকিৎসাধীন সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু ঘটে। তারপর আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণভার তিনি নিজের হাতে নেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করে রাজনীতি শুরু করেন। লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মিলিত বিরোধী দলের সম্মেলনে ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকদের পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চলমান একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণাধিকার পরিবর্তন করার দাবিনামা ৬ দফা ঘোষণা করেন। সে সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা দাবিনামাকে পাকিস্তানের বিরোধী দলসমূহের কর্মসূচির অংশ হিসেবে গ্রহণ না করা হলেও তারপর থেকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে শুরু হয় নতুন অধ্যায়।
লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মিলিত বিরোধী দলের সম্মেলন থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্মসূচি ভিন্নমাত্রা লাভ করে। তিনি নিরলসভাবে একেরপর এক বিবৃতি, সংবাদ সম্মেলন, আলোচনা সভা, জনসভা করে ৬ দফা দাবির সঙ্গে পুরো বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ সূত্রে বেঁধে ফেলার সংগ্রামে আত্মনিবেদন করেন। ১৯৬৬ সালের ৮ মের মধ্যে তিনি দেশের ৩৩টি অঞ্চলে ৩৩টি বিশাল জনসভায় ৬ দফার তাৎপর্য তুলে ধরেন। অগনিত পথসভা ও তাৎক্ষণিক সৃষ্ট হাজার হাজার মানুষের জমায়েতেও ৬ দফার তাৎপর্য তুলে ধরেন। তাঁর এই অভাবিত তৎপরতায় বাঙালি জাতি সাড়া দেয়। ৬ দফা বাস্তবায়নে তারাও অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়।
৬ দফা ঘোষণার পর ৬ দফা দাবির সঙ্গে জনসংযোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মনিবেদন এবং ৬ দফা দাবির প্রতি বাঙালি জাতির অকুণ্ঠ সমর্থন পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালি শাসক এবং তাদের পূর্ব পাকিস্তানের দোসরদের ভীত ও আতঙ্কিত করে তুলে। ফলে তাঁকে ১৯৬৬ সালের ৮ মে গ্রেপ্তার করে কারাগারের অন্ধকার ও নির্জন সেলে ফেলে দেয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাবন্দি করেও পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালি শাসক এবং তাদের পূর্ব পাকিস্তানের দোসরেরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে সশস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনার অভিযোগে তারা ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি তাঁকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র প্রধান আসামি করে এবং সে বছররের জুন মাসে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গঠিত বিশেষ আদালতে তাঁর বিচারকাজ শুরু করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে এহেন ষড়যন্ত্র ও বিচার বাঙালিসমাজ মেনে নিতে পারেনি। তারা আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে সে আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। ফলে ২২ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুসহ সব আসামিকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু তাতে তাঁর গদি রক্ষা পায়নি। কারামুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ ও প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে তাঁর স্বেচ্ছাচারমূলক শাসনকাজ চালানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে দেননি। ফলে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সেদিনই সমগ্র পাকিস্তানে পুনরায় সামরিক শাসন জারি করেন।

পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। রাজনীতিবিদদের দাবি মেনে তাদের শর্তানুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক ভোটারদের অবাধ ভোটাধিকার প্রদানের মাধ্যমে ১৯৭০ সালের মধ্যে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেন।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে পাকিস্তানের ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ একক রাজনৈতিক দল হিসেবে ১৬৭টি আসন লাভ করে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সময়মতো আওয়ামী লীগের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে টালবাহানা শুরু করে। অনেক দেনদরবারের পর প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন ডাকে। সে অধিবেশনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা গঠনের সুযোগ পেতো। কিন্তু আওয়ামী লীগকে মন্ত্রিসভা গঠনের সুযোগ না দেয়ার জন্য ১ মার্চ দুপুরে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সে অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। ফলে ঢাকায় তীব্র গণআন্দোলন সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ ঢাকায় আসেন। ২৩ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনা চলে। কিন্তু সে আলোচনা চূড়ান্ত না করে সশস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলন স্তব্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। সেদিন রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে হত্যায় মেতে ওঠে। এ ঘটনার পর পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনের গণরায় বাস্তবায়ন সম্ভব নয় উপলব্ধি করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র যুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ ঘটনার কিছুক্ষণ পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ ইউনিট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে।
১৯৭১ সালের ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান করে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার এক আমবাগানে শপথগ্রহণের মাধ্যমে গঠিত সরকারের নেতৃত্বে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি ১২ জানুয়ারি সরকার গঠন করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৬ সালের দিকে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের কথা বলেন। ১৯৫৮ সালের সংবাদপত্রেও তাঁর সে দাবির কথা প্রকাশিত হয়েছে। সে সময়কালে মওলানা ভাসানীও কথার কথা হিসেবে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি কখনো নির্দিষ্টভাবে বাঙালি জাতির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেননি। কার্যতভাবে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই নির্দিষ্টভাবে বাঙালি জাতির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন। ৬ দফাকেন্দ্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে তিনিই বৈদিক ঋষিদের মতো গভীর সাধনায় বাঙালি জাতিকে জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করেছেন এবং তিনিই সে আন্দোলনকে সফলতার দিকে নিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর কারাবাস, তাঁর নামে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ প্রদান ও প্রহসনমূলক বিচারের আয়োজন সে জাতীয়তাবোধকে আরো শক্তিশালী করেছে।
১৯৬৬ সালের ৮ মে তাঁকে গ্রেপ্তার এবং ১৯৬৮ সালে তাঁকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র প্রধান আসামি করেও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থামিয়ে দেয়া যায়নি। বঙ্গবন্ধু সৃষ্ট স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তাঁর সহযোদ্ধারা এগিয়ে নিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধু সৃষ্ট স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জনসমর্থন এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রবল আস্থার কারণে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ১৯৬৯ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলন এক সময় গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে পাকিস্তানে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেয়া হয়। তারপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কয়েকশ সভা, জনসভা করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ জাগরণের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে ৬ দফা ভিত্তিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগকে ভোট প্রদানের জন্য বাঙালি জাতিকে প্রস্তুত করেন। ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ঘটে।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দেয়ার পর ১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অমিত শক্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে আত্মত্যাগের শপথে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। ফলে সে শক্তিবলে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিকালেও বাঙালি তরুণরা অসম সাহসিকতার সঙ্গে নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও বাঙালির জাতির স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বে বাঙালি জাতির স্বতন্ত্র জাতিসত্তার পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। আজ বাঙালির চেতনায় অসাম্প্রদায়িক-উদার যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সে বোধের ¯্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে এই মহান কাজটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান করেছেন, আর কেউ করেননি।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খানসহ অসংখ্য নেতা রাজনীতি করেছেন। কিন্তু পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে কোনো নেতার কারাবন্দিত্ব থেকে মুক্তির জন্য ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়নি এবং কোনো নেতা এককভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করে জাতীয় নির্বাচনে তাঁর রাজনৈতিক দলকে পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভের বিরল দৃষ্টান্তে স্থাপন করতে পারেননি। সবচেয়ে বড় কথা, কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নিজের সৃষ্ট বাঙালি জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করে এবং তাঁর অনুপ্রেরণায় সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার বিরল গৌরব কোনো নেতাই প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। সুতরাং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে আজকের উদার ও অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তবোধ এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হতো না- এ কথা বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের হাজার বছরের ইতিহাস অবলীলায় স্বীকৃতি দেয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়