ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

বঙ্গবন্ধুকে যেমন দেখেছি

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সপ্তম শতকের বাঙালি রাজা শশাঙ্ক থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ে বহু দেশি, বিদেশি শাসক এই বাংলা শাসন করেছেন। কিন্তু বাঙালি কখনই তাদের স্বাধিকার ফিরে পায় নাই। অনেক অত্যাচার, নির্যাতন, লুণ্ঠনের শিকার হয়েছিল এই বাংলা। শশাঙ্ক পরবর্তী প্রায় একশ বছর বাংলাদেশে ঘোর অরাজকতা, অনৈক্য, আত্মকলহ ও বহিঃশত্রæর আক্রমণ চলে। এই যুগকে মাৎস্যন্যায়ের যুগ বলা হয়। বাংলা এক সময় ধনঐশ্বর্যে ভরপুর ছিল। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন এক ষড়যন্ত্রমূলক প্রহসনের যুদ্ধে নবাব সিরাজের পরাজয়ের পর ইংরেজরা দৈত্যরূপে আবির্ভূত হয় বাংলার মানুষের কাঁধে। তারা শুষে নিয়ে গেছে বাংলাকে। অত্যাচার করেছে নিরীহ বাঙালির ওপর। খাজানার খড়গ তাদের নিঃস্ব করেছে। এরা ১৯০ বছর শাসন করেছে এদেশ। সর্বশেষ পাকিস্তানিদের চব্বিশ বছরের শাসন ও শোষণে যখন আমরা অতিষ্ঠ তখন শেখ মুজিবই আমাদের মুক্তির দিশারী। স্কুল জীবন থেকেই তাঁর মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। এরপর কলেজ জীবন থেকে তাঁর রাজনৈতিক পদযাত্রা। নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিলের তিনি সদস্য ছিলেন ১৯৪৩ সাল থেকে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর রাজনৈতিক অঙ্গনে। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পূর্ব থেকে।
বঙ্গবন্ধু একটি ইতিহাসের নাম। তিনি ইতিহাসের এক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। বাংলার মানুষের কাছে তিনি স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। লক্ষ লক্ষ তরুণ এই ফেরিওয়ালার পিছু পিছু ছুটেছে। শুনেছে তাঁর আদেশ, নির্দেশ। হয়েছে তাঁর ভক্ত, অনুরাগী। শত শত বছরে যারা পারে নাই তা তিনি পেরেছেন। বাস্তবে খুলে দিয়েছেন সেই স্বপ্নের অলিন্দ। বঙ্গবন্ধুর মাঝে আমরা এক বিশ্ব মানবতার কথা জানতে পারি। তিনি ছিলেন একজন উদার নৈতিক মানুষ। তিনি গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদয়িক বাংলাদেশের একজন মূর্ত প্রতীক। তাঁর ত্যাগ, তিতিক্ষা, দৃঢ় মনোবলের সোপান ছেষট্টি, ঊনসত্তর, সত্তর ও একাত্তরের সোনালি ফসল ঘরে তোলা।

১৯৭০ সাল। ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের প্রচারণা তুঙ্গে। ১৮ জুন নির্বাচনের প্রচারণার জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান তদানীন্তন সময়ের গাইবান্ধা মহকুমা শহরের ইসলামিয়া হাইস্কুল মাঠে আসেন। স্কুলের সামনে মঞ্চ তৈরি হয়েছে। দুপুর থেকে স্কুল মাঠ লোকে লোকারণ্য। অনেকে গাছের ডালে, টিনের চালে জায়গা করে নিয়েছে। স্কুলের ঠিক দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ওই স্কুলেরই একটা টিনের ঘর ছিল। তার উপরে বহু লোক উঠেছিল। মঞ্চের পূর্বপাশ ঘেঁষে আমি দাঁড়িয়ে আছি। নেতাকে এক নজর দেখার জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লোকের ঢল। মঞ্চে নেতা আসলেন। মঞ্চের উপর কোনো চেয়ার, টেবিল, ছিল না। সবাই মঞ্চের উপরে বসে পড়লেন। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে বসে পাইপ টানছেন। তাঁর সত্তায় ছিল বাঙালির প্রতি গভীর মমত্ববোধ। জেল-জুলুম, নির্যাতন, কোনো কিছুই তাঁকে দমাতে পারে নাই। অমিত তেজদীপ্ত নির্মোহ তাঁর বক্তৃতা সবাইকে আকৃষ্ট করে মুহূর্তেই। অত্যন্ত কাছ থেকে দেখলাম এক পুরুষ যিনি বাঙালি জাতির প্রতি ¯েœহান্ধ, মানব দরদী। বাঙালির প্রতি তাঁর অক্ষয় ভালোবাসা, শাশ্বত আস্থা দেদীপ্যমান। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিয়ার রহমান। উপস্থিত ছিলেন গাইবান্ধার জনাব লুৎফর রহমান ও জনাব ওয়ালিউর রহমান। পরে তাঁরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ইসলামিয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের পুত্র জনাব ওয়ালিউর রহমানের উপস্থাপনায় সভা শুরু হলো। প্রথমে অন্যরা বক্তৃতা করার পর যখন বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা শুরু করলেন তখন মানুষ সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেল। বক্তৃতা চলছে এমন সময় মাঠের কোণে টিনের ঘরটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে বহু লোক আহত হয়। একজন মৃত্যুবরণ করেছে বলে জানা যায়। বঙ্গবন্ধু সভা মঞ্চ থেকে তাদের তাৎক্ষণিক হসপিটালে ভর্তি করার জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিলেন। সভা কিছুক্ষণ পর শেষ হলো। উপস্থিত জনতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর বক্তৃতা শুনেছে। নেতা ও জনতা হয়েগিয়েছিল অভিন্ন সত্তার আধার।
উনিশশ সত্তরের ৭ ডিসেম্বরের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে মোট সাধারণ আসন সংখ্যা ছিল ১৬২টি এবং সংরক্ষিত মহিলা আসন সংখ্যা ৭টি। তন্মধ্যে আওয়ামী লীগ সাধারণ আসন পেয়েছিল ১৬০টি এবং সংরক্ষিত মহিলা আসন পেয়েছিল ৭টি, মোট ১৬৭টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের দল হিসেবে আওয়ামী লীগ আত্মপ্রকাশ করে। তারপর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮টি আসন পায়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। পশ্চিম পাকিস্তানিদের মাথায় বাজ পড়লো। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে তাদের এত দিনের মৌরুসি স্বত্ব হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলো। শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। একাত্তরের ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি মুক্তিকামী জনতার কাছে তাঁর শেষ নির্দেশ পৌঁছে দিলেন। আজ থেকে ঊনপঞ্চাশ বছর পূর্বে উনিশ মিনিটে এক হাজার একশ সাতটি শব্দ, শব্দব্রহ্ম হয়ে গর্জে উঠেছিল অপেক্ষমাণ সেই জনসমুদ্রে। বিকেল তিনটা বিশ মিনিট, সেই অবিনশ্বর পঙ্ক্তি, সেই অবিনশ্বর দীক্ষাধ্বনি সবুজ জমিনে মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের অসংখ্য পতাকায় বাতাসে উড়েছিল। একটি নতুন ঠিকানার অভ্যুদয় বার্তা কবি শুনিয়েছিলেন ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানে। কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে একজন কবির কবিতার সাথে তুলনা করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি কবি এবং তাঁর ভাষণকে কবিতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন এভাবে- ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে, রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে, অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন। ….গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতা খানি : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই অবিস্মরণীয় ভাষণটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বাক্ষর হয়ে রয়েছে।
এরপর নয় মাস। মুক্তিকামী জনতার ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংগ্রামের ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ। শুধু সম্মুখ সমরে নয়, যুদ্ধের ময়দানে বিভিন্ন জন, বিভিন্ন সংগঠন, পেশাজীবী, শ্রমজীবী, যে যেভাবে পেরেছেন প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন। এই দেশ মাতৃকার যুদ্ধে কামার, কুমার, কৃষক, জেলে, তাঁতি, সবাই ছিল জয় বাংলা পতাকাতলের অকুতোভয় সৈনিক। তখন সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিবিসি বাংলা, আকাশবাণী এবং স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর শুনতো। পরিস্থিতি আস্তে আস্তে খারাপ হতে লাগলো। শান্তি কমিটির নামে মৌলানাসাবেরা পাক হানাদারদের খেদমতগার ও গোয়েন্দার কাজে ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’ নামে কিছু যুবককে সংঘবদ্ধ করেছিল। এরাই পরবর্তীতে ধর্ষণ, লুণ্ঠন কাজে জড়িত ছিল। এই যুদ্ধে ভারত প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল। দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ও ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন করি।
দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখনো সত্যকে অসত্যের পথে ঠেলে দিয়ে এক শ্রেণি শকুনির ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নতুন প্রজন্মের কাছে ২০২০-এর এই মুজিব বর্ষে আমাদের সত্য কথাগুলো তুলে ধরতে হবে জাতির কাছে এবং জানাতে হবে বঙ্গবন্ধুর সোনালি স্বপ্নময় দেশ ভাবনার কথা। তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্নের মাধ্যমে সত্য ইতিহাস উপস্থাপন করা। আর তখনই আমরা ঋণ মুক্তির দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি পাব নতুন প্রজন্মের কাছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়