ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠন, কঠিন কণ্টকাকীর্ণ ইতিহাসের পথ পরিক্রমা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। গত দেড়-দুই বছর ধরে করোনা অতিমারির জটিল এই পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নানাভাবে পালিত হয়েছে। এতে আনুষ্ঠানিকতার বেশ কিছু আয়োজন যেমন ছিল, তেমনি ৫০ বছরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পথ চলা নিয়ে নানা অভিজ্ঞতার বিনিময়ও ঘটেছে। একইভাবে সাফল্য-ব্যর্থতার নানা দিকও লেখালেখিতে তুলে আনার চেষ্টা হয়েছে। এর কতটা রাজনীতি সচেতন ও শিক্ষিত মহল গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে বা নেবে। সেটি অবশ্য মৌলিক প্রশ্ন। তবে ব্যাপক জনগণকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে রাজনৈতিক এবং শিক্ষা সচেতন মহলকেই। দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা হচ্ছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বিশেষ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়েও আমরা বুকে হাত দিয়ে হলফ করে বলতে পারছি না যে আমাদের ৫০ বছরের রাজনীতি এবং বেড়ে ওঠা শিক্ষা সংস্কৃতির ধারকবাহক গোষ্ঠী বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আদর্শকে নিষ্ঠার সঙ্গে ধারণ করেছে, সেটি যদি ঘটত তাহলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বৃহত্তর বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে ছোট ছোট নৃ-জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতির অভাব এবং গণতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্যের অভাব আমাদের রাষ্ট্রে পরিলক্ষিত হতো না। আমাদের প্রায় সব রাজনৈতিক দলই গণতন্ত্রের কথা বেশ উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তাদেরও অবদান রয়েছে বলে দাবি করে। কিন্তু গণতন্ত্রের অন্যতম প্রাণশক্তি হচ্ছে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য সমান অধিকারের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের শৈথিল্য, বিচ্যুতি, আপসকামিতা ও দুর্বলতা প্রকাশ করা কিংবা ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। অসাম্প্রদায়িকতা ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। গণতন্ত্র হচ্ছে রাষ্ট্রের নাগরিক পরিচয়ে সকলের সমান অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা। তাতে ব্যত্যয় ঘটলে গণতন্ত্রের ওপর আস্থা হারানোর সুযোগ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ঘটে। গণতন্ত্র সম্পর্কে এমন পরিষ্কার অবস্থান নির্ধারিত থাকার পরই কেবল সকলেই রাষ্ট্রের চরিত্র যেমন নিরূপণ করতে পারেন, দুর্বলতাও নির্ণয় করতে পারেন। সুতরাং আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকালে সংবিধানে ৪ মৌল নীতির গ্রহণের মূল লক্ষ্যই ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা। কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ৪ মৌল নীতির ওপর যে আঘাত নেমে আসে অর্থাৎ যারা ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে রাষ্ট্রের মূল নীতির পরিবর্তন ঘটায় তারা আদতেই বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করে ১৯৪৭-এর ভাবাদর্শে ফিরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যেই রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রশাসন, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতির পরিবর্তন ঘটায়। বাংলাদেশ অতি দ্রুত অসাম্প্রদায়িকতার ধারা থেকে সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজালে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে আবদ্ধ করে ফেলে। এর ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম মৌল নীতি ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভুলভাবে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখে। এরপর থেকে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ অনেকগুলো রাজনৈতিক দলের আদর্শের বিষয় নয় বলেই স্পষ্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দ্ব›েদ্বর মুখ্য বিষয় হিসেবে সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে এবং বিপক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবস্থান পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক বিরোধ মূলতই রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িকতাকে কেন্দ্র করে ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠেছে। ফলে মুখে আমরা যতই গণতন্ত্রের কথা বলি না কেন, কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজের অভ্যন্তরে দ্ব›দ্ব, সংঘাত, বিরোধ এবং দূরত্বের প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অসাম্প্রদায়িকতাকে রাজনীতির একটি পক্ষ মোটেই গ্রহণ করছে না বরং সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সবকিছুর ওপর কর্তৃত্ব করার মানসিকতা বজায় রাখা। এটি মোটেও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সে কারণেই স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বেশ কিছু অর্জনকে অনেকটাই মøান করে দিচ্ছে এর সর্বগ্রাসী বিস্তার। এ বিষয়ে আমাদের বিশেষভাবে মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করি।
সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে একটি ধর্মীয় রাজনৈতিক মতার্দশ, যা সকল সম্প্রদায়ের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষা সাংস্কৃতিক অধিকারকে বিকশিত হতে বাধাগ্রস্ত করে। বিশেষত ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা যখন রাষ্ট্রের মূল নীতি-আদর্শকে প্রভাবিত করার সুযোগ পায় তখন রাষ্ট্রের নাগরিকতার পরিচয় খাতা-কলমেই থাকে। মানুষের মনোজগতে উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা সবকিছুকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এটি যে কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক পরিণতি ডেকে নিয়ে আসে। মূলত পশ্চাৎপদ সমাজ ও পুরনো রাষ্ট্রব্যবস্থাগুলো এ ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনৈতিকভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় প্রদান করেছিল। শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের সমর্থনকারীরা উগ্র সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করে সমাজ ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসবাসকারী ভিন্ন ধর্ম ও জাতিগত সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন এবং তাদের অধিকার হরণের সকল প্রকার জোরজবরদস্তিমূলক শক্তির প্রয়োগ ঘটিয়েছে। একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে একাধিক ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ের মানুষের বসবাস ঐতিহাসিকভাবেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু বিশেষ কোনো ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ের মানুষ কিংবা শাসকগোষ্ঠী অপরাপর ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়ের মানুষের ওপর নির্যাতন, হত্যা, লুণ্ঠন, ভূমি থেকে উচ্ছেদ, ধর্ষণ ইত্যাদির মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে ঘটিয়ে থাকলেই সেটি হয় সেই সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িকতা। যখন কোনো সম্প্রদায় তার সীমা অতিক্রম করে জোরজবরদস্তিমূলক অপরাধ সংঘটিত করে তখনই সেটি সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞায় পড়ে। সাম্প্রদায়িকতা সে কারণেই হচ্ছে একটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, যার পেছনে থাকে গোষ্ঠীগত স্বার্থ এবং অর্থবিত্ত। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা দৃশ্যত ধর্ম জাতীয়তার মহৎ আদর্শকে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অপব্যবহার করে থাকে। সে কারণেই সাম্প্রদায়িকতা কোনো আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক দলের আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয় না। বরং আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বসবাসকারী সকল মানুষকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা এবং সংবিধানে সেই স্বীকৃতির নিশ্চয়তা বিধান করা, কোনোভাবেই ধর্মীয় ও জাতিগত ভাবাদর্শ রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসবাসকারী নাগরিকদের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার কিংবা হস্তক্ষেপ করার সুযোগ কাউকে না দেয়া। আধুনিক রাষ্ট্রে তাই বড় পরিচয় হচ্ছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই রাষ্ট্রের নাগরিক। নাগরিক হওয়ারও কতগুলো শর্ত রয়েছে। প্রথম শর্তটি হচ্ছে, জন্মগত অধিকার। আধুনিক সব রাষ্ট্রই সকল শিশুকে তার নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের অধিকার দেয়ার অঙ্গীকার প্রত্যেকটি রাষ্ট্রেরই থাকে। তবে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল রাষ্ট্রগুলো এসব অধিকার সমানভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে না। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে যেসব রাষ্ট্র পরিচালিত হতে থাকে, সেগুলো মৌলিক এসব অধিকার প্রদানের আইনগত ভিত্তি ও কাঠামো দাঁড় করিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। প্রাপ্তবয়স্করা নাগরিক অধিকার লাভের ক্ষেত্রে যেমন ভোটাধিকারসহ রাষ্ট্র কর্তৃক প্রবর্তিত সকল অধিকারই ভোগ করে থাকে, একইভাবে রাষ্ট্রকেও তারা আর্থ-সামাজিকসহ সকল ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করার জন্য শ্রম, মেধা দিয়ে সেবা করে থাকে। আধুনিক রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি তাই নাগরিকদের প্রতি অনেক বেশি উদার। ফলে নাগরিকরা রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে বৈষম্যের সকল প্রকার বেআইনি হস্তক্ষেপ থাকে মুক্ত থাকে। আধুনিক উন্নত রাষ্ট্রগুলো নাগরিকতার বৈশিষ্ট্যকে আরো সম্প্রসারিত করেছে। ভিন্ন দেশের নাগরিকদেরও গ্রহণ করার মাধ্যমে নাগরিকতা প্রদান করা হচ্ছে। এরা ভোটাধিকারসহ প্রায় সকল অধিকারই ভোগ করতে পারে। তাদের সন্তানরা অনায়সেই এসব রাষ্ট্রের স্থায়ী নাগরিক হিসেবে ছাড়পত্র পেয়ে থাকে। এটিই হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন ও বিবর্তন। আধুনিক রাষ্ট্র বহু জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার প্রদানের মাধ্যমে যে সমাজ ও রাষ্ট্র তৈরি করছে সেটি চূড়ান্তভাবে মানবতাবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রে উত্তরণের পথ রচনা করছে। যদিও এসব রাষ্ট্রে জাতিধর্মের নানা বৈচিত্র্য সাংবিধানিকভাবে গৃহীত, তারপরও এটি আত্মস্থ হওয়ার প্রক্রিয়াটি সব রাষ্ট্র ও সমাজে একরকম নয়, কোথাও কোথাও উগ্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ এবং বৈষম্যের মানসিকতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তারপরও আধুনিক উন্নত রাষ্ট্রগুলো বড় ধরনের ধর্মীয় ও জাতিগত বিরোধ রাষ্ট্রীয়ভাবে সমর্থন করে না। অনেকক্ষেত্রেই বরং শূন্য সহনশীলতা ও উদারতা প্রদর্শন করছে। এটিই হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল চরিত্র। মানবসভ্যতা ধীরে ধীরে সেই পথেই অগ্রসর হচ্ছে।
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করেছে। পাকিস্তান মাত্র ২৩ বছর আমাদের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থা ছিল মধ্যযুগীয় সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের গর্ভ থেকে জাত। যদিও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে। কিন্তু স্বাধীনতালাভকারী পাকিস্তান রাষ্ট্রটি আধুনিক কোনো জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গুণাবলি অর্জন করার লক্ষ্য সম্মুখে নির্ধারণ করেনি। এটি গড়ে উঠেছিল হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের রাজনৈতিক দ্ব›দ্বকে ব্যবহারের মাধ্যমে বিশেষ শাসকগোষ্ঠীর সুবিধা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। সে কারণে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভের আগেই প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছিল এই রাষ্ট্রের ভাষা কী হবে? সেই প্রশ্নের উত্তরও তারাই নির্ধারণ করে ছিল একমাত্র উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার পরিচয়কে অস্বীকার করে পাকিস্তান পূর্ব বাংলার জনগণের ধর্মীয় জাতিগত এবং সম্প্রদায়গত অধিকারকেও ধূলিসাৎ করার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার যে ঘোষণা দিয়েছিল সেটি পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকারকে অস্বীকার করার নামান্তর ছিল। পাকিস্তান শুরুতেই একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রচরিত্রের পরিচয় প্রদান করেছিল। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িকতার মূল বৈশিষ্ট্যই ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অন্যান্য নৃ-জাতি গোষ্ঠীর পরিচয় এবং পূর্ব বাংলার জনগণের ধর্মীয় রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক অধিকারকে অস্বীকার করা, হরণ করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। পাকিস্তান রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চরিত্রের কোনো বৈশিষ্ট্যই গ্রহণ করেনি। সে কারণেই একটি সংবিধান রচনা করাও রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর বিবেচনায় ছিল না। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান যে সংবিধান গ্রহণ করে তা নামে ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের হলেও সেই রাষ্ট্রে পূর্ব বাংলার জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদেরও স্বীকৃতি ছিল না। সে কারণেই পাকিস্তান রাষ্ট্র ইসলাম ধর্মের অপব্যবহার করে যে সাম্প্রদায়িকতার পরিচয় দিয়েছিল তার নিষ্ঠুর প্রকাশ ঘটেছিল ২৩ বছরের শাসন, শোষণ এবং সর্বশেষ ১৯৭১ সালের গণহত্যার মাধ্যমে। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান রাষ্ট্র ও শাসক শ্রেণি যে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছিল তা ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের নামান্তর বা তারো চাইতে ভয়ঙ্কর ছিল। পাকিস্তান কতটা সামরিক সন্ত্রাসনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল সেটি ১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলার নিরীহ মানুষের ওপর হত্যা, নিপীড়ন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং জাতিগত নিধনের বহিঃপ্রকাশ থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ১৯৪৭-১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক চরিত্র সর্বোচ্চ নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে প্রতিভাত হয়।
সে কারণেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যযুগীয় চরিত্রের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত ও সচেতন হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার জনগণ বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম, দাবিদাওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে নিজস্ব জাতিসত্তার বিকাশ ও রাষ্ট্রের অপরিহার্যতার বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এবং মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের বড় অংশই সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের মানসিকতায় বেড়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও আদর্শের গুরুত্ব উপলব্ধির চেষ্টা করতে দেয়া হয়নি। সে ধরনের রাজনৈতিক সংগঠনও সেখানে ততটা বিকশিত হয়নি। ফলে নাগরিক অধিকারের বিষয়গুলো পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে যেমন উপেক্ষা করেছে, রাজনৈতিক দলগুলোও সেই ধারণা থেকে দূরে ছিল। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল। একইসঙ্গে তারা পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকারের প্রতিও ছিল বিরূপ মনোভাবাপন্ন। এখানকার বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল পাকিস্তান রাষ্ট্রচরিত্রের বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি। ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্র একটি আধুনিক গণতন্ত্রবিরোধী রাষ্ট্র- এই ধারণাটিও ব্যাপকভাবে অনুপস্থিত ছিল। ফলে পাকিস্তানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল সম্মুখের দিকে অগ্রযাত্রা নয় বরং মধ্যযুগীয় সাম্প্রদায়িক পশ্চাৎপদ রাষ্ট্রের দিকে পিছু হটা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ এবং কিছু কিছু গণতান্ত্রিক শক্তির আন্দোলন ছিল সম্মুখের দিকে রাষ্ট্রকে নিয়ে যাওয়া। সেখানে অবশ্য পথের ভিন্নতা ছিল। তবে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা প্রদানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবুর রহমান জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে আপসহীন রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের পথে অনড় ছিলেন। সেখান থেকেই আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের আন্দোলন একসূত্রে গ্রোথিত হতে থাকে, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পূর্ব বাংলার জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ হিসেবে সংগঠিত হয়। শেখ মুজিব সেই বিস্ফোরণের মূল কাণ্ডারি হিসেবে আবির্ভূত হন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে তখন যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল তা বুঝতে পারেনি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। পাকিস্তানও পূর্ব বাংলার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যকে উপলব্ধি করতে পারেনি। ’৭০-এর নির্বাচনে পূর্ব বাংলার স্বীয় বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সেটিকেও হজম করতে পারেনি পাকিস্তানের রাজনৈতিক শাসকগোষ্ঠী। তারা তা নিষ্প্রভ করার জন্য সামরিক শক্তির সমাবেশ ঘটিয়ে পূর্ব বাংলায় যে গণহত্যা সংগঠিত করেছিল তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা ইতিহাসের নতুন পর্বের সূচনা। এই ঐতিহাসিক নবযাত্রাকে পাকিস্তান শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করতে চেয়েছিল। সেটিকে প্রতিহত করতে বাংলাদেশ সশস্ত্র পন্থায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছিল। ১৬ ডিসেম্বর এর বিজয় নিশ্চিত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক নানা ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে বাংলাদেশ স্বাধীন আধুনিক রাষ্ট্রের অভিযাত্রায় যুক্ত হয়।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে পা রাখেন। বাংলাদেশ পাকিস্তানকে কেবল পরাজিতই করেনি, সেই রাষ্ট্র চরিত্রকে প্রত্যাখ্যান করে যে আদর্শগুলো গ্রহণ করেছিল তা হচ্ছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ। এই চারটি মূল আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ হতে চেয়েছিল এই অঞ্চলের সবচাইতে উদারবাদী আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো রাষ্ট্র বিশেষ কোনো ধর্মের বা ধর্মীয় পরিচয়ের জনগোষ্ঠীর পক্ষে বা বিপক্ষে নয় বরং সকল নাগরিকের অধিকার রক্ষার পক্ষে। এটিই হলো গণতন্ত্রের মূল মন্ত্র। বাংলাদেশ এই মূল মন্ত্রটি গ্রহণ করেছিল ১৯৭২-এর সংবিধানে। শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যও হচ্ছে গণতান্ত্রিক এই রাষ্ট্রের অন্যতম একটি স্তম্ভ। জাতীয়তাবাদ আধুনিক জাতি রাষ্ট্রের একটি উদারবাদী দর্শন। জাতিগত পরিচয়ে সকল নাগরিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সমান অধিকার ও দায়িত্ব পালন করবে। কোনো অবস্থাতেই উগ্র জাতীয়তাবাদের স্থান রাষ্ট্র প্রশ্রয় দেবে না। ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়ে সকল ছোট-বড় জাতিগোষ্ঠীর উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জন করাই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সেই সময়ের মূল পরিকল্পনা ছিল। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চরিত্র দান করার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছিল সংবিধানে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ অগ্রসর, উদারবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিল। যদিও পথটি বাংলাদেশের জন্য মোটেও সহজ ছিল না। পাকিস্তানের শাসন, শোষণ এবং যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি আমাদের অর্থনীতির পথে ছিল বড় বাধা। তবে এই বাধা কোনো অবস্থাতেই অলঙ্ঘনীয় ছিল না, বরং উদার জাতীয়তাবাদ, শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামো সৃষ্টির মাধ্যমে এসব পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে ওঠা সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র। বলা চলে নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির যাত্রাকালের লক্ষ্যস্থির হয়েছিল আধুনিক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। এর চাইতে মহৎ অগ্রসর চিন্তা ও উদ্যোগ তখন আর দ্বিতীয়টি হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা, প্রতিষ্ঠাতা, জাতির পিতা এবং সরকারপ্রধান হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যথার্থ এসব লক্ষ্য স্থির করেছিলেন। তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের গর্ভ থেকে দ্বিতীয় পাকিস্তান রাষ্ট্র নয় বরং আধুনিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দর্শন উপস্থাপন করেন যা আমাদের জন্য অবশ্যই নতুন- অগ্রসর, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অনেকটাই অনুসরণীয় পথ ছিল। তবে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব মাটি ও মানুষের বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দিয়েই এমন একটি চার স্তম্ভ বিশিষ্ট রাষ্ট্রগঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এটি রাষ্ট্র গঠন ইতিহাসে নতুন অভিজ্ঞতা হিসেবেই গণ্য করার বিষয়। এর জন্য প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনের একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া, যা বাংলাদেশ অর্জনের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক একটি রাষ্ট্রচরিত্র লাভ করার সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। প্রয়োজন ছিল সেইসব সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপদানের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, সচেতনতা সৃষ্টি করা, আর্থসামাজিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক বিকাশ সাধন করা। এটি অবশ্যই একটি কঠিন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা রক্ষার মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে। সেই কাজটি সম্পাদন করেই তবে দেশের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হয়। রাজনৈতিক দলগুলো মূলত জনগণকে কোনো অবস্থাতেই ভুল পথে পরিচালিত করার দায় নিতে পারে না। তাদের সামান্য বিচ্যুতিই আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের চ্যালেঞ্জকে ভয়াবহ সংকটের মুখে ফেলে দিতে পারে। সেই নজির পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যথেষ্ট রয়েছে। বাংলাদেশেও দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের ভুগতে হচ্ছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে নির্মম হত্যাকাণ্ড শুধু বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের প্রতি কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল সেনা কর্মকর্তার আচরণের বহিঃপ্রকাশ নয়, এই হত্যাকাণ্ডটি ছিল গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিষয়- যার লক্ষ্য ছিল ৪ মৌল নীতির রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেয়া, ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাবাদর্শের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের ধারায় ধরে রাখা। খন্দকার মোশতাক অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে পুনরুত্থানের সুযোগ করে দেয়। এটিকে কঠোরভাবে বাস্তবায়নের জন্য সামরিক শক্তির হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা অর্পণ করা হয়, যেন কোনো অবস্থাতেই অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির পুনরুত্থান ঘটতে না পারে। ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরের পর রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা সামরিক শাসকগোষ্ঠীর হাতে চলে যায়। জেনারেল জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং সংবিধানে গৃহীত চার মৌল নীতির প্রতি নিষ্ঠাবান হওয়ার তার কোনো কারণ থাকার কথা নয়। কেননা তিনি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বেড়ে ওঠা একজন সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে তার মানসিকতায় পাকিস্তানের ভাবাদর্শ বহু আগেই রোপিত হয়েছিল। তিনি সেই আদর্শের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো নজির ’৭১- পূর্ববর্তী সময়ে স্থাপন করেনওনি। ১৯৭১ সালে ঘটনাচক্রে তিনি চট্টগ্রামে দায়িত্বপালনরত অবস্থায় থাকার কারণে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তানে তখন তার অবস্থান থাকলে বোঝা যেত তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতেন কিনা। অনেক সামরিক কর্মকর্তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, প্রাণও উৎসর্গ করেছিলেন। আবার বেঁচে যাওয়া অনেক সামরিক মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদর্শ গ্রহণের ক্ষেত্রে উদাসীনতা প্রদর্শন করেছিলেন। অনেকে এর অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক আদর্শ বোঝার পর্যায়ে ছিলেন না। মূল বিষয়টি হচ্ছে রাষ্ট্র রাজনীতির লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে ধারণ করা না করার ওপর। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত না থেকে এমন কঠিন রাজনৈতিক শিক্ষা লাভ করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাঙালি বহু সামরিক কর্মকর্তা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে নানা বিভ্রান্তির খপ্পরে পড়েন। তাদের অনেকেই ’৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হন কিংবা নীরবে সমর্থন করেন, ক্ষমতার দ্ব›েদ্বও নিজেরাও জড়িয়ে পড়েন, সংগঠিত করেন অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে এমন বিয়োগান্তক ঘটনার স্বীকার হয়েছিলেন বহু সামরিক কর্মকর্তা। তাদের এমন বিয়োগান্তক পরিণতির অন্যতম প্রধান কারণ ছিল রাষ্ট্র রাজনীতির জটিল মতাদর্শগত অবস্থান সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকা। অনেককিছুই তারা আবেগ, রোমান্টিকতা, অস্পষ্টতা, মধ্যবিত্তের উচ্চাকাক্সক্ষার সীমাবদ্ধতার কারণে উপলব্ধি করতে পারেননি। এর পরিণতি তাদের জন্য যেমন সুখের হয়নি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যারা গভীর ষড়যন্ত্র করেছিল, তাদের উদ্দেশ্যকেই সফল হতে সাহায্য করেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র হারিয়েছে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য।
জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারকবাহক রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতিকে তাদের জন্য জটিল এবং কঠিন করে দিলেন। সেই সঙ্গে রাজনীতির মাঠে তিনি সাম্প্রদায়িক শক্তির অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিলেন। অসাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি হাটি হাটি পা পা করে চলার সময়ে পা কেটে দেয়া হলো। সমাজ ও রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তিকে দ্রুত জায়গা দখল করে দেয়ার সুযোগ করে দিলেন। নিজে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করলেন। দলের আদর্শ হিসেবে যা গ্রহণ করেছিলেন তা মূলত ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার পুনরুত্থান ঘটাতে সাহায্য করেছিল। রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানোর সুযোগ করে দিলেন। তার রাজনৈতিক দলে স্বাধীনতাবিরোধী ডান এবং বাম ধারার বেশ কিছু গোষ্ঠী যুক্ত হয়। সাধারণ মানুষকে এরা সাম্প্রদায়িকতার ভাবাদর্শে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়। তিনি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার প্রচার ও প্রসার ঘটানোর সুযোগ করে দিলেন। সংবিধানে তিনি মৌলিক আদর্শের বিপরীতে বিকৃত ও ভুল ব্যাখ্যা সংবলিত মতাদর্শ যুক্ত করেছিলেন। এর ফলে বাংলাদেশের সমাজে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার বিকাশ ঘটার সুযোগ পায়। রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতাই বিশেষভাবে স্থান করে নেয়। এর ফলে বাংলাদেশে বেশ কিছু দুঃখজনক সাম্প্রদায়িক আক্রমণ সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায়। এখনো সমাজের সর্বস্তরে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে অনেকেই বিত্ত-বৈভবের মালিক হচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বাংলাদেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমনকি তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতাও অনেকক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের জীবন-জীবিকা সবস্থানে নিরাপদ থাকে না। সমাজ ও প্রশাসনে তাদের অধিকার রক্ষা করার সুযোগ কমে আসছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজটি বাধাহীনভাবে চলছে। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে কোনো কার্যকর ভূমিকা নিতে পারছে না, প্রায়ই সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে নানা ধরনের বিধিনিষেধ, হাঙ্গামা ঘটার মতো দুর্ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতামূলক বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে নিরীহ, নিরপরাধ মানুষের ওপর হামলা, বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং জীবন বিপন্ন করার মতো আগ্রাসী ঘটনা সংঘটিত হতেও দেখা যাচ্ছে। ২০২১ সালে দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের যে তাণ্ডব সংগঠিত হতে দেখা গেছে তা দীর্ঘদিনের সাম্প্রদায়িক প্রচার-অপপ্রচারেরই ফসল। সমাজের একটি গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্য যেন ওঁৎ পেতে আছে। কোনো কিছু যাচাই-বাছাই না করেই এরা দেশের সর্বত্র ধর্মের নামে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেও দ্বিধা করে না। এর ফলে দেশে আইনশৃঙ্খলা যেমনভাবে লঙ্ঘিত হয়, একইভাবে দেশের অভ্যন্তরে নিরীহ সাধারণ মানুষ বিপন্ন বোধ করে। এর প্রতিক্রিয়া দেশের বাইরেও কমবেশি সংগঠিত হয়। ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষিত গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক লক্ষ্য অর্জন শুধু প্রশ্নের মুখেই পড়ে না, বাস্তবায়নও দুরূহ হয়ে উঠেছে। সে কারণে দেশে একদিকে অর্থনৈতিক উন্নতি ও সমৃদ্ধি ঘটলেও সমাজের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত হচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে এর থেকে উত্তরণের উপায় কী?
সুবর্ণজয়ন্তীর এই ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশকে এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে সেটি ১৯৭৫-এর আগে ভাবা যায়নি। কিন্তু ’৭৫-পরবর্তী রাজনীতি আমাদেরকে এতটাই বিভক্তির মধ্যেই ফেলে দিয়েছে। দীর্ঘদিন এই বিভক্তি রাজনীতিতে শক্তি করে নেয়ার ফলে সমাজেও এর বিস্তার ঘটেছে। শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও প্রসারের চাইতে পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস ও সাম্প্রদায়িক বিভক্তির নানা উপাদান যুক্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের শিশুদের মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষায় বেড়ে ওঠার পরিবর্তে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শে বেড়ে ওঠার প্রচার-প্রচারণা প্রতিনিয়ত করতে দেয়া হচ্ছে। প্রকৃত শিক্ষা সেখানে থাকছে না। শিশুর মানস বিকাশ তাই সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে আটকে যাচ্ছে, বৃহত্তর মানবিক মূল্যবোধ, মানুষের পরিচয় এবং সাংস্কৃতিক ধ্যান-ধারণায় বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। সে কারণে আমাদের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাই চলছে হ-য-ব-র-ল অবস্থায়। এখান থেকে আধুনিক বিজ্ঞানচিন্তা, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতির ধ্যান-ধারণা লাভ করার সুযোগ খুব একটা ঘটছে না। শিক্ষা যেখানে মানুষের অন্তর্দৃষ্টিকে খুলে দেয়, সেখানে সাম্প্রদায়িকতাযুক্ত শিক্ষা কোনো অবস্থাতেই মানুষের মধ্যে বৃহত্তর উদারবাদী চিন্তা ও জ্ঞান বিকাশের সুযোগ করে দেয় না। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের সবচাইতে দুর্বল এবং পিছিয়ে পড়া প্রতিষ্ঠান হচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষাব্যবস্থা যতদিন পর্যন্ত আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারের লক্ষ্যে না সাজানো হবে, ততদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রের রাজনীতি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আধুনিকভাবে গড়ে তোলার জন্য যোগ্য, দক্ষ, অভিজ্ঞ এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের জোগান দিতে পারবে না। রাজনীতিকে পরিবর্তিত করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় যে সব মৌলিক দুর্বলতা রয়েছে সেগুলোকে পরিবর্তন করতে হবে। তাহলেই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্য কারিগর সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। সেটি যতদিন পর্যন্ত না ঘটবে ততদিন পর্যন্ত আধুনিক রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক নিয়মে পরিচালিত হওয়ার সুযোগ পাবে না। সেই নেতৃত্ব গড়ে ওঠার শিক্ষাই এখন সবচাইতে জরুরি প্রয়োজন। দেশের রাজনীতিতে যে বিভাজন এবং যোজন যোজন দূরত্ব তৈরি হয়েছে সেটি দূর করতেই একান্ত প্রয়োজন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের। দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হচ্ছে রাজনীতিতে তেমন শিক্ষিত নেতাকর্মী বেড়ে ওঠার সুযোগ খুবই সীমিত হয়ে গেছে। কারণ সমাজে অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা মানুষের সংখ্যা আনুপাতিক হারে হ্রাস পেয়েছে। এরই প্রভাব পড়েছে গোটা রাজনীতিতে। এখন রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িকতার ও কলুষমুক্ত করতে হলে প্রয়োজন অসাম্প্রদায়িক আদর্শে বেড়ে ওঠা নেতাকর্মীতে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঢেলে সাজানো। তারাই পারবে ভবিষ্যতের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জটিল কাজটি সম্পন্ন করার দায়িত্ব নেয়ার।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়