সংসদীয় কমিটি ; এক এনআইডিতে পাঁচের বেশি সিম নয়

আগের সংবাদ

ইউপি নির্বাচন : পোস্টারে ছেয়ে গেছে ভোলাহাটের জনপথ

পরের সংবাদ

পুনরাবৃত্তি রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি > আবরার হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন দণ্ডিত ৫

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রকি আহমেদ : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ রাব্বী হত্যাকাণ্ড দেশের সব মানুষকে ব্যথিত করেছে। এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে আর না ঘটে তা রোধকল্পে সব আসামির (২৫) সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত এ মামলায় মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন তিনি। আসামিদের সবাই বুয়েটের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের কর্মী। তাদের মধ্যে ২২ জনের উপস্থিতিতে আদালত এই রায় ঘোষণা করেন; বাকি তিনজন মামলার শুরু থেকেই পলাতক।
বিচারক রায়ে বলেন, আবরারকে মারধর করে হত্যা করার অভিপ্রায়ে আসামিরা ২০১৯ সালের ৪ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে বুয়েটের শেরে বাংলা আবাসিক হলের ক্যান্টিনে এবং পর দিন রাত ১০টার পর হলের গেস্টরুমে দফায় দফায় মিটিং করেন। পরে তারা ৬ অক্টোবর রাত ৮টা থেকে ৭ অক্টোবর ভোর পর্যন্ত শেরে বাংলা হলের ২০১১ ও ২০০৫ নম্বর রুমে আবরার ফাহাদকে চড়, থাপ্পড়, লাথি, কিল, ঘুষি মেরে, কনুই দিয়ে পিঠে, ক্রিকেট স্ট্যাম্প, স্কিপিং রোপ দিয়ে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে একাধিকবার পিটিয়ে ৫০/৬০টি এবং পরবর্তী সময়ে আবারো ৪০/৫০টি মারাত্মক গুরুতর রক্তাক্ত জখমসহ হত্যা করে। তারা শিবির সন্দেহে আবরারের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে তাকে হত্যা করেছে যা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে। তাই রাষ্ট্রপক্ষে ৪৬ সাক্ষীর সাক্ষ্য, ছয়জনের সাফাই সাক্ষী ও সব তথ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধিরি ৩০২/৩৪/১০৯/১১৪ ধারায় সব আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের জোরালো সামঞ্জস্যতার ভিত্তিতে ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলো।
মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামিরা হলেন- মেহেদী হাসান রাসেল, মুনতাসির আল জেমি, খন্দকার তাবাককারুল ইসলাম ওরফে তানভীর, শাদাত ওরফে এ এস এম নাজমুস সাদাত, মিজানুর রহমান ওরফে মিজান, সামছুল আরেফিন রাফাত, শামীম বিল্লাহ, মাজেদুর রহমান ওরফে মাজেদ, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, মনিরুজ্জামান মনির, মেহেদী হাসান রবিন ওরফে

শান্ত, মোজাহিদুর রহমান ওরফে মুজাহিদ, অনিক সরকার ওরফে অপু, মেফতাহুল ইসলাম জিওন, ইফতি মোশাররফ সকাল, এস এম মাহমুদ সেতু, মোর্শেদ ওরফে মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম, মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল জিসান (পলাতক), এহ্তেশামুল রাব্বি ওরফে তানিম (পলাতক) ও মুজতবা রাফিদ (পলাতক)। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাদের গলায় ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়া দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও ইস্যু করা হয়। তারা যে তারিখে ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করবেন কিংবা পুলিশ কর্তৃক ধৃত সেই তারিখ থেকে প্রদত্ত দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হবে রায়ে উল্লেখ করা হয়।
যাবজ্জীবন দণ্ডিত আসামিরা হলেন- মুহতাসিম ফুয়াদ, মোয়াজ ওরফে মোয়াজ আবু হোরায়রা, আকাশ হোসেন, ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না ও অমিত সাহা। তাদের সবাইকে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড ও অনাদায়ে আরো ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তারা সবাই দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় অপরাধ করেছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া ইসতিয়াক আহমেদ মুন্নার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১০৯ ধারা ও অমিত সাহার বিরুদ্ধে ১১৪ ধারায়ও অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে।
এদিকে দণ্ডপ্রাপ্ত ২৫ আসামি ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ এ ধারার সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। রায়ে আরো বলা হয়েছে, জব্দকৃত আলামত বিধি মোতাবেক ধ্বংস করা হোক। আসামিরা ইচ্ছা করলে অত্র রায়ের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন ২০০২ এর ১৪ ধারা অনুসারে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে আপিল দায়ের করতে পারবেন।
রায় ঘোষণার জন্য গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকার কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মামলাটিতে আটক ২২ আসামিকে আদালতে হাজির করে হাজতখানায় রাখা হয়। এরপর আদালত চত্বরে পুলিশের কড়া নিরাপত্তায় সাড়ে ১১টার পর আসামিদের এজলাসে তোলা হয়। ১২টার সময় রায় পড়া শুরু হয়ে ১২টা ২০ মিনিটে শেষ হয়। এ সময় বিচারক দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা ইস্যু করলে সাড়ে ১২টার দিকে আসামিদের এজলাস থেকে নামিয়ে পরে প্রিজন ভ্যানে করে আবার কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় আসামিদের চোখ ছলছল করতে দেখা যায়।
রায় ঘোষণা পর্যন্ত নীরব থাকা আসামিদের প্রিজন ভ্যানে উঠানোর পর কেউ কাঁদতে থাকেন, কেউ চিৎকার করতে থাকেন আবার কেউ স্বজনদের সান্ত¡না দেন। এর মধ্যে আবরারের রুমমেট মিজানুর রহমান মিজান কান্নাকাটি করে চিৎকার করে বলেন, আমি নির্দোষ। আবরার ছিল আমার বন্ধুর মতো। আমি তাকে হত্যা করিনি। আমাকে কেন মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। আরেক আসামি তার মাকে বলেন, মা তুমি ভেঙে পড় না। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই। এ সময় আসামি ও তার স্বজনদের কান্নাকাটিতে আদালত চত্বরে শোকের মাতম ওঠে।
এদিকে রায় ঘোষণার পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তাদের মধ্যে মোশারফ হোসেন কাজল বলেন, বিজ্ঞ বিচারক যে রায় দিয়েছেন আমরা সন্তুষ্ট। এ রায়ের মাধ্যমে যেন আর কোনো শিক্ষার্থী হত্যাকাণ্ডের শিকার না হন সেই ম্যাসেজ যাবে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর রাজনৈতিক দলগুলো নির্যাতন চালায় তাদের জন্যও এ রায় একটি সতর্কবার্তা। আমি অনুরোধ করব, ছাত্রলীগ করলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করতে হবে। ক্ষমতার অপব্যবহার নয়।
অন্যদিকে রায় ঘোষণার পর আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা আদালতে বলেছি, আবরার যে মারা গেছে তার কোনো ডেথ সার্টিফিকেট নেই। এছাড়া এ মামলায় যারা মাস্টার মাইন্ড ছিল তাদের আনা হয়নি। কোনো সিসি টিভি ফুটেজও নেই। মাস্টারমাইন্ড ও বড় ভাইদের নাম জাজমেন্টে আসা উচিত ছিল। আসামিরা যে নির্দোষ তা আমরা প্রমাণ করেছিলাম। তবুও আদালত আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা দিলেন। আমরা রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাব।
মামলার রায়ের পর আবরারের বাবা বলেন, বিচারক যে রায় দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ। এর জন্য সরকার, আইন মন্ত্রণালয়সহ সব বিভাগকে ধন্যবাদ জানাই। তবে এই রায় যেন উচ্চ আদালতে বহাল থাকে। আমার সন্তানকে ফিরে পাব না। কিন্তু এ রায়ে তার আত্মা হয়তো শান্তি পাবে। আমাদের চোখের পানি কখনো শেষ হবে না। আর কোনো বাবাকে যেন ছেলে হারা না হতে হয়।
ঘটনাক্রম : আবরার বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন তিনি। ফেসবুকে একটি পোস্টে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের করা কয়েকটি চুক্তির সমালোচনা করার জেরে শিবির সন্দেহে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর সন্ধ্যার পর আবরারকে শেরে বাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে লাথি, কিল, ঘুষিসহ স্কিপিং রোপ ও ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতনের পর দোতলা ও নিচতলার সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় তাকে অচেতন অবস্থায় ফেলে যায় কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী। ভোরে চিকিৎসক এসে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনার কয়েক দিন পর ২৭ অক্টোবর রাত ৮টা ৩০ মিনিটে নিহতের বাবা বরকত উল্লাহ চকবাজার থানায় বাদী হয়ে ১৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর একই বছরের ১৩ নভেম্বর তদন্তে প্রাপ্ত আরো কয়েকজনকে আসামি করে ২৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। পুলিশের তদন্তে বের হয়, আবরারকে হত্যা করার জন্য দুবারে আসামিরা পরিকল্পনা করে। আর বৈঠকে না থেকেও হত্যার দিকনির্দেশনা দেন বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল এবং সহসভাপতি মুনতাসির ফুয়াদ। এমনকি আবরারের মৃতদেহ তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেলার জন্য বুয়েটের চিকিৎসককে রাসেল চাপ দিয়েছিলেন বলেও তদন্তে উঠে আসে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়