দেয়াল চাপায় শিশুর মৃত্যু : কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে আইনি নোটিস

আগের সংবাদ

বিজয়ী বিদ্রোহীদের ভাগ্যে কী আছে : সিদ্ধান্ত অমান্যকারীরা সাময়িক বহিষ্কার > ১৯ নভেম্বর আ.লীগের সভায় আসতে পারে নতুন সিদ্ধান্ত

পরের সংবাদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধদেব বসু

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৩, ২০২১ , ১:১২ পূর্বাহ্ণ

বাংলায় সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতিতে যাদের সক্রিয় উদ্যোগ এবং অংশগ্রহণে বিংশ শতকীয় আধুনিকতা জেগে উঠেছে তাদের কেন্দ্রীয় অভিভাবক এবং তাদের মধ্যে সর্বাধিক সৃষ্টিকর্মের অধিকারী হলেন বুদ্ধদেব বসু (জন্ম ৩০ নভেম্বর ১৯০৮ কুমিল্লা- মৃত্যু ১৮ মার্চ ১৯৭৪ কলকাতা)। মেধাবী ছাত্র বুদ্ধদেব ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় মেধাক্রমে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। ১৯৩০ সালে অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করলেন, ১৯৩১ সালে এম এ পরীক্ষায় একই ফলাফলের পুনরাবৃত্তি ঘটালেন। ঢাকা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ভাগ্য বুদ্ধদেবকে ধরে রাখতে পারেনি। ১৯৩১-এ কলকাতা চলে গেলেন এবং রিপন কলেজে প্রভাষক পদে যোগ দিলেন। এটিই নতুন নামায়নে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ। ১৯২৭ থেকে ১৯৩১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অবস্থান। তিনি স্মৃতিময় রমনা এবং বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর গদ্যে ও কবিতায় ধরে রেখেছেন। ৪৩ বছর পর তিনি শুনলেন- ‘আর আজ শুনছি বিধ্বস্ত সেই বিদ্যাপীঠ’। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। বুদ্ধদেব বসু ১৯৭১-এ লিখলেন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : ১৯২৮’।
আর আজ শুনছি সে সব রাস্তায় সাঁজোয়া-বাহিনী
আর বন্দুক আর ধ্বংস আর উন্মত্ততা গুঁড়িয়ে
যায় হাজার হাজার ভবিষ্যৎ, আগুন জ¦লে
রক্ত-রঙা প্রচণ্ড।
সত্যি? একি সত্যি হতে পারে?
লম্বা করিডোর গম্ভীর, ঠাণ্ডা ¯িœগ্ধ বইয়ের
গন্ধে ভরা লাইব্রেরি, কমনরুম শব্দমুখর
ফেনিল। ক্লাসে বসে কখনো আসেনি ঝিমুনি
কখনো কোনো সহপাঠিনীর চোখ চঞ্চল, আর
কখনো এক বিশাল স্তব্ধতার ফাঁকে-ফাঁকে
কর্ডেলিয়ার অতি কোমল কণ্ঠস্বর চুইয়ে পড়ে।…
আর আজ শুনছি বিধ্বস্ত সেই বিদ্যাপীঠ। সব
মিনার লুটিয়ে পড়ল মাটিতে সব বই ভস্মীভূত হয়তো,
প্রান্তরগুলি কবরের মতো হাঁ করে আছে-
যৌবন আর স্বাধীন মন আর সুন্দর মহান প্রাচীনতাকে
গ্রাস করার জন্য।
উনিশ বছর বয়সের সে সময় তার কানে কানে বলে যায় ‘অতীত কখনো লুপ্ত হবে না।’
বুদ্ধদেব বসুর সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আধুনিকতার আন্দোলনের তিনিই ছিলেন প্রধান গুরু। বয়স তখন উনিশ কুড়ি একুশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই অশোক মিত্র (১৯১৭-১৯৯৯) বিখ্যাত ভারতীয় অর্থনীতিবিদ বুদ্ধদেব বসুকে যেমন দেখেছেন : যতদিন ঢাকা ছিলাম, বুদ্ধদেব বিভোরতায়ই কেটেছে। উপরে যা বলেছি ঢাকা এবং বুদ্ধদেব উন্মাদনা, আমার স্মৃতিতে দুটো তাই একীভূত (এর আগের অনুচ্ছেদগুলোতে বুদ্ধদেব ও ঢাকা সম্পর্কে ঢের বন্দনা করেছেন তিনি তার আপিলা-চাপিলা গ্রন্থে)। ভালো করে যখন জ্ঞান হলো। প্রগতি ৩৩ দিনে বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু উজ্জ্বলতার রেশটুকু পড়ে আছে ঢাকা শহরে। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হলাম, সাহিত্যের বিশ্লেষণশৈলী শেখাতেন মন্মথনাথ ঘোষ, অমলেন্দু বসু। মনোবিজ্ঞানকে প্রায় সাহিত্য করে নিয়ে বোঝাতেন পরিমল রায়। খুব ঘরোয়া পরিবেশ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, মাস্টারমশাইদের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কে এক আশ্চর্য অদ্ভুত নিবিড়তা; সুতরাং ক্লাসের সকাল-সন্ধ্যা ছুটির দিন জুড়ে আমাদের সম্মিলিত সাহিত্যালোচনা, সে আলোচনার অনেকটা জুড়ে বুদ্ধদেব বসু।
নিজের কথা বুদ্ধদেব লিখলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হলাম তখন থেকে আমার মধ্যে যেন নতুন জীবন এলো।’ তাদের প্রায় সম্পূর্ণ দলটি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং দুজন ছাড়া সবাই জগন্নাথ হলের সঙ্গে সংযুক্ত। তারা তখন হাতের লেখা ‘প্রগতি’ বের করতেন। বুদ্ধদেবের আইএ পরীক্ষায় বৃত্তি নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর সিদ্ধান্ত হলো ছাপার হরফে প্রগতি বের হবে। ১০ টাকা করে ১০ জনের ১০০ টাকা চাঁদায় টায়েটুয়ে পত্রিকা বের করা সম্ভব- এতদিন বুদ্ধদেবের চাঁদা নিয়েই আশঙ্কা ছিল, কিন্তু বৃত্তি সে আশঙ্কা ঝেরে ফেলে দিল- ‘দারুণ উত্তেজনা, জল্পনা, আলোচনা, কিছুদিনের পরম সুখকর পরিশ্রমের পর শেষটায় একদিন, আষাঢ়ের এক শুভদিনে শীত মলাটে ঊর্ধ্বমুখী নারীমুণ্ডের প্রতিকৃতিযুক্ত হয়ে সত্যি সত্যি একদিন ছাপার অক্ষরে প্রগতি বেরুলো।’
প্রগতির প্রকাশ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের ছাত্র হয়ে বুদ্ধদেব বসুর আত্মপ্রকাশ- দুই-ই ঘটল একই সময়ে, একই মাসে- ‘আশ্চর্যরকম পরিপূর্ণ’ হয়ে উঠল তার জীবন। প্রগতির প্রথম সংখ্যার পরই ১০ জন উদারদাতা ছিটকে পড়লেন, রায় পেলেন কেবল দুজন- এক সময় প্রগতি বের করার শখ মিটে গেল, মধ্যপথে প্রগতির গতি থেমে গেল। ততদিনে জীবনের চাকা মনের ওপর দাগ কাটতে শুরু করেছে।
অমলেন্দু বসু ইংরেজির ছাত্র ১৯২৬ থেকে, পরে শিক্ষক। তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বুদ্ধদেব বসুকে কেন্দ্র করে আমাদের একটা সাহিত্যচক্র ছিল। সে আমাদের কী উন্মাদনা, কী নেশা! ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকেই আমরা গিয়ে মিলতাম আদিত্যের দোকানে…এবং কয়েক ঘণ্টা বসে চা এবং সিগারেটের মাদকতা সংযোগে কত যে সাহিত্যিক আলোচনা এবং বিতর্ক হতো- রুশ নরোয়েজীয়, ফরাসি, জার্মান নাটক ও উপন্যাসের অনুবাদ, সবুজপত্র প্রবাসী কল্লোল, কালিকলম, প্রগতি, ধূপছায়ার আলোচনা। আলোচনার বিষয়ের অন্ত ছিল না। মনে হতে পারত এই বাউণ্ডুলে ছেলেগুলো কি লেখাপড়া করে না? কিন্তু আমাদের এই ক্ষুদ্র সাহিত্যগোষ্ঠীতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম পদ অধিকার করা একটা প্রায় সার্বজনিক ঘটনা ছিল।’ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হলাম, তখন থেকে আমার মধ্যে নতুন জীবন এলো।’ বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, কার্জন-কল্পিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হিসেবে তৈরি হয়েছিল রমনা- অনেকের মুখে তখন নামও ছিল ‘নিউ টাউন’। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমলে এখানেই অধিষ্ঠিত ছিল ঢাকা কলেজ। বঙ্গভঙ্গ ভেস্তে যাওয়ার প্রায় দেড় দশক পরে সেই পুরনো বিদ্যাপীঠকে কেন্দ্র করে স্থাপিত হলো নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয়- নবনির্মিত অব্যবহৃত হলসমূহ প্রাণপ্রাপ্ত হলো। রেললাইন থেকে শহরের উত্তরতম প্রান্ত পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি; (উত্তরের অংশে সরকারি কর্তাব্যক্তিদের বাসভবন, সাধারণের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ, মদ্যবিলাসী ও বলনৃত্যপ্রিয় শ্বেতাঙ্গ রাজপুরুষ ও বণিকদের ঢাকা ক্লাব, মাঝখানে ঘোড়দৌড়ের মাঠ কালীমন্দির) কিন্তু দক্ষিণ অংশটি পুরোপুরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকারভুক্ত…।’
বুদ্ধদেব বসুর বর্ণনা অননুকরণীয়- ‘ভিতরের জমকালো এক ব্যাপার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নিখিল বাংলার একমাত্র উদ্যান-নগরে পনের-কুড়িটি অট্টালিকা নিয়ে ছড়িয়ে আছে তার কলেজ বাড়ি, ল্যাবরেটরি, ছাত্রাবাস, আছে ব্যায়ামাগার ও জলক্রীড়ার জন্য পুষ্পরিণী- যেখানে সেখানে সবুজ মাঠ বিস্তীর্ণ। ইংল্যান্ড দেশীয় পল্লী-নিবাসের মতো ঢালু ছাদের এক একটি দোতলা বাড়ি-নয়ন-হরণ, বাগানসম্পন্ন, সেখানে কর্মস্থলের অতি সন্নিকটে বাস করেন আমাদের প্রধান অধ্যাপকরা; অন্যদের জন্যও নীলক্ষেতে ব্যবস্থা অতিসুন্দর। স্থাপত্যে কোনো একঘেয়েমি নেই, সরণি ও উদ্যান রচনায় নয়াদিল্লির জ্যামিতিক দুঃস্বপ্ন স্থান পায়নি। বিজ্ঞান ভবনগুলো আরক্তিম ও তুর্কি শৈলীতে জাফারখচিত, মিনারশোভন, অন্যান্য বিভাগ স্থান পেয়েছে একটি সরল ছাদের বহুপক্ষযুক্ত দীর্ঘাকার শাদা দোতলার একতলা- সরকারি সেক্রেটারিয়েট হওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল বাড়িটি। সর্বত্র প্রচুর স্থান ঘেঁষাঘেঁষি ঠেলাঠেলি : কোনো কথাই উঠে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো সম্পর্কে বলেছেন, আক্ষরিক অর্থে পুরোটা আবাসিক না হলেও গড়নটা কিছুটা সে ধরনের। ‘যেসব ছাত্র স্বগৃহবাসী তাদেরও সংলগ্ন থাকতে হয়, কোনো না কোনো হল বা হোস্টেল তাদের প্রাচীরাতিরিক্ত ক্রিয়াকর্মের সেটাই হলো ঘটনাস্থল। সেখানে আছে আলাদা আলাদা গ্রন্থাগার ও রঙ্গালয় ও নানান ধরনের খেলার ব্যবস্থা; অনুষ্ঠিত বিতর্কসভা, সংগীত প্রতিযোগিতা, বার্ষিক ভোজ ও আরো অনেক সময়োচিত অধিবেশন; সেখানকার নাট্যাভিনয় দেখতে নগরবাসী সোৎসাহে সমবেত হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কমনরুমের কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন : ‘বিশ্ববিদ্যালয় খাশমহলে মনোরঞ্জনী উপচার ছিল। মনে পড়ে ছাত্রদের কমনরুমটিতে প্রথম ঢুকে চমকে গিয়েছিলাম, আমাদেরই বিশ্রামের জন্য এই ব্যবস্থা, যা প্রায় বিশ্বাস করতে পারিনি।’ দুটি বিশালায়তন কামড়া, প্রধান কক্ষে সারি সারি আরাম কেদারা, টেবিলে ছড়ানো সম্ভ্রান্ত সব বাংলা সাময়িকী, ‘পাঞ্চ থেকে রিভিউ অব রিভিউজ পর্যন্ত রং-বেরঙের লন্ডনি চালান- দুই ক্লাসের মধ্যবর্তী পঞ্চান্ন মিনিট চমৎকার কেটে যায় সেগুলো উল্টে-পাল্টে।’ যাদের বিনোদনের প্রকৃতি ভিন্ন তাদের জন্য দেয়াল ঘেঁষে তাসের টেবিল, দাবার ছক, পাশের ছোট কক্ষে পিংপঙ খেলার ব্যবস্থা।
‘সিগারেটখোর’ বুদ্ধদেব বসু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সুবিবেচনার প্রশংসা করেছেন কারণ আড্ডা-গল্প-সিগারেট চালিয়ে যাওয়া ছেলেদের সুবিধার জন্য যথেষ্টসংখ্যক ছাইদানও তারা সরবরাহ করেছে। এই কমনরুমে বসেই বুদ্ধদেব বসু প্রবাসীতে ধারাবাহিক প্রকাশিত শেষের কবিতা আর বিচিত্রায় প্রকাশিত যোগাযোগ (প্রথম দু’কিস্তির নাম ছিল তিন পুরুষ)। কমনরুমের পাশের একটি রুমে ছাত্রদের পরিচালিত ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি জার্নাল কার্যালয়; সেখানে ইংল্যান্ডের কিছু ‘উঁচু কপালে এবং আধ উঁচু কপালে’ পত্রিকাও তার নজরে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধদেব ও তার বন্ধুদের দ্বিতীয় রদেডু আদিত্যর দীনহীন চায়ের দোকান- টিনের চাল, দর্মার বেড়া, মলিন টেবিল, ন্যাড়া টুল- সারা তল্লাটে এটিই একমাত্র চায়ের দোকান। ভোজ্য তালিকায় হাঁসের ডিমের মামলেট টোস্ট-রুটি ‘বিরল শুভদিনে’ আলুর শিঙ্গাড়া, কোনো কোনো দিন আদিত্যর নিজের হাতে তৈরি মিস্টান্ন, চা অবিরাম। কখনো ছুটির ঘণ্টার পর কখনো ক্লাস পালিয়ে সেখানে মিলিত হচ্ছেন বুদ্ধদেব, টুনু (পরবর্তীকালে বিখ্যাত কবি অজিত দত্ত), অমল, পরিমল এবং আরো কেউ কেউ। খাবারের দাম দেয়ার জন্য পকেট হাতড়াবার প্রয়োজন হতো না, লিখে রেখো বললেই হতো। ‘এই আদিত্য এবং আমার পুরানা পল্টনের মুদিখানায় সিগারেটের দেনা সম্পূর্ণ শোধ না করেই আমি ঢাকা ছেড়েছিলাম…’ এ জন্য বহু বছর পরও বুদ্ধদেব বসু অনুশোচনা করেছেন। বুদ্ধদেব বসু তার সময়ের ছাত্রীদের কথাও লিখেছেন- যেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক- ‘তারা অবকাশের প্রতিটি মিনিট যাপন করেন তাদের পর্দায়িত বিশ্রাম-কক্ষে, অধ্যাপকদের নেতৃত্ব ছাড়া সেখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হন না।’ ছাত্রীদের পশ্চাৎবর্তী করে ক্লাসে নিয়ে যান এক এক জন অধ্যাপক, ক্লাস শেষে একই কায়দায় নির্বিঘেœ পৌঁছে দেন কমনরুমে। ক্লাসে ছাত্রদের কাছ থেকে বেশ দূরত্বে পৃথক তাদের বসার ব্যবস্থা। ‘সেখানে তারা চক্ষু নত করে রাখেন পুঁথির ওপর কোনো প্রশ্ন করেন না। অধ্যাপককে পাঠ্যবিষয়ে হাসির কথা থাকলে তাদের গাম্ভীর্যে টোল পড়ে না।’
বুদ্ধদেব তার চার বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে (১৯২৮-১৯৩১) প্রকাশ্য ছাত্রীকণ্ঠ একবার মাত্র শুনেছিলেন- মেয়েদের জন্য আয়োজিত একটি সংগীত প্রতিযোগিতায়। অবশ্য তিনি এটা বলেছেন ছাত্র ও ছাত্রীদের বিভাজক দেয়ালটি পুরোপুরি নীরন্ধ্র ছিল মনে করাটা ভুল হবে। বেয়ারার হাতে চিরকুট পাঠিয়ে কোনো বাসন্তী সেন বা অমিতা চন্দর সঙ্গে দু’এক মিনিট অর্থহীন কথা শোনা ও বলা যেত।
বুদ্ধদেব রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করেছেন, ‘আমরা জন্মেছিলেম স্ত্রীলোকহীন জগতে’- এই সত্যটি রবীন্দ্রনাথের প্রায় পৌত্রের বয়সী বুদ্ধদেবদের বেলাতেও সত্যি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার পথে তার চোখে পড়েছে মন্দচরণে হাঁটা, এলোমেলো চুলের বিজ্ঞানী সত্যেন বসু, সোনালি চশমাপরা সতর্ক সাইকেল চালক ডক্টর সুশীল কুমার দে, দ্রুত ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপে হেঁটে যাওয়া রমেশচন্দ্র মজুমদার; বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে লাজুক শিক্ষক ইংরেজির সত্যেন্দ্রনাথ রায়; সাইকেল থেকে মেসে নিজের ছাত্রকে দেখে বিব্রত হয়ে বলেন, ‘এই যে বুদ্ধু, ভালো আছো?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি সারাংশ নিজেই প্রণয়ন করেছেন, আকাশবাণীর এক কথিকায় বলেছেন : ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯২৭ সালে। ১৯৩১ সালে এমএ পাস করে কলকাতায় চলে আসি। এই ৪ বছরে আমি মনের দিক থেকে এমন বেগে বেড়ে উঠেছিলাম যে, পরে ভাবলে মনে হয়েছে যেন ৪ বছরের ব্যাপার নয়, যেন আমার জীবনের সেই অধ্যায় অনেক বেশি দীর্ঘ। যেন কানায়-কানায় ঘটনায় ভরা, প্রতিটি দিন কোনো না কোনো অভিজ্ঞতায় আন্দোলিত। (ভূঁইয়া ইকবালের গ্রন্থ বুদ্ধদেব বসু থেকে সৈয়দ, আবুল মকসুদের ঢাকায় বুদ্ধদেব বসুতে উদ্ধৃত) বুদ্ধদেব বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই নির্বাচন এসে যায়, তিনি নির্বাচনের প্রতি আগ্রহী কেউ নন। বরং নিরাসক্তই ছিলেন। বক্তৃতাপটু নেতৃস্থানীয় ছাত্র সুধাংশু বিকাশ রায় চৌধুরী বুদ্ধদেবকে ধরে তার দল থেকে সাহিত্য সম্পাদক পদে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিলেন এবং ‘সুধাংশু বিকাশের বুদ্ধি বাগ্মিতার জোরে আমি যখন এই ভোটাভুটি খেলায় জিতেও গেলাম তখন ব্যাপারটা হয়ে উঠল আমার পক্ষে বিশুদ্ধ একটি বিড়ম্বনা।’ বুদ্ধদেব বলেছেন, কমিটি, সাব-কমিটি, সংবিধান, আইন-কানুন সভা-সমিতি- এর কোনোটিই তাকে আকৃষ্ট করেনি, সুতরাং তিনি পদ-সর্বস্ব হয়েই থাকলেন, ক্ষমতা প্রয়োগ করলেন না; তবে একটি কাজে মন দিয়েছিলেন, সে বছর জগন্নাথ হলের বার্ষিক পত্রিকা বাসন্তিকা’র শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল ।
ভবতোষ দত্ত সৈয়দ আবুল মকসুদকে বলেছেন, ‘ঢাকাকে কলকাতার লোকদের মতো তিনিও মনে করতেন মফস্বল।’ সুতরাং মহানগরী কলকাতার টান ছিল অনুপেক্ষণীয়।
কিন্তু মেধাবী বুদ্ধদেবের দুর্ভাগ্য, ঢাকার ডাবল ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট কলকাতা ভালো চোখে দেখেনি, এমনকি তার হিন্দু নামও কাজে আসেনি। কলকাতায় ডাবল ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট-এর যে চাকরি ও মর্যাদা তার পাওয়ার কথা তা পাননি। তাতে বরং ভালোই হয়েছে, তিনি পরিপূর্ণ বুদ্ধদেব বসু হয়ে উঠেছেন।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়