এম কে রানা, বরিশাল থেকে : দলের নীতিমালা উপেক্ষা করে যুগ্ম মহাসচিব এড. মজিবর রহমান সরোয়ার একাধিক পদ দখলে রাখায় অনেক ত্যাগী নেতাকর্মীরা এতদিন কোণঠাসা হয়েছিলেন। সর্বশেষ গত ১২ সেপ্টেম্বর দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বরিশালের বিভিন্ন শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টার ওই বৈঠকে বরিশালের তিন কমিটির নেতাদের সঙ্গে কথাও বলেন তারেক। বৈঠকের পরপরই গুঞ্জন উঠেছিল বরিশাল বিএনপির রাজনীতিতে এড. মজিবর রহমান সরোয়ারের একক আধিপত্যের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার বরিশাল মহানগর, জেলা (উত্তর) ও জেলা (দক্ষিণ) কমিটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই গুঞ্জনের অবসান ঘটল।
সূত্রমতে, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বিএনপির রাজনীতিতে নাম লেখান এড. মজিবর রহমান সরোয়ার। এরপর বরিশাল জেলা শ্রমিক দলের সভাপতি পদ বাগিয়ে নেন। ১৯৯০ সালে বরিশাল নগরীর কাউনিয়া টেক্সটাইল মিলে শ্রমিক নেতা সালামকে গুলি করে হত্যা মামলার প্রধান আসামি হয়ে আত্মগোপন করেন সরোয়ার। একই বছর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন হলে বরিশাল বিএনপিতে সরোয়ার যুগের সূচনা হয়। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে।
রাজনৈতিক সূত্রমতে, ২০০৩ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে সরোয়ারের মনোনয়ন নিশ্চিত হলে সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামাল ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এবায়েদুল হক চাঁন বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে প্রায় আট বছর দলের বাইরে ছিলেন। ২০১০ সালে এবায়েদুল হক চাঁন দক্ষিণ জেলায় পদ পেলেও দক্ষিণ ও উত্তর দুটি জেলা কমিটিই নিয়ন্ত্রণ করতেন সরোয়ার। আর আহসান হাবিব কামাল দলে ফিরলেও হারানো মহানগর সভাপতি পদ আর ফিরে পাননি। তিনি ২০১৩ সালে সিটি মেয়র নির্বাচিত হলেও দলে তার অবস্থান পোক্ত করতে পারেননি সরোয়ারের দাপটে। সরোয়ারের একক নেতৃত্বের কারণে কোণঠাসা হয়ে নব্বই দশকের ছাত্রদল নেত্রী বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস আক্তার শিরিন ঢাকায় গিয়ে কেন্দ্রের রাজনীতিতে জড়ান। এদিকে বিগত

এক দশকে দলীয় বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচিতে তেমন একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব এড. মজিবর রহমান সরোয়ার। কারণ হিসেবে জানা যায়, দলে তার একক আধিপত্যের কারণেই নেতাকর্মীরা এখন আর তার কাছে ঘেঁষেন না।
ঝিমিয়ে পড়া বরিশাল বিএনপিকে চাঙ্গা করতে বরিশাল মহানগরসহ তিনটি সাংগঠনিক কমিটি গঠনে শীর্ষ পদের জন্য স্থানীয় ১৮ নেতার তথ্য নেয় দলের হাইকমান্ড। গত ১২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার বরিশাল অঞ্চলের সাংগঠনিক নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল সভা করে শীর্ষ পদপ্রত্যাশী নেতাদের তথ্য সংগ্রহ করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জানা গেছে, ওই বৈঠকে দলের কার্যক্রমে অসন্তোষ প্রকাশ করে দলের হাইকমান্ড। এমনকি দেশের অন্য বিভাগের তুলনায় এ বিভাগে সাংগঠনিক কার্যক্রম কেন পিছিয়ে, তাও জানতে চান তারেক রহমান। এমনকি দলীয় কোন্দলকে উসকে দেয়ার জন্য দলের শীর্ষ নেতারা ক্ষোভও প্রকাশ করেন। এর পরপরই গুঞ্জন ওঠে বরিশাল বিএনপির রাজনীতিতে সরোয়ার যুগের অবসান হচ্ছে। গত বুধবার কেন্দ্রীয় বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক মোহম্মদ মুনির হোসেন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বরিশাল মহানগর এবং দক্ষিণ ও উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠনের বিষয়টি প্রকাশের মধ্য দিয়ে সেই গুঞ্জনের অবসান হলো। কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি মনিরুজ্জামান ফারুককে বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক করা হয়েছে। এছাড়া আইনজীবী আলী হায়দার বাবুল সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এবং সদস্য সচিব করা হয়েছে মহানগর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মীর জাহিদুল কবির জাহিদকে। দক্ষিণ জেলা কমিটিতে সাবেক ছাত্রনেতা মজিবর রহমান নান্টুকে আহ্বায়ক এবং আকতার হোসেন মেবুলকে সদস্য সচিব হিসেবে রাখা হয়েছে। উত্তর জেলা কমিটিতে দেওয়ান মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে আহ্বায়ক এবং গৌরনদী পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান মুকুলকে সদস্য সচিব করা হয়েছে।
নবগঠিত তিন কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন- আলোচনায় থাকা দলের যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক মেয়র মজিবর রহমান সরোয়ার, দীর্ঘদিন সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়া ৫৩ মামলার আসামি মহানগর বিএনপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জিয়া উদ্দীন সিকদার জিয়া, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবায়েদুল হক চাঁন ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম শাহীন, উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও এমপি মেজবাহউদ্দীন ফরহাদ এবং ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমানসহ অনেক নেতা।