দেশে ২ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৮৪৬

আগের সংবাদ

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে সেমিতে অস্ট্রেলিয়া

পরের সংবাদ

বাজার অস্থির দিশাহারা মানুষ : নিত্যপণ্যের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় আরেক দফা বাড়বে

প্রকাশিত: নভেম্বর ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৬, ২০২১ , ১২:৩১ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : জীবনযাত্রার ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতি দিয়ে চলতি বছর শুরু হয়েছিল। এরপর চাল, ডাল, আটা, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। ৮৫ থেকে ১০৫ টাকার সয়াবিন তেলের দাম কয়েক দফায় বাড়িয়ে প্রতি লিটার ১৬০ টাকায় নেয়া হয়। ৪০-৪৫ টাকার পেঁয়াজ ঠেকেছে ৬০-৭০ টাকায়। জীবনধারণে অন্যান্য পণ্য ও সেবার দামও এ সময় বেড়েছে। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় জনজীবনে মারাত্মক চাপ পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এতে পরিবহন ও কৃষি ব্যয় বাড়বে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব পড়েছে দেশীয় বাজারে। এ বছরে ‘আপাতত’ দাম কমে আসার সম্ভাবনা কম বলে মনে করেন তারা।
অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণকারী সংগঠনগুলো বলছে, জ্বালানি তেলের বাড়তি দামের প্রভাবে পরিবহন ব্যয় ও পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়লেও এতে উদ্যোক্তা বা পরিবহন মালিকদের কোনো ক্ষতি হবে না। তারা দাম বাড়িয়ে নিজেদের খরচ ঠিকই সমন্বয় করে নেবেন। ফলে শেষ পর্যন্ত জ্বালানির বাড়তি দামের খেসারত সাধারণ মানুষ অর্থাৎ ক্রেতা-ভোক্তাকেই দিতে হবে। তাদের আনুপাতিক হারের চেয়েও বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে এবং সেবা নিতে হবে, যা আসলে জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যধিক বাড়াবে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে দেশে বেসরকারি সংগঠন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০ অনুযায়ী, দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ, যা ২০১৯ সালে ছিল ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং পণ্য ও সেবামূল্যের হার ছিল ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ, যা আগস্টে ছিল ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এ সময় খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ২১ শতাংশ, যা আগস্টে ছিল ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। এছাড়া খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতিও বেড়ে দাঁড়িয়েছে

৬ দশমিক ১৯ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে গতকাল শুক্রবার দেখা যায়, সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে সবজির সরবরাহ বাড়লেও দাম কমার লক্ষণ নেই। তেল, চিনি, ডাল, আটা, ময়দাসহ নিত্যপণ্যের দাম আগে থেকেই বাড়তি রয়েছে। আগামী ৭ নভেম্বর থেকে সরকারিভাবে আমন ধান ও চাল কেনা শুরু হবে। অর্থাৎ আমন ধান উঠেছে কৃষকের ঘরে। বাজারে নতুন চালও আসছে কিছু কিছু, কিন্তু চালের দাম নামেনি। গত বছরের তুলনায় বেশি রয়েছে ১০ শতাংশ। তেল, চিনি, ডালের দাম এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। ভোজ্যতেল সয়াবিনের দাম বেড়ে প্রতি লিটার ১৬০ টাকায় উঠেছে। তেলের দাম গত বছরের তুলনায় বাড়তি রয়েছে ৪৭ শতাংশ। প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮২ টাকায়। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত এক সপ্তাহে আটা, ময়দা, তেল, এমএস রডসহ আট ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। তবে ১৪ ধরনের পণ্যের দাম কমেছে। কিন্তু জ্বালানি তেল ইস্যুতে এ চিত্র উল্টে যেতে পারে বলে ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আলুর দাম কেজিতে ছিল ২৫ থেকে ২৮ টাকা। ভারতীয় রসুন কেজিতে ১৪০ টাকা, দেশি রসুনের কেজি ৮০ থেকে ৯০ টাকা, বিদেশি আদা কেজিপ্রতি ১৪০ টাকা, দেশি আদা কেজিতে ৮০ থেকে ১০০ টাকা, দেশি পেঁয়াজ কেজিতে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কাঁচামরিচের কেজি ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা, বরবটি ৯০ থেকে ১০০ টাকা, বাঁধাকপি প্রতিটি ৪০ টাকা, গাজর ও টমেটোর কেজি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। কেজিপ্রতি কুমড়া ৪০ টাকা, বেগুন ৭০ থেকে ৮০ টাকা, কচুরমুখি ৪০ টাকা, শসা ৫০ থেকে ৭০ টাকা। এছাড়া প্রতিটি লাউয়ের দাম ৪০ থেকে ৬০ টাকা। মাছের বাজারে দেখা গেছে, আকারভেদে রুই মাছের কেজিপ্রতি দাম ২৭০ থেকে ৩৮০ টাকার মধ্যে চাওয়া হচ্ছে। পাঙ্গাশের দাম ১৫০ এর নিচে। পোয়া মাছ ও ট্যাংরা বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩২০ টাকা প্রতিকেজি।
কিছুটা কমেছে ব্রয়লার মুরগির দাম। শুক্রবার কেজিপ্রতি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায়। এছাড়া লাল লেয়ার ২২০ টাকা ও সোনালি ৩০০ থেকে ৩১০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। গরুর মাংস ৬০০ টাকা ও খাসির মাংস ৯০০ টাকা টাকায় বিক্রি হয়েছে। মুরগির দাম কমার বিষয়ে কাওরানবাজারের ব্যবসায়ী মো. আলি বলেন, বাজারে আমদানি (সরবরাহ) বেড়েছে তাই দাম কমেছে। সামনে আরো কমতে পারে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে, তাই সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়িয়েছে। তবে, ডিজেল যেহেতু এনার্জি সোর্স, কাজেই দাম বাড়ার ফলে মূল্যস্ফীতি হবে; পরিবহন, কৃষিসহ সব ক্ষেত্রেই খরচ বেড়ে যাবে। সব মিলিয়ে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ায় ভোক্তাপর্যায়ে প্রভাব ফেলবে এবং মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরেক দফা ঊর্ধ্বমুখী হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যবিত্তের বাজার করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই সরকারের উচিত হবে বাজার তদারকি আরো জোরদার করা। যাতে কেউ কারসাজি করতে না পারে। তিনি বলেন, করোনার কারণে দেশের সাধারণ মানুষের আয়ের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছে, অনেকের ব্যবসাও বন্ধ হয়েছে। ফলে আয় কমে এসেছে দেশের একটি বড় অংশের মানুষের। মির্জা আজিজ বলেন, নি¤œবিত্ত বা দারিদ্র্যসীমার নিচে এবং দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি যারা আছেন, সরকারের উচিত তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সহযোগিতা করা। সেখানে প্রয়োজনে বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং এগুলো যাতে সুষ্ঠুভাবে বিতরণ হয় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
করোনা ভাইরাসের কারণে অর্থনীতির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের আয়ের ওপরও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেকের ব্যবসাও বন্ধ হয়েছিল। ফলে আয় কমেছে দেশের একটি বড় অংশের মানুষের। এর বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টার মধ্যেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় জনজীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ। রাজধানী ঢাকার কাওরানবাজারের আলু ও পেঁয়াজ বিক্রেতা মনির বললেন, বাজারের যা অবস্থা, তাতে কাল-পরশু হয়ত এর চেয়ে চার-পাঁচ টাকা বেশি লাগতে পারে দাম। সুতরাং এখন যে দাম নিচ্ছি এটাই কম। মালিবাগ বাজারে কথা হয় ক্রেতা রহিমের সঙ্গে। মধ্যবিত্ত পরিবারের এ সদস্য বলেন, প্রতিবারই জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বাজারে এর সরাসরি প্রভাব পড়ে। কারণ তেলের দাম বাড়লে বিদ্যুৎ, পানি, পরিবহন ব্যয় বাড়ে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়ে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় যতটা উৎপাদন বাড়ে পণ্যের দাম বাড়ে তার দ্বিগুণ, যা সরকার মনিটর করতে পারে না। ঢাকার কারওয়ানবাজারে নিয়মিত বাজার করেন রাহেলা খাতুন। তিনি বলেন, এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। সব দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণ করে বেড়েছে। কমার কোনো ল²ণও তো দেখি না। এখন আবার যোগ হয়েছে তেলের বাড়তি দামের অজুহাত।
কনজিউমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, এমনিতেই নিত্যপণ্যের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিশেষ করে ভোজ্যতেল, চাল, চিনি, সবজির দামের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকায় নাভিশ্বাস। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন করে জ্বালানি তেলের বাড়তি দাম। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দামও দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। অস্বাভাবিক বেড়েছে ডলারের দামও। কয়েক দিন আগে সীমিত আয়ের মানুষের ভরসাস্থল টিসিবির পণ্যের দামও বাড়ানো হয়েছে। এ অবস্থায় কেরোসিন ও ডিজেলের দাম বাড়ানোতে ভোক্তাপর্যায়ে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়