সম্প্রীতির জমিনে শকুনের চোখ

আগের সংবাদ

ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান এখন ‘মেটা’

পরের সংবাদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রন্থিত ইতিহাস : পণ্ডিত বিদায়

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২৯, ২০২১ , ১১:৫৮ অপরাহ্ণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনাকাল ১৯২১-১৯৫২ পর্যন্ত ৩১ বছরের যে অগ্রন্থিত ইতিহাস বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক, ঐতিহাসিক ও গবেষক রতন লাল চক্রবর্তী প্রণয়ন করেছেন এবং তার যথেষ্ট শ্রমের স্বাক্ষর নিয়ে বইটি ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে। লেখক করোনাকালে ১ ডিসেম্বর ২০২০ প্রয়াত হয়েছেন, ৭১ বছর বয়সে। বইটির বিভিন্ন অধ্যায়ের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ রয়েছে, একই সঙ্গে যেসব তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে তা যথার্থ নয় বলার সুযোগও খুবই কম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে এ বইটি আলোচিত হওয়ার দাবি রাখে।
১৯৪৫-১৯৫৫-এর মধ্যে যেসব শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে ভারতে চলে গেছেন, তাদের তালিকাটিই বলে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রেক্ষাপটে রয়েছে ১৯৪৬-এর দাঙ্গা, ১৯৪৭-এর ভারত ভাগ, চাকরি ও জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করা রতন লাল প্রণীত বিভাগভিত্তিক তালিকা :
ইংরেজি
ড. পি কে গুহ, ড. এস এন রায়, ড. অ্যারনসন, চারুপমা বসু, এ বি চক্রবর্তী, এ্যানি জেরাল্ডাইন স্টক।
বাংলা
মোহিতলাল মজুমদার, ড. মনমোহন ঘোষ, ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বিশ্বরঞ্জন ভাদুড়ী, হরনাথ পাল, গণেশচরণ বসু।
ইতিহাস
ড. কালিকারঞ্জন কানুনগো, জ্যোতির্ময় সেন, ড. ধীরেন্দ্র চন্দ্র গাঙ্গুলী, সুধীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ড. শশীভূষণ চৌধুরী, পৃত্থীশচন্দ্র চক্রবর্তী, সুশীল কুমার চৌধুরী।
সংস্কৃত
ড. সুশীল কুমার দে, ড. পি সি হাজরা।
অর্থনীতি
ড. এইচ এল দে, ড. পরিমল রায়, ড. বি কে সাহা, কে সি মুখার্জি, ভবতোষ বারুড়ী, এস ভি আয়ার, ভারতল²ী মুখোপাধ্যায়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান
ড. অবনী ভূষণ রুদ্র, ড. ধীরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, ড. এ কে ঘোষাল, এ কে সেন।
দর্শন
হরিদাস ভট্টাচার্য, ক্ষীরোদচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বি এন রায়, নরহরিদাস বসাক।
রসায়ন
ড. যোগেন্দ্রকুমার চৌধুরী, আর এল দে, ড. কে পি বসু, ড. আর এম পুরকায়েস্থ, ড. আশুতোষ সেন, ড. এম সি নাথ, অমৃতারেণু ঘোষ, এস কে মিত্র, এন সি চক্রবর্তী, সত্যপ্রসাদ রায় চৌধুরী।
গণিত
ড. টি বিজয় রাঘবন, নলিনী মোহন বসু, জ্যোতির্ময় ঘোষ।
জীববিদ্যা
ড. পি মহেশ্বরী।
বাণিজ্য
জওহর লাল গুহ, মতিনউদ্দীন খান।
গ্রন্থাগার
মনোরঞ্জন রায়।
অশনাক্তকৃত
সাতজনকে শনাক্ত করা যায়নি। ড. এস এন সরকার, ড. টি এন সেন, ড. পি কে দে, ড. এন কে চট্টোপাধ্যায়, ডিপি ব্যানার্জী, এন আর রায় ও এইচ এন দত্ত।
কেবল ১৯৫০ সালের এপ্রিলের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১৬ শিক্ষক ভারতে চলে যান। এ বছর ফেব্রুয়ারির দাঙ্গায় বাংলা বিভাগের একজন শিক্ষক ছুরিকাহত হন এবং অর্থনীতির একজন শিক্ষকের বাড়ি লুট হয়। এটাও স্বীকার্য, উঁচু পর্যায়ের না হলেও অন্তত সমপর্যায়ের পদে সমপর্যায়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কেউ কেউ চাকরির তল্লাশি করছিলেন। কেউ কেউ উচ্চপদে উচ্চ বেতনে চাকরি পেয়েও ছিলেন।
ফেব্রুয়ারিতেই হিন্দু শিক্ষকদের অনেকেই পরিবার পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতের অন্যত্র নিরাপদ স্থানে রেখে আসার উদ্দেশ্যে কেউ ব্যক্ত করে, কেউ অব্যক্ত রেখে ছুটি প্রার্থনা করেন। কিন্তু তখনকার বিধান অনুযায়ী সাত দিনের বেশি ছুটি মঞ্জুর করা যেত না। সুতরাং বারবার ছুটি বাড়ানোর আবেদন জমা পড়ত। এসব ক্ষেত্রে যেমন হওয়ার কথা তাদের পূর্ব স্বাক্ষরিত আবেদন কোনো না কোনো শুভানুধ্যায়ী জমা দিয়ে থাকবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পর্ষদের ২২ এপ্রিল ১৯৫০-এর সভায় যাদের ছুটি বৃদ্ধির আবেদন মঞ্জুর করা হয় রতন লাল চক্রবর্তী তাদের নামের তালিকাটি উপস্থাপন করেছেন :
১. চারুপমা বসু, প্রভাষক, ইংরেজি
২. এ বি চক্রবর্তী, প্রভাষক ইংরেজি
৩. ড. আর সি হাজরা, রিডার, সংস্কৃতি
৪. বি আর ভাদুড়ী, প্রভাষক, বাংলা
৫. হরনাথ পাল, প্রভাষক, বাংলা
৬. ড. বি এন রায়, রিডার, দর্শন
৭. নরহরিদাস বসাক, প্রভাষক, দর্শন
৮. ড. পৃত্থীশচন্দ্র চক্রবর্তী, রিডার, ইতিহাস
৯. এস ডি আয়ার, রিডার, অর্থনীতি
১০. কে সি মুখার্জি, প্রভাষক, অর্থনীতি
১১. এন আর রায় (পদ ও বিষয়ের উল্লেখ নেই)
১২. ড. ডি পি মুখার্জি (পদ ও বিষয়ের উল্লেখ নেই)
১৩. এইচ এন দত্ত (পদ ও বিষয়ের উল্লেখ নেই)
১৪. জওহর লাল গুহ, প্রভাষক, বাণিজ্য
১৫. ড. এস কে মিত্র, প্রভাষক, রসায়ন
১৬. ড. এন সি চক্রবর্তী, প্রভাষক, রসায়ন
শেষ পর্যন্ত এই তালিকার সকলেই ভারতে চলে গেছেন। তালিকার প্রথম নাম চারুপমা বসু ইংরেজি মেধাবী ছাত্রী, বুদ্ধদেব বসুর ক্লাসমেট ছিলেন। তিনিই ওমেন্স হোস্টেলের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক। ইংরেজির পি কে গুহ থেকে বিষয় অশনাক্তকৃত এইচ এন দত্ত পর্যন্ত সবার ক্ষেত্রেই চলে যাওয়ার প্রধান কারণ দাঙ্গার সম্ভাবনা ও নিরাপত্তাহীনতার কথা একবাক্যে বলা যায়। এটি আংশিক সত্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৫৫ বছর, সরকারি চাকরির অনুরূপ। কিন্তু কলকাতা বা ভারতের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তা ৬০ বছর। কাজেই যাদের বয়স ৫৫-এর কাছাকাছি তারা আরো পাঁচ বছর কাজ করার সুযোগ খোঁজ করবেন এবং পেলে তা গ্রহণ করবেন এটাই স্বাভাবিক।
বলাবাহুল্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন যথেষ্ট মর্যাদা সম্পন্ন ছিল। কাজেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অন্যত্র ভালো চাকরি পাবেন এটাই ছিল প্রত্যাশিত। তালিকায় ইংরেজির প্রথম নাম প্রফুল্লকুমার গুহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন ১ জুলাই ১৯২১ থেকে শিক্ষক। তিনি যখন শেকসপিয়র পড়াতেন ওথেলো কিংবা কিং লিয়র তার পাণ্ডিত্য ও কণ্ঠস্বর কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লাসরুমকে যেন নাট্যমঞ্চে পরিণত করে ফেলত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি ভালোবাসতেন, ঢাকায় হিন্দু-মুসলমান প্রীতির বন্ধনের তিনি প্রশংসা করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এ এফ রহমান, রমেশচন্দ্র মজুমদার জ্ঞান ঘোষ, শহীদুল্লাহ, নরেশ সেনগুপ্ত শুধু তাদের ঔদার্য ও ব্যক্তিত্বের প্রভাবে এই অসম্ভবকে সম্ভব করলেন।’ অসম্ভব বিষয়টি হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।
রতন লাল চক্রবর্তীর গ্রন্থে প্রফুল্লকুমার গুহকে ১৯৪৫-১৯৫৫-এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়া শিক্ষকদের তালিকায় আনা হলেও তিনি নিজের লেখায় উল্লেখ করেছেন ২৩ বছর অধ্যাপনার পর ১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের আগে ময়মনসিংহ কলেজের প্রভাষক ছিলেন। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য তিনি আবেদন করেছিলেন। ভাইস চ্যান্সেলর ফিলিপ হার্টগ তার বিশ্বাসভাজন কারো কাছে প্রফুল্ল গুহের প্রশংসা শুনে তাকে যোগদান করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে প্রফুল্লকুমার গুহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য হয়েছিলেন।
উপস্থাপিত তালিকায় দুজন ইংরেজের নাম আছে- ইংরেজির এ জি স্টক এবং ড. অ্যানারসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা বিদ্বেষের প্রশ্নটি তাদের বেলায় সেভাবে প্রযোজ্য নয় যেভাবে প্রযোজ্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বেলায়। আবার এটাও সত্য জার্মান বংশোদ্ভূত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর হিউম্যানকে তাড়াতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলন করেছেন। লক্ষণীয় এই তালিকায় বাণিজ্য বিভাগের মতিনউদ্দিন খানের নামও আছে। তার বেলায় দাঙ্গার কথা বলার সুযোগ কম। তিনি মুসলমান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি কারণ রয়েছে। শুরুতে শিক্ষকদের যে বেতন প্যাকেজ দিয়ে আনা হয়েছিল তিন বছরের মধ্যে তার উল্লেখযোগ্য অংশ ছেঁটে দেয়া হয়। ১৯৪০ ও ১৯৫০ দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষকের প্রারম্ভিক বেতন ছিল ১৫০ টাকা, সিনিয়র প্রভাষকের ২৫০ টাকা, রিডারের ৪০০ টাকা এবং অধ্যাপকের ৬০০ টাকা। ভারতবর্ষেই কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতন-প্যাকেজ এর চেয়ে ভালো ছিল। প্রারম্ভিক বেতন ও শেষ বেতন দুটোই বেশি- আর তা শিক্ষকদের আকৃষ্ট করার জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত। বিশেষ করে একটি পদোন্নতিসহ চাকরি পেলে তো কথাই নেই।
পাশাপাশি রতন লাল চক্রবর্তী এ প্রশ্নও রেখেছেন বেতন-ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ হলে অপেক্ষাকৃত কম বেতনে ভারতের মুসলমান অধ্যাপকরা ঢাকায় এসে যোগ দিতেন না। আবদুল হালিম, আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ, আহমেদ হাসান দানি কিংবা ইশতিয়াক হোসেন কোরেশী। কিন্তু কেন এলেন? সন্দেহ নেই সবকিছু ছাপিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিই তাদের ঠেলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশে পাঠিয়েছে, যেমনভাবে অনেক শিক্ষককে ভারতে চলে যেতে হয়েছে। রতন লাল চক্রবর্তী গ্রন্থটির যথেষ্ট গবেষণা প্রসূত। পঞ্চম ও শেষ অধ্যায় ‘সবশেষে পণ্ডিত বিদায়ের পালা’। ১৭ আগস্ট ১৯২১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোর্টের (এখন যা সিনেট) প্রথম সভায় বাংলার ছোট লাট (গভর্নর) ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর আর্ল অব রোনাল্ডশে অংশগ্রহণ করেন। প্রথম বছর (১৯২১-২২) মুসলমান শিক্ষক ১৩ জন এবং অমুসলমান ৫৬ জন নিয়োগ পান, দ্বিতীয় বছর ১ জন মুসলমান ৪ জন অমুসলমান। অমুসলমান মানে বাস্তবে প্রায় সবাই হিন্দু; তবে রটে গেল নিয়োগপ্রাপ্ত ১০০ জনের মাত্র ১৫ জন মুসলমান আর সব হিন্দু।
নবাব কে এম ইউসুফ খান বাহাদুরের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি দল (খান বাহাদুর আযমে, হাকিম হাবিবুর রহমান, মৌলভী আবদুস সিদ্দিক, নইম উদ্দীন আহমেদ, মৌলভী হাফিজ আবদুর রাজ্জাক, মৌলভী আবদুর রাজ্জাক, মৌলভী মফিজ উদ্দীন আহমেদ ও খান বাহাদুর জহিরুদ্দীন আহমেদ) গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে তাদের অসন্তোষ ব্যক্ত করেন। তারা তাকে বলেছিলেন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের ঘোষণার পর পূর্ব বাংলার মুসলমানরা মনে করেছে : ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে মুসলমানদের জন্য মুসলমানদের প্রতিষ্ঠান’। তাদের ভাষ্যের অনূদিত অংশ : পূর্ব বাংলার মুসলমানরা প্রত্যাশা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত মুসলমানদের প্রতিষ্ঠান হবে, যার স্টাফরা হবেন মুসলমান, তারা বাংলার মুসলমান তরুণদের পড়াবেন। আমরা মনে করি ঢাকা সফরকালে লর্ড হার্ডিঞ্জ যা বলেছিলেন তার সঙ্গে এ প্রত্যাশার পর্যাপ্ত যৌক্তিকতা রয়েছে।’
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার মতো যোগ্য প্রার্থী মুসলমানদের মধ্যে হাতেগোনা ক’জন ছিলেন, তবে তাদের আকর্ষণ ছিল ভারতীয় কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের দিকে, সরকারি কলেজে শিক্ষকতার দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়ার নজির আগেও ছিল, এখনো আছে। শিক্ষকতার ন্যায্য হিস্যা মুসলমানদের দেয়ার দাবি ক্রমেই উচ্চকিত হতে থাকে। প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চ্যান্সেলর ফিলিপ হার্টগের একটি ভাষণের একাংশ অনূদিত হওয়া আবশ্যক। ‘আপনাদের জানা আছে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর মুসলমান প্রতিনিধি দল যে লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার ফলশ্রæতিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। এই প্রতিষ্ঠার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য ছিল পিছিয়ে পড়া মুসলমান সম্প্রদায়কে সামনে টেনে আনা। বাংলার ৫২ ভাগ মানুষ মুসলমান; বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানে মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা মাত্র ১০ ভাগের কাছাকাছি। শিক্ষার দিক থেকে বিবেচনা করতে গেলে তা মোটেও সন্তোষজনক কোনো পরিসংখ্যান নয়। ঢাকায় আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করব যেন মুসলমান শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়, সম্প্রদায়ের সদস্যদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হবে যেন তারা বাংলার রাজনীতি ও রাষ্ট্রচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু লর্ড হার্ডিঞ্জ একটি বিষয় জোর দিয়ে বলেছেন- এটা মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হবে না। সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে, যতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়তি নির্ধারণে আমার ভূমিকা থাকবে, সেই আদর্শ নিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হবে।’
পরিস্থিতি যুগপৎ ভারতে এবং এর পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব বাংলায় খারাপ হতে থাকে। দুই দেশই তাদের সংখ্যালঘুর দিকে আঙুল তুলে তাদের ‘এজেন্ট’ আখ্যা দিতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে পূর্ব বাংলা সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগে ‘দ্য এলিমিনেশন অব হিন্দু এলিমেন্টস ফ্রম ঢাকা ইউনিভার্সিটি’ নামের নথিও খোলা হয় বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। পৃত্থীশচন্দ্র চক্রবর্তী ও গণেশচরণ বসুর বিরুদ্ধে গোয়েন্দাবৃত্তির অভিযোগ এনে তাদের যথেষ্ট হেনস্তা করা হয়। এর প্রভাব অন্য হিন্দু শিক্ষকদের ওপর পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। পরবর্তী সময়েও এই মনোভাবের যে পরিবর্তন ঘটেনি তার প্রমাণ একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে জগন্নাথ হল ম্যাসাকার এবং বিশিষ্ট হিন্দু শিক্ষকদের ক’জনকে প্রকৃত অর্থেই ‘এলিমিনেট’ করা।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়