বিজিএমইএ সভাপতি : বন্ধ মিল চালু হলে ফেব্রিক্সের চাহিদা মেটানো সম্ভব

আগের সংবাদ

খাদ্য নিরাপত্তাই প্রধান চ্যালেঞ্জ : সরকারি হিসাব মতে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবুও চালসহ খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়

পরের সংবাদ

দুর্গাপূজায় ছুটি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাঙালির মহোৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা বঙ্গদেশে সার্বজনীন। দুর্গাপূজা শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব নয়, এর আবেদন সার্বজনীন। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে একই কথা বলেছেন। আমরা যখন ঢাকায় ‘মহানগর পূজা কমিটি’ নাম নিয়ে ঢাকেশ্বরী মেলাঙ্গনে দুর্গাপূজা শুরু করি, তখনো এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ‘সম্প্রীতি’। এখন সেটি দেশে প্রধান পূজা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিলনকেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই সেখানে যান। তবে বেগম খালেদা জিয়া কখনো ঢাকেশ্বরীতে পূজায় গিয়েছেন, তেমনটা দেখা যায়নি। কেউ দেখে থাকলে আমার ভুল শুধরে দেবেন। পূজায় কাউকে আঘাত দেয়া উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু সম্প্রীতির নমুনা দেখে উইমেন চ্যাপ্টারের শান্তা মারিয়া মনে হয় কিছুটা রেগে বলেই ফেলেছেন, তাহলে ছুটির বেলায় এত দৈন্যতা কেন? তিনি একটি হিসাব দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে বছরে ১১ দিন সংবাদপত্র বন্ধ থাকে, তন্মধ্যে ৯ দিন মুসলিম সম্প্রদায়ের উৎসবের জন্য, বাকি দুদিন পহেলা বৈশাখ ও মে দিবস।
সরকারি ছুটির হিসাব না-ই বা দিলাম। দাবি আছে, দুর্গাপূজায় তিনদিন ছুটির। মিডিয়া বলছে, বাংলাদেশে এবার প্রায় ৩৩ হাজার পূজা হচ্ছে। নিরাপত্তার কমতি নেই। ডিএমপি বলেছে, পূজার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। সামাজিক মিডিয়া জানাচ্ছে, দেশে মূর্তিপূজা বন্ধের দাবি আছে, যথেষ্ট আপত্তিকর কথাবার্তাও আছে। ক’বছর আগে সাম্প্রদায়িক সংগঠন ‘আওয়ামী ওলেমা লীগ’ প্রশ্ন তুলেছে, দুর্গাপূজায় হিন্দুদের ৩ দিন ছুটি চাই কেন? তদুপরি মূর্তিভাঙা তো আছেই এবং যথারীতি এর কোনো বিচার কখনো ছিল না, এখনো নেই! এতসবের মধ্যেও পুলিশ প্রহরায় দেশে ধুমধামে পূজা হচ্ছে। পুলিশ না থাকলে কী হতো বলা মুশকিল? আওয়ামী লীগ আমলে সবসময়ই পূজায় জাঁকজমক বেশি থাকে, অন্যদের আমলে কেন থাকে না, সেটা তারা চিন্তা করে দেখতে পারেন।
সার্বজনীন দুর্গাপূজার মূল থিমটি হচ্ছে, অসুরের বিরুদ্ধে সুরের বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের বিজয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এবারকার থিম হতে পারে, করোনার বিরুদ্ধে মানবজাতির বিজয়। পূজার ধর্মীয় দিকটি হিন্দুর হলেও উৎসবটি আসলেই সবার। শুধু দেশে কেন, এই প্রবাসেও তাই। নিউইয়র্কে এবার তিনটি নতুন পূজা যুক্ত হয়ে মোট ১৮টি পূজা হচ্ছে, এদের সেøাগান, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’। ১৯৯০ সালে নিউইয়র্কে শম্ভু চন্দ ও রতন তালুকদারের নেতৃত্বে হিন্দুরা যখন ‘বাংলাদেশ পূজা সমিতির’ ব্যানারে প্রথম পূজা করে তখনো ব্যাপারটা তাই ছিল। তিন দশক পরে পূজা যেমন বেড়েছে, বেড়েছে কোন্দল, সম্প্রীতি কি বেড়েছে? সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের লোকজন আজকাল পূজায় তেমন দেখা যায় না? নিউইয়র্কে বাংলাদেশের সরকারি মহলের সম্প্রীতি জোরদারের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই!!
২০১৬ সালে স্থায়ী মিশন ও কনস্যুলেট মিলে সেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ব্যাপারটি অনেকটা নিখর্চার, কিন্তু প্রশংসনীয়। সেবার পূজায় পররাষ্ট্র দপ্তরের তরফ থেকে কনস্যুলেটের মাধ্যমে ডাকযোগে একটি পূজার কার্ড পাঠানো হয়, আমিও পেয়েছিলাম। কার্ডে ত্রিনয়নী দুর্গা, ‘হ্যাপী দুর্গাপূজা’, শারদীয় শুভেচ্ছা বা পূজা গ্রিটিংস সবই ছিল এবং এটি স্বাক্ষর করেছেন তৎকালীন নিউইয়র্ক কনসাল জেনারেল শামীম আহসান। উদ্যোগটি অবশ্যই মহৎ, প্রশংসনীয়, আমি ফোন করে শামীম আহসানকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। এমনতর ছোট ছোট ঘটনা যে জনসংযোগে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে, এই কার্ড প্রমাণ।
২০১৬ সালে জ্যাকসন হাইটসের প্রাণকেন্দ্রে প্রথম পূজা হয়। এতে অনেকে খুশি হন, এমনি একজন আমাদের বামঘেঁষা বন্ধু গোপাল স্যানাল এবং তিনি তাতে সংযুক্ত থাকতে চেয়েছিলেন। হঠাৎ শুনি গোপাল দেশে গেছেন। তারপর ফেসবুকে দেখি নবদম্পতির ছবি। মন্তব্যে লিখলাম, ‘গোপাল, এই ছিল মনে’! গোপাল উত্তর দিল, দাদা, মানববন্ধনে আর একজন বাড়ল! প্রগতিশীল আন্দোলনে নিউইয়র্কে গোপাল একজন অগ্রণী সৈনিক, প্রতিটি মানববন্ধনে তিনি সামনের সারিতে। একটি গল্প বলি, এক নারী এক মন্দিরে যান, পূজা শেষে তিনি পুরোহিতকে বলেন, ‘এই মন্দিরে আর আসব না’? পুরোহিত জিজ্ঞাসা করেন, কেন? নারী জানালেন, এ মন্দিরে অসংখ্য মানুষ, হৈচৈ, ঠিকমতো মনোনিবেশ করা যায় না। পুরোহিত বললেন, ঠিক আছে, আসবেন না, তবে একটি ছোট্ট অনুরোধ করি? ‘ওকে’, নারীর উত্তর। পুরোহিত ওই নারীর হাতে একটি জলপূর্ণ ঘট দিয়ে বললেন, আপনি এই ঘট নিয়ে একবার মন্দিরের চারদিক ঘুরে আসুন। যাত্রাকালে পুরোহিত আবার বললেন, ‘দেখবেন, একফোঁটা জল যেন উপচে না পড়ে’। তিনি মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে মন্দিরের চতুর্দিক ঘুরে কিছুক্ষণ পর পুরোহিতের সামনে এসে বিজয়ীর হাসি দিয়ে বলেন, ‘একফোঁটা জলও পড়েনি’। পুরোহিত তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি যখন মন্দিরের চারপাশ ঘুরছিলেন, তখন কি কোনো শব্দ শুনেছিলেন’? তিনি জানালেন, না, শুনেননি। পুরোহিত বললেন, ‘ঘটের জল যাতে উপচে না পড়ে এ জন্য আপনি এতটা একাগ্র ছিলেন যে, অন্য কোনো শব্দ আপনার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি, একাগ্রতাই সবকিছু। বঙ্গদেশে যারা কুম্ভ নৃত্য দেখেছেন, তারা জানেন, নর্তকি নাচের যত মুদ্রাই প্রদর্শন করুক না কেন, তার মন নিবিষ্ট থাকে মাথার ওপর কলসীতে, যাতে ওটি পড়ে না যায়! আবারো বলা যায়, একাগ্রতাই সবকিছু।
কথা ছিল, পূজা উপলক্ষে শুধুই শান্তির ললিত বাণী শোনাব। কিন্তু ছাগশিশু ও বাঘের গল্পটা মনে এলো : ছাগলের বাচ্চাটি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছিল যে সে জলঘোলা করেনি। বাঘ কিন্তু সেই যুক্তি শুনেনি, বরং ঘাড় মটকাবার আগে বলেছিল, ‘তুই না করিস তোর বাপ করেছে’। কয়েক দিন আগে সিলেটে মসজিদ থেকে মাইকে আহ্বান জানিয়ে ইস্কন মন্দিরে হামলা করা হয়। অভিযোগ আজানের সময় মন্দির থেকে মাইকে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ডিস্টার্ব করা হয়েছে! আসলে ইস্কনে কোনো মাইকই ছিল না। ধর্ম অবমাননার অজুহাতে রামু, নন্দীরহাট, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা, নাসিরনগর, রংপুর, শাল্লা বা অন্যত্র হামলার ঘটনা তো আছেই। অজুহাত সৃষ্টি কি খুব কষ্টকর? যুক্তি যেখানে অচল, শক্তি সেখানে সচল। সরকার সন্ত্রাস দমনে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিয়েছেন, সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে কিন্তু সম্পূর্ণ উদাসীন। আবার ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট বা ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি বড়ই একপেশে! মূর্তি ভাঙলে কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগে না, এজন্য অর্ধ-শতাব্দীতে এ অপরাধে একজনের বিচার হয়নি।
দেবীদুর্গা আসেন, সঙ্গে কিছু অসুরও আসে, তিনি চলে যান, অসুরগুলো রেখে যান। অসুরেরা মূর্তি ভাঙে, পূজা এলে প্রতিমা ভাঙার মৌসুমও আসে? গত ২১ সেপ্টেম্বর রাতে কুষ্টিয়া ও দিনাজপুরে কয়েকটি পূজামণ্ডপে প্রতিমা ভাংচুর দিয়ে এবার মৌসুম শুরু হয়েছে। এরপর ২৪ সেপ্টেম্বর চুয়াডাঙ্গায় প্রতিমা ভেঙেছে। আরো আছে। বাংলাদেশে সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদে সব ধর্মাবলম্বীর স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। যারা এই অধিকার খর্ব করার চেষ্টা করছে রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না? তাই, হিন্দুরা পূজার বাজেট কমান, বাজেট থেকে টাকা বাঁচিয়ে মন্দির ও মূর্তি রক্ষায় ব্যয় করুন। রাষ্ট্র যেখানে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, সেখানে আপনাকেই নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হবে? আর একটি মজার ব্যাপার হচ্ছে, পুলিশ কিন্তু মাঝে-মধ্যে এদের ধরে, পরে নিজেরাই ডাক্তার হিসেবে সার্টিফিকেট দিয়ে দেন যে, ‘লোকটি মানসিক ভারসাম্যহীন’ এবং ছেড়ে দেন। শুনে অবাক হতে হয়, এসব ‘জাতে মাতাল তালে ঠিক’ পাগল শুধু মূর্তি বা মন্দির ভাঙে, অন্য কিছু নয়?
পূজার আনন্দের মাঝে এবার মানুষ ‘ঝুমন দাশ’র কথা মনে রাখবে, মুক্ত ঝুমন স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে পূজা দেখতে পারবে। ধর্ম যার যার হলেও উৎসব যেমনি সবার, রাষ্ট্রও তেমনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার। দেশে পূজার সময় নেতানেত্রীরা বিভিন্ন পূজামণ্ডপে যান, তাদের আপ্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু দেনদরবারও চলে। মনে আছে মহানগরের পূজার চাঁদার জন্য স্বপন সাহা ও আমি আশির দশকে একবার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে গিয়েছিলাম, তিনি ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন। এতদিন পরে মনে হয় এবার আবার কিছু চাইলে কেমন হয়? এখন তো তিনি শুধু সভানেত্রী নন, তিনি প্রধানমন্ত্রী, দিতে চাইলে অনেক কিছুই দিতে পারেন। একটি সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়, ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’, মানবাধিকার কমিশন বা নিদেনপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর একজন সংখ্যালঘু ও মানবাধিকার বিষয়ক উপদেষ্টাই বা কম কি? মডেল মন্দির, প্যাগোডা চাইলেই বা ক্ষতি কি? পূজার গিফট হিসেবে প্রধানমন্ত্রী অনুদান দিয়েছেন, চাইলে আরো অনেক কিছু দিতে পারেন, সবই সদিচ্ছা। এবারের দুর্গাপূজা সব মানুষের কল্যাণ বয়ে আনুক, সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক। সবাইকে শারদীয় দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা।
শিতাংশু গুহ : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়