ঢাকা সেনানিবাসে এনআইডি বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন

আগের সংবাদ

যশোর বোর্ডের হিসাব থেকে আড়াই কোটি টাকা উত্তোলন : জালিয়াতির অভিযোগ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে

পরের সংবাদ

খাদ্য নিরাপত্তাই প্রধান চ্যালেঞ্জ : সরকারি হিসাব মতে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবুও চালসহ খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়

প্রকাশিত: অক্টোবর ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

তানভীর আহমেদ : বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশের তালিকায় অবস্থান করছে। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ের তুলনায় বর্তমানে ধান উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ। তবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতি বছরই আমদানি করতে হয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খাদ্যশস্য। ক্রমাগতই বাড়ছে এ আমদানির পরিমাণ। দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ- সরকারিভাবে এমন দাবি করা হলেও ১৬ কোটির বেশি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখনো অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে প্রতি বছর চালসহ বিপুল পরিমাণ খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয় কেন? তাদের মতে, সরকারি হিসাবে ভুল তথ্য অথবা গোজামিল রয়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, যে কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকদের খাদ্য নিরাপত্তায় সরকারিভাবে কমপক্ষে ৬০ দিনের খাদ্য মজুত রাখা প্রয়োজন। আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর একদিনের খাদ্য চাহিদা প্রায় ৪৬ হাজার টন। সে হিসাবে ৬০ দিনের জন্য খাদ্য মজুত রাখার কথা ২৭ লাখ টন। সেখানে সরকারের কাছে খাদ্য মজুত রয়েছে ১৮ লাখ ১৪ হাজার টন। যা সাম্প্রতিক সময়ের রেকর্ড পরিমাণ মজুত। তবে বাংলাদেশের মানুষের ঘরে, মিল ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় খাদ্যপণ্য যথেষ্ট মজুত রয়েছে বলে মনে করে সরকার। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন ব্যবস্থা নেই।
কৃষি খাতে এখন উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। বর্তমানে চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান হলো সবার ওপরে। তাছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চাষ করা মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম ও আলু উৎপাদনে অষ্টম বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ, গম দুই গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ ও সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। খাদ্যশস্য, মাছ, ডিম ও মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ, বলছে কৃষি বিভাগ; আলু উৎপাদনে উদ্বৃত্ত। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে আলু রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। মাছ রপ্তানিও বাড়ছে। চিরকালের দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ৬৭ লাখ টন চাল নষ্ট হয়। এ ক্ষতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা গেলে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টন বাড়তি চাল পাওয়া সম্ভব। অন্যদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে এ পর্যন্ত বার্ষিক সর্বোচ্চ চাল আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৯ লাখ টন। এ বছরও প্রায় ৩০ লাখ টন চাল আমদানি করছে সরকার। এর মধ্যে আগে এসেছে ১৩ লাখ টন।

নতুন করে ১৭ লাখ টন চাল আমদানি প্রক্রিয়াধীন। সে অনুযায়ী উৎপাদিত ধান-চাল নষ্ট হওয়ার মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব হলে প্রকৃতপক্ষেই চালে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করত দেশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্যশস্যের কৌশলগত মজুতের জন্য চাল আমদানি করা যেতে পারে। তবে সেটা কোনোভাবেই মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশের বেশি নয়। মোট আমদানির পরিমাণ মোট উৎপাদনের ২০ শতাংশের বেশি হলে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ঝুঁকি তৈরি হয়। বেশি আমদানি করলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। খাদ্যশস্য উৎপাদনের জমির উৎপাদিকা শক্তি বেশ গুরুত্বপূণ। আমদানি নির্ভরতা কমাতে হলে ফলন বাড়ানোর বিকল্প নেই। সেজন্য শস্যের জাতের উন্নয়ন ও মানসম্মত বীজ সরবরাহ বাড়ানো, মাটির স্বাস্থ্য, বালাই ব্যবস্থাপনা ও কৃষিতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া, স্থানীয় সেবা প্রদান ব্যবস্থা উন্নয়ন করতে হবে। এছাড়া বাজার ব্যবস্থা, কৃষি গবেষণা ও যান্ত্রিকীকরণের উন্নয়ন, বিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণ কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
কৃষি অর্থনীতিবিদ প্রফেসর গোলাম হাফিজ ভোরের কাগজকে বলেন, ২০১০ সাল থেকে আমরা খাদ্যে অর্থাৎ চালে উদ্বৃত্ত উৎপাদন করে যাচ্ছি। তারপরও বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের চাল আমদানি করতে হয়। যদিও বাজারে অদৃশ্য হাতের কারসাজির কারণে মাঝে মাঝে দাম বেড়ে যায়, সংকট সৃষ্টি হয়। এ জন্য সরকারকে মজুত বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, চাল-গমসহ খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়লেও জনসংখ্যার তুলনায় খাদ্য চাহিদা কতটুকু তা যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা নেই। বর্তমান উৎপাদন ও ব্যবহারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও সুবিন্যস্ত নয়। ত্রæটি রয়েছে খাদ্য উৎপাদন, আমদানি ও ব্যবস্থাপনাতে- যা দূর করা অত্যন্ত জরুরি। তাই কৃষক ও ভোক্তার স্বার্থ রক্ষার দিকে যেমন মনোযোগ দিতে হবে এবং সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিত করতে হলে খাদ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করতে হবে।
কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, দেশে মাছ, পোল্ট্রি, প্রাণীখাদ্য ও স্টার্চ হিসেবে চালের ব্যবহার দিন দিন বেড়েছে। এছাড়া বিভিন্ন খাদ্য প্রস্তুতে বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে চালের ব্যবহার হচ্ছে। ফলে উৎপাদন বাড়লেও দেশে চাল ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপের ফলে দেশে চালের রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে। গড় উৎপাদনশীলতাও বেড়েছে। তারপরও চাল আমদানি করতে হচ্ছে নানা কারণে। দেশে জনসংখ্যা ও চালের চাহিদার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। অন্যদিকে বছর বছর জনসংখ্যা বাড়ছে, চাষের জমি কমছে। অন্যান্য ফসলের চাষেও জমির ব্যবহার বাড়ছে।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম জানান, সরকারের কৃষিখাত সংশ্লিষ্টরা চাল উৎপাদনের যে তথ্য দেন, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। বিবিএসের (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো) মাথাপিছু চাল ভোগের পরিমাণ ধরে হিসাব করলে দেশে বছরে দুই কোটি ৮০ লাখ টনের বেশি চালের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মোট উৎপাদন এর চেয়ে অনেক বেশি। উৎপাদন যদি চাহিদার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে এত চাল গেল কোথায়? কেন আমদানি করতে হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন প্রতিমন্ত্রী।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, খাদ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য অধিদপ্তর ও অন্যান্য সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত কয়েক বছরে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী হওয়ায় দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করা হয়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলে চাল আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ লাখ ৫৪ হাজার টন। ২০১১-১২ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি খাতে আমদানির পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ১৩ হাজার টন। ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে চাল আমদানি পরিমাণ কমে এলেও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯০ হাজার টন। ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চাল আমদানির ওপর যথাক্রমে ১০ ও ২৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় আমদানির পরিমাণ ভীষণভাবে কমে যায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শুধু বেসরকারি খাতে চাল আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৩ হাজার টনে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চাল আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৮ লাখ টনে, যা সাম্প্রতিককালের সর্বোচ্চ পরিমাণ চাল আমদানি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি খাতে ১ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে শুধু বেসরকারি খাতে চার হাজার টন চাল আমদানি করা হয়। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে ১৩ লাখ টনের কিছু বেশি চাল আমদানি করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়