হাসেম ফুডে অগ্নিকাণ্ড : ৩ মাস পর দগ্ধ ছেলের মরদেহ পেলেন বাবা

আগের সংবাদ

রোহিঙ্গাদের অস্ত্র-অর্থের উৎস কী

পরের সংবাদ

বিপন্ন নদী ইছামতীকে বাঁচাতে হবে

প্রকাশিত: অক্টোবর ১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১, ২০২১ , ১২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

পাবনার ইছামতী অঢেল সম্পদের, সীমাহীন ঐতিহ্যের এবং বিশাল গৌরবের ঐতিহ্য। নদীটির উৎপত্তির ইতিহাস সঠিকভাবে জানা না গেলেও যতটুকু জানতে পেরেছি- নদীটি প্রকৃতিগতভাবে উৎপন্ন হয়নি। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে বাংলার তৎকালীন রাজধানী জাহাঙ্গীরনগরের যাতায়াতের সুবিধার কথা চিন্তা করে বাংলার শাসনকর্তা ঈশা খাঁর নির্দেশে তদানীন্তন প্রাদেশিক শাসন কর্মকর্তা ইছামতী নদীটি খনন করেন। তার স্মৃতি রক্ষার্থেই নদীটি খনন করেন। তার স্মৃতি রক্ষার্থেই তারই নামানুসারে এ নদীর নামকরণ করা হয় ইছামতী (সূত্র বিবৃতি, ২৯ এপ্রিল, ২০১৯, সাংবাদিক আবদুল হামিদের নিবন্ধ), যদিও কোনো ইতিহাস গ্রন্থে বা গুগলস সার্চ করে তার প্রমাণ পেলাম না। তবে ইছামতী পদ্মার শাখা নদী, এ নিয়ে বিতর্ক নেই।
বিগত শতাব্দীর প্রথম দিকে পাবনার শীতলাই জমিদারের লালরঙা বহু কক্ষবিশিষ্ট বাড়ি, যেটা শীতলাই জমিদারের বাড়ি বললে সবাই এক ডাকে চিনত (বর্তমানে এডরুক লেবরেটরির কারখানা ও প্রধান কার্যালয়), পদ্মার তীব্র ভাঙনে ওই বিশাল ভবন (এবং কয়েক একর জমিতে নানাবিধ ফুল বাগান, বুদ্ধদেবের শ্বেত পাথরের বিশাল মূর্তি ও সৌন্দর্যবর্ধক বৃক্ষরাজি শোভিত বাগান) পদ্মার তীব্র ভাঙনে নদীতে চলে যাওয়ার আশঙ্কার কথা তৎকালীন প্রকৌশলীরা জানালে জমিদার পরিবার কয়েক লাখ টাকা খরচ করে শক্ত গাঁথুনি দিয়ে পদ্মার ইছামতীর সংযোগস্থল বন্ধ করে দেয়। তার পর পদ্মা-ইছামতী তাদের সংযোগ আজ পর্যন্ত ফেরত পায়নি। ফলে বর্ষাকালেও যখন পদ্ম ফুলে-ফেঁপে ওঠে, তখনো আজকের ইছামতী পদ্মার এক চামচ জলও পায় না। এই সংযোগ মুখটি পাবনা পৌর এলাকার পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত। তখন পদ্মার ভাঙন এতই তীব্র হয়েছিল যে পাবনা শহরের অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়েছিল। এতদসত্ত্বেও বহুদিন পর্যন্ত বর্ষাকালে প্রতি বছর পদ্মার ঘোলা জল ইছামতী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হুড়াসাগরে মিলিত হতো পাবনার সরাসরি পশ্চিমে।
আবার যমুনার সংযোগকারী হুড়াসাগর দিয়ে বর্ষাকালে যমুনার কালো জল ইছামতী দিয়ে পদ্মায় গিয়ে মিলিত হতো। এভাবে বছরের মধ্যে প্রায় ছয় মাস ইছামতী বিশাল প্রশান্ত এক নদীতে পরিণত হতো। ছোট ছোট লঞ্চ, গহনার নৌকা, পণ্যবাহী নৌকা, যাত্রীবাহী নৌকা পাবনা-বেড়া নৌরুটে ওই ছয়-সাত মাস চলাচল করত।
আমার গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার ভুলবাড়িয়া গ্রামে। প্রায় ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ওই গ্রামে বাস করেছি- রোজ বন্ধু-বান্ধব মিলে বারো মাস স্নান করেছি। আমাদের বাড়িটি ছিল ইছামতীর তীরে। হাঁটাপথে মাত্র তিন মিনিটের দূরত্বে। তাই ইছামতীর সঙ্গে আমার প্রাণের সম্পর্ক। গহনা নৌকায় চড়ে বাল্যকালে কতদিন যে ওই নদী দিয়ে বাবার সঙ্গে পাবনা বেড়াতে এসেছি আবার পাবনা থেকে ফিরে বাড়ি গিয়েছি এখন আর তা মনে নেই। দিনে কমপক্ষে চারবার ইছামতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো নিয়মিত। প্রথমত, স্নানের সময়; দ্বিতীয়ত এবং তৃতীয়ত আতাইকুলা হাইস্কুলে পড়তে যাওয়া ও আসার সময় এবং বিকালে নদীর ধারে খেলাধুলার সময়।
১৯৪৭-এ ১৪ বছর বয়সে চলে এলাম পাবনা শহরে স্থায়ীভাবে। বাসা ভাড়া নেয়া হয়েছিল রাধানগরে। সেখান থেকে গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে পড়তে যাওয়া-আসার সময়, বাজার করতে যাওয়ার-সময়ও সাক্ষাৎ হতো ইছামতীর সঙ্গে। অতঃপর ওই বাসা ছেড়ে অপর পাড়ে অন্য বাসায় এলাম। ভর্তি হলাম পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। তখনো যাতায়াতের সময় নতুন ব্রিজ দিয়ে ইছামতী দর্শন হতো রোজ দুবার। তাই শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত ইছামতীর সঙ্গে আত্মীয়তা- শুধু আমার নয়, পাবনা জেলাবাসী বেশিরভাগ লোকেরই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে।

কোথায় গেল সেই ইছামতী?
আমাদের নিত্যদিনের সাথী সেই ইছামতী আজ অদৃশ্য। স্থান পেয়েছে স্মৃতির পাতায়। অভ্যাস বশত ইছামতীকে দেখতে যাই- হতাশ হই, বেদনার্ত হই, কারণ সেই প্রিয় ইছামতী আজ আর নেই। তাকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে।
মনে পড়ে, আজ থেকে ৫০ বছর আগেও এ নদীতে পণ্যবাহী যাত্রীবাহী নৌকা চলাচল করেছে। নানা সাজে সাজিয়ে অসংখ্য লম্বা কিন্তু সরু সরু বাইচের নৌকায় নেচে নেচে গান গেয়ে গ্রামের তরুণরা নৌকাবাইচ খেলেছে। বছর বছর মহাসমারোহে নৌকাবাইচের প্রতিযোগিতাও হয়েছে, হয়েছে কোনো বিশিষ্টজনদের দিয়ে নৌকাবাইচের প্রতিযোগীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান।
দেখেছি আশ্বিন মাসে (অক্টোবর) দুর্গাপূজা উপলক্ষে যখন হিন্দুরা প্রতি বাড়িতে কমপক্ষে ১০-১৫টি করে নারকেল কিনে নাড়– বড়ি বানাতেন, প্রতিটি পূজামণ্ডপে পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গাপূজার ঘটে বা নৈবেদ্যের জন্য ২৫-৩০টি করে নারকেল কিনতেন, কিনতেন ১০-১৫টি করে নারকেল দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনের পরে দিন কয়েকের মধ্যে ল²ীপূজা উপলক্ষে- তা তারা কিনতেন নতুন ব্রিজের উত্তর পাশে ইছামতী দিয়ে নৌকায় আনা স্তূপীকৃত নারকেল ডিপো থেকে পাইকারি দামে। আজ সেসবই অতীতের বিস্মৃত বিষয় মাত্র।

ইছামতী হত্যাকারী কারা?
ইছামতী কি আপন মনেই শীর্ণকায় হয়ে পড়েছে? নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা হয়তো তাই ভাবেন। এই ভাবনা সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। বস্তুত যখন শীতলাই জমিদারবাড়ি এবং পাবনা শহর নদী গড়ে বিলীন হওয়ার উপক্রম থেকে বাঁচাতে মজবুত বাঁধ দেয়া হলো তখন থেকেই পদ্মার শাখা নদী ইছামতীতে পদ্মার জল আসা বন্ধ হয়ে গেল। অপরপক্ষে পলি পড়ে বা বাঁধ দিয়েই হোক, যমুনার জল বর্ষাকালেও ইছামতীতে আসা বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে শ্রোতস্বিনী ইছামতী শ্রোতহীন এক বন্ধ জলাশয়ে পরিণত হলো। সুযোগ গ্রহণ করতে থাকল ভূমিদস্যুরা। ধীরে ধীরে সইয়ে সইয়ে সুকৌশলে তারা প্রথমে নদী-তীরে মাটি ফেলে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরতে থাকল ইছামতীর উভয় পাড়ে। নদীর প্রস্থ কমে আসতে লাগল। এবার ওই খুনিরা বিশাল বিশাল অট্টালিকা গড়ে তুলল নদীর উভয় তীরে যেন সেখানে ইছামতীর অস্তিত্ব কোনো দিন ছিল না।
এর আগে তারা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করে নদী-তীরবর্তী ওই জমি নিজেদের নামে রেকর্ড করিয়ে নিয়ে মালিক বনে যেতেন। অথচ নদী-বিল প্রভৃতি জলাশয়ের মালিক আইনত সরকার- কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়। এই প্রক্রিয়া বছর বছর বিনা বাধায় চলতে চলতে খুন হয়ে গেল- অপমৃত্যু ঘটে গেল ইছামতীর। আজ ইছামতীর দিকে তাকালে একটি নোংরা ভাগাড়ে, দুর্গন্ধময় নর্দমা বলে মনে হয়। দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনও ইছামতীতে অতীতে ছিল বার্ষিক অনুষ্ঠান। আজ আর তা নেই। যারা খতিয়ান করে মালিক হয়ে গেলেন তারা ছাড়াও অপর অনেকে ভুয়া আমলানামা তৈরি করে আদালতে সরকারের বিরুদ্ধে স্বত্ব প্রতিষ্ঠার দাবিতে মামলা দায়ের করে সরকারি উকিলের বা কখনো কখনো অসৎ বিচারককে হাত করে ভুয়া ডিগ্রি অর্জন করে মালিক বলে যান। অতি ধূর্ত কেউ কেউ আবার এই দুভাবে অর্জিত মালিকানার স্থায়িত্ব সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে তা হয় নিজের আত্মীয়স্বজন বা ভিন্ন লোকদের কাছে বিক্রি করে দেন। ক্রেতারা দলিলমূলে নাম খারিজ করে প্রশ্নাতীতভাবে ওই জমির ‘বৈধ’ মালিক বনে যান। এমন ঘটনা জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘটেছে। যেমন পাবনা, বেড়া ও সাঁথিয়া। ওই মালিকরা সর্বদা সরকারি দলের নেতাকর্মী বনে যান। সরকারি কর্মকর্তারাও তাদের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করেন। ফলে সমাজে এই ভূমিদস্যুদের প্রভাব ব্যাপকভাবে বেড়ে যেতে থাকে। এর পর তাদের আর পায় কে? পাবনার ইছামতী এই ভূমিখেকোদের অসহায় শিকার।

ডিএস খতিয়ান
এই খতিয়ানকে নির্ভুল বলে উচ্চতম আদালতও স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাই ওই খতিয়ানে উল্লেখিত এলাকার মূল মালিক কে তা স্পষ্টাক্ষরে লিখিত আছে। এই খতিয়ানকে পরিবর্তন করার অধিকারও কারো নেই। মালিকের বৈধ ওয়ারিশরা মালিকের মৃত্যুর পর পাবেন ডিএস আইনে।
তাই ডিএস খতিয়ানে বর্ণিত এলাকাই হচ্ছে ইছামতীর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ-সংক্রান্ত চূড়ান্ত এলাকা। সবাইকেই এই এলাকা অভ্রান্ত বলে মানতে হবে।
ডিএস খতিয়ানভুক্ত সম্পূর্ণ এলাকা যতদিন ইছামতী নদীর এলাকা ছিল ততদিন ইছামতী দৈর্ঘ্য-প্রস্থে এবং গভীরতায় ছিল বিশাল। কিন্তু ওই খতিয়ানকে আড়াল করে যারা পরবর্তীতে ষাটের দশকের জরিপকালে জরিপ কর্মকর্তাদের অনেককে অবৈধভাবে প্রভাবিত করে নিজ নিজ নামে এসএ রেকর্ড (ষাটের দশকে) এবং পরবর্তীতে আরএস খতিয়ান নিজেদের নামে অবৈধভাবে লিপিবদ্ধ করে ভোগ দখল করছেন তারা যেই হোন কেন- তারা সবাই আইনত অবৈধ দখলদার। অপরাধী শাস্তিযোগ্য অপরাধে।
সময়মতো জনতা এর বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে না পারলেও ধীরে ধীরে এই অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ, অবৈধ স্থাপনাগুলো ভাঙা, দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ইছামতীর আগের এলাকা পুরোপুরি পুনরুদ্ধার, নদী-খনন এবং ইছামতীর সাবেক রূপ ফিরিয়ে আনতে গণআন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বছর কয়েক আগে হাইকোর্টে মামলা করলে হাইকোর্ট তার প্রদত্ত রায়ে স্পষ্টত উল্লেখ করেন- ডিএস খতিয়ান অপরিবর্তনযোগ্য, সুতরাং ওই খতিয়ানে বর্ণিত এলাকার কোনো অংশ কেউ দখল বা সেখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করে থাকলে তা সম্পূর্ণ অবৈধ। সুতরাং ওই অবৈধ দখল থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকা উদ্ধার করতে সবাইকে আইনি দখলদারকে উচ্ছেদ বৈধ এবং তা করার নির্দেশও আদালত দিলেন। আদালতের বিবেচনায় নদীরও প্রাণ আছে। সুতরাং প্রাণহানিও সম্পূর্ণ অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই উচ্চ আদালত নির্দেশ দিলেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবৈধ সব নদীর অবৈধ দখলদার ও অবৈধ স্থাপনা থেকে উদ্ধার করে ডিএস খতিয়ান অনুযায়ী নদীগুলোর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা উদ্ধার করা হোক।

পাবনাতে ইছামতী উদ্ধার আন্দোলন
মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালে ইছামতী নদী পুনরুদ্ধার ও খননের দাবিতে সৃষ্ট আন্দোলন ও লেখালেখির ফলে কাজ শুরু হয় একটি অবৈধ স্থাপনা ভাঙা ও সামান্য খনন শুরুর মধ্য দিয়ে। এ ব্যাপারে তদানীন্তন সরকার কিছু অর্থও বরাদ্দ করেছিল। কিন্তু দু-একদিন কাজ করার পরই অদৃশ্য কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়- প্রশ্ন ওঠে তৎকালীন এক নেতার এ ব্যাপারে সততা নিয়ে।
কাজ থামার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনও থেকে যায় মূলত হতাশা ও প্রভাবশালী নেতাটির ভয়ে। এরপর চলতে থাকে বহু বছর ধরে সব জাতীয় পত্রিকায় ইছামতী নিয়ে লেখালেখি। দীর্ঘকাল ধরে এই প্রক্রিয়া চলার পরে স্বাভাবিক কারণেই তা-ও বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু সম্প্রতি কয়েক বছর হলো নতুন কর্মীরা, পরিবেশ আন্দোলন ও কোনো কোনো এনজিও এ আন্দোলন শুরু করে। স্থানীয় একজন পত্রিকা সম্পাদকের নেতৃত্বে ‘ইছামতী উদ্ধার কমিটি’ বা এই জাতীয় নামে গঠিত একটি সংগঠনের নেতৃত্বে। এই শুভ প্রচেষ্টায় শরিক হন অনেক সাধারণ মানুষ। প্রধানত পাবনা শহরের। অনেক সভা-সেমিনার-আলাপ-আলোচনা-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে আলোচনা ও স্মারকলিপি প্রদান প্রভৃতি করার পরও যখন কাজ তেমন একটা হলো না, তখন সবাই বাধ্য হলেন আন্দোলনের পথ ধরতে। করোনার জন্য তাতেও অসুবিধা; কিন্তু তাতেও থেমে থাকছে না রাজপথের সমাবেশ ও মানববন্ধন। সরকারি কিছু উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল জানা যায়। ২০০৩ সালে, আজ থেকে ১৮ বছর আগে তৎকালীন জেলা প্রশাসক একটি ইছামতী নদী জরিপ কমিটি গঠন করেন, যার সদস্য করা হয়েছিল অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব (আহ্বায়ক) পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীকে সদস্য সচিব করে। জেলা পরিষদ, পৌরসভা, সড়ক ও জনপথ, এলজিইডি ও সদর ভূমি অফিসের প্রতিনিধিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯২২ সালে প্রকাশিত ডিএস মৌজা ম্যাপ অনুযায়ী জরিপ করা হয়- চিহ্নিত করা হয় নদীর মূল প্রশস্ততা ও পরিসর। জরিপকালে বেরিয়ে আসে অনেক অবৈধ দখলদার বিভিন্ন অসৎ উপায় অবলম্বন করে ১৯৬২ সালের এসএ রেকর্ড ও সর্বশেষ আরএস রেকর্ডে তাদের নামে জাল কাগজপত্র তৈরি করে ওই খতিয়ানগুলোতে নিজেদের নাম তুলে নিয়ে ‘বৈধ’ মালিক সেজে বসে আছে। সে সময় জরিপ দল ২৮৫ জন অবৈধ দখলদারের তালিকা, মৌজার ট্রেসিং ম্যাপ তৈরি ও স্পষ্টভাবে অবৈধ দখলদারদের বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ৯ ডিসেম্বর, ২০০৩ সালে জে.প্র;/পাব/রাজস্ব/জরিপ/২০০৩/১০(৮) নং স্মারকপত্র তৎকালীন জেলা প্রশাসকের কাছে দাখিল করা হয়। ইছামতীকে নিয়ে তখন একটি মাস্টার প্ল্যানও তৈরি হয়েছিল। ওই প্ল্যানের মধ্যে ছিল অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ, নদী খনন, গাইড ওয়াল নির্মাণ, নদী প্রশস্তকরণের পর তার দুই ধারে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে শহরবাসীর বৈকালিক ও সকালের ভ্রমণের মাধ্যমে স্বাস্থ্য উদ্ধার, উভয় পাশে বৃক্ষরোপণ ও মানুষের ওই সৌন্দর্য উপভোগ বা বিশ্রামের জন্য বহুসংখ্যক ইট-সিমেন্টের বড় বেঞ্চ নির্মাণ। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ইতোমধ্যে ইছামতী নামক খালটিতে মরা গরু, বাছুর, কুকুর, বিড়াল, গোটা পৌর এলাকার বর্জ্য ফেলতে ফেলতে নদীর চিহ্নটুকুও হারিয়ে যেতে বসেছে, পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছে।

জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা
তারা হামেশাই বলে থাকেন বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। তাই এ আন্দোলন বা দাবি হয়তো তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয়। মাঝে বিগত ৩০ মার্চ অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ অভিযান প্রথম শুরু হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে মাত্র তিন দিন যেতে না যেতেই ২ এপ্রিল তা স্থগিত করে দেয়া হয় অবৈধ দখলদার ও জনপ্রতিনিধিদের চাপে। এক মাসের জন্য।
সেই যে বন্ধ হলো, তার আর যেন শেষ নেই। প্রত্যাশিত ছিল জনপ্রতিনিধিরা উদ্যোগী হয়ে কাজ শুরুর তাগিদ দেবেন। কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কিনা তার নিয়মিত তদারকি করবেন, কিন্তু তা হচ্ছে না। প্রশাসনিক তৎপরতাও দৃশ্যমান নয়।

জনগণ চেয়ে থাকবেন না
এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মানুষ কিন্তু থেমে নেই, থেমে থাকবেনও না। তারা আন্দোলন অব্যাহত রাখবেন- আন্দোলনকে দিনে দিনে তীব্রতর করে তুলবেন। এ আন্দোলন সরকারবিরোধী নয়। কাউকে ক্ষমতায় বসানো বা ক্ষমতা থেকে নামানোরও নয়। আন্দোলনটি একান্তই দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব স্তরের মানুষের। কারণ ভুক্তভোগী তারাই ওই বিশিষ্টজনেরা বা অবৈধ দখলদাররা নন। তবুও আন্দোলনটির সাফল্য যেমন সাধারণ মানুষের তেমনই আবার ওই বিশিষ্টজন ও তাদের বংশধরদের উপকারে আসবে। মনে রাখুন ডিএস খতিয়ান অনুযায়ী দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ, গভীরতা সব ঠিক হতে হবে। আজ হোক কাল হোক এ আন্দোলনের সাফল্য অনিবার্য- পরিপূর্ণ সংহতি জানালাম ইছামতীকে পুনরায় রক্ষা করে তোলার আন্দোলন, তার ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার, নৌ চলাচল, মৎস্য স্বল্প ব্যয়ে নদীপথে চলাচল এবং পরিবেশ উন্নয়নের স্বার্থে হাইকোর্টের রায়ের সমর্থনে।

রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়