নলডাঙ্গা : আ.লীগ-বিএনপি নেতাসহ আটক ১১ জুয়াড়ি

আগের সংবাদ

উন্নয়নের ভোগান্তি আর কত : কোনো প্রকল্পই শেষ হয় না নির্ধারিত সময়ে, বছরজুড়েই চলে সেবা সংস্থাগুলোর খোঁড়াখুঁড়ি

পরের সংবাদ

রোহিঙ্গাদের অস্ত্র-অর্থের উৎস কী

প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

** মিয়ানমার-ভারত থেকে আসে অস্ত্র ** প্রত্যাবাসন বিরোধীদের মদত ** বাংলাদেশি উগ্রবাদীদের উসকানি **
ইমরান রহমান : কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনী ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বাহিনীগুলোতে সদস্য বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ানো হচ্ছে ওয়ান শুটারগান, নাইন এমএম পিস্তল, রিভলবার, থ্রি কোয়ার্টার গান, এলজি, এসবিবিএল, রাইফেলসহ অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুত। এসব অস্ত্র দিয়েই নিয়মিত ঘটছে খুন, অপহরণ, ডাকাতি ও চোরাচালানের মতো ঘটনা। সশস্ত্র বাহিনীগুলো হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না স্থানীয়রা। অনেক সময় আক্রান্ত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক পর্যায়ে পৌঁছেছে- সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে ড্রোনসহ অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
রাতের আঁধারে ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে আসা এসব অস্ত্রের চালান ঠেকানো না গেলে অদূর ভবিষ্যতে বড় ধরনের অঘটন ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে, সবকিছু ছাপিয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঘরবাড়ি হারানো এসব রোহিঙ্গার অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনার টাকার উৎস কোথায়? নেপথ্যে থেকে কোন স্বার্থে কারা ইন্ধন দিচ্ছে নিঃস্ব রোহিঙ্গাদের।
পুলিশ-র‌্যাব- বিজিবি-এপিবিএনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক ইউনিটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের ৩৪টি ক্যাম্প ঘিরে গড়ে ওঠা ১০-১৫টি সশস্ত্র বাহিনীর অস্ত্র কেনার অর্থের বড় একটি উৎস ইয়াবা, মানব পাচার ও স্বর্ণ চোরাচালান। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যেসব সিন্ডিকেট ইয়াবা, মানব পাচার ও স্বর্ণ চোরাচালান করছে, তাদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেয় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। চোরাচালান ছাড়াও যারা প্রত্যাবাসন চায় না, তারা রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে প্রমাণ করার জন্য অস্ত্র সরবরাহ করছে। বিশেষ করে মিয়ানমারের একাধিক সংস্থা তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে চাহিদা অনুযায়ী সীমান্তে সরবরাহ করছে বিভিন্ন অত্যাধুনিক অস্ত্র। অভিযোগ আছে, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের মোটা অঙ্কের অর্থের জোগান দিচ্ছে বিভিন্ন এনজিও। কারণ এনজিওগুলোও চায় না রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হোক। কেননা প্রত্যাবাসন হলে, থেমে যাবে এনজিওগুলোর কার্যক্রম। ফলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে রাখতে গোপনে অর্থ সরবরাহ করে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন এনজিও।
এর বাইরে, ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছে। সেখানে উপার্জিত টাকার একটি অংশ সংগ্রাম করার নামে সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছে পাঠানো হচ্ছে। ডাকাতি ও অপহরণ থেকে উপার্জিত টাকাও ব্যয় করা হচ্ছে অস্ত্র কিনতে। শুধু এগুলোই নয়, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশি বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় উগ্রবাদী রাজনৈতিক দলের। দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটানোর জন্য

রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে অর্থায়ন করছে তারা। রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দিচ্ছে একাধিক রাজনৈতিক সংগঠন।
এ ছাড়াও বাংলাদেশি সন্ত্রাসীরা এবং স্বার্থলোভীরা রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে অস্ত্র আনছে। বিনিময়ে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। অনেক সময় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরেও অপহরণ ও হত্যায় ভাড়া করে আনা হচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের। এর থেকেও মোটা অঙ্কের টাকা আয় করছে তারা। এ ছাড়াও সম্প্রতি আইস চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ইয়াবার চেয়ে আইস লাভজনক হওয়ায় তাদের আয় হচ্ছে বেশি। ফলে ভবিষ্যতে আরো আধুনিক অস্ত্র কেনার প্রতি সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো মনোযোগী হতে পারে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), আল-ইয়াকিন ছাড়াও কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকায় সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী আদ্দু বাহিনী, গিয়াস বাহিনী ও সালমান শাহ বাহিনী। সালমান শাহ বাহিনীর সালমান শাহ কারাগারে থাকলেও সক্রিয় রয়েছে বাহিনীর কার্যক্রম। এ ছাড়া আছে জোকি বাহিনী, পুতিয়া বাহিনী, খালেক বাহিনী, জাকারিয়া গ্রুপ ও মুন্না গ্রুপ। শালবন পাহাড়কেন্দ্রিক নয়াপাড়া ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলে সবচেয়ে বেশি। সেখানে অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুত করা হয়েছে বলেও তথ্য রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। সর্বশেষ রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যার পর আলোচনায় আসে আরসা ও আল ইয়াকিন।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সক্রিয় ১০-১৫টি সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রতিটিতে রয়েছে ৭০-৮০ জন করে সদস্য। প্রত্যেক বাহিনীর কাছে রয়েছে অর্ধ শতাধিক দেশীয় ও বিদেশি অস্ত্র। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের গোলাবারুদ। নির্জন পাহাড়ে আস্তানা গাড়ায় তাদের সন্ধান পায় না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে, মাঝেমধ্যে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চালানো হয় সাঁড়াশি অভিযান। বেশ কয়েকটি অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত হয়েছে বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী। গ্রেপ্তার হয়েছে কয়েকটি সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধানও। তারা বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্যানুযায়ী, গত চার বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ৭১টি খুন, ৭৬২টি মাদক, ২৮টি মানব পাচার, ৮৭টি অস্ত্র, ৬৫টি ধর্ষণ ও ১০টি ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে। ৩৪টি মামলা হয়েছে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের অপরাধে। গত ১ বছরে ২০টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে কক্সবাজারের এপিবিএন-১৬। র‌্যাবের অভিযানে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে দেশীয় ৬৮টি অস্ত্র ও বিদেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে ১০টি। এ সময়ে অস্ত্র ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৩৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ১৮ জন সন্ত্রাসী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা জানান, অধিকাংশ রোহিঙ্গা ক্যাম্প পাহাড়ি এলাকায়। সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের গুদামও সেখানে। রাতে জনপদে নেমে আসে ডাকাতিসহ খুন খারাবি করতে। পেশাদার এসব খুনি চুক্তিতে খুনের কাজও করে। হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে আবার চলে যায় গোপন আস্তানায়। এমনকি একজনের কাছেই আছে দশটি আগ্নেয়াস্ত্র। কিছু বিদেশি, কিছু দেশি। ক্যাম্পে অত্যাধুনিক অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র এখন সন্ত্রাসীদের হাতে হাতে। তবে তাদের সঙ্গে কিছু স্থানীয় লোকজনও জড়িত রয়েছে।
কক্সবাজারের এপিবিএন-১৪ এর অধিনায়ক পুলিশ সুপার মো. নাইমুল ভোরের কাগজকে বলেন, রাতের আঁধারে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে আসা যাওয়া করে। বেশির ভাগ ঘটনায় দেখা গেছে, মাদকের চোরাচালান থেকে প্রাপ্ত অর্থ তারা অস্ত্র কেনার জন্য ব্যবহার করছে। তবে, খুব বেশি উন্নত অস্ত্র কিংবা বেশি পরিমাণ অস্ত্র তাদের কাছে রয়েছে বলে মনে হয় না। সবই দেশীয় ওয়ান শুটারগান জাতীয় অস্ত্র। তবে, ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তৎপর রয়েছে। যে কোনো তথ্য পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
কক্সবাজারের এপিবিএন-১৬ এর অধিনায়ক পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে প্রায়ই অস্ত্র উদ্ধার করা হলেও এসব অস্ত্রের অর্থ তারা কোথায় পাচ্ছে, সেটি সুনির্দিষ্ট করে বলার মতো জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। তবে, প্রতিটি ঘটনায় আমরা অস্ত্রের উৎস ও অর্থায়ন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।
কক্সবাজারের র‌্যাব-১৫ এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, মাদক ও অস্ত্র বেচাকেনার মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যেহেতু রোহিঙ্গাদের একটি অংশ আগে থেকেই মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত; সেহেতু তারাই মাদকের সঙ্গে অস্ত্র নিয়ে আসছে। ইতোপূর্বে চাপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্র আসার তথ্যও আমরা পেয়েছি। এর বাইরে অন্য কোনো উপায়ে তারা অর্থের জোগান পাচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সঠিক জানা নেই।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে যে অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলোর ভিন্ন রকম প্রেক্ষাপট। ঢালাওভাবে বলা সম্ভব নয় কিভাবে তারা অর্থের জোগান পাচ্ছে। তবে, প্রতিটি মামলা তদন্তে সব ধরনের তথ্যের বিষয়ে জোর দেয়া হয়ে থাকে।
টেকনাফ থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, নাফ নদী পার হয়ে রোহিঙ্গারা সহজে মিয়ানমারে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে তারা অস্ত্র নিয়ে আসছে। আমাদের প্রাথমিক ধারণা চোরাচালানের অর্থ দিয়েই অস্ত্র কেনা হচ্ছে। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কিনা সে বিষয় থানা পুলিশের পক্ষে বলাটা সম্ভব নয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়