টার্গেট পূরণে সংশয়! : দুর্গাপূজায় ভারতে যাচ্ছে ২০০০ টন ইলিশ

আগের সংবাদ

এনআইডি স্বরাষ্ট্রে নেয়ার প্রক্রিয়া জানেই না ইসি

পরের সংবাদ

ফল চাষে সাফল্যের চমক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

** ফল চাষের জমি বাড়ায় বিশ্বে শীর্ষে বাংলাদেশ ** দেশীয় ফল উৎপাদনে শীর্ষ দশে ** ৭২টি দেশি-বিদেশি ফল চাষ **
তানভীর আহমেদ : বাংলাদেশ ফল উৎপাদনে পৌঁছেছে উচ্চতার শিখরে। দেশীয় ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় ১০ নম্বর অবস্থানে বাংলাদেশ। প্রতি বছর ফল উৎপাদনে আগের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফল গবেষকরা বলছেন, দুই যুগ আগেও আম, কাঁঠাল, লিচু, দেশি বরই, জাম, কলা ছিল এ দেশের প্রধান ফল। এখন দেশে ৭২টিরও বেশি দেশি-বিদেশি ফল চাষ হচ্ছে। একই সঙ্গে নিত্যনতুন ফল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ সফলতা পেয়েছে। কম আয়তনের দেশ হয়েও ফল চাষে জমি বাড়ার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। বছরে ১০ শতাংশের বেশি হারে ফল চাষের জমি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ফল গবেষকরা। এটি আগামী কয়েক বছরে দ্বিগুণ হবে বলেও আশাবাদ তাদের।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ তথ্যে জানা যায়, গত ২০ বছর ধরে বাংলাদেশে সাড়ে ১২ শতাংশ হারে ফল উৎপাদন বাড়ছে। একই সঙ্গে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ৪টি ফলের মোট উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়, আমে সপ্তম ও পেয়ারায় অষ্টম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে দশম। আম, কাঁঠালের বাইরে মৌসুমি ফলের মধ্যে আছে জাম, লিচু, কুল, কামরাঙা, পেঁপে, বেল, লেবু, আনারস, আতা, সফেদা, লটকন ও তরমুজ।
বিশ্বে ফল উৎপাদনে সর্বোচ্চ হারের রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ। আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরে দেশে ফলের উৎপাদন প্রায় ২৩ লাখ টন বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশি-বিদেশি জাত মিলে উৎপাদিত ফলের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২৩ লাখ ৮৯ হাজার টন। ২০ বছর আগে আম আর কাঁঠাল ছিল এ দেশের প্রধান ফল। এখন বাংলাদেশে ৭২ প্রজাতির ফলের চাষ হচ্ছে। আগে হতো ৫৬ প্রজাতির ফল চাষ। এছাড়া বিশ্বের অন্যতম পুষ্টিকর ফল ড্রাগন, অ্যাভোকাডো, রাম্বুটান, স্ট্রবেরি, ডুমুর, মাল্টা, বেল, নারিকেল, জাম্বুরা, রংগন, সূর্য ডিম ও খেজুরের বেশ কয়েকটি জাতের চাষও দেশে দ্রুত বাড়ছে।
দেশের উৎপাদিত ফলের প্রায় ৬০ শতাংশ বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও শ্রাবণ (মে-আগস্ট) মাসেই পাওয়া যায়। এছাড়া বিভিন্ন রকম দেশীয় ফল পাওয়া যায়। তবে আম, কাঁঠাল,

লিচু, পেয়ারা, আনারসই প্রধান। পাওয়া যায় জাম, আমলকী, আতা, করমজা, জামরুল, বেল, গাব, কাঁচা তাল ইত্যাদি। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে উৎপাদন হয় ২১ শতাংশ, যার মধ্যে আমড়া, কামরাঙা, কদবেল, চালতা অন্যতম। জানুয়ারি থেকে এপ্রিলে উৎপাদন হয় মোট ফলের ১৯ শতাংশ, যার মধ্যে কুল, বেল, কলা ও সফেদা অন্যতম।
ফল উৎপাদনে সম্প্রতি অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে পাহাড়ি এলাকা। দেশের উল্লেখযোগ্য অংশ পাহাড়ি অঞ্চল। পাহাড় ছড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের কিছু অংশে, ময়মনসিংহের দক্ষিণাংশে, সিলেটের উত্তরাংশে, কুমিল্লার পূর্বাংশে, নোয়াখালীর উত্তর-পূর্বাংশে ও পার্বত্য চট্টগ্রামে। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামেই আছে দেশের মোট জমির প্রায় ১০ শতাংশ। এসব পাহাড়ের অনেকটা বনাঞ্চল।
ভূমি বৈচিত্র্যের জন্য মাঠ ফসলের চেয়ে উদ্যান ফসল চাষে পাহাড় বেশি উপযোগী। উদ্যান ফসলের মধ্যে বহু রকমের ফল পাহাড়ে চাষ করা যায়। পাহাড়ে প্রায় ২০ রকমের ফল খুব ভালোভাবে চাষ করা যায়। বর্তমানে পাহাড়ে বেশ কয়েক রকমের ফলের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে যেমন- আম, কলা, কাঁঠাল, লেবু ও আনারস। নতুন ফলের মধ্যে ড্রাগন ফল, মাল্টা ও কমলা চাষ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। বান্দরবানের রামুতে চাষ করা হচ্ছে কাজুবাদাম। খাগড়াছড়িতে প্যাসন ফল চাষের সফলতাও দেখা গেছে। এরই মধ্যে সরকার এ অঞ্চলে পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আর্থিক ও পুষ্টির চাহিদা উন্নয়নের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় আম। এক সময় শুধু রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে হিমসাগর, গোপালভোগ, ল্যাংড়া ও ফজলি আমের ওপর দেশের চাষিরা নির্ভরশীল ছিলেন। এক যুগ আগে আম্রপালি আমের উদ্ভাবন আম চাষের সব ভৌগোলিক বাধা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এখন দেশের মোট উৎপাদিত আমের ৪০ শতাংশ এই জাতের।
কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল। ‘ভিটামিন-এ’সহ অন্যান্য পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল কাঁঠালকে বলা হয় মাংসের বিকল্প। সারা বিশ্বে বছরে ৩৭ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়। সবচেয়ে বেশি কাঁঠাল হয় ভারতে, যার পরিমাণ ১৮ লাখ টন। দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ, ১০ লাখ টনের বেশি।
বাংলাদেশের খুব প্রিয় ফল লিচু এখন দিনাজপুর ছাড়িয়ে পাবনা, নাটোর, মেহেরপুর এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৭ দশমিক ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে ৮০ হাজার টন লিচু উৎপাদন হয়েছে। লিচুর উন্নত জাতের মধ্যে বেদানা, বোম্বাই, চায়না-২, চায়না-৩, বারি লিচু-৩, বারি লিচু-৪ বাণিজ্যিক বাগানগুলোতে ব্যাপক চাষ হচ্ছে।
পেয়ারা উৎপাদনে বর্তমানে বিশ্বের অষ্টম স্থানে বাংলাদেশ। এ অর্জন হয়েছে গত ১০-১২ বছরে। এক সময় শুধু দেশি পেয়ারার চাষ হতো। বর্তমানে কাজি পেয়ারার চাষ বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। সিডলেস জাতের পেয়ারা ও থাই জাতের পেয়ারা বেশ জনপ্রিয়। এক সময় পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিতে সবচেয়ে বেশি পেয়ারা হতো। বর্তমানে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশির ভাগ জেলায় পেয়ারার চাষ হয়। উল্লেখ্য, পেয়ারার কিছু উন্নত প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনার উদ্ভাবনের মাধ্যমে সারা বছর পেয়ারাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে।
ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ জনপ্রিয় ফল লেবু সারা বছর মানুষ খায়। লেবুর অনেক জাতের মধ্যে পাতি লেবু, কাগজি লেবু, এলাচি লেবু, সিডলেস লেবু, সরবতি লেবু, বাতাবি লেবু, কমলা লেবু ও মাল্টা লেবু উল্লেখযোগ্য। সারাদেশে লেবু চাষ হলেও মৌলভীবাজার, সিলেট, খাগরাছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, রংপুর, পাবনা, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলায় সর্বাধিক লেবু উৎপন্ন হয়। বর্তমানে সীমিত আকারে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে লেবু রপ্তানি হয়। ছাদে লেবু চাষ অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বারি মাল্টা-১, বাউকুল, আপেলকুল, ড্রাগন ফল ছাদ বাগানের মাধ্যমে ফল চাষে নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সাত্তার মণ্ডল বলেন, ফল চাষে বাংলাদেশে একটি বিপ্লব হয়েছে। গত ১০ বছরে দেশে বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষের পাশাপাশি বাড়ির আঙিনা ও সড়কের পাশে ফলের গাছ রোপণের প্রবণতা বেড়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মেজবাহুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফলের উৎপাদনে বাংলাদেশ রেকর্ড করেছে। দেশে বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষের পাশাপাশি বাড়ির আঙিনা, বাসার ছাদ ও রাস্তার ধারে ফলের গাছ রোপণ হচ্ছে। এতে কৃষকরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি দেশের ফল উৎপাদনও বাড়ছে। তিনি বলেন, অঙ্গজ প্রজননের মাধ্যমে ফল উৎপাদনে বেশি সাফল্য এসেছে। আগে বীজের চারার মাধ্যমে ফল পেতে ৮-১০ বছর লেগে যেত। বর্তমানে এ পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে কৃষকরা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ফল চাষের জন্য অঙ্গজ প্রজনন ব্যবহার করছে। এতে পরের বছরই ফল পাচ্ছেন তারা। আর এটি সম্ভব হয়েছে কৃষিবিজ্ঞানী ও গবেষকদের নিবিড় গবেষণার কারণে। এখন এমন কিছু বিদেশি ফল এ দেশে জায়গা করে নিয়েছে, যা আগে ছিল না। এই ফলগুলোর অতিরিক্ত উৎপাদন আমাদের মোট ফল উৎপাদনে প্রতি বছর নতুন নতুন রেকর্ড এবং বিশ্বে ফল উৎপাদনেও জায়গা করে নিচ্ছে।
কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত এবং কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ গড়া। সেলক্ষ্য বাস্তবায়নে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে। দেশে ফলের উৎপাদন বাড়ানো ও তার চাষ সম্প্রসারণের কাজ অব্যাহত রয়েছে। সুষম খাদ্য নিশ্চিত করতে ফলের উৎপাদন ও উন্নয়নের দিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়