ই-অরেঞ্জের সাবেক সিওও রাসেল রিমান্ডে

আগের সংবাদ

যাত্রীসেবার মান তলানিতে : সড়ক আইন প্রয়োগে উদাসীনতা > নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ কর্তৃপক্ষের

পরের সংবাদ

জরাজীর্ণ লাইন, ঝুঁকিপূর্ণ সেতু, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন : চলতি বছরেই শতাধিক রেল দুর্ঘটনা

প্রকাশিত: আগস্ট ৩১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৩১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এন রায় রাজা : মেয়াদোত্তীর্ণ ৭৩ শতাংশ ইঞ্জিন দিয়ে চলছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সাধারণত ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল ২০ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে ৬০ বছরের পুরনো ইঞ্জিনও রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে নিয়ে আসা কানাডার জিএম বি-১২ মডেলের ইঞ্জিনই মূলত রেলের ভরসা। যেগুলো অনেক আগেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাদুঘরে ঠাঁই নিয়েছে। অন্যদিকে জরাজীর্ণ লাইন, ঝুঁকিপূর্ণ রেল সেতুর কারণে কমেছে রেলের গতি, বাড়ছে দুর্ঘটনা। এমনকি দীর্ঘ সময় চলাচল ও ইঞ্জিনের সক্ষমতা না থাকায় আগুন লাগার ঘটনাও মাঝেমধ্যে ঘটছে। সব মিলিয়ে অনেকটা জীবন বাজি রেখেই চলছেন রেলযাত্রীরা।
এদিকে, রেলের পরিসংখ্যান ঘেটে দেখা গেছে, প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে ৩টি দুর্ঘটনা ঘটে। চলতি সপ্তাহে ৭টি ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটেছে। তারমধ্যে গতকাল সোমবার সোনার বাংলা এক্সপ্রেস সীতাকুণ্ডের ইয়াকুব নগরে এবং খুলনা থেকে পার্বতীপুরগামী ট্যাঙ্কারবাহী ট্রেন উথলী স্টেশনে লাইনচ্যুত হয়। এছাড়া গত দুদিন আগে ঢাকা এবং আশপাশে ট্রেনের ধাক্কায় তিনজন নিহত হয়। চলতি বছরের এ পর্যন্ত রেলওয়ের দুটি অঞ্চলে প্রায় শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। যার অধিকাংশই লাইন মেরামতের অভাব, পুরাতন বগি ও ইঞ্জিন এবং মান্ধাতার আমলের কাঠের তৈরি স্লিপার ভেঙে এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তদন্ত রিপোর্টে উঠে এসেছে।
দেশের প্রায় ৩ হাজার ৫৭ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে হাজারখানেক কিলোমিটার অন্তত ৫০ বছর আগের, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে ৮০০ কিলোমিটার রেললাইনের সংস্কারে কাজ চলছে ধীরগতিতে। দীর্ঘ লকডাউনে ক্লিব, ফিসপ্লেটসহ রেলপথে পর্যাপ্ত পাথর ও মাটি দিয়ে সংস্কারের কথা থাকলেও তেমন কোনো কাজ হয়নি। মূলত মনিটরিংয়ের অভাবে এসব লাইন ঝুঁকিতেই রয়ে গেছে। এতে রেল দুর্ঘটনা নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ বছরে লাইন মেরামত ও সংস্কারে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয় হয় রেলের।
এ ব্যাপারে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, বিএনপি-জামায়াতের আমলে রেলের কোনো উন্নয়ন

ঘটেনি। ইঞ্জিন, বগি, ডাবল লাইনসহ অনেক কিছুরই স্বল্পতা রয়েছে। রেলের মোট ইঞ্জিনের মধ্যে ৭৩ শতাংশের মেয়াদ পার হয়ে গেছে বলে তিনি স্বীকার করেন। তবে স্বল্পতা কাটাতে ইন্দোনেশিয়া থেকে বগি আনা হয়েছে এবং আরো আসবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের অপারেশন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার সময় রেলওয়েতে লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিন ছিল ৪৮৬টি। বর্তমানে তা ২৭৩টিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এসব ইঞ্জিনের মধ্যে ১৯৫টিই মেয়াদোত্তীর্ণ। মিটারগেজ ও ব্রডগেজের ৩৯টি মিলিয়ে বর্তমানে ৭৮টি ইঞ্জিনের কার্যদক্ষতা রয়েছে। অর্থাৎ ৭৩ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়ে চলছে রেলওয়ের সেবা। সচল ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে ব্রডগেজ ৯৪টি। বাকি ১৭৯টি মিটারগেজ ইঞ্জিন। মিটার গেজের ১৪০টি ইঞ্জিনই মেয়াদোত্তীর্ণ। এসব ইঞ্জিনের মধ্যে ৪৫টি ইঞ্জিনের বয়স ২১-৩০ বছর, ৩১টির বয়স ৩১-৪০ বছর এবং ৬৪টি ইঞ্জিনের বয়স ৪১-৬০ বছরের বেশি। আর ৯৪টি ব্রডগেজ ইঞ্জিনের মধ্যে ২৪টির বয়স ৩১-৪০ বছরের মধ্যে। ৩১টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন ৪১ বা তারও বেশি বছর ধরে চলছে।
রেলসূত্র জানায়, ১৯৬১ সালে আমেরিকা থেকে ২২০০ সিরিজের (এমইজি-৯) ১১টি, ১৯৬৯ সালে কানাডা থেকে ২৩০০ সিরিজের (এমইএম-১৪) ৮টি, কানাডা থেকে ১৯৭৮ সালে ২৪০০ সিরিজের (এমইএম-১৪) আরো ৯টি এবং ১৯৮১ সালে হাঙ্গেরি থেকে ৩৩০০ সিরিজের (এমএইচজেড-৮) ৩টি ইঞ্জিন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জন্য আনা হয়েছিল। ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ২৯০০ সিরিজের (এমইআই-১৫) একটি ইঞ্জিন আনা হয়। এসব ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল ২০ বছর নির্ধারিত। আমেরিকা থেকে আনা ১১টির আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে ৩৮ বছর আগেই। কানাডা থেকে প্রথম ধাপে আনা ৮টি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে ৩০ বছর আগেই। দ্বিতীয় ধাপে কানাডা থেকে আনা ৯টির আয়ুষ্কাল উত্তীর্ণ হওয়ার পরও ৪১ বছর ধরে চলছে। হাঙ্গেরি থেকে আনা ৩টির আয়ুষ্কাল উত্তীর্ণ হয়ে ৩৮ বছর হয়েছে। এসব ইঞ্জিনের অনেকগুলোর পায়ের ডিজিটাল ব্রেক কাজ করে না। ‘ডেডম্যান ফুট প্যাডেল’ কাজ করছে না। হাতের ব্রেক কাজ করলেও জরুরি পায়ের ব্রেক কাজ করছে না। এ রকম ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে হাজার হাজার যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে বিভিন্ন এক্সপ্রেস। অনেক ইঞ্জিনের জিআই তার দিয়ে জোড়া লাগানো হয়েছে ব্রেকসহ নাট-বল্টু। বেশিক্ষণ চললে অনেক সময় গরম হয়ে আগুনও ধরে যায়। রেলওয়ের কমলাপুর বগি ওয়ার্কশপের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন প্রায় ১০-১২টি ইঞ্জিন মেরামতের জন্য ওয়ার্কশপে আসে। অধিকাংশ ইঞ্জিন জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করা হয়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বলেন, রেলওয়ের উন্নয়ন করতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। বিনিয়োগ হচ্ছে কিন্তু গুরুত্ব বিবেচনা করা হচ্ছে না। টেকসই উন্নয়নে কৌশল জরুরি বিষয়। তিনি বলেন, সরকারি ছত্রছায়ায় উন্নয়ন হলেও সেবা সঠিকভাবে পাওয়া যায় না এটা পরীক্ষিত। সড়ক, নৌ, আকাশপথে যাত্রী পরিবহনে বেসরকারি বিনিয়োগ রয়েছে। শুধু রেলে সরকারিভাবে সেবা দেয়া হয়। রেলসেবাকে নিরাপদ ও লাভজনক করতে চাইলে দ্রুতগতিতে চলার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। রেলপথে লেভেলক্রসিংয়ে হাটবাজার সরিয়ে নিরাপদে চলার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। রেলের উন্নয়নে যাত্রীদের সময় যেমন বাঁচবে তেমনি খরচও কমবে। তাই রেলওয়েকে আধুনীকায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে বেসরকারি উদ্যোগও কাজে লাগাতে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়