ম্যান ইউতে ফিরলেন রোনালদো

আগের সংবাদ

চেনা উইকেটে অচেনা নিউজিল্যান্ড

পরের সংবাদ

ঝরে গেল তিন নক্ষত্র

প্রকাশিত: আগস্ট ২৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : তারা তিনজনই কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন এঁকেছেন। সাহিত্যাঙ্গনে বিস্ময় ছড়িয়ে রচনা করে গেছেন সুন্দরের পথ। সে পথ-আলোয় মেধার জড়োয়া দিয়ে ভরিয়েছেন অজ¯্র পাঠকের মন-মনন। গতকাল শনিবার বাঙালির বুকে বিষাদের রুমাল গুঁজে দিয়ে একই দিনেই নিভে গেলেন সেই তিন প্রজ¦লিত সূর্য! দূরে বহু দূরে চলে গেলেও তারা রেখে গেছেন অমর সব সাহিত্যকীর্তি!
ঝরে যাওয়া তিন নক্ষত্র হলেন- দেশের পাঠকপ্রিয় গোয়েন্দা কাহিনি ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের লেখক বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক শেখ আবদুল হাকিম, কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী ও রম্যলেখক আতাউর রহমান। এই তিন গুণীর মৃত্যুতে শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
শেখ আবদুল হাকিম : গতকাল শনিবার বেলা একটায় রাজধানীর মাদারটেকের নন্দীপাড়ায় বড় মেয়ের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। মৃত্যুকালে ছেলে শেখ পুলক হাসান, দুই মেয়ে শেখ সাদিয়া হাকিম, শেখ আপালা হাকিমসহ আত্মীয়স্বজন এবং সারাদেশে তার লেখার অসংখ্য গুণমুগ্ধ অনুরাগী পাঠক রেখে গেছেন শেখ আবদুল হাকিম। তার স্ত্রী ফরিদা বেগম ছয় বছর আগে গত হন।
আপালা হাকিম গণমাধ্যমকে জানান, দীর্ঘদিন ধরেই তার বাবা শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। সম্প্রতি রোগের তীব্রতা বেড়ে গেলে গত মাসে তাকে চিকিৎসার জন্য বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে প্রায় মাসখানেক চিকিৎসা নেয়ার পরে অবস্থার উন্নতিও হয়। বাড়িতে আনার পর আবার গত দুয়েক দিন থেকে শ্বাসকষ্ট কিছুটা বেড়েছিল। গতকাল সকালে তার শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক থাকলেও দুপুরের দিকে আকস্মিকভাবেই দ্রুত অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়। বাদ মাগরিব জানাজা শেষে নন্দীপাড়া কবরস্থানেই তাকে দাফন করা হয়।
শেখ আবদুল হাকিমের জন্ম ১৯৪৬ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। তার বাবার নাম শেখ আবদুর রফিক। তারা পাঁচ ভাই, তিন বোন। দেশভাগের পর তারা ঢাকায় চলে আসেন। শেখ আবদুল হাকিম গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে দেশের অন্যতম প্রকাশনা সংস্থা সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পেশাদার লেখক হিসেবে কাজ করছিলেন। এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের জনপ্রিয় রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস সিরিজ ‘কুয়াশা’ ও ‘মাসুদ রানার’ অনেক বইয়ের নেপথ্য লেখক ছিলেন তিনি। এ ছাড়া নিজ নামেও তিনি এই ধারার বহু জনপ্রিয় রোমাঞ্চ

উপন্যাসের অনুবাদ এবং মৌলিক উপন্যাস রচনা করে পাঠকসমাজে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বিশেষ করে তার অনুবাদে মারিও পুজোর গডফাদার এ দেশের পাঠক সমাজে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে।
জনপ্রিয় এই লেখক সেবা প্রকাশনীর মাসিক ‘রহস্য পত্রিকা’র সহকারী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত ছিলেন অনেক বছর। লেখক সম্মানী ও স্বত্ব নিয়ে সেবা প্রকাশনীর প্রকাশক কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে তার দ্ব›দ্ব আদালত পর্যন্ত গড়ায়। শেখ আবদুল হাকিমের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে- টেকনাফ ফর্মুলা, জুতোর ভেতর কার পা, জল দাও জল, মুঠোর ভেতর তেলেসমাতি, ঋজু সিলেটীর প্রণয়, আতঙ্ক, সোমালি জলদস্যু, আইডিয়া, তিতলির অজানা, লব্ধ সৈকত, জ্যান্ত অতীত, তাহলে কে?, চন্দ্রাহত, সোনালি বুলেট, কামিনী প্রভৃতি। এছাড়া কয়েক খণ্ডে প্রকাশ হয়েছে ?উপন্যাস সমগ্র।
তার অনুবাদগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- এরিক মারিয়া রেমার্কের ‘দ্য ব্ল্যাক অবিলিস্ক’, ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’, ভিক্টর হুগোর ‘দ্য ম্যান হু লাফস’, জুলভার্নের ‘আশি দিনে বিশ্বভ্রমণ’, মার্ক টোয়েনের ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অব হাকলবেরি ফিন’, মেরি শেলির ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’, আলেকজান্ডার দ্যুমার ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’, ডগলাস ফ্রাঞ্জ ও ক্যাথেরিন কলিন্সের ‘দ্য ম্যান ফ্রম পাকিস্তান : নিউক্লিয়ার স্মাগলার আবদুল কাদির খান’ এবং কেন ফলেটের ‘দ্য ম্যান ফ্রম সেন্ট পিটার্সবার্গ’-এর বাংলা ‘আততায়ী’।
বুলবুল চৌধুরী : ক্যানসারে আক্রান্ত কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী মারা গেছেন। গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে রাজধানীর নিজ বাসায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করে বুলবুল চৌধুরীর ছেলে আর রাফী চৌধুরী জানান, ছয় মাস আগে বুলবুল চৌধুরীর ক্যান্সার শনাক্ত হয়। এরপর তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনকোলোজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সারওয়ার আলমের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেন। কিন্তু ক্যান্সার তার শ্বাসযন্ত্রে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে তিনি কিছু খেতে পারছিলেন না। কেমো নেয়ার মতো তার শারীরিক অবস্থাও ছিল না। চিকিৎসকের পরামর্শে বাসায় চলছিল তার চিকিৎসা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হলেন তিনি।
রাফী চৌধুরী আরো জানান, আজ রবিবার সকাল ৯টায় বাংলাবাজারের প্যারীদাস রোডের শিমতলা মসজিদে প্রথম জানাজা শেষে সকাল ১১টায় শ্রদ্ধা নিবেদন ও দ্বিতীয় জানাজার জন্য বুলবুল চৌধুরীর মরদেহ বাংলা একাডেমিতে নেয়া হবে। তবে তাকে কোথায় দাফন করা হবে, গতকাল রাত ৯টা পর্যন্ত তা চূড়ান্ত হয়নি।
অতি সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত বুলবুল চৌধুরী ১৯৪৮ সালের ১৬ আগস্ট গাজীপুরের দক্ষিণবাগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পড়ালেখা করেছেন তখনকার জগন্নাথ কলেজে। তার প্রথম লেখা বের হয় ১৯৬৭ সালে। প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘টুকা কাহিনি’ দিয়েই সাহিত্য জগতে সাড়া ফেলতে সক্ষম হন। তিনি নিজের অধিকাংশ লেখায় গ্রামীণ জীবনকে নানা আঙ্গিকে উপস্থাপন করেন। এছাড়া নগরায়ণের জটাজালও তার লেখালেখিতে অনন্য বিচিত্রতায় উঠে আসে। লেখালেখির বাইরে পেশাগত জীবনে বুলবুল চৌধুরী সাংবাদিকতার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন বহুদিন। কাজ করেছেন দেশের প্রথম সারির বিভিন্ন দৈনিকে।
তার প্রকাশিত ছোট গল্পগ্রন্থগুলো হলো- ‘টুকা কাহিনি’, ‘পরমানুষ’, ‘মাছের রাত’ ও ‘চৈতার বউ গো’। তার উপন্যাসের তালিকায় রয়েছে- ‘অপরূপ বিল ঝিল নদী’, ‘কহকামিনী’, ‘তিয়াসের লেখন’, ‘অচিনে আঁচড়ি’, ‘মরম বাখানি’, ‘এই ঘরে ল²ী থাকে’, ‘ইতু বৌদির ঘর’ এবং ‘দখিনা বাও’।
সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২১ সালে বুলবুল চৌধুরী একুশে পদক লাভ করেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান ২০১১ সালে। এছাড়া তিনি হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, জসীমউদদীন স্মৃতি পুরস্কার এবং ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন।
আতাউর রহমান : করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সকাল ৬টায় মৃত্যুবরণ করেন বিশিষ্ট রম্যলেখক ও বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক আতাউর রহমান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। তিনি দুই ছেলে, স্ত্রীসহ অনেক আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। বাদ মাগরিব গ্রামের বাড়ি গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকা দক্ষিণ মাদ্রাসা মাঠে নামাজে জানাজা শেষে নিজ গ্রামে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
আতাউর রহমান ১৯৪২ সালে সিলেট সদর মহকুমার গোলাপগঞ্জ থানার নগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনা করেন ঢাকা দক্ষিণ হাইস্কুল, সিলেট এমসি কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কর্মজীবনের শুরুতে সিলেট মদন মোহন কলেজে এবং পরে সিলেট এমসি কলেজের ইংরেজি বিভাগে প্রায় চার বছর অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি সুপিরিয়র সিভিল সার্ভিস (সিএসপি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ডাক বিভাগে যোগদান করেন। সর্বোচ্চ পদ মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ২০০২ সালে অবসরে যান তিনি। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তিনি আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। সাড়ে চার বছর লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসে এবং আড়াই বছর রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন তিনি। সুবক্তা হিসেবেও সুনাম ছিল তার। আতাউর রহমান ২৪টি মূল্যবান গ্রন্থের রচয়িতা। তার লেখা ‘পরদাদার ভ্রমণ কাহিনি’, ‘নঞ তৎপুরুষ’, ‘দুই দুগুনে পাঁচ’, ‘নিদ্রাহীন নিশিথে’, ‘যৎকিঞ্চিৎ’ প্রভৃতি গ্রন্থ ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়