ডুপ্লেক্স বাসায় অগ্নিকাণ্ডে দুই গৃহকর্মীর মৃত্যু

আগের সংবাদ

খোঁড়াখুঁড়িতে জনদুর্ভোগ : লকডাউনে কাজ করলে এখন ভোগান্তি হতো না > জমানো পানিতে বাড়ছে এডিস মশা

পরের সংবাদ

পাহাড়ই আমাদের মা ছেড়ে যাব কোথায়?

প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইমরান রহমান, শেরপুর থেকে : গারো পাহাড়ের ঢালে একটি কুঁড়েঘরে বাস করেন শারীরিক প্রতিবন্ধী ফৈমনি চিরান (৪০)। সঙ্গে থাকেন তার মা জরমোন চিরান ও স্বামী রুপম রেমা। স্বামীর দিনমজুরির সামান্য টাকায় টানাপড়েনের সংসার। শারীরিক অক্ষমতার কারণে বেশি কিছু করতে পারেন না, তবুও পরম যতেœ ঘরের পাশে বরবটি চাষ করেছিলেন। কিন্তু সেই বরবটি আর কপালে জোটেনি ফৈমনির। বন বিভাগের কর্মকর্তারা এসে তার স্বপ্নের বাগান মুহূর্তেই কেটে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। এ কথা বলতে বলতে চোখের অশ্রæ যেন থামছিলই না। চোখ মুছতে মুছতে বললেন, বাপ-দাদা যা করে গেছে, আমরাও তাই করব। কিন্তু বন বিভাগ কিছু করতে দেয় না। এমন হইলে এই পাহাড়ে আমরা খাব কি? চলব কিভাবে? পাহাড়ই তো আমাদের মা, ছেড়ে যাব কোথায়?
শুধু ফৈমনি নয়, শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুরি এলাকার খ্রিস্টানপাড়ার বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, বন বিভাগের অপতৎপরতায় অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে সেখানকার ৪৭টি পরিবার। সামাজিক বনায়নের প্রকল্প ‘সুফল’-এর নামে কিছুই করতে দেয়া হচ্ছে না তাদের। বাড়ির পাশে শাকসবজি, সুপারি বাগান বা যাই আবাদ করা হোক না কেন, ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। এমনকি নিজেদের লাগানো গাছ কাটলেও বন আইনে মামলা দেয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে। সামাজিক বনায়নে যে অংশীদারত্বের কথা বলা হচ্ছে, সেখানেও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ। একই সঙ্গে সামাজিক বনায়নে একাশিয়াসহ যে গাছগুলো রোপণ করা হচ্ছে তা বনের জন্য ক্ষতিকর বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় ঐতিহাসিক গারো পাহাড়ে গারো সম্প্রদায়কে টিকিয়ে রাখতে পৃথক ভূমি কমিশন গঠনসহ ৫টি প্রস্তাব দিয়েছে নাগরিক সমাজ। তবে জেলাটিতে থাকা ৬৫

হাজার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করেই সবধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন শেরপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মোমিনুর রশিদ।
গবেষকরা বলছেন, সারা পৃথিবীতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মতো করে কেউ বন রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারেনি, পারবেও না। সুতরাং বন রক্ষায় এই নৃগোষ্ঠীদের টিকিয়ে রাখতেই হবে। সামাজিক বনায়নে জাতিসংঘ ও আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী সব নিয়ম মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
গত সোমবার বিকেলে সরেজমিনে খ্রিস্টানপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ফৈমনির প্রায় শতাধিক বরবটির গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে সবজির মাচাও। একইভাবে ওই এলাকার সোভিতা ম্রির সুপারি বাগানের ১০০ সুপারি গাছ ও আরো ৩টি পরিবারের চাষ করা লাউ, বরবটি ও করলার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। চলতি মাসের ১২ তারিখের এ ঘটনার পর থেকে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে গারো সম্প্রদায়ের সবার মধ্যে। তাদের একটি গির্জাও দখলে নিয়ে বনায়নের পরিকল্পনা করা হচ্ছে- এমন আশঙ্কায় ক্ষোভ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। ইতোমধ্যে তারা বালিজুরী রেঞ্জের বন কর্মকর্তার কার্যালয় ঘেরাও করে প্রতিবাদও করেছেন। বাসিন্দাদের অভিযোগ, বন বিভাগ তাদের উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা থেকেই এসব কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যদিও বন বিভাগ বলছে, সরকারের নির্দেশনা মানতে খাস জমি দখলমুক্ত করে বনায়নের জন্যই তারা এমনটি করেছেন।
এ বিষয়ে রেঞ্জ অফিসার (বালিজুরী) রবিউল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, সরকারের নির্দেশনা মানতে গেলেই এখানকার বাসিন্দারা আমাদের শত্রæ মনে করে। কিন্তু আমাদের কিছু করার থাকে না। শেরপুরের সহকারী বন সংরক্ষক ড. প্রান্তোষ রায় ভোরের কাগজকে বলেন, বালিজুরী রেঞ্জে ৮৮৮ জন জবরদখলকারী রয়েছেন। এদের হাত থেকে জমি রক্ষা করে সরকারের নির্দেশনানুযায়ী বনায়নের কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। শুধু গারোদের সবজি কাটা হয়নি, মুসলিম আরো ৩০টি পরিবারের দখলে থাকা জমি উদ্ধারে এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুফল প্রকল্পের আওতায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে প্রভাবশালী একটি মহলের কারণে অনেক গারো অংশীদারত্বের তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। তারপরও সবাইকে এর আওতায় এনে কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।
গারোদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে, শেরপুরের জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশিদ ভোরের কাগজকে বলেন, গারোদের দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। পরবর্তী ব্যবস্থা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী নেয়া হবে। তবে শেরপুরের ৬৫ হাজার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। সুফল প্রজেক্টের সুফল থেকে কেউ যেন বাদ না যায়, সে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি খ্রিস্টানপাড়ায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের জন্য শ্রীবরদী ইউএনওকে বলা হয়েছে।
এদিকে খ্রিস্টানপাড়ার ক্ষতিগ্রস্ত গারোদের সবজির খেত ও সুপারি বাগান পরিদর্শন শেষে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে নাগরিক সমাজ। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে শেরপুর প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ৫টি প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে- সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি গঠন করা, বন বিভাগের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া, আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি আইনে চাষাবাদ করতে দেয়া, সামাজিক বনায়নের নামে গারোদের উচ্ছেদ না করা এবং সুফল প্রকল্প পরিবেশবান্ধব করার পাশাপাশি আদিবাসীদের অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া। বনে বাস্তুসংস্থান বজায় রাখতে বন আইনের সংশোধনের প্রতিও আলোকপাত করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক সমাজের পক্ষে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরিন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারহা তানজীম তিতিল, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের ভূমি ও আইনবিষয়ক সম্পাদক, কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার উজ্জল আজিম, এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এন্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) কর্মসূচি কর্মকর্তা (আইন) একেএম বুলবুল আহমেদ প্রমুখ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়