মির্জা ফখরুল : জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার মানুষ বিশ্বাস করে না

আগের সংবাদ

বিলুপ্তির পথে সোনাগাজীর ঐতিহ্য ‘পানের বরজ’

পরের সংবাদ

জাহাঙ্গীর কবির নানক : হঠাৎ বিস্ফোরণে সব তছনছ হয়ে গেলো

প্রকাশিত: আগস্ট ২০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মুহাম্মদ রুহুল আমিন : বরিশাল এ কে স্কুলে পড়ার সময় ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতিখড়ি জাহাঙ্গীর কবির নানকের। ১৯৭১ সালে বরিশাল বিএম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রসংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। এরপর বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক, পরে সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, পরে সাধারণ সম্পাদক। এরপর যুবলীগে প্রথমে সাংগঠনিক, পরে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং পরে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, পরে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা-১৩ আসন থেকে দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দায়িত্ব পালন করেছেন স্থানীয় সরকার ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনি এলএলবি পাস করেছেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কারাবরণ করেছেন একাধিকবার।
বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনাবহুল দিনটি নিয়ে ভোরের কাগজের সঙ্গে কথা বলেন সেই সময়ের যুবলীগের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির নানক।
সেদিনের স্মৃতিচারণ করে নানক বলেন, আমি তখন যুবলীগের চেয়ারম্যান। ঘটনার দিন সকাল থেকেই আমরা ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ছিলাম। সাংবাদিকরাও ছিলেন। বিকালে সমাবেশ। অন্যান্য দিন সমাবেশস্থল ও আশপাশের ভবনে পুলিশ মোতায়েন থাকে। আমাদেরকে জিজ্ঞেসও করেন কোনো সমস্যা আছে কিনা। কিন্তু ওইদিন কোনো পুলিশ নেই। কি রকম যেন একটা গুমোট পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। সন্দেহ আরো গভীর হয় ও উদ্বেগ বাড়ে। প্রশ্ন জাগে সমাবেশকে ঘিরে তাদের পরিকল্পনা কী? নেত্রী আসার আগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা যুবলীগ অফিসে বসে আছেন। এর মধ্যে খবর এলো যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশে আসার কর্মসূচিটি বাতিল করা হয়েছে। এই খবর শুনে সবাই উৎফুল্ল। হঠাৎ একজন এসে জানাল পীর ইয়ামেনী মার্কেটে কিছু লোক রহস্যজনকভাবে ঘোরাঘুরি করছে। সুধাসদন থেকে খবর পেলাম নেত্রী রওনা দিচ্ছেন দলের সিনিয়র নেতারা আমু ভাই, সুরঞ্জিত দা, কাদের ভাই মঞ্চে চলে গেলেন। আমরা নেত্রীকে রিসিভ করার জন্য যুবলীগের প্রায় দুই হাজার নেতা-কর্মী ওসমানী মিলনায়তনের সামনে গেলাম। নেত্রীর গাড়ি স্কট করে সমাবেশে নিয়ে আসি। নেত্রীর গাড়ি দেখে পুরো এলাকা লোকারণ্য হয়ে গেল। নেত্রীর গাড়ি খুব কষ্ট করেই ভেতরে নিয়ে গেলাম।
সম্প্রতি ধানমন্ডির নিজ অফিসে ভয়াল একুশে আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে নিজের দেখা সেদিনের বিবরণ এভাবেই ভোরের কাগজের কাছে তুলে ধরেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক।
নানক বলেন, সমাবেশ শেষে শান্তি মিছিলের কর্মসূচি ছিল। নেত্রীকে নিয়ে সমাবেশে ঢুকতেই কাঁটাতারের বেড়া ছিল। নেত্রীর গাড়ি ঢোকার পর আমরা আর ভেতরে গেলাম না, কারণ সেখানে স্পেস ছিল না। আমরা মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছি। দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুনছি। বিকেল ৫টা ১৩ মিনিটে নেত্রীর বক্তৃতা শেষ পর্যায়ে। আমরা মিছিল করব, প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ মঞ্চ ঘিরে শুরু হলো একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ। মুহুর্মুহু শব্দে সবকিছু তছনছ হয়ে গেল। বাঁচাও বাঁচাও, মাগো, বাবাগো চিৎকারে পুরো এলাকা আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে গেল। মানুষ চারদিকে ছুটোছুটি করছে। লোকের ধাক্কা আর দৌড়াদৌড়ির ভিড়ে আমরা পীর ইয়ামেনী মার্কেটের ভেতরে ঢুকে যাই। এরপর আমরা বের হলাম। নেত্রীর খবর নিলাম। এমন সময় দেখলাম নেত্রীর বিশেষ সহকারী আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমকে দেখে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম ‘নাসিম নেত্রীর অবস্থা কী’?
তিনি বললেন, নেত্রী ভালো আছেন, সেফলি বের হয়ে সুধাসদনের দিকে গেছেন। আমরা দ্রুত সুধাসদন ছুটলাম নেত্রীর কাছে। সারাদেশের নেতাকর্মীরা টেলিফোন করে জানতে চাচ্ছেন, তারা কী করবেন! সুধাসদনে ঢুকে দেখি নেত্রী সোফায় বসা আর সোফার হাতলে বসে নেত্রীর গলা জড়িয়ে ধরে কান্না করছেন ছোট আপা (শেখ রেহানা)। কারণ নেত্রী বেঁচে ফেরত এসেছেন। নেত্রী কিংকর্তব্যবিমূঢ়, কোনো কথা বলছেন না, একেবারেই নীরব। ঘটনাস্থলের বিস্তারিত নেত্রীকে জানালাম। এরই মধ্যে নেত্রীর নিরাপত্তায় পুরো সুধাসদন কর্ডন করে রেখেছে আমাদের নেতাকর্মীরা। আমি আপাকে বললাম… ওদের (বিএনপি-জামায়াত) আর ছাড়ব না। ক্ষমতায় থাকতে দেব না। অনির্দিষ্টকালের হরতাল দিয়ে সব কলাপস করে দিব। রক্তের বদলা নেবই। ওদের পতন না ঘটা পর্যন্ত হরতাল চলবে। যেখানে যার বাড়িঘর আছে, সমস্ত জ¦ালিয়ে দেব। নেত্রী তখন বললেন… আমি রাজনীতি করি মানুষের জন্য। আগে আমার মানুষকে বাঁচাও। হরতাল হলে তারা মুভমেন্ট করতে পারবে না। রাজনীতি পরে। তিনি কেঁদে কেঁদে বললেন ‘আমার জন্য আর কত মানুষ জীবন দিবে? ওদের বাঁচাও। আমার আর রেহানার সমস্ত গহনা বিক্রি করে হলেও ওদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করো।’
তিনি আমাদের চিকিৎসকদের নিয়ে তিনটি চিকিৎসক টিম করে হাসপাতালে নামিয়ে দিতে বললেন। কারণ ড্যাবের ডাক্তাররা সরে গেছে, আহতদের কোনো চিকিৎসা তারা দেবেন না। আমরা তখন ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, প্রফেসর আ ফ ম রুহুল হকসহ আমাদের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বললাম। তারা সবাই যার যার জায়গা থেকে আহতদের চিকিৎসায় নেমে পড়লেন। ঢাকা শহর ভুতুরে নগরীতে পরিণত হয়ে গেল।
জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, সেদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ফেনীতে ছিলেন। সেখান থেকে তিনি খোঁজ নিচ্ছিলেন গুলিস্তানের কী খবর। কারণ তার নির্দেশেই এ হামলা করা হয়েছিল। কারণ ঘটনাগুলো ছিল পরিকল্পিত।
নানক বলেন, মধ্যরাতে নেত্রী সুধাসদনে আমাদের ডেকে পরদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে যেতে বললেন। আলামত সংরক্ষণের নির্দেশ দিলেন। সকাল ৮টায় পার্টি অফিসের গেলাম। মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াও আসলেন। আমরা পার্টি অফিসে ঢুকতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। আমি চিৎকার করে বললাম, আমাদের অফিসে আমরা যাব, কালকে তোমরা মারছো পাইকারিভাবে। আজকে অফিসে যাব, সেখানে যাইতে দিবা না? আমরা যাবই… বাধা দিলে মেরেই ফেলব। পুলিশের কর্মকর্তারা ওয়াকিটকিতে কথা বলার পর আমাদের ভেতরে যেতে দিল। চারদিকে ছোপ ছোপ রক্ত, তখনো শুকায়নি। হাতের আঙুল, নখ, কাঁচা গোশত, হাজার হাজার জুতা পড়ে আছে। লাল ব্যানার ছিঁড়ে লাঠিতে বেঁধে ট্রাকসহ পুরো এলাকা আমরা ঘিরে রাখলাম। গ্রেনেডের চিহ্নিত জায়গাগুলোয় লাল পতাকা টানিয়ে দিলাম। যে ট্রাকটা অস্থায়ী মঞ্চ ছিল, সেটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। চাকা পাংচার হয়ে পড়ে আছে। একজন আর্মি অফিসার আর বিচারপতি জয়নুল আবেদীন এসে আমাদের দেখে বিব্রতবোধ করছিলেন। ওইদিন রাতেই (২২ আগস্ট) সিটি করপোরেশনের গাড়ি সব আলামত ধুয়ে ফেলল। ট্রাকটা নিয়ে গেছে। কোনো আলামত তারা রাখেনি। সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে রেখেছে।
নানক বলেন, সোবহানবাগের একটি হোটেলে বসে পরদিন আমরা করণীয় নির্ধারণে বসি। ঢাকায় যেহেতু সেদিন যুবলীগ তাৎক্ষণিক তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনি। তাই আমি, যুবলীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক মির্জা আজম এবং নেত্রীর বিশেষ সহকারী আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকা মহানগর যুবলীগের ১০৯টি কমিটি প্রেস রিলিজের মাধ্যমে বাতিল করে দিলাম। এরপর সাত দিনের মধ্যে আমরা সে কমিটিগুলো গঠন করলাম। আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। সারাদেশ উত্তাল হয়ে পড়ল।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়