বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স

আগের সংবাদ

তালেবান আতঙ্কে বিশৃঙ্খলা > আফগানদের দেশ ছাড়ার হিড়িক : উড়ন্ত বিমান থেকে খসে পড়ল তিনজন

পরের সংবাদ

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র

প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

১৫ আগস্ট এমন প্রেমময় সূর্যোদয় কথাই ছিল বাংলার আকাশে-আকাশে, কিন্তু রক্তিম আভাময় ভোর জীবন্ত রক্তাক্ত রঙে রাঙানো আঁকানো হলো, কারণ রাতের আঁধার কেটে যে আলো আনন্দে শীর্ষ বাজাবে তাতে পিতার তাজা রক্ত ছড়িয়ে ছিল, জড়িয়ে ছিল, হ্যাঁ আমি ১৯৭৫ সালের সেই ভয়াল সকালের কথাই বলছি, যে সকাল মুয়াজ্জিনের আজানের মধুর সুর ধ্বনিত হওয়ার পূর্বেই রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। ১৯৭৫-এর সেই অভিশপ্ত সকালে গুলির শব্দে স্তব্ধ হয়ে যায় ঘড়ির কাঁটা, আজো সেই বাড়ির থেমে থাকা ঘড়িটি স্মৃতি হয়ে আছে, সেখানকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোরবেলা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সামরিক বাহিনীর কতিপয় দেশবৈরী ঘাতকের হাতে সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত ঘটনাটি সৃষ্টি হয়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেট যেমন বাংলাদেশের প্রগতির ধারাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। ঠিক তেমনি বিদেশে থাকা জাতির পিতার দুই কন্যা শেখ হাসিনা-শেখ রেহানার পৃথিবী যেন উলট-পালট করে দিয়েছিল। মা-বাবা-ভাইসহ স্বজন হারানোর বেদনায় ভারাক্রান্ত অসহায় দু-বোনের জীবন হয়ে পড়ে কাণ্ডারিবিহীন নৌকার মতো।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও ছিল। জিয়াউর রহমান সরকার গঠনের পর স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন। তিনি পাকিস্তানের দোসরদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। এতেই প্রমাণিত হয়, জিয়াউর রহমান আর যাই হোক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। জিয়াউর রহমান এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্তের সময়ই তাঁর জড়িত থাকার তথ্যটি পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান তখন বেঁচে না থাকায় আইনানুযায়ী তাঁকে অভিযোগপত্রে আসামি হিসেবে দেখানো যায়নি। একই কারণে খন্দকার মোশতাককেও বাদ দেয়া হয়েছে। জিয়ার পথ ধরে আমরা দেখেছি জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়া হত্যাকারীদের জাতীয় সংসদে সদস্য করে তাদের পুরস্কৃত করে। একটি বিষয়ে পৃথিবীর অন্যান্য ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপ্রধানের হত্যার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর হত্যার একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। সালভেদর আলেন্দেকে যখন হত্যা করা হয় চিলিতে তার বাসভবনে, তার স্ত্রী ও সন্তানকে হত্যা করা হয়নি। ১৯৭৫ সালে শিশুপুত্র ১০ বছরের রাসেলসহ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, যাতে রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের উত্তরাধিকারের নাম নিশানা না থাকে। মুজিব দর্শন বলে দেশে আর কিছু যেন অবশিষ্ট না থাকে। যে অবিশ্বাস্য নৃশংসতায় হত্যা করা হয়েছিল, সে রকম আর উপমহাদেশে কাউকে হত্যা করা হয়নি। ব্যতিক্রম বাংলাদেশ, বাঙালির চিরাচরিত মানসিক দীনতা দেখেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী,/রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি’। বিনাবিচারে নিরাপরাধ নারী ও শিশুসহ নির্মমভাবে যে হত্যা করা হয়েছিল, সে হত্যার কারণ, তারা পাকিস্তানের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চেয়েছিল।
বিশ্বের অনেক জাতি বা রাষ্ট্রের স্রষ্টা অস্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে নিতে হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্রষ্টা আব্রাহাম লিংকন স্বাভাবিক মৃত্যুর সুযোগ পাননি। তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ভারত ও বাংলাদেশের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু দুজনই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ঘাতকের গুলিতে নিহত হন। কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা, চিলির সালভাদর আলেন্দে, ব্রাজিলের জোয়াও গোলার্ট, ইরানের মোহাম্মদ মোসাদ্দেক, গুয়াতেমালার জ্যাকাবো আরবেঞ্জ কিংবা ঘানার কোয়ামে নক্রুমার ও মিসরের আনোয়ার সাদাত তারা নিজ নিজ দেশে যখন সংস্কারের কর্মসূচি শুরু করেছেন, সিআইএর সাহায্য নিয়ে সেই দেশের সেনাবাহিনী তাদের ক্ষমতাচ্যুত করেছে।
পৃথিবীর এই ক্ষমতাচ্যুত নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কয়েকটি বিষয়ে মিল ছিল। তিনিও তাদের মতো জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। তিনি নিজ দেশের সম্পদ সুষম বণ্টনের জন্য বিদেশনির্ভরতা কমিয়ে সংস্কারের কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের সম্পদ, তেল-গ্যাস বিদেশি কোম্পানির হাত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন শুরু করেছেন দ্বিতীয় বিপ্লব। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের ঘোর সমর্থক ছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল এবং এমনকি সপ্তম নৌবহর পাঠানোর হুমকি দিয়েছিল। এই ঘটনাটি দেশের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাব তৈরি করতে সাহায্য করেছিল।
প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সরকারের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। বঙ্গবন্ধু বললেন, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়ায় ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে গেছে। এই বাস্তবতা নিক্সন প্রশাসন মেনে নিতে পারছে না। তারা চেয়েছিল পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে মিলিতভাবে তারা ভারত মহাসাগরে নৌঘাঁটি স্থাপন ও ভারতে সোভিয়েত প্রভাব হ্রাসে ব্যবহার করবে। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মিলিতভাবে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা লাভে সাহায্য করায় তাদের এই পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর কথা থেকে বোঝা যায় উনি নিজেও জানতেন উনার সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চলছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে ঘিরে মার্কিন কূটনীতির ব্যর্থতা প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তার নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা কিসিঞ্জারের জন্য ছিল প্রবল পরাজয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয় আমেরিকা মেনেনিতে পারেনি, কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে উপহাস করেছিল, প্রতিশোধ নিতে কিসিঞ্জারের সরাসরি হস্তক্ষেপে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ওই পরাজিত শত্রæদের দোসর নিজেদের জিঘাংসা চরিতার্থ করল যেন। পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সমাজতন্ত্রী ভাবাপন্ন নেতাদের বিভিন্ন সময় সিআইএ একে একে হত্যা করেছে। ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করানো হয়েছে শিখ বিছিন্নতাবাদীদের দ্বারা।
‘বাংলাদেশ, দি আনফিনিশড রেভলিউশন’-এর লেখক লরেন্স লিফশুলজ লিখেছেন যে, মুজিব হত্যার চক্রান্তকারীরা ঢাকায় আমেরিকান দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং দুপক্ষের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনাও হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে এই যোগাযোগ রক্ষার ভার পড়েছিল ঢাকায় সিআইএর প্রধান ফিলিপ চেরির ওপর, অথচ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় আমেরিকান দূতাবাসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি গোষ্ঠীর যে যোগাযোগ ছিল তা তো নিছক রটনা নয়। স্বয়ং কিসিঞ্জার তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, এই যোগাযোগের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য তিন মাস ধরে এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা হয়েছিল। শেষ আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোস্তাক বিনা কারণে অপসারিত হননি। মেজরদের ষড়যন্ত্রের কথা খোন্দকার জানতেন মুজিবকে হত্যা করে তাকে ক্ষমতায় বসানোই যে মেজরদের ইচ্ছা তাও তার অজানা ছিল না। কাজেই যে অসামরিক যোগাযোগকারীর কথা লিফশুলজ লিখেছেন তিনি যদি খোন্দকার হন তাতে আশ্চর্য কী! তিনি আমেরিকানদের পরিচিত, আমেরিকানরাও তার পরিচিত।
ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা ছিল সেটা একদিন বের হবে। হত্যার বিচার হয়েছে। তবে এই ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা ছিল, একদিন সেটাও আবিষ্কার হবে। তবে আগামী প্রজন্ম জানতে চায়, কেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল।
সাইদ আহমেদ বাবু : কলাম লেখক ও সংগঠক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়