খুলনায় মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর : সম্প্রীতি পরিষদ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের প্রতিবাদ

আগের সংবাদ

হার্ড ইমিউনিটি কতটা সম্ভব : নতুন নতুন ধরন নিয়ে শঙ্কা >> টিকার সুফল কিছুটা হলেও মিলবে : আশা বিশেষজ্ঞদের

পরের সংবাদ

পিতৃহন্তারকদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ

প্রকাশিত: আগস্ট ১২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি : সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর একদিকে হতবিহ্বল শোকার্ত অন্যদিকে ঘাতকের উদ্ধ্যত আচরণে ভয়ার্ত জাতি সম্মিলিত প্রতিবাদ করার শক্তি হারিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দিন কিশোরগঞ্জ, পটুয়াখালী ও বরগুনাতে বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদ হলেও সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। খুনিদের দায়মুক্তি দিয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর জারি হয় কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। জাতীয় চার নেতাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই তখন কারাগারে। প্রতিবাদ যেন দানা বাঁধতে না পারে সেজন্য রমজান ও শারদীয় দুর্গাপূজার অজুহাতে দুই মাস বন্ধ রাখা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবুও বন্দুকের নল উপেক্ষা করে বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ করে অনেকেই। বাম সংগঠনগুলোই প্রথম প্রতিবাদ করে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনী সারাদেশে ২২ মাস প্রতিরোধ যুদ্ধ করে। নিহত হন শতাধিক যোদ্ধা। নিষিদ্ধ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশ্যে কবিতা পড়ার অপরাধে কবি নির্মলেন্দু গুণকে কারাবাস করতে হয় সাতদিন।
দেশের বাইরে প্রথম প্রতিবাদ করেন মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের মারদেকা টুর্নামেন্টে থাকা জাতীয় ফুটবল দল। বঙ্গবন্ধু ও তার পুত্র ক্রীড়ানুরাগী, আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালের হত্যাকাণ্ডের সংবাদে সালাহউদ্দিন ও চুন্নুদের উদ্যোগে বাংলাদেশের খেলার দিন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং খেলার শুরুতে খেলোয়াড়রা এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।
ওই সময়ের রাজনীতিবিদ, ছাত্রনেতাদের মতে, জাতীয় চার নেতা এবং তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাকসহ আওয়ামী লীগের মূল নেতাদের গ্রেপ্তারের পর গ্রেপ্তার আতঙ্কে আত্মগোপনে চলে যান অনেকেই। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার ২১ মন্ত্রীই তখন মোশতাকের কেবিনেটে। বাকশালের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে দ্বিধা করেননি। দিকনির্দেশনা না পেয়ে ছাত্রনেতারা হতাশ হয়ে পড়েন।
গায়েবানা জানাজা : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম গায়েবানা জানাজা পড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন পংকজ ভট্টাচার্য। ৪ নভেম্বর প্রথমে ‘কাঁদো কাঁদো দেশবাসী’ শিরোনামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল নিয়ে

৩২ নম্বরের দিকে যান তারা। ভয়ংকর ওই সময়ে পুলিশের বাধা ছিল পায়ে পায়ে। ৩২ নম্বর চত্বরের আগেই পুলিশের বাধা পেয়ে সেখানেই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। বক্তৃতা দেন মহিউদ্দিন আহমেদ। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন খালেদ মোশারফের মা। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বঙ্গবন্ধুর ১৭ জন মন্ত্রীর বৈঠককালে উপস্থিত হয়ে গায়েবানা জানাজায় অংশ নেয়ার অনুরোধ জানান। যদিও নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে একমাত্র মহিউদ্দিন আহমেদ ছাড়া আর কেউ সেখানে উপস্থিত হননি।
এ ব্যাপারে পঙ্কজ ভট্টাচার্য ভোরের কাগজকে বলেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা তখন জেলে। যারা বাইরে ছিলেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সাজেদা চৌধুরী, দপ্তর সম্পাদক আনোয়ার চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগাযোগ করি। প্রথম প্রতিবাদ বামরাই করেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রথম মিছিল বের হয়। কিশোরগঞ্জে মিছিল করে। ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শোক মিছিল করি। গায়েবানা জানাজা করি। সবার সামনে ছিলাম আমি। পরদিন ইত্তেফাক ওই ছবিটি প্রকাশ করে আমার মাথায় লালবৃত্ত এঁকে।
কাদেরিয়া বাহিনীর ২২ মাস : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদের সাহসী নাম কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। ১৭ হাজার মুজিবভক্ত সঙ্গে নিয়ে টানা ২২ মাস প্রতিরোধ যুদ্ধ করেন তিনি। ২২ আগস্ট প্রথমে ৬ জন সঙ্গী নিয়ে জামালপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢোকে ‘হত্যাকারী অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে’ সশস্ত্র প্রতিরোধের ডাক দেন তিনি। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এই বাহিনীর একটি গ্রুপ যমুনা নদী হয়ে নৌপথে বাংলাদেশে আসে। সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের নিশ্চিন্তপুর চরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। এতে বগুড়া জেলা যুবলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক খসরু নিহত হন। পরে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্তে গোবড়াকুড়া গ্রামে প্রবোধ দিওর বাড়িতে প্রতিরোধব্যূহ তৈরি করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া হয়। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার ছিল বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ভারতের তিন মাইল ভেতরে চান্দুভূইয়ে। ‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’ নামে তাদের লোগো ও ব্যাজে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়। ৭টি ফ্রন্টে বিভক্ত হয়ে তারা দীর্ঘ ২২ মাস প্রতিরোধ যুদ্ধ করেন। এতে নিহত হন ১০৪ জন। আহত হন কয়েকশ যোদ্ধা। এছাড়া প্রতিশোধ ও প্রতিরোধের ডাক দিয়ে শেরপুরের ৫০০ প্রতিবাদী তরুণের বিদ্রোহ ও লড়াই আলোচিত ঘটনা।
ইউ আর নট মাই প্রেসিডেন্ট : খুনি খন্দকার মোশতাক ১৬ অক্টোবর এমপিদের বৈঠক ডাকে। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, অধ্যাপক আবু সাইদসহ ১০ জন এমপি বৈঠক বর্জন করেন। যোগ দেন ২৭০ জন এমপি। তেজগাঁও এমপি হোস্টেলে আয়োজিত ওই বৈঠকে খুনিচক্র ফারুক, রশীদ, হুদা, ডালিম, শাহরিয়ার, নূর উপস্থিত থাকায় বৈঠকের শুরুতেই কয়েকজন এমপির তীব্র প্রতিবাদে তারা চলে যেতে বাধ্য হয়। এমপিদের কয়েকজন হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানান। প্রয়াত এডভোকেট সিরাজুল হক মোশতাকের ক্ষমতা দখলকে অবৈধ অভিহিত করে বলেন, আমার প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু। আপনি আমার প্রেসিডেন্ট নন। আপনি খুনি।
এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে : টানা ৬৭ দিন বন্ধ থাকার পর ১৮ অক্টোবর খোলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কারফিউ, পুলিশ-বিডিআরের টহলসহ গোয়েন্দা তৎপরতার মধ্যেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগের রাতে কলাভবন, সায়েন্স এনেক্স ও কার্জন হলের দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয় ১৫ আগস্ট থেকে ‘নিষিদ্ধ’ ৩টি স্লোগান জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু এবং এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে। ঢাকায় প্রকাশ্য প্রতিবাদ হয় ২০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে সংগ্রামী ছাত্র সমাজের ব্যানারে। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ হয় ৪ নভেম্বর। ছাত্র-জনতার ওই মিছিলের লিফলেট ছাপানোর সময় মোহাম্মদপুরে লিফলেটসহ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা কাজল ব্যানার্জি (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক) ও শওকত হোসেন। এজি অফিসে লিফলেট বিলির সময় গ্রেপ্তার হন চামেলীবাগের ছাত্র ইউনিয়নকর্মী আবু সিদ্দিক ও শাহ জামাল। তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। ওইদিন বটতলায় প্রতিবাদ সমাবেশে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন ডাকসু ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ভোরের কাগজকে বলেন, পনের আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দিনই কিশোরগঞ্জ, পটুয়াখালীতে প্রতিবাদ হয়েছে। এক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ৪ নভেম্বর আমরা বটতলায় প্রতিবাদ করি।
এদিকে, ওইদিনই বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট সভায় হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন চ্যান্সেলর। ছাত্র প্রতিনিধি ইসমত কাদির গামা, মাহবুব জামান ও অজয় দাশগুপ্ত আনুষ্ঠানিকভাবে শোকপ্রস্তাব উত্থাপন করলে সর্বসম্মতভাবে তা অনুমোদিত হয় এবং এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। ওইদিন ছাত্র-জনতার বিশাল মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যায়। বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যার প্রতিবাদে ৫ নভেম্বর ঢাকায় আধা বেলা হরতালের ডাক দেয়া হয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়