খুলনায় মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর : সম্প্রীতি পরিষদ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের প্রতিবাদ

আগের সংবাদ

হার্ড ইমিউনিটি কতটা সম্ভব : নতুন নতুন ধরন নিয়ে শঙ্কা >> টিকার সুফল কিছুটা হলেও মিলবে : আশা বিশেষজ্ঞদের

পরের সংবাদ

তিস্তা ও ধরলা পাড়ের কান্না থামবে কবে : নদী রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ

প্রকাশিত: আগস্ট ১২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইমরান রহমান, কুড়িগ্রাম থেকে ফিরে : ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে; কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ কথাগুলো কুড়িগ্রামের তিস্তা ও ধরলা পাড়ের মানুষের জীবনে ‘চরম সত্য’। নদীর একপাড় ভাঙলে নতুন স্বপ্নে তারা ঘর বাঁধেন অপর পাড়ে। কিন্তু বছর ঘুরতেই ভাঙা শুরু হয় সেই পাড়ও। বছরের পর বছর ধরে ভাঙা-গড়ার এ খেলায় নিঃস্ব হয়ে চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করার থাকে না তাদের।
এদিকে নদীর ভাঙন রোধে সরকারের পক্ষ থেকে ৫৯৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হলেও সেটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রয়েছে নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ। ভুক্তভোগী ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, নদীর ভাঙন রোধে সময়মতো কাজ শুরু না করা এবং প্রকল্প ঘিরে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তার বিভিন্ন অনিয়মের কারণেই ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না জনসাধারণের। যদিও জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে ওঠা সব ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
গত সোমবার কুড়িগ্রাম সদরের সিএনবি ঘাট, সেনের খামার (নিধিরাম) ও রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের নদী সংলগ্ন কয়েকটি গ্রাম ঘুরে নদী ভাঙনে মানুষের অসহায়ত্ব এবং নদীর পাড় রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পের বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র দেখা গেছে। কুরবানির ঈদের পরেই ভাঙনে

বিলীন হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রাম, নিঃস্ব হয়ে পড়েছে হাজারেরও বেশি বাসিন্দা। নদী ভাঙনের ফলে ভেঙে যাওয়া ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিতে দেখা গেছে কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের।
স্থানীয়রা বলছেন, নদী ভাঙনের ফলে তাদের বাড়িঘর তলিয়ে গেলেও কর্মকর্তাদের দেখা মিলছে না। যেভাবে কিংবা যেখানে জিও বস্তা ফেললে নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, সেখানে বস্তা ফেলছে না পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। যেখানে ড্রেজিং করা হচ্ছে, নিয়ম বহির্ভূতভাবে তার পাশেই জিওব্যাগ ফেলা হচ্ছে। ঠিকাদার নিয়োগ না দিয়ে দায়সারাভাবে করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ। এমনকি বড় অঙ্কের টাকা লুটপাটের জন্য সরকারের নকশা অনুযায়ী বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করা হচ্ছে না। স্থানীয় সাংসদ মো. পনির উদ্দিন আহমেদও (কুড়িগ্রাম-২) এসব কাজে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন।
সরজমিনে দেখা যায়, কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়ন সংলগ্ন তিস্তা নদীর ভাঙনে কয়েক শ’ পরিবার নিঃস্ব হয়েছেন। নদীর ¯্রােতে ভেঙেই চলছে তিস্তার আশপাশের বাসিন্দাদের বাড়িঘর। ভাঙন বাড়তে থাকায় বসতবাড়ি ভেঙে ঘরের চালা, আসবাবপত্র, গবাদিপশুসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নৌকা ও বিভিন্ন যানবাহনে করে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন বাসিন্দারা। এলাকাবাসী জানান, তিস্তার ভাঙনে গতিয়াশাম, মণ্ডলপাড়া, নাখেন্দা, খিতাব খাঁ, বাবুর বাজারসহ কয়েকটি গ্রামের এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। এসব গ্রামের কৃষক, জেলে, শ্রমজীবী কয়েক শ’ পরিবার একাধিকবার নদী ভাঙনের ফলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। মাত্র কয়েকদিনে বগুড়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কয়েকটি মসজিদ বিলীন হয়ে গেছে।
বিলীন হওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়টির পরিচালনা পরিষদের সভাপতি আজহার আলী মণ্ডল ভোরের কাগজকে বলেন, কুরবানির ঈদের কয়েকদিন আগে তিস্তার গর্ভে তলিয়ে যায় তার বসতভিটাসহ প্রায় তিন শতাধিক ঘরবাড়ি। এখন যাদের ঘরবাড়ি অবশিষ্ট আছে, তারা আতঙ্কে রাতে ঘুমাতে পারেন না। শুধু স্কুলটি রক্ষা করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে কিছু জিও ব্যাগ ফেলা হলেও, অন্য সময় তাদের খোঁজ থাকে না। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বারবার যোগাযোগ করা হলেও পানি উন্নয়নের বোর্ডের কোনো সাড়া মেলে না।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার সিএনবি ঘাট এলাকায় দেখা যায়, নদীর মাঝখান থেকে ড্রেজিং করে তার পাশেই জিও ব্যাগে বালি ভর্তি করা হচ্ছে। জিও ব্যাগগুলো খুবই নি¤œমানের। ওই এলাকার বাসিন্দা আবদুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, ভাঙনের প্রকোপে ছোটবেলা থেকে নদীর দুই পাড়ে ৫ বার ঘর বানিয়েছি। যে কূলেই যাই, ভাঙন পিছু ছাড়ে না। এবারো ভাঙনে ঘরবাড়ি হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাড়ির পাশে কয়েক’শ জিও ব্যাগ জমা রাখা হলেও ভাঙন রোধে আমার ঘরের পাশে কোনো ব্যাগ ফেলা হচ্ছে না। সেখানকার আরো কয়েকজন বাসিন্দা অভিযোগ করেন, যে জায়গাগুলোতে জিও ব্যাগ ফেললে ভাঙন রোধ করা যাবে সেখানে ফেলা হচ্ছে না। ফলে বিলীন হতে চলেছে সিএনবিঘাট এলাকা।
মোগলবাসা ইউনিয়নের সেনেরখামার এলাকায় ধরলা নদীর বাঁধ ভেঙে গ্রামের ভেতর পানি ঢুকে গেছে। বাঁধটি নতুন করে নির্মাণে প্রকল্প পাস হলেও খরচ বাঁচানোর জটিলতায় কাজ শুরু হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। সেনেরখামার এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম বলেন, নদী যেহেতু ভেঙে গ্রামের মাঝ দিয়ে ঢুকেছে, সেহেতু সোজাসুজি বাঁধ নির্মাণ করলে পুরো গ্রাম রক্ষা হবে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা চাচ্ছেন তীর দিয়ে মাটি ফেলতে। এতে তাদের খরচ কম হবে। এখানকার দেড়শ বিঘা জমিতে আমরা মৌসুমে ধানসহ সবজি চাষ করে থাকি। এই-ই আমাদের রোজগার। কিন্তু তীর দিয়ে মাটি ফেললে বা বাঁধ দিলে আমাদের জমি খাস জমিতে পরিণত হবে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সোজাসুজি বাঁধ নির্মাণ করে তা টিকানো সম্ভব নয়। তাছাড়া এখানে সরকারিভাবে তীর সংরক্ষণের কাজ এসেছে, বাঁধ নির্মাণের নয়।
এদিকে বাঁধ নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতার জন্য জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীকে দায়ী করছেন কুড়িগ্রাম-২ আসনের সাংসদ মো. পনির উদ্দিন আহমেদ। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, ৫৯৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদনের পর জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী টেন্ডারের দরপত্র আহ্বান করলেও তার মনোনীত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ায় ধরলা নদীর বাঁধ রক্ষা প্রকল্পের অগ্রগতি নেই। নদীর ভাঙনে ঝুঁকিতে থাকা কয়েকটি উপজেলায় ত্বরিত গতিতে কাজ করতে কর্মকর্তাদের বলেছি। কিন্তু তারা দেখছি, দেখব বলে কিছুই করছে না। এমনকি তাদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকেও পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো তারা আমাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে। এই সাংসদের অভিযোগ, নির্বাহী প্রকৌশলীসহ অন্যরা কারো ইঙ্গিতে কিংবা যোগসাজশে পাউবো কর্মকর্তারা এমন অনিয়ম করছেন। তিনি বিষয়টি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে লিখিত আকারে জানিয়েছেন। তাছাড়া স্থানীয় এক বাসিন্দা দুদকেও লিখিত অভিযোগ করেছেন।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কুড়িগ্রাম জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম দাবি করেন, এমপির লোকদের কাজ না দেয়ায় তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। এমপির পিএস যে তার কাছে কাজ চেয়েছেন, এমন প্রমাণাদিও রয়েছে। তিনি বলেন, প্রকল্প পরিচালক সব যাচাই-বাছাই করেন, সব ঠিক থাকলেই কাজ দেয়া হয়। এখানে তার এককভাবে কিছু করার সুযোগ নেই। ফুলবাড়ির সোনাইগাজীসহ বেশ কয়েক জায়গায় ইতোমধ্যে জিও বস্তা ফেলা হয়েছে। মৌসুমে সিসি ব্লকও ফেলা হবে। প্রকল্পের কিছু কিছু কাজ আগামী বছরের জুনে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে কাজের জন্য এখন পর্যন্ত ১৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে, কিন্তু ২৮টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ৬০ কোটি টাকার কাজ করেছে। টেন্ডারসহ যাবতীয় কাজে কোনো অনিয়ম করেননি বলেও দাবি করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়