নির্ধারণ হবে আশুরার তারিখ : জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভা বসছে আজ

আগের সংবাদ

সংক্রমণ ঠেকানোর কৌশল কী

পরের সংবাদ

অযতœ অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে বিবিচিনি শাহী মসজিদ

প্রকাশিত: আগস্ট ১০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বেতাগী (বরগুনা) প্রতিনিধি : দেশজুড়ে কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে হাজারো ঐতিহাসিক স্থাপনা। এর ভেতরে মুঘল আমলের যে কয়টি পুরাকীর্তির নিদর্শন আছে বাংলাদেশে তার মধ্যে অন্যতম বিবিচিনি শাহী মসজিদ। বরগুনার বেতাগী উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বিবিচিনি ইউনিয়নে এটি অবস্থিত। প্রায় সাড়ে তিনশ বছরের পুরনো এই স্থাপত্যের আয়তন খুব বিশাল না হলেও স্থাপত্য রীতিতে মুঘল ভাবধারার ছাপ স্পষ্ট প্রতীয়মান। দক্ষিণ বাংলার ইসলাম প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে অভিহিত এই মসজিদ নিয়ে রয়েছে অনেক অলৌকিক কাহিনী ও ইতিহাস। শৈল্পিক স্থাপনা অযতœ-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। আবার রাস্তার অভাবে দর্শনার্থীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। বিশুদ্ধ পানি, অজু ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের ব্যবস্থা নেই এখানে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে শাহ নেয়ামতুল্লাহ নামে এক সাধক পারস্য থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে দিল্লিতে আসেন। ওই সময় সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র ও বাংলার সুবাদার শাহ সুজা তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে ইসলাম প্রচারের জন্য শাহ নেয়ামতুল্লাহ শিষ্যসহ বজরায় চড়ে গঙ্গা নদী অতিক্রম করে বিষখালী নদীতে (তৎকালীন চন্দ্রদ্বীপে) নোঙ্গর করেন।
তখন শাহ সুজার অনুরোধে ওই গ্রামে এক গম্বুজ বিশিষ্ট শাহী মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে সাধক নেয়ামতুল্লাহ শাহের কন্যা চিনিবিবি ও ইছাবিবির নামের সঙ্গে মিলিয়ে ওই গ্রামের নামকরণ করা হয় বিবিচিনি এবং মসজিদটির নাম রাখা হয়েছে বিবিচিনি শাহী মসজিদ। শাহ নেয়ামতুল্লাহর নামের সঙ্গে মিল রেখেই বিবিচিনি গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামের নামকরণ করা হয় নেয়ামতি। এক সময় অঞ্চলটি ছিল মগ-ফিরিঙ্গিদের আবাসস্থল। তাদের হামলার প্রতিরোধে মসজিদটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
সরেজমিন মসজিদ এলাকায় পা রাখতেই দূর থেকে ছোট্ট টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদটির একমাত্র গম্বুজটিতে চোখে পড়ে। দিগন্তজোড়া সবুজের মাঝখানে ৩০ ফুট উঁচু টিলার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বিবিচিনি শাহী মসজিদের ভবনটি প্রায় ২৫ ফুট উঁচু। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট, প্রস্থ ৩৩ ফুট, দেয়ালগুলো ৬ ফুট চওড়া। দক্ষিণ ও উত্তরে তিনটি দরজা রয়েছে। তবে মসজিদটিতে মূল প্রবেশদ্বার একটি। মসজিদের সংস্কার কাঠামোয় প্রবেশদ্বারের মূল ফটক সংস্কার করা হলেও প্রবেশপথ এখনো অপরিসর। মসজিদের ধূসর বর্ণের ইটগুলো মুঘল আমলের ইটের মাপের সমান। সরাসরি না দেখলে এই পুরাকৃর্তীর সৌন্দর্য কোনোভাবেই উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
দর্শনার্থী ও নামাজিদের ওঠানামার জন্য মসজিদের পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে রয়েছে দুটি সিঁড়ি। পূর্ব পাশে সিঁড়িটি ২৫ ধাপবিশিষ্ট এবং উচ্চতায় ৪৬ ফুট। অপরদিকে দক্ষিণ পাশের সিঁড়িটি ২১ ধাপবিশিষ্ট এবং উচ্চতায় ৪৮ ফুট। অন্যদিকে মসজিদের পাশেই রয়েছে ৩টি ভিন্নধর্মী কবর, কবরগুলো সাধারণ কবরের মতো হলেও লম্বায় ১৪-১৫ হাত। মসজিদের পশ্চিম ও উত্তর পাশে অবস্থিত কবরে শায়িত আছেন সাধক নেয়ামতুল্লাহ এবং তার দুই মেয়ে চিনিবিবি ও ইছাবিবি।
স্থানীয়ভাবে মসজিদটি নিয়ে প্রচলিত আছে নানা কাহিনী। বলা হয়ে থাকে, শাহ নেয়ামতুল্লাহের দ্বীনি প্রচারে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন বহু হিন্দু ও বৌদ্ধ। স্থানীয় লোকমুখে প্রচলিত ওই সময় বিষখালী নদীর পানি ছিল লবণাক্ত। সুপেয় পানির অভাবে মানুষের কষ্ট দেখে শাহ নেয়ামতুল্লাহ নিজের তসবিহ বিষখালী নদীতে ভিজিয়ে দেন। এরপর থেকেই নদীর পানির লবণাক্ততা দূর হয়। তাছাড়া সে যুগে সুন্দরবন সংলগ্ন এই অঞ্চলের নদীগুলোতে অসংখ্য কুমির ছিল। কিন্তু একই কারণে বিষখালী নদীতে কুমির আসত না বলে প্রচলিত আছে।
দর্শনীয় এই মসজিদে অগণিত নারী-পুরুষ নামাজ আদায় করে তাদের নেক মকসুদ পূর্ণতা লাভের উদ্দেশ্যে। এছাড়া টাকা-পয়সা ও অন্যান্য মানতের মালামাল রেখে যেত মসজিদ প্রান্তে। প্রতি সপ্তাহে অসংখ্য মানুষ এসে ইবাদত-বন্দেগি করে। যে যে আশা নিয়ে এখানে আসে তার অধিকাংশই পূর্ণ হয় বলে শোনা যায়।
প্রসাদের মতো অপরূপ কারুকাজ মণ্ডিত মসজিদটির রয়েছে নানা ইতিহাস। জানা গেছে, মুঘল স্থাপত্যের গৌরব, মর্যাদার ও ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে দেশেই নয় বাংলাদেশের বাইরেও এমনকি ইতিহাসখ্যাত ব্রিটেন জাদুঘরেও এ স্থাপত্যটি সম্পর্কে নিদর্শন পাওয়া গেছে।
ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে টিকে থাকা এই শৈল্পিক স্থাপনাজুড়ে এখন শুধুই অযতœ আর অবহেলার ছাপ। মসজিদটির দেয়ালের কিছু কিছু অংশের পলেস্তারা ধসে গেলে ১৯৮৫ সালে উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে তা মেরামত করা হয়। এরপর ১৯৯২ সালে প্রতœত্ত্ব বিভাগ মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের দায়িত্ব নেয় এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনের তালিকাভুক্ত করে।
নিদর্শনটি দেখতে আসা-যাওয়ার উপযোগী রাস্তার অভাবে দর্শনার্থীদের ভোগান্তি হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি পান, অজু ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহারের ব্যবস্থা নেই এখানে। মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন কেয়ারটেকার থাকলেও নেই অন্য কোনো দায়িত্বশীল লোক। তাই ঐতিহাসিক এই মসজিদটির সরকারিভাবে সংরক্ষণের দাবি এলাকাবাসীর।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সুহৃদ সালেহীন বলেন, সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে বিবিচিনি শাহী মসজিদের প্রতি স্থানীয় প্রশাসনের বিশেষ নজর রয়েছে। মসজিদটি সংস্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়