শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি : চলতি সপ্তাহেই শতভাগ শিক্ষক টিকার আওতায়

আগের সংবাদ

উৎসবের গণটিকায় বিশৃঙ্খলা

পরের সংবাদ

ভাষাসৈনিক উসুয়ের স্বপ্ন এবং রাখাইনদের সাম্প্রতিক অবস্থা

প্রকাশিত: আগস্ট ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

১৯৭০ সালে পটুয়াখালী অঞ্চলে এক লক্ষাধিক রাখাইন বাস করতেন। বর্তমানে ২০২১ সালে তার সংখ্যা দুই হাজারে নেমে এসেছে। অবস্থা বিবেচনায় মনে হচ্ছে রাখাইন সেখানে সংখ্যালঘু নয়, সংখ্যাশূন্য হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছেন। এমতাবস্থায় স্মরণ করছি রাখাইন ভাষাসৈনিক উসুয়ের কথা। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক উসুয়ের স্বপ্নের কথা।
উসুয়ে ১৯৩২ সালের ৭ ডিসেম্বর পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার ফেলাবুনিয়া গ্রামের এক অবস্থাসম্পন্ন রাখাইন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ফসাউ ও মা চানথাপ্রæ। উসুয়ে স্কুলে-কলেজে পড়াশোনাকালীন সময়ে জড়িয়ে পড়েন বাম রাজনীতিতে। ২০ বছর বয়সে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মিটিং, মিছিলে যোগ দেন। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উসুয়ে ভেবেছিলেন পাকিস্তানি শাসন কাঠামোর মধ্যে নিষ্পেষিত বাঙালির ভাষার অধিকার যদি প্রতিষ্ঠা করা যায় তাহলে রাখাইনরাও একদিন তাদের নিজ ভাষা বা মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। সেই সময় থেকেই পরিচিত হয়ে উঠেন ভাষাসংগ্রামী হিসেবে। ১৯৫৭ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) যোগদান করেন। মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে দেশের অধিকারকামী মানুষের প্রিয় নাম উসুয়ে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে উসুয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বরগুনা জেলার তালতলী এলাকায় রাখাইন পাড়ায় অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। স্থানীয় লোকজন ও বিহারাধ্যক্ষ উ ক্যাহ্লাসা মহাথেরোর সহযোগিতা নিয়ে প্রতিটি রাখাইন এলাকায় নারী-পুরুষ-মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় এবং খাদ্যের ব্যবস্থা করেছিলেন। যুদ্ধের সময় প্রত্যক্ষ করেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, গণধর্ষণ ও লুণ্ঠন কার্যক্রম। তাকে অনেকে পরামর্শ দিয়েছিলেন দেশ ছাড়ার কিন্তু উসুয়ে দেশে থেকেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। উসুয়ে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন-
‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের মানুষ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান এবং আদিবাসী সকলে একত্রিত হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এ দেশ আমার। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং বহু মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। দীর্ঘ ৪০ বছর অতিক্রম হলো, স্বাধীন রাষ্ট্রে আদিবাসীরা এর সুফল অর্জন করতে পারেনি। তারা দীর্ঘদিন থেকে অবহেলিত, নির্যাতিত। বর্তমান মহাজোটের সরকার আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন, আদিবাসীদের প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষার বাস্তবায়নের প্রতিশ্রæতি দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় হয়েছে। সমতলের আদিবাসীদের জন্য মন্ত্রণালয় হওয়া প্রয়োজন। বিগত সময়ে সরকার আমলে পটুয়াখালী জেলার দক্ষিণাঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। কিন্তু এতে কোনো উন্নয়ন হয়নি। আদিবাসীরা চেয়েছিল জমি ক্রয় করে সমবায় সমিতিভিত্তিক পরিচালনা করতে। সে ক্ষেত্রে ৫ হাজার টাকা করে গরু-ছাগল ক্রয় করে আদিবাসীদের সামাজিক উন্নয়নে বরাদ্দ দিয়েছে। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সালের বন্যায় ও জলোচ্ছ¡াসে দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার আদিবাসীর ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গিয়েছে। ভয়াবহ সে জলোচ্ছ¡াসে পটুয়াখালী জেলার ৮০ ভাগ আদিবাসীর বন ও ভূমি হারিয়ে অস্তিত্বের সংকটে আছে। দক্ষিণ অঞ্চলের আদিবাসীদের যেটুকু জমি আছে তাও কয়েক বছরে হারিয়ে যাবে। কারণ ভূমিগ্রাসীরা খুবই তৎপর জমি দখলের জন্য। ভূমি লুটপাটের বিরুদ্ধে প্রশাসন থেকে আইনানুগ পদক্ষেপ নেই। এই পরিস্থিতিতে আদিবাসীরা খুবই চিন্তিত। কিছুদিন আগে আদিবাসী একটি পরিবারের ওপর হামলা করে ওই পরিবারের একজনকে কুপিয়ে আহত করেছিল। অভিযোগ করার পরও প্রশাসন থেকে কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা পাইনি। সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তিটি আংশিক সফল হয়েছে অবিলম্বে শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন কামনা করছি। সর্বোপরি আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে।’
উল্লেখ্য, উসুয়ে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। সেই সুবাদে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পলাতক অবস্থায় কক্সবাজার জেলা সার্কিট হাউস পাহাড় সংলগ্ন বাহারপাড়া বৌদ্ধবিহারে বেশ কয়েকদিন আত্মগোপন করেছিলেন। বিহারাধ্যক্ষ উ চান্দিমা মহাথেরো বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন। সে সময় থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাম রাজনীতির মতাদর্শ লালন করলেও এই সাক্ষাৎ উসুয়েকে ৬ দফা এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি সংবেদনশীল করে তোলে। সেই যোগাযোগ পরবর্তীতেও ছিল, সে কারণে ১৯৭৫-এর পর উসুয়ে সামরিক শাসকের রোষানলে পড়েন।
বর্তমানে উসুয়ের রাখাইন পরিবার-রাখাইনরা কেমন আছেন? এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না শোষণ-বঞ্চনা এবং ভূমিদস্যুদের প্রবল হয়রানির ফলে তারা বর্তমানে কতটা শঙ্কিত অবস্থায় রয়েছেন। ১৮ শতকের শুরুতে এ অঞ্চলে প্রথম বসতি গড়ে তুলেছিলেন রাখাইনরা। তারা এলাকায় কুয়া খনন করেছিলেন বলে এর নাম কুয়াকাটা বলে কথিত রয়েছে। এখানে লক্ষাধিক রাখাইন বসবাস করতেন ১৯৭১ সালে। ২০১৫ সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের সংখ্যা মাত্র আড়াই হাজারে নেমে এসেছে। পটুয়াখালী ও বরগুনায় রাখাইনদের সংখ্যা ২ হাজার ৫৬১ জন। পটুয়াখালীতে ১৪৪টি ও বরগুনায় ৯৩টি রাখাইনপাড়া ছিল, বর্তমানে সেখানে পটুয়াখালীতে ২৬টি ও বরগুনায় ১৩টি পাড়া কোনো রকমে টিকে আছে। প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের হাতে চলে গেছে রাখাইনদের উপাসনালয়। কুয়াকাটা বৌদ্ধ বিহারের ৯৯ শতাংশ জমির অধিকাংশ দখল হয়ে গেছে। তাঁতশিল্প, তাদের সুপেয় পানি পান করার রিজার্ভ পুকুর দখল হয়েছে। দেবোত্তর সম্পত্তি স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশে প্রভাবশালীরা মিথ্যা দলিল করে হাতিয়ে নিয়েছে। ১৯০৬ সালে এলাকায় ১৯টি বৌদ্ধ মন্দির ও বিহার ছিল সেখানে বর্তমানে ১টি মন্দির রয়েছে। তাদের কালাচান পাড়ার ৫০ শতাংশ শ্মশান দখল হয়ে গেছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ রাখাইনদের ৪ শতাংশ জমি দখল করে ব্রিজ তৈরি করেছে। সিন্ডিকেট করে রাখাইনদের ভূমির ওপর চলছে হাউজিং ব্যবসা। দেবোত্তর সম্পত্তি বৌদ্ধ মন্দির স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় আবাসন ব্যবসায়ীরা দখল করে ভবন নির্মাণ করেছেন। আইনের ভাষায় যা কিনা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। এতে প্রতীয়মান হয় যে, কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে দখলদাররা। পায়রা বন্দরের কাছে ৩০০ বছরের ঐতিহ্যপূর্ণ ছয়আনিয়াপাড়া রাখাইন গ্রামটি পায়রা বন্দরের উন্নয়নের কারণে উচ্ছেদের সম্মুখীন।
দেখা যাচ্ছে যে আদিবাসীর জীবন ও সংস্কৃতি ভূমিকেন্দ্রিক। সমতলের আদিবাসীদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এখন ভূমিহীন। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন থাকলেও আইনের প্রয়োগ নেই। ভূমির জন্য মধুপুরের সংরক্ষিত বনে, সুন্দরবনে, উত্তরবঙ্গে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সংরক্ষিত বনের আদিবাসীরা, বান্দরবানের ম্রো, উপকূলের রাখাইন, খাসি পুঞ্জিবাসীরা বিপন্ন বোধ করছেন। এ রকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত আদিবাসী জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। চা-বাগান সম্প্রসারণ, বন্দর সম্প্রসারণ, কখনো রাষ্ট্র কর্তৃক বা রাজনৈতিক প্রভাবশালী, পেশিশক্তির দ্বারা, কখনো বনায়ন, জাতীয় উদ্যানের নামে অথবা সেনা ক্যাম্প স্থাপনের নামে বা বিজিবি সদর দপ্তর স্থাপনের নামে তারা ভূমি হারাচ্ছেন। নারীদের ওপর সহিংসতা বাড়ছে। আদিবাসীদের জীবনে এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাংলাদেশে বসবাসরত অধিকাংশ আদিবাসীর ভূমিকেন্দ্রিক সাধারণ সমস্যা এগুলো। এসব উদ্যোগের ফলে মানুষের শ্মশানভূমি, পানির উৎস, উপাসনালয়, বৌদ্ধ বিহারের দখল হচ্ছে।
আদিবাসী ভূমি অধিকার সংরক্ষণের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করে আদিবাসী ও সংখ্যালঘুবিষয়ক সংসদীয় ককাস। আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করা। সমতলের আদিবাসীদের জন্য অবিলম্বে পৃথক ভূমি কমিশন গঠন। পাহাড়ের ভূমি কমিশনকে আরো কার্যকর করা। বাংলাদেশ আদিবাসী অধিকার আইন প্রণয়ন। দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষা আইন কার্যকর করা।
এছাড়া বৈশ্বিক মহামারি কোভিড ১৯-এর কারণে রাখাইনদের আর্থিক অসচ্ছলতা ক্রমান্বয়ে প্রকট হচ্ছে। এজন্য রাখাইনসহ সমগ্র আদিবাসীর জন্য একটি বিশেষ প্যাকেজ দেয়া। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। জাতিসংঘ ঘোষিত ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য : ‘খবধারহম ঘড় ঙহব ইবযরহফ : ওহফরমবহড়ঁং ঢ়বড়ঢ়ষবং ধহফ ঃযব পধষষ ভড়ৎ ধ হবি ংড়পরধষ পড়হঃৎধপঃ’. ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয় : আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকারের আহ্বান’। তার মানে সমন্বি^ত উন্নয়ন উদ্যোগ প্রয়োজন। আদিবাসীদের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্র, বেসরকারি সংস্থা, নাগরিক সমাজ, সংস্কৃতিকর্মী, মানবাধিকার সংগঠক, পাশাপাশি দেশের মূলধারার সব সংবেদনশীল মানুষকে সক্রিয় হতে হবে। এজন্য তাদের জীবন ও সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা জানানোর সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

জান্নাত-এ-ফেরদৌসী : কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়