শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি : চলতি সপ্তাহেই শতভাগ শিক্ষক টিকার আওতায়

আগের সংবাদ

উৎসবের গণটিকায় বিশৃঙ্খলা

পরের সংবাদ

বঙ্গমাতা পদক পেলেন ৫ নারী : ‘বঙ্গমাতা জিলাতুন্নেছা মুজিব ছিলেন সবচেয়ে বড় গেরিলা’

প্রকাশিত: আগস্ট ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : একটা গেরিলা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন হয়েছি- এই মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমার মা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছিলেন সবচেয়ে বড় গেরিলা। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৯১তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন ও বঙ্গমাতা পদক-২০২১ বিতরণ অনুষ্ঠানে গতকাল রবিবার এসব কথা বলেন তিনি। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন সরকারপ্রধান। অনুষ্ঠানের অন্য প্রান্ত রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা পাঁচ বিশিষ্ট নারী ও তাদের অনুপস্থিতে পরিবারের সদস্যদের হাতে পদক তুলে দেন। একই অনুষ্ঠানে সারাদেশে দুই হাজার দুস্থ নারীকে নগদ দুই হাজার টাকা করে মোট ৪০ লাখ টাকা এবং চার হাজার সেলাই মেশিন বিতরণ কার্যক্রমেরও উদ্বোধন করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম, জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান চেমন আরা তৈয়ব ও অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। পদকপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ জোবেদা খাতুন পারুল তার অনুভূতি ব্যক্ত করেন। গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় প্রান্ত থেকেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে সংযুক্ত ছিলেন। বঙ্গমাতার জীবন ও কর্মের ওপর অনুষ্ঠানে একটি ভিডিও চিত্র পরিবেশিত হয়।
বঙ্গমাতার স্মৃতিচারণ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমার মা একদিকে সংসার সামলাতেন। অন্যদিকে জাতির পিতার অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পরামর্শ দিতেন। সেগুলো যাতে সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন হয় তার ব্যবস্থা করতেন। যা আন্দোলন-সংগ্রামে গতির সঞ্চার করেছিল। আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ সঠিক পথে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে চলতে পারে সেই নির্দেশনা দিয়েছেন। আমার মা সব সময় বাবাকে বলতেন, তুমি সংসার নিয়ে ভেবো না। দেশের জন্য কাজ করছ। সেটাই ভালো করে করো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংসার সামলানোর পাশাপাশি আমার মা জেলখানায় সমস্ত তথ্য বাবার কাছে পৌঁছে দিতেন। জেলখানায় থাকা বাবার কাছ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের কাছে অত্যন্ত গোপনে পৌঁছে দিতেন। এভাবেই তিনি পুরো জীবনটাকে উৎসর্গ করেন বাবার রাজনৈতিক আদর্শের কাছে। কিন্তু কখনো রাজনৈতিক নেতা হতে হবে, রাজনীতি করে কিছু পেতে হবে সে চিন্তা মায়ের ছিল না। কোনো সম্পদের প্রতিও তার আগ্রহ ছিল না। এভাবেই নিজের জীবনকে গড়ে তুলেছিলেন। এমনকি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও মা খুনিদের কাছে নিজের জীবন ভিক্ষা চাননি। নিজে জীবন দিয়ে গেছেন। জাতির পিতার সিঁড়িতে পড়ে থাকা লাশ দেখে সোজা বলে দিয়েছেন- ‘তোমরা ওনাকে মেরেছো, আমাকেও মেরে ফেলো।’ খুনিরা বলেছিল আমাদের সঙ্গে চলেন।

তিনি বলেছিলেন, তোমাদের সঙ্গে আমি যাব না, তোমরা এখানেই আমাকে খুন করো। ঘাতকের বন্দুক গর্জে উঠেছিল, সেখানেই আমার মাকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। কতটা সাহস একটা মানুষের মনে থাকলে সে মানুষটা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবন ভিক্ষা না নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারেন। আজকে আমাদের দেশের নারী সমাজ যে একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছে সেখানে আমি মনে করি আমার মায়ের এই কাহিনি শুনলে অনেকেই অনুপ্রেরণা পাবে। শক্তি ও সাহস পাবে দেশের জন্য, জাতির মঙ্গলে কাজ করতে।
মায়ের স্মৃতি রোমন্থন করে শেখ হাসিনা বলেন, আমার মা সব সময় জাতির পিতার পাশে থেকে প্রেরণা জুগিয়েছেন। মা কখনো সামনে আসেননি, কোনো মিডিয়ার সামনে যাননি, কখনো নিজের নামটা ফলাতে চাননি। তিনি নীরবে পাশে থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে বাবাকে সহযোগিতা করে গেছেন, সমর্থন দিয়ে গেছেন। এটাই সব থেকে বড় ত্যাগ স্বীকার বলে আমি মনে করি। তিনি আরো বলেন, একটা গেরিলা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন হয়েছি। আমি সব সময় বলি, আমার মা ছিলেন সবচেয়ে বড় গেরিলা। অসাধারণ স্মরণশক্তি ছিল তার। তিনি গোপনে গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করতেন, দিক-নির্দেশনা দিয়ে আসতেন। আমাদের বাড়িতে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকও হয়েছে। ছয় দফা ছেড়ে অনেক নেতা চলেও গেছেন। আমার মা তখন খুব শক্ত ছিলেন ছয় দফার পক্ষে। রাজনৈতিকভাবে তিনি যে কতটা সচেতন ছিলেন- সেটা তার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সেই সময় ছয় দফা থেকে এক চুল এদিক-ওদিক যাবেন না তিনি, এটাই ছিল তার সিদ্ধান্ত। আমার মা বুঝেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ছয় দফার একটি দাঁড়ি, কমাও বদলাবে না। আর সেটাই আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে পাস হয়েছিল।
সংগঠন চালানো ও আন্দোলন গড়ে তুলতে বঙ্গমাতার সক্রিয় ভূমিকার উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, গোপনে দলের লোকজনের সঙ্গে দেখা করা, ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, তাদের নির্দেশনা দেয়া এবং পোশাক পরিবর্তন করে বোরখা পরে মিছিল-মিটিং করা, মায়ের এসব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা অন্ধকারেই ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পাকিস্তানি গোয়েন্দারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সব সময় রিপোর্ট দিত। ওই রিপোর্টগুলো নিয়ে বই প্রকাশ করার সময় আমি খোঁজ করে দেখেছি সেখানে মায়ের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের রিপোর্ট নেই। যদিও মা ছিলেন রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয়। তিনি গোপনে দলের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিটি সংগ্রামে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অসামান্য অবদান রয়েছে। আমার মা সারা জীবন বাবাকে দেশের মানুষের জন্য চিন্তা করতে প্রেরণা জুগিয়েছেন। স্বামীর কাছে মানুষের নানা ধরনের চাহিদা, আকাক্সক্ষা থাকে। অনেক কিছু পাওয়ার থাকে। আমার মায়ের, বাবার কাছে কোনো কিছুর চাহিদা ছিল না। তিনি সবসময় বলতেন, তুমি দেশের কথা চিন্তা করো। আমাদের কথা ভাবতে হবে না। প্রেরণাটাই দিয়ে গেছেন। আমার মায়ের যে অবদান রয়েছে, এ দেশের রাজনীতিতে, শুধু তাই না, বাংলাদেশের মানুষের অগ্রগতিতেও তার অবদান আছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রতিটি মেয়ের শিক্ষা নেয়া উচিত, আর্থিক সচ্ছলতা দরকার। খালি অধিকার অধিকার বলে চিৎকার করলেই হবে না। অধিকার আদায় করতে হবে। শিক্ষার মাধ্যমে আর্থিক সচ্ছলতা অর্জন করে প্রতিটি মেয়েকেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে- সেই উপলদ্ধিতা তার ছিল। নিজের গহনা বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। মায়ের অভ্যাস ছিল বই কেনা। নিউমার্কেট থেকে তিনি বই কিনতেন। আমাদেরও নিয়ে যেতেন। আমার বাবা বার্ট্রান্ড রাসেলের বই পড়ে ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে মাকে শোনাতেন।
এ সময় ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিচারণ করে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেন, শুধু একটাই প্রশ্ন সব সময়, কেন এই হত্যাকাণ্ড? আমার মা, ভাইয়েরা, যারা নিজের জীবন উৎসর্গ করলেন, জীবনের সুখ-আহ্লাদ একটা জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য বিলিয়ে দিলেন, সেই বাঙালিই তাদের কেন হত্যা করল?
বঙ্গমাতা পদক পেলেন পাঁচ বিশিষ্ট নারী : অনুষ্ঠানে রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, সমাজসেবা, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, গবেষণা, কৃষি ও পল্লী উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার জন্য এ বছর পাঁচ বাংলাদেশি নারীকে ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব’ পদক দেয়া হয়। প্রথমবারের মতো অন্তর্ভুক্ত পদকটি এবার থেকে নারীদের জন্য ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক হিসেবে গণ্য হবে। পুরস্কার হিসেবে ১৮ ক্যারেট স্বর্ণের ৪০ গ্রাম ওজনের একটি পদক, চার লাখ টাকার চেক, সার্টিফিকেট এবং উত্তরীয় দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা পদক তুলে দেন।
এবার যারা পদক পেয়েছেন, তারা হলেন- বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মমতাজ বেগম (মরণোত্তর), জয়াপতি (মরণোত্তর), মোসাম্মাৎ নুরুন্নাহার বেগম, বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ জোবেদা খাতুন পারুল এবং নাদিরা জাহান (সুরমা জাহিদ)।
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসন মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান চেমন আরা তৈয়ব মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন। এছাড়া, পদক বিজয়ীদের পক্ষে বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ জোবেদা খাতুন পারুল নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তব্য করেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়