জন্মদিন : প্রমথ চৌধুরীর সাহিত্যচিন্তা

আগের সংবাদ

বঙ্গবন্ধুর চোখে বঙ্গমাতা

পরের সংবাদ

টাকার রং

প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজের মুদ্রা-টাকার যে রং রয়েছে, সেটা আমাদের সবারই জানা। পরিমাণ ভেদে টাকার রংও ভিন্ন ভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। এই রং বৈচিত্র্যপূর্ণ তো বটেই এবং বহু রঙের সমাহারে। আমাদের আলোচ্য বিষয় দৃশ্যমান টাকার রং নিয়ে নয়, টাকাকে দুই পৃথক রঙে বিভক্তিকরণের সামাজিক আচার নিয়ে। বর্ণিল রঙের এই টাকাকে আমাদের সমাজে সচরাচর সাদা-কালো দুই পৃথক রঙে চিহ্নিত করার অলিখিত নিয়ম প্রচলিত ছিল এবং রয়েছে। সেটা বহুকাল-যুগ পূর্ব থেকেই। অতীতে সামাজিক মান-মর্যাদার প্রশ্নটিও প্রচলিত টাকার রঙের ওপর নির্ভর করত। অর্থাৎ ব্যক্তির অর্থ বৈধ না অবৈধ সেটা নির্ধারিত হতো ব্যক্তির অর্থ বা টাকা সাদা না কালো নির্ধারণের ভিত্তিতে। হঠাৎ বিত্তবান ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কিংবা আয়ের সঙ্গে সম্পদ ও ব্যয়ের অসঙ্গতিতে সামাজিক জীবনে ওই ব্যক্তিকে নিয়ে মানুষের কৌতূহল সৃষ্টি হতো। জন্ম দিত নানা জল্পনা-কল্পনার।
আমার কৈশোরের একটি ঘটনা স্মরণ করছি। সরকারি উদ্যোগে পাকিস্তান সরকার কয়লা আমদানি করত, কয়লা নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তর নামের সরকারি প্রতিষ্ঠান ছিল। আমদানিকৃত কয়লা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বার্জযোগে ঢাকার নারায়ণগঞ্জে পরিবহনে বেসরকারি ঠিকাদার নিয়োগ করা হতো। বার্জে করে কয়লা পরিবহনের জনৈক ঠিকাদার আমাদের এলাকায় বসবাস করতেন। হঠাৎ ব্যক্তিটির অস্বাভাবিক আর্থিক উন্নতিতে কৌতূহলী স্থানীয়দের মধ্যে এক প্রকার সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রমাণযোগ্য তথ্যের অভাবে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলেনি। সেজন্য অবশ্য খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। অচিরেই ঠিকাদারের বাড়িতে পুলিশ এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। ঠিক দুদিন পর কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে ঠিকাদার বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু প্রকৃত রহস্য আর চাপা থাকেনি। দ্রুত সেটা পুরো এলাকায় চাউর হয়ে গিয়েছিল। ঠিকাদার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় কয়লা পরিবহনের জন্য ১৪টি বার্জে কয়লা ভর্তি করে ঢাকার পরিবর্তে অন্যত্রে কয়লা নামিয়ে পাচার করে এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানান কয়লাসহ পরিবহনকৃত ১৪টি বার্জ নদীতে ডুবে গেছে। সরকারি পণ্য তছরুপের অভিযোগে ঠিকাদারকে আটক করে পুলিশ। তবে তার দ্রুত অব্যাহতিতে মজার কথাও প্রচার পেয়েছিল। তার এই অপকীর্তির সঙ্গে সরকারি দপ্তরের লোকজনও জড়িত ছিল। এমনকি বার্জ ডুবেছে কিনা সেটা তদন্তে সরকারি দপ্তর যাদের নিয়োগ করেছিল; ঠিকাদার ও সরকারি কয়লা নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা দ্রুত তাদের বখরা দিয়ে সমঝোতা করে ফেলে। পরিশেষে তদন্ত নাটকের যবনিকা এবং ঠিকাদার বেকসুর খালাস পেয়ে যান। তবে ঠিকাদারের প্রতিষ্ঠানকে কয়লা পরিবহনের কাজ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়। শাস্তি কেবল এটুকুই তিনি পেয়েছিলেন।
সামাজিকভাবে এলাকায় তিনি ‘কয়লা চোর’ খ্যাতি কিন্তু লাভ করেন। এমনকি তার সন্তানরা পর্যন্ত কয়লা চোরের খ্যাতি মাথায় নিয়ে নত মুখে এলাকায় চলাচলে বাধ্য হয়। তাদের একতলা বাড়ি দ্রুত চারতলায় রূপান্তরিত হয়। এবং এলাকায় বাড়ি, জমি-সম্পত্তি কেনায় যেন ঠিকাদারের হিড়িক পড়েছিল। স্থানীয় কাউকে বাড়ি-সম্পত্তি বিক্রি করতে আর দালালের শরণাপন্ন হতে হতো না। বিক্রেতা স্বয়ং ঠিকাদারের কাছে হাজির হলেই ন্যায্যমূল্যে বাড়ি-সম্পত্তি বিক্রি করতে পারতেন। এতে এলাকায় ঠিকাদারের সম্পত্তির পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। সেই পাকিস্তানি আমলে রিকশাযাত্রী ঠিকাদার-পরিবার রিকশার পরিবর্তে মাজদা গাড়ি হাঁকায়। অর্থ-বিত্ত, সম্পত্তি বৃদ্ধিতেও কিন্তু সামাজিক মর্যাদা তাদের বৃদ্ধি পায়নি। বরং কয়লা চোরের নামকরণে তাদের কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সামাজিক মর্যাদা পুনরুদ্ধারে মসজিদ-মাদ্রাসায় অঢেল অর্থ প্রদান করে সমাজে নিজেকে মর্যাদাবান রূপে প্রতিষ্ঠার কৌশলী উদ্যোগ ঠিকাদার গ্রহণ করেছিলেন। এই কৌশলটি তার অপবাদ ঘুচাতে সহায়তা করেছিল বটে, তবে প্রকাশ্যে না হলেও নেপথ্যে ঠিকাদারের কুখ্যাতির গুঞ্জন কিন্তু একেবারে বিলুপ্তি ঘটেনি। সেটা বহুকাল টিকে ছিল।
তখন সমাজে অনৈতিক অপকর্ম-অপকীর্তি নিয়ে মানুষ সরব হয়ে উঠত। উল্লেখিত ঘটনা তারই নির্জলা প্রমাণ। সমাজের সামাজিক শক্ত-পোক্ত ভিত্তি ছিল। যেটা উপেক্ষা করার শক্তি ব্যক্তির ছিল না। সামাজিক নিয়ম-নীতিতে সৎ ও স্বাভাবিক জীবনাচরণে মানুষ বাধ্য হতো। সমাজচ্যুতির ভয় ছিল বলেই মানুষ সমাজকে অগ্রাহ্য করতে পারত না। সমাজে তখনো অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল কিন্তু আজকের ন্যায় এতটা ব্যাপক ও নির্লজ্জভাবে ছিল না। সামাজিক মান-মর্যাদাকে মানুষ সমীহ-মান্য করত। এ বিষয়ে সবার কম-বেশি সচেতনতা ছিল। যেটি আজকে ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। সমাজ বিচ্যুতির ভয় এখন কারো নেই। সমাজকে এখন কেউ গ্রাহ্য করে না। যে যার খুশি ও ইচ্ছানুযায়ী চলে। সামাজিক মানুষ এখন আর সামাজিক পরিমণ্ডলের বৃত্তে নেই। আত্মকেন্দ্রিকতায় নিমজ্জিত। ব্যক্তিগত উন্নতির পিছু মানুষ অবিরাম ছুটছে। এই ছুটে চলার মধ্যে নীতি-নৈতিকতার ধার কেউ আর ধারে না। সবাই চায় ব্যক্তিগত উন্নতি। সেটা যে কোনো উপায়ে হোক। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আমাদের সমাজে এখন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি পরিবারে পরিবারে পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। পারিবারিক জীবনাচার বলেও কার্যত এখন তেমন কিছু নেই। পরিবারমাত্রই ব্যক্তি এবং তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা। এর বাইরে মা, বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন কেউ আর বিবেচনায় নেই। যার যার- তার তার অবস্থা।
সামাজিক মানুষ এখন আত্মকেন্দ্রিকতার বৃত্তে আটকে পড়েছে। ব্যক্তিগত উন্নতি ছাড়া আর কিছুই তার সামনে গ্রাহ্য নয়। নীতি, নৈতিকতা, দেশপ্রেম, মানবিকতা বিসর্জনে ব্যক্তিগত অর্থ-বিত্ত, ভোগ-বিলাসিতাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামষ্টিক দৃষ্টিভঙ্গির আকাল পড়েছে আমাদের সুবিধাভোগী শ্রেণির মাঝে। অর্থনৈতিক উন্নতির অভিলাষে বৈধ-অবৈধ, অনৈতিকতার বিবেচনা করছে না। টাকা চাই, টাকা চাই, হেন যে কোনো উপায়ে। কেবল নিজ উন্নতির অভিমুখে ছুটে চলা তো পুঁজিবাদী দর্শন। পুঁজিবাদ ব্যক্তির উন্নতির দর্শন, সমষ্টির নয়। আমাদের বিদ্যমান পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুঁজিবাদী দর্শন সমাজের সর্বস্তরে বিস্তার লাভ করেছে। ব্যক্তিগত উন্নতির এই অভিযাত্রায় ধনীর সংখ্যা বেড়েছে বটে, তবে দারিদ্র্যপীড়িতদের সংখ্যা কিন্তু কমেনি। বরং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে, অতীতের তুলনাতে। মূল কারণটি চিহ্নিত করতে না পারলে পরিত্রাণের উপায় আমরা পাব কোথা থেকে!
টাকার সাদা ও কালো রঙের বিষয়টি রাষ্ট্রীয়ভাবেও দেখা হয়। রাষ্ট্রও সাদা এবং কালো টাকা চিহ্নিত করে। দেশের এ যাবৎকালের প্রায় সব সরকারের শাসনামলে কালো টাকাকে সাদায় পরিণত করার সুযোগ দেয়া হয়, কিছু শর্ত আরোপে। অর্থাৎ কালো টাকা রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধতা পেয়ে সাদায় পরিণত হতে পারে। রাষ্ট্রই যেখানে কালোকে সাদা রূপান্তরের সহজ সুযোগ করে দেয়, সেখানে সমাজের আর সাধ্য কি! সমাজ তো রাষ্ট্রেরই অধীন। রাষ্ট্র যেখানে অবাধে ছাড় দেয়, সমাজ তো সেখানে নিষ্ক্রিয় হতে বাধ্য। সমাজে এখন মান-মর্যাদা ও যোগ্যতা অর্থ-বিত্তের মাপকাঠিতে নির্ধারিত। কে কোন উপায়ে অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছে, সে বিবেচনাও করা হয় না। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই ব্যক্তিটির উন্নতি ঘটিয়েছেন, এমনটি বলা ও ভাবা হয়। একাত্তরের পূর্বে অনেককে দেখেছি অত্যন্ত দারিদ্র্যপীড়িত; স্বাধীনতার পরে তাদের অনেকেই ফুলে-ফেঁপে একাকার। আলাদিনের জাদুর বাতি যেন হাতে পেয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে নিকৃষ্ট উপায়ে বিত্তবান হওয়ার প্রবণতা ও প্রতিযোগিতা আমরা দেখে চলেছি। ব্যক্তির এই উন্নতি অস্বাভাবিক এবং অবশ্যই অনৈতিক। নীতি-নৈতিকতার ধার এখন আর কেউ ধারে বলে অনুমানও করা যাবে না।
পাকিস্তানি আমলে বাইশ পরিবারের কথা বেশ প্রচলিত ছিল। সেই বাইশ পরিবার পাকিস্তানের অর্থনীতি, রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত। স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি পরিবার সৃষ্টি হয়েছে। এরাই আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি, সাংস্কৃতিক সব কিছুর নিয়ন্ত্রক। রাজনীতি অর্থনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সে কারণে রাজনীতিতেও এখন রাজনীতিকদের তুলনায় বিত্তশালী ব্যবসায়ীদের সংখ্যাই অধিক। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আরো দ্রুত অর্থশালী হওয়া সম্ভব বলেই ব্যবসায়ীরা দলে দলে শাসক দলগুলোতে নাম লিখিয়েছে। ক্ষমতার রাজনীতির আনুকূল্যে তাদের সাফল্য অর্জনেও বিলম্ব ঘটছে না।
টাকাকে এখন আর সাদা-কালো বিভাজনে কেউ বিভাজিত করে না। টাকা-টাকাই, সেটা আবার সাদা-কালো বলা কেন! কে কোন পথে কিংবা উপায়ে অর্থবিত্ত অর্জন করেছে সেটা বিবেচ্য নয়। বরং ব্যক্তির আর্থিক অর্জনকেই যোগ্যতা এবং ঈশ্বর কর্তৃক প্রাপ্ত বলেই মান্য করা হয়। অতীতের দেখা ঘটনাটির ন্যায় ঘটনা কিংবা আরো অভিনব ঘটনা বর্তমানে অহরহ ঘটছে, কিন্তু সমাজে কোনো প্রতিক্রিয়া আমরা দেখি না। টাকার রং নিয়ে সমাজে আর উচ্চ-বাচ্য কেউ করে না। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে করা হয় মাত্র। শর্তাধীনে সে ক্ষেত্রে পরিত্রাণের সুযোগও করে দেয় স্বয়ং রাষ্ট্রই। আয়বহির্ভূত অর্থকে আয়ভুক্ত বা বৈধতা প্রদান করার সুযোগ দেয়া হয়, রাষ্ট্রকে অর্থদণ্ড প্রদানে। অর্থাৎ কালো টাকাকে সাদায় রূপান্তরিত করার রাষ্ট্রীয় স্বাভাবিক (!) ব্যবস্থাধীনে। তাই এখন টাকার পরিমাণগত শব্দ ও রংই টাকার পার্থক্য নির্ধারণ করে, সাদা-কালোর বিভাজনে নয়। টাকা এখন টাকাই, সে যে উপায়ে অর্জিত হোক না কেন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভে বাধাপ্রাপ্ত হয় না। ঘৃণা-ধিক্কারের যোগ্যও থাকে না, বিপরীতে পায় নিষ্কণ্টক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক স্বীকৃতি।
মাযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়