পরীমনরি ঘনষ্ঠি কে এই কবীর

আগের সংবাদ

তালিকায় হাইপ্রোফাইলদের নাম

পরের সংবাদ

বঙ্গবন্ধুর চোখে বঙ্গমাতা

প্রকাশিত: আগস্ট ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অতি অল্প বয়সে ঘটনাচক্রে ফজিলাতুন্নেছা ওরফে রেণু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের গৃহিণী হয়ে আসেন। তার সম্পর্কে আমাদের জানার বড় উৎস হলো বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজ নামচা’ কিংবা বঙ্গবন্ধুর বিশেষ এক উক্তি। এগুলো মুদ্রিত কিন্তু তার বাইরেও এক ভিন্ন জগৎ ছিল তা আমরা কোথায় পাব? তবুও বঙ্গমাতার ৯১তম জন্মদিবসে মুদ্রিত প্রসঙ্গে কিছু আলোকপাত করা হলো, যা জন্ম জন্মান্তরে পুরুষ মাত্রেরই শিক্ষণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। ১৯৬৬-৬৯ সালে কারাগারে রাজবন্দি থাকাবস্থায় শেখ মুজিব আত্মজীবনী লিখেছেন। তার উপক্রমনিকাতে আছে, ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেল গেটে বসে বলল, বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবন কাহিনী।’ লেখার ব্যাপারে শেখ মুজিব দ্বিধান্বিত ছিলেন কিন্তু যেদিন তার স্ত্রী তাকে লেখার জন্য কয়েকটি খাতা দিয়ে গেলেন এবং যখন হাতে একটি মোক্ষম সুযোগ পেলেন, তখন থেকেই লিখতে বসে গেলেন। স্মৃতিনির্ভর এই বইটিতে তিনি বহুবিধ প্রসঙ্গের অবতারণাসহ অনেক জায়গায় তাঁর স্ত্রীর সম্পর্কে লিখেছেন। এ দেশে কয়েকজন রাজনীতিবিদ তাদের আত্মজীবনী লিখেছেন, তাদের কারো কারো স্ত্রী ছিল উচ্চ-শিক্ষিতা, কিন্তু তাদের লেখায় স্ত্রীর কথা তেমন আসেনি, যা শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উঠে এসেছে।
শেখ মুজিবের জন্ম ১৯২০ সালে। আত্মজীবনীতে সে সময় থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত সময়ের কথা তিনি বর্ণনা করেছেন। স্ত্রীকে শুধু তিনি বই লেখার প্রেরণাদায়িনী হিসেবে তুলে আনেননি, তাকে তুলে ধরেছেন একজন স্বামী অন্তপ্রাণ স্ত্রী হিসেবে, একজন স্নেহময়ী মা হিসেবে, একজন স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ-দেবরের প্রতি নিবেদিত ও শ্রদ্ধাবান গৃহবধূ হিসেবে, একজন কষ্টসহিষ্ণু, সর্বংসহা সংবেদনশীল নারী হিসাবে। আত্মজীবনীতে মুজিব লিখেছেন, ‘আমার স্ত্রীর ডাক নাম রেণু।’ অবশ্য তার পোশাকি ফজিলাতুন্নেছা নামটি বইয়ের কোথাও উল্লেখ নেই। হিসাব করে দেখা যায় মুজিব ও তাঁর স্ত্রীর বয়সের ব্যবধান প্রায় ১০ বছরের। তিনি আরো লিখেছেন, ‘আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স তেরো বছর হতে পারে।’ এই বাল্যবিবাহের কারণ হিসেবে ৩ বছর বয়সে রেণুর পিতৃ-বিয়োগ ও মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের কথা এসেছে। শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘রেণুর দাদা আমার দাদার চাচাতো ভাই। রেণুর বাবা মানে আমার শ্বশুর ও চাচা তার বাবার সামনেই মারা যান। মুসলিম আইন অনুযায়ী রেণু তাঁর সম্পত্তি পায় না। রেণুর কোনো চাচা না থাকায় তাঁর দাদা (শেখ কাশেম) নাতনি ফজিলাতুন্নেছা ও তাঁর বোন জিন্নাতুন্নেছার নামে সব সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান।’ রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এই নাতনির বিবাহ দিতে হবে।’ রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা; মুরব্বির হুকুম মানার জন্য রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। রেণু তখন কিছু বুঝত না, কেননা তার বয়স তখন বোধহয় ৩ বছর হবে।
রেণুর যখন ৫ বছর বয়স তখন তাঁর মা মারা যান আর দাদা মারা যান ৭ বছর বয়সে। তারপর রেণু শেখ মুজিবের মার কাছে চলে আসেন এবং তার ননদ, দেবরদের সঙ্গে শ্বশুর-শাশুড়ির অপত্য স্নেহে বড় হতে থাকেন। তিনি ছোটবেলায় বাবা বাবা বলে কান্নাকাটি করলে শাশুড়ি জবাব দিতেন এবং পরবর্তীতে রেণু শাশুড়িকে বাবা বলে ডাকতেন বলে শোনা যায়। ১৯৩৩ সালে তাদের বিয়ে হলেও শেখ মুজিবের লেখা থেকে জানা যায় তাদের ফুল সজ্জা হয়েছিল ১৯৪২ সালে।
আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু তাঁর লেখাপড়া, রাজনীতি ও কলকাতা-ঢাকার জীবনের কথা লিখেছেন। তিনি পড়াশোনার জন্য আব্বা-মা উভয়ের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিতেন। তদুপরি তিনি পড়াশোনা ও রাজনীতির আংশিক খরচ এমনকি সিগারেট খাওয়ার টাকাও স্ত্রীর কাছ থেকে নিতেন। এই টাকা নেয়ার কথাটা আত্মজীবনীতে এবং বিশেষত রেণু প্রসঙ্গে কয়েকবার এসেছে। তিনি লিখেছেন, ‘আব্বা আম্মা ছাড়াও সময় সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত বাড়ি গেলে এবং দরকার হলেই আমাকে দিত। কোনোদিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না। গ্রামের বাড়িতে থাকত, আমার জন্যে রাখত।’
মুজিব ছিলেন মনে-প্রাণে রাজনীতিবিদ। সেকালে রাজনীতিকে তেমন ভালো চোখে দেখা হতো না বলে স্বামীর রাজনীতিকে স্ত্রীরা কেউই সহজভাবে মেনে নিতেন না। জেলে যাওয়াটা ছিল আরো অগ্রহণযোগ্য বিষয়। শেখ মুজিব বঙ্গশার্দূল বা বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার আগে বেশ কয়েকবার জেলে গেছেন। কিন্তু তার পতœী তাকে কখনো রাজনীতি থেকে বিরত থাকতে বলেননি। তিনি বলতেন রাজনীতি কর, আপত্তি নেই, কিন্তু পড়াশোনাটি করবে। তারপরও যখন রাজনীতির কারণে সঠিকার্থে বাংলা ভাষার সপক্ষে আমরণ অনশন করছিলেন তখন রেণু বললেন, ‘জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ।’ পৃথিবীতে যে নারীর কেউ নেই, ছোট বেলায় মা-বাবা-দাদা মারা গেছেন, তার পক্ষে স্বামীকে কণ্ঠকাকীর্ণ রাজনীতির ব্ল্যাংক চেক দেয়া কঠিন ছিল। স্বামী-সন্তানের প্রতি যেমন, তেমনি শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতিও রেণুর ছিল অনন্ত শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। রেণু যে শুধু তাঁর প্রতি বা তার নিকটজনের প্রতি সংবেদনশীল ও মানবিক ছিলেন তা নয়, তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতিও অতিশয় সংবেদনশীল ছিলেন, তার প্রমাণও নেতার লেখায় মিলে। তিনি মাদারীপুর বোনের বাড়ি যাচ্ছিলেন- দুজন শুভাকাক্সক্ষী সহযাত্রী সঙ্গে ছিলেন। শীতের রাতে তাদের কোনো চাদর না থাকায় কষ্টের অন্ত ছিল না। রেণু তার নিজের গায়ের চাদর খুলে তাদের দিয়েছিলেন।
শেখ মুজিব লিখলেন, মাত্র এক ঘণ্টার এক ‘দেখা’ সমস্ত দিন তাঁর হৃদয় ও মন জুড়ে থাকে।’ বৃষ্টি এলেই তার মনে যক্ষরাজ জেগে উঠত, একদিন জেলখানায় ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়ার কালে শেখ মুজিব বই নিয়ে বসেছেন। তারপর তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন ‘মনে করবেন না, বই নিয়ে বসলেই লেখাপড়া করি। মাঝে মাঝে বইয়ের দিকে চেয়ে থাকি সত্য, মনে হবে কত মনোযোগ সহকারে পড়ছি। বোধ হয় সেই মুহূর্তে আমার মন কোথাও কোনো অজানা অচেনা দেশে চলে গিয়েছে। নতুবা কোনো আপনজনের কথা মনে পড়ছে। নতুবা যার সাথে মনের মিল আছে। একজন আর একজনকে পছন্দ করি, তবু দূরে থাকতে হয়, তার কথাও চিন্তা করে চলেছি।’ আবার এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘জেলের বাইরে থাকতে মাথা ব্যথায় অনেক সময় কষ্ট পেতাম। স্যারিডন দুই-তিনটা খেয়ে চুপ করে থাকতাম। আধ ঘণ্টা পরেই ভালো হয়ে যেতাম। আবার কাজে নেমে পড়তাম। রেণু স্যারিডন খেতে দিতে চাইত না। ভীষণ আপত্তি করত। বলত, হার্ট দুর্বল হয়ে যাবে। আমি বলতাম, আমার হার্ট নাই, অনেক পূর্বেই শেষ হয়ে গেছে! এই জাতীয় উক্তিতে রসিকতার চেয়ে আত্মসংবরণের প্রয়াসও যে দৃশ্যমান। তবে স্ত্রী সম্পর্কে তার পূর্ণাঙ্গ ধারণাটা মিলে অন্য এক জায়গায় যা রোজ নামচার বাইরে : ‘আমি আমার জীবনে দেখেছি আমি বুলেটের সামনে এগিয়ে গেলেও আমার স্ত্রী কোনোদিন বাধা দেননি। আমি দেখেছি ১০/১১ বছর জেলখানায় থাকলেও তিনি কোনোদিন মুখ খুলে প্রতিবাদ করেননি। যদি তিনি তা করতেন তাহলে আমি জীবনে অনেক বাধার মুখোমুখি হতাম। এমন অনেক সময় ছিল যখন আমি জেলে যাবার সময় সন্তানদের জন্য একটি পয়সাও রেখে যেতে পারিনি। আমার নিরন্তর সংগ্রামী জীবনে তাঁর প্রচুর অবদান আছে।’
এবারে আমরা স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে তাঁর দাম্পত্য জীবনে বেগম ফজিলাতুন্নেছার ন্যায় এমন ধীরস্থির প্রাজ্ঞ, সর্বংসহা বুদ্ধিদীপ্ত, দূরদর্শী ও স্বামী অন্তপ্রাণ নারীর আবির্ভাব না হলে শেখ মুজিব বঙ্গশার্দূল, বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা বা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হতেন না কিংবা বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হতো না।
অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা; ও উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়