চাঁদাবাজির মামলা ৪ দিনের রিমান্ডে দর্জি মনির

আগের সংবাদ

বন্যার পদধ্বনি : পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে

পরের সংবাদ

জন্মদিন : প্রমথ চৌধুরীর সাহিত্যচিন্তা

প্রকাশিত: আগস্ট ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রথথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬) সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন। দেশ-বিদেশের নানা বিদ্যাপীঠে বিদ্যাসাধনা শেষে থিতু হয়েছিলেন কলকাতায়। নামিদামি ব্যারিস্টার হওয়া সত্ত্বেও ওই পেশায় খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি। আখেরে সাহিত্য সাধনা ও সম্পাদনায় নিজেকে নিবেদন করেছিলেন। গল্প, কাব্যকবিতা অথবা উপন্যাসের ন্যায় সাহিত্যের নানা শাখা-প্রশাখায় লেখালেখি করলেও প্রমথ চৌধুরীর মৌল পরিচয় মূলত প্রাবন্ধিক। প্রবন্ধসাহিত্যকে তিনি মান্য পর্যায়ে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। এই সাহিত্য শাখাতেই লিপিবদ্ধ করে গেছেন সাহিত্য সংশ্লিষ্ট তাঁর নানারকম ভাবনাচিন্তার শিল্পফসল। নানা প্রকৃতির জ্ঞান, বিদ্যা ও বিষয়ের অন্তর্ভেদী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তাঁর প্রবন্ধনিবন্ধে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। চিন্তা ও যুক্তির পরম্পরায় তিনি জীবন ও সাহিত্যকে অবলোকন করতে পেরেছিলেন। রামায়ণ-মহাভারত অথবা গীতার ন্যায় সহস্রবর্ষের অতীত ঐতিহ্য সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাদি থেকে সমসাময়িক সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর পরিশুদ্ধ ধারণা ছিল। জয়দেবের গীতগোবিন্দএ অনেকেই আধ্যাত্মিকতার সন্ধান পেলেও প্রমথ চৌধুরী পাননি। তাঁর কাছে রাধা-কৃষ্ণ আর দশজন মানুষের ন্যায়ই ‘রক্তে-মাংসে’ গঠিত মানুষ বলেই বিবেচিত। কাব্যে শৃঙ্গার রসের আধিক্য থাকায় বিষয় হিসেবে এটিকে উৎকৃষ্ট বিবেচনা করতে পারেননি। বরং কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ তাঁর কাছে মান্যতা পেয়েছিল বেশি। তবে প্রমথ চৌধুরী জয়দেবের ভাষাভঙ্গির তুমুল প্রশংসা করেছেন।
দুই.
সনেট পঞ্চাশৎ (১৯১৩) এবং পদচারণা (১৯১৯) শিরোনামে দুটি কবিতাগ্রন্থ লিখলেও কবি-পরিচিত পাননি তিনি। তবে কবিতা প্রসঙ্গে কিছু দরকারি ধারণা উপস্থাপন করেছেন। অন্তত প্রবন্ধসাহিত্য তো তা-ই বলে। মানবমনে নানা সময়ে নানা ভাব ও ভাবনার উদয় হয়। ‘এসব অস্থির ভাবকে ভাষায় স্থির করবার নামই হচ্ছে রচনাশক্তি।’ মানুষ গদ্যেপদ্যে নানাভাবে এসব রচনাশক্তির পরিচয় দিতো বিশেষত কবিতামাধ্যম। সাহিত্যশিল্পের সৃজনলগ্ন থেকেই মানুষ শব্দ-ছন্দ সমন্বয়ে সুকৌশলে মনোভাব প্রকাশ করে আসছে। শুধু ভাব প্রকাশ করলেই নয়, ভাবের সহিত ভাষারও শিল্পমাধুর্য থাকা চাই। তবেই তো কবিতা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। কবিতায় খুঁজে পাওয়া কাব্য-আত্মা। প্রমথ চৌধুরীকে লিখতে দেখি-‘যাহারা ভাবের সহিত ভাষা যুক্ত করিয়া কবিতাকে সজীব করিয়া তুলিতে পারেন তাঁহাদেরই কবিতার আত্মা আছে।’ সেই সঙ্গে প্রমথ চৌধুরী আরো স্মরণ করিয়ে দেন- ‘কাব্যের উদ্দেশ্য ভাব প্রকাশ করা নয়, ভাব উদ্রেক করা।’ পাঠকের ভাব উদ্রেক করতে না পারলে শিল্প হিসেবে কবিতা ব্যর্থ। কবিতার কাজ-সম্পৃক্ততা তৈরি করা। এক হৃদয় থেকে অন্য হৃদয়ে, শত মন ও মননে, জীবন ও জনপদে আলোর ন্যায় ছড়িয়ে যাওয়া। প্রমথ চৌধুরীর মতে, ‘বিশ্বমানবের মনের সঙ্গে নিত্যনতুন সম্বন্ধ পাতানোই হচ্ছে কবি-মনের নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম।’
তিন.
প্রমথ চৌধুরী ছিলেন মূলত আশাবাদী সাহিত্যিক। অতীতের চেয়ে বর্তমানের প্রতি তাঁর ভক্তি ও ভালোবাসা ছিল বেশি। বর্তমানের ওপর ভিত্তি করেই তিনি ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে চাইতেন। সাহিত্যে বিপুলসংখ্যক লেখকের আগমন দেখে তিনি আশান্বিত হতেন। নারীর আগমনকে তিনি ইতিবাচকভাবে দেখেছেন। সাহিত্যে রাজধর্মের জায়গায় গণধর্মের বিজয় দেখে তিনি খুশি হতেন। নবীন সাহিত্যকীর্তি আকারে ছোট হলেও প্রকারে বেড়ে যাবে বলে অভিমত দিয়েছেন। অর্থাৎ ভবিষ্যতের সাহিত্যকর্ম গাছের ন্যায় উপরের দিকে উঠে না গিয়ে ঘাসের ন্যায় চারদিকে ছড়িয়ে যাবে। প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়-‘বহুশক্তিশালী স্বল্পসংখ্যক লেখকের দিন চলে গিয়ে স্বল্পশক্তিশালী বহুসংখ্যক লেখকের দিন আসছে।’ বর্তমান স্বদেশের স্বসাহিত্য সমাজের দিকে তাকালে প্রমথ চৌধুরীর ভবিষ্যদ্বাণী দারুণভাবে মিলে যায়। এখন আর মধুসূদন-রবীন্দ্র-নজরুলের ন্যায় লেখক দেখা যায় না। তবে আকারে না হলেও প্রকারে সাহিত্যসেবীর সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। এভাবে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে বহু মানুষের সংশ্লিষ্টতাকে প্রমথ চৌধুরী বঙ্গসাহিত্যে নবযুগ বলে বিবেচনা করতেন। তাঁর মতে, নবযুগের ধর্মই হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন ঘটানো, পুরো সমাজকে একটি ভ্রাতৃবন্ধনে আবদ্ধ করা। দেশি অথবা বিদেশি বুলির বশবতী না হয়ে প্রমথ চৌধুরী নবীন সাহিত্যিককে নিজের অন্তর্নিহিত শক্তির সন্ধানে নিরত হতে পরামর্শ দিয়েছেন।
চার.
প্রমথ চৌধুরী একটি সুবৃহৎ দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্যকে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। যাপিত জীবন ও জনপদের নানাকিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও সাহিত্যের উৎপত্তি ও সংশ্লিষ্টতা মূলত মানবমনের সঙ্গে। সাহিত্য মানবমনকে স্পর্শ করে, জাগিয়ে তোলে, সুসম্প্রসারিত করে। ‘একমাত্র সাহিত্যই এ পৃথিবীতে মানবমনের সকল প্রকার সংকীর্ণতার জাতশত্রæ।’ মনোজগতে বাতি জ্বালানো এবং ফুল ফোটানোই সাহিত্যের একমাত্র ধর্মকর্ম। জাতীয় ঐক্য সাধনেরও প্রধান উপায় এই সাহিত্য। সাহিত্য শব্দ সমবায়ে সংগঠিত বিপুল সঞ্জীবনীসুধা। সেই সাহিত্যসুধা ও শক্তির মধ্য দিয়েই মূলত জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠে। তবে ‘সাহিত্যে খেলা’ নিবন্ধে প্রমথ চৌধুরীর এসব সাহিত্যচিন্তার সঙ্গে কিছুটা বৈপরীত্য মত ও মতামত দেখতে পাই। এই নিবন্ধে তিনি বলতে চেয়েছেন, সাহিত্য সৃষ্টি জীবাত্মার লীলামাত্র। স্বয়ং ভগবান যেমন কোনো কারণ ছাড়াই এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন। সাহিত্য সৃষ্টির প্রায় অনুরূপ ঘটনা। জীবাত্মার লীলামাত্র। সাহিত্য এক প্রকৃতির শিল্প। এই শিল্পকে তিনি ‘art for art’s sake’ শিল্প-শিরোনামে অভিহিত করেছেন। তবে এই সাহিত্য তত্ত্বকথা তাঁর একান্ত নিজস্ব নয়। ‘art for art’s sake’ সাহিত্য আন্দোলন সর্বপ্রথম উৎপত্তি ঘটেছিল ফ্রান্সে। সেখান থেকে ইউরোপের অপরাপর দেশেও ছড়িয়ে পড়ে বিশেষত ধনতান্ত্রিক শিল্পদেশে। বঙ্গদেশের এই জনপদ ও জীবনেও তার প্রভাব খানিকটা দেখা যায়। কল্লোলগোষ্ঠীর অনেকের সঙ্গে প্রমথ চৌধুরীও এই সাহিত্য আন্দোলন দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁকে লিখতে দেখি এই তত্ত্বকথা- ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেয়া, কারো মনোরঞ্জন করা নয়।’
পাঁচ.
‘সমালোচনা সাহিত্য শাখা’ প্রসঙ্গে লেখক খুবই হতাশ। নানা দিক থেকে নানাজন সমালোচনা-সাহিত্যেশিল্পে সংশ্লিষ্ট হলেও দরকারি সমালোচনা সাহিত্যধারা আজোবধি গড়ে ওঠেনি। সমালোচনা সাহিত্যের লক্ষ্য, সাহিত্যে অন্তর্নিহিত স্বরূপ পাঠকের সামনে তুলে ধরা। কিন্তু সমালোচক ওই পথে না হেঁটে ‘অতিনিন্দা এবং অতি প্রশংসা’য় ব্যতিব্যস্ত। দুটোই লেখকের বিচারবিবেচনায় জঘন্য। দুয়ের মধ্যে অতি প্রশংসার প্রাবল্য বেশি। সেখানে স্বার্থসিদ্ধির জন্য সত্যের অপলাপ ঘটে থাকে। ‘এক একটি ক্ষুদ্র লেখকের ক্ষুদ্র পুস্তকের যেসকল বিশেষণে স্তুতিবাদ করা হয়ে থাকে সেগুলো বোধহয় শেকসপীয়র কিংবা কালিদাসের সম্বন্ধে প্রয়োগ করলেও একটু বেশি হয়ে পড়ে।’ মাঝেমধ্যে নবীনদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে তীব্র নেতিবাচক সমালোচনাও চোখে পড়ে। কিন্তু প্রবীণ অথবা প্রতিষ্ঠিতদের ধারেকাছেও কেউ যেতে চায় না। প্রমথ চৌধুরীকে লিখতে দেখি-‘খ্যাতনামা লেখকদের বিচার করবার অধিকার যেখানে কারো নেই, সেখানে অখ্যাতনামা লেখকদের উপরে জজ হয়ে বসবার অধিকার সকলেরই আছে।’
কখনো-সখনো লেখক সমালোচক সেজে পরস্পরে অংশীদারিত্ব-কারবার খুলে বসে। অর্থাৎ তুমি আমার প্রশংসা করবে, আমি তোমার। বাজারে গ্রন্থ কাটতির লক্ষ্যে কতিপয় লেখক-সমালোচক এভাবে অবিবেচনা ও অনৈতিক পথে হাঁটে। প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়-‘আমার মাল তুমি যাচাই করে পয়লা নম্বরের বলে দাও, তোমার মাল আমি যাচাই করে পয়লা নম্বরের বলে দেব।’ এতে পাঠক প্রতারিত হচ্ছে, প্রবঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমান সমালোচনা সাহিত্যের দিকে তাকালে দেখব- প্রমথ চৌধুরীর কোনো অভিযোগই ভিত্তিহীন নয়। বর্তমানে সমালোচনা-সাহিত্যের পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে নাজুক থেকে নাজুকতর হচ্ছে। সাহিত্য প্রসঙ্গে তাঁর এসব ভাবনাচিন্তা, বিচারবিবেচনা বারবার কাছে টানে। সেইসঙ্গে ভবিষ্যতের পথেয় হয়ে থাকে। ৭ আগস্ট এই দিনে প্রমথ চৌধুরী পিতা দুর্গাদাস চৌধুরী ও মমতাময়ী মাতা মগ্নময়ীর কোলজুড়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন। জন্মদিনে লেখকের প্রতি অশেষ প্রণতি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়